আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা #পর্ব_৩+৪

0
229

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা
#পর্ব_৩+৪

আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল। এভাবে আমি প্রথমটা শেষ করে দ্বিতীয়টা ধুঁয়ে নিতেই আম্মা বলল, রেডি হ।

– কেন?

– ডাক্তার দেখাবো। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।

আমি চোখ সরু করে বললাম, হঠাৎ?

– যে তুই গাজর বাসায় ঢুকতেই তার চৌদ্দ গুষ্টির উদ্ধার করে দিতি, সে আজ গাজর খাইতেসে।

আমি উদাস উদাস ভাব কইরা দার্শনিক ভঙ্গিতে কইলাম, গাজর খাইলে শরীর সুস্থ থাকে। তাই ভাবতেসিলাম এবার থেকে রোজ দুই না না তিনবেলা তিনটা গাজর খামু। আম্মা আব্বা কি বলবে বুঝতে না পাইরা নিজের কাজে চলে গেল। আমিও নাক মুখ কুঁচকে গাজর খাইতে লাগলাম। চারদিনে আমি দুই কেজি গাজর খেয়ে শেষ করলাম। তিনবেলায় তিনটা না করে ছয়টা করে গাজর খাইতে লাগলাম। আম্মা তো টেনশানে পড়ল, এই মেয়ের কি হল!? একদিন আম্মা নিজের ফোনে ভিডিও দেখতে গিয়া আঁতকে উঠল। মেমরি ভর্তি গাজরের হালুয়ার রেসিপি। অন্তত এদিক ওদিক করে বিশ পঁচিশটা হবে। আম্মা ডাক দিল। তখন আমি রান্নাঘরে গাজরের সাথে যুদ্ধ করতেসি। ডাক শুনে তার কাছে গেলাম। আমাকে দেইখা আম্মা চমকায় উঠল। আমি গাজর বানু হয়ে আছি। দুই হাতে গাজর। মাথায় গাজর কুচি, সারা শরীরের গাজর কুচি। আম্মা কইল, এই অবস্থা কেন?

– রান্না করতেসি।

আম্মা অবাক হইল। যে মেয়ে প্লেট ধোঁয়ার জন্য রান্নাঘরে যাইতে চায় না সে মেয়ে আজ রান্নাঘরে। আম্মা জিগাইল, কি রাঁনতেছিস আবার? আমি নিরাশ হয়ে কইলাম, সর্বাঙ্গে যাহার ছড়াছড়ি তাই রাঁনতেসি। কি জন্য ডাকছো? আম্মা আর কিছু বলল না। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে চলে গেলাম। একে তো কখনো রান্না করি নাই, তার উপর গাজরগুলা নিয়া সিদ্দত করতেসি, এর মাঝে আম্মার হুদা ডাকটা ভালো লাগে নাই। যাই হোক, অনেক কষ্টে অনেক চেষ্টার পর গাজরের হালুয়া বানাইলাম। তারপর কাকের গলা ছেড়ে ইচ্ছামতো গোসল করে সেজেগুজে রেডি হয়ে নিলাম। সুন্দর করে চোখে গাঢ় কাজল দিলাম। বাসায় পরার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর লাল জামাটা পরসি। আলমারি খুলে জামা নিলে আম্মা কইব, এখানে কি বিয়া শাদি লাগসে যে নতুন জামা পরছিস।

আমি বড় একবাটি নিয়ে পাশের বাসায় নক করলাম। আন্টি দরজা খুলে বললেন, আরে ছোঁয়া ভেতরে এসো। এখানে আসার পর তো একবারো আসো নাই। আমি মিষ্টি করে সালাম দিলাম। মনে মনে বললাম, একেবারের জন্যই চলে আসমু, আপনার ছেলের লগে বিয়া দিয়া দেন। আন্টি আমাকে সোফায় বসালেন। আমি বাটিটা আন্টিকে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, এটা আমি বানিয়েছি। ভাবলাম আপনাদেরকেও একটু দিয়ে যাই। বাসায় কেউ নাই? আন্টি বললেন, ওমা! গাজরের হালুয়া! তোমার আঙ্কেল অফিসে। এখনো আসেনি। দাঁড়াও তোমাকে একটু দেই। আমি মনে মনে কইলাম, আঙ্কেলের খবর জাইনা আমি কি করমু। আমার জামাইর খবর বলেন। আমি বললাম, লাগবে না আন্টি, বাসায় আরও আছে। আন্টি তাও ছোট একটা পিরিচে আমাকে দিলেন। তখনই আমার ক্রাশ বাসায় ঢুকল। আমি তার দিকে হা করে তাকাই আছি। গায়ে ফুটবল জার্সি ঘামে লেপ্টে আছে। মুখ পানি দিয়ে ধোয়ায় কপালের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে লেগে আছে। সেগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গরমে মুখের সাথে কাল অবধি লাল হয়ে আছে। ওকে আমার চেরি ফল!!!!! তোকে দেইখা আমার মনে গান বাজতেছে, তোরে হেব্বি লাগছে। সে এসে বলল, আম্মু আজকে আমাদের টিম জিতেছে। তারপর আমার পিরিচের দিকে দেখে বলল, গাজরের হালুয়া! বলেই পিরিচটা নিয়ে নিল টেবিল থেকে। আমার দিকে একবার তাকালোও না। আমি মনের দুঃখে বললাম, আমি আসি আন্টি।

– ওমা, চলে যাবে!

আমি যেই দরজা খুলেছি ক্রাশ বলল, এটা কে বানিয়েছে? বাপ রে, লবণ দিয়ে রান্না করেছে নাকি? লবণ ঢালতে তো কার্পণ্য করে নাই।

এমন প্রশংসা শোনার পর পা দুটো আর থাকতে চাইল না, সাথে সাথে বাসায় দৌঁড়। দরজা বন্ধ করে সেটার সাথে লেপ্টে দাঁড়াই আছি। বুকটা ঢিপঢিপ করতেসে। ব্যাঙও মনে হয় এতো জোরে লাফায় না। আমি গিয়ে হালুয়া একটু মুখে দিতেই মুখ বাংলার পাঁচ হয়ে গেসে। আসলেই লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। আমি পানি দিয়ে ভালো করে কুলি করতেই আম্মার ডাক। আমি আম্মার কাছে গিয়ে দেখলাম আব্বা চলে আসছে এবং উনি কোনো কারণে মুখে চামুচ ঢুকাইয়া আটকে আছে। ঘটনা বুঝতে না পেরে হাতের দিকে তাকাতেই বুঝলাম তার আটকে যাওয়ার কারণ। আমার গাজরের হালুয়ার লবণের কেরামতি। আমি অপরাধীর মতো দাঁড়াই আছি। আম্মা বললেন, গত মাসের জন্য তোর আব্বুকে দিয়ে লবণ কিনাইসিলাম। এখন রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আয় তো লবণের ডিব্বা অর্ধেক খালি কেন? আমি মিনমিন করে বললাম, বুঝতে পারি নাই চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলসি। আম্মা তখন মুক্ষম প্রশ্নটা করলেন, তোর আন্টির কেমন লাগছে? আমি বললাম, আন্টি খায় নাই, তার ছেলে খাইসে। বলসে আমি লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। শুনে আব্বা মুচকি হাসতেসে। আম্মাও মুখ টিপে হাসতেসে। আমি নিজের রুমের দরজার ছিটকিনি আটকাইয়া মনের দুঃখে বাপ্পারাজের মতো গান গাইতে লাগলাম,

গাজরের হালুয়া রে…
কার দুঃখে তুই লবণের সাগরে…
ডুব দিয়ে আমার মান ইজ্জত লুটিলি রে…

রাতে আবার ফ্যানের নিচে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গাজর চাবাইতেসি আর ভাবতেসি কি করা যায়। ভাবছিলাম গাজর দিয়ে হাত করমু, কিন্তু গাজর আমার খবর করে দিল। কি করা যায়…… হাতের গাজরটারে জিজ্ঞাস করলাম, তুই বল কি করা যায়। হঠাৎ গাজরটাই আমারে আইডিয়া দিল। ব্যাস। আমি খুশির ঠেলায় গাজরের লগে নাচতে নাচতে তার মাথায় কামড় বসিয়ে বললাম, এই ল তোর বকশিস।
.
.
.
.
পরদিন স্কুল থেকে এসেই গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। উঁকি মেরে দেখলাম ক্রাশ কখন বের হয়। তিনটার দিকেই সে ব্যাট বল হাতে বেরিয়ে গেল। আমি আম্মাকে চিল্লাইয়া কইলাম, আম্মু আমি একটু বাইরে যাইতেসি। আম্মা চিল্লাইয়া কিসু কইল। কিন্তু আমি কান না দিয়া বেরিয়ে আসলাম। কলিং বেল টিপতেই আন্টি দরজা খুললেন। আমি হাসিমুখে সালাম দিলাম। আন্টি হেসে বললেন, কি খবর? আমি মুখ ভার করে বললাম, আন্টি, কালকে বুঝতে পারিনি চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি।

– প্রথম রান্না করলে এমন একটু আধটু হয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে বুঝলেন? আন্টি হেসে বললেন, আমিও প্রথম প্রথম এমন করে ফেলতাম। আমি যখন প্রথম বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছিলাম তখন রান্নার র ও জানতাম না। কোথাও হলুদের জায়গা মরিচ, আদার জায়গায় রসুন, এমন দিয়ে দিতাম। তারপর শ্বাশুড়ি আমাকে যত্ন করে রান্না শিখিয়েছেন।

ওনার কথা শুনে মনটা আনন্দে নাইচা উঠল। আজ আমিও আমার হবু শ্বাশুড়ির কাছে রান্না শিখমু। আমি মুখ কালো করে বললাম, আমাকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখিয়ে দেবেন আন্টি? এজন্যই এসেছি। শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কবে রান্না শিখবো তা তো জানি না আপাতত আপনার থেকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখতে চাই। আন্টি রাজি হলেন কিন্তু তার কাছে গাজর নেই। আমি বললাম, আমি তাহলে বাসা থেকে নিয়ে আসি। আজকে আব্বু এক কেজি গাজর এনেছে। আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাটিতে গাজর নিলাম। যেই না দরজার কাছে গেলাম আম্মা দেখে ফেলল। ডাক দিলেন, ছোঁয়া… আমি দিলাম ভৌঁ দৌঁড়। চলে এলাম আন্টির কাছে। আন্টি আমাকে সুন্দর করে শিখিয়ে দিলেন। আধা ঘন্টায় রান্না শেষ। আমি এক চামুচ খেয়েই বুঝলাম কেন আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার পাগল! আন্টি আমাকে একবাটি দিয়ে বললেন, চলো খাবে। আমরা বসার ঘরে আসতেই ক্রাশ ঢুকল। আমি তার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম। সে সোজা রুমে চলে গেল, একবার তাকালোও না। কষ্টে দুঃখে আমার কান্না চলে আসলো। আন্টি বললেন, খাও।

– জ্বি, আন্টি।

এমন সময় সে এসে বলল, আজকেও গাজরের হালুয়া? কয় মণ লবণ দিয়েছে? শুনেই অভিমান হইলো। মনে মনে কইলাম, এত তাড়াতাড়ি কেমনে আইলো! আন্টি প্রতিবাদ করে বললেন, কি হচ্ছে? আমি বললাম, আপনি তো গেলেন এক ঘন্টাও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি আসলেন কি করে? ক্রাশ আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে বলল, তুমি জানলে কি করে? পাহারা দিচ্ছিলে নাকি? আমি পড়লাম ফাঁদে। মনে মনে বললাম, এটা তুই কি করলি, ছোঁয়া। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম!! একে তো কালকের লজ্জায় থাকতে পারতেছিস না। এখন যদি জানতে পারে তুই নজর রাখিস তাইলে তো এখানেই মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যেতে হবে। আন্টি আমাকে বাঁচাই দিলেন, মেয়েটাকে একটু শান্তি করে খেতে দে। আমি দুই চামুচ খেয়েই বললাম, আমার হয়ে গেছে। আপনার রান্না অনেক মজা আন্টি। ক্রাশ বলল, দেখতে হবে না কার আম্মু। ইস্, কতটা হালুয়া নষ্ট করতেসে। বলেই আমার হাত থেকে বাটিটা নিয়ে হালুয়াটা খাওয়া শুরু করল। আমি তো বেকুবের মতো তাকাই আছি। সে খাওয়া শেষ করে বলল, আম্মু, আজকের হালুয়াটা বেস্ট ছিলো। খুব ভালো হইসে। আজকে ভালো করে খেলতে পারিনি দেখে মন খারাপ ছিল। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। এটা খেয়েই মন ভালো হয়ে গেছে।

শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ল। আমি দরজার দিকে দৌঁড় দিয়ে বললাম, আমি আসি আন্টি। আরেক দিন আসবো। এক দৌঁড়ে ছাদে। আমার সাধের নীল ফ্রকটা ধুঁয়ে দিয়েছিল আম্মু। আমিই রোদে দিয়ে গেসিলাম। এসে দেখি এখনও বৃষ্টি শুরু হয় নাই। বাতাস ছুটেছে। বাতাস দেইখাই আমি ফ্রকের কথা বেমালুম ভুইলা গেসি। বাতাসে দাঁড়াই আছি। আমার খুশি আর দ্যাখে কে। আমি বাতাসে লাফাইতেসি আর ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাইতেসি। এর মধ্যেই ফোঁটা ফোঁটা করে ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে আমি পাগল হই গেলাম। বাচ্চাদের মতো লাফাইতে লাগলাম। আমার লাফানি দেখলে ব্যাঙও মনে হয় কইব, আমরাও বাচ্চা থাকতে এতো লাফাই নাই। কতক্ষণ লাফাইসি জানি না। এদিকে বৃষ্টিরও থামার নাম নাই। তখন পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, আগে কি বৃষ্টি দেখো নাই? আমি তাকাই দেখি ক্রাশ দাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শ্যাষ। বৃষ্টিতে জামা কাপড় সারা শরীরে সাপের মতো প্যাঁচাই আছে। তারে দেইখাই রশি থেকে আমার জামাটা একটানে নিয়া দৌঁড় দিলাম। ভাগ্য ভালো এত প্যাঁচের পরও হবু জামাইর সামনে উন্ডুস (ধাক্কা) খাই পড়ি নাই। খাইলে আমি মাটির ভেতর ঢুইকাও শান্তি পাইতাম না। আমি এসেই দরজা মেরে দিলাম। বুকের ব্যাঙটা তো দৌঁড় প্রতিযোগিতায় নাম দিসে। আমার শরীর থেকে টপ টপ করে পানি পড়তেসে। আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গোসল করতে করতে আম্মার চিৎকার শুনতে পাইলাম।

– এই মেয়ের কি জীবনে কান্ড জ্ঞান হবে না। একে তো এই ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে আসছে। সারা ঘর পানিতে ভাসাই দিয়ে এখন গোসল করতেসে।

আমি গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই, হাচ্চি……। একবার দুইবার তিনবার… হাঁচতে লাগলাম। আম্মা এসে বললেন, হলো তো। ধর, পাশের বাসার ভাবি এই এক বাটি হালুয়া দিয়ে গেছে তোর জন্য। এটা খেয়ে একটা নাপা খেয়ে নে। আমি রাখলাম টেবিলে। আম্মা খাবার আর ঔষধ রেখে গেল। আমি নাক টানতে টানতে বাটিটা নিলাম। এক চামুচ মুখে দিতেই ক্রাশের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে লজ্জায় বিছানার সাথে মিইশা গেলাম। তাতেই ঘুম।
চলবে…

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_৪

আম্মা খাবার আর ঔষধ রেখে গেল। আমি নাক টানতে টানতে বাটিটা নিলাম। এক চামুচ মুখে দিতেই ক্রাসের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে লজ্জায় বিছানার সাথে মিইশা গেলাম। তাতেই ঘুম।

আম্মা আব্বার কথা শুনে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলতে পারতেসি না। জ্বলতেসে। খুব ঠান্ডা লাগতেসে। শরীর কাঁপুনি দিতেসে। নড়তেই মনে হল গায়ে কম্বল দেওয়া। মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাইতেসে। কানে আসল, আম্মা বলতেসে, একশ চার ডিগ্রি উঠে গেছে। তুমি ডাক্তার ডাকো।

– দাঁড়াও, আমি ফোন করতেসি। এত রাতে যাবো কি করে।

আব্বা ফোনে ডায়াল করল। আম্মা আবার বললেন, মেয়েটা আমার একটা কথাও শোনে না। এখন জ্বর একটা বাঁধাই আনসে। নিজের জামাটাও সামলাই আনতে পারে নাই। জর্জেটের জামা। কেমনে আনসে কে জানে। একেবারে উপর থেকে নিচে ছিঁড়ে ফেলছে। শুনেই আমি পিটপিট করে তাকালাম। তারপরই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। আমার কান্না শুনে আব্বা আম্মা কাছে আইসা বলল, কি হইসে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমি কাঁনতে কাঁনতে কইলাম, আমার এত সাধের জামা!!!!! আম্মা ধমক দিয়া চিল্লাই বলল, একদম কানবি না। জামা একটার দফারফা করে এখন জ্বর বাঁধাই শুই আছে। ঔষধ দিয়ে গেসি সেটাও খায় নাই। জ্বর আসবে না তো কি আসবে। আমি বকা খেয়ে ফোঁপাতে লাগলাম।

সারা রাত জ্বরে ভুগলাম, সকালে একটু কমল। ঘুম ভেঙে দেখি আন্টি পাশে বসে আম্মার সাথে কথা বলতেসে। এই একজ্বরে নেতিয়ে পড়ছি। তবে মনটা খুশি হই গেল। আমার শ্বাশুড়ি আম্মা তো দেখতে আইলো। কি জামাইটা… আমি তাকাতেই আন্টি হেসে বললেন, কেমন আছো? আমি হাসলাম। আন্টি বললেন, কালকে আমার ছেলেটাও বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি বাঁধিয়েছে। ও বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি বললাম তোর জামা কাপড় গুলো তো ছাদে। বৃষ্টি আসলে ভিজে যাবে। দশ মিনিট পর দেখি কাকভেজা হয়ে আসছে। সাথে কাপড়গুলাও ভিজাই আনসে।

আমি তো খুশি। মনে মনে কইলাম, দেখতে হইবো না কার জামাই। মনের কতো মিল!!! কি কানেকশান!!!! আমার সাথে তারও সর্দি হইসে।

– আর বলিয়েন না ভাবি, কালকে একটা জামা ধুয়ে দিসিলাম, ছাদে। মেয়েটা বের হওয়ার সময় বললাম, আসার সময় নিয়ে আসিস। মনে হয় কানেই নে নাই। পরে দেখি পুরা ঘর পানিতে চপ চপ করতেসে। বুঝলাম, মেয়ের কান্ড। বৃষ্টিতে ভিজে আসছে। বারান্দায় জামাটা ঝুলতেসে। ওটাও ভিজা। মেলতে গিয়ে দেখি জামার কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত ছিঁড়া।

আম্মা জামা আইনা সামনে মেইলা ধরল। আমার তো চোখে পানি চইলা আসলো। আমার সবচেয়ে ফ্যাবোরেট জামা ছিল। আমি উঠে হেলান দিলাম। আন্টি সাহায্য করলেন। আমি হাত বাড়িয়ে জামা নিলাম। এমন সময় আমার ক্রাশের গলা শুনলাম। আন্টি বললেন, আমি আসি ভাবি, ছেলে কলেজ যাবে। আমার দিকে ফিরে বললেন, ভালো হয়ে যাস তাড়াতাড়ি। আমি মাথা কাত করলাম। আন্টি যেতেই আমি দৌঁড়ে গিয়া দরজার কাচে চোখ লাগালাম। দেখলাম ক্রাশ বের হইতেসে। আম্মা ডাক দিয়া কইল, ওখানে কি করিস?

– আসি।

ক্রাশ চলে গেলে আমি ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসলাম। আম্মা আমাকে আদার রঙ চা এনে দিলো। আমি বললাম, চা খাইতে ইচ্ছা করতেসে। আম্মা চোখ রাঙাই কইল, চা না খাইলে নিম পাতার রস খাওয়াবো। সব একেবারে বাপ বাপ বলে পালাবে। শুনেই আমার মুখ বেঁকে গেল। একবার খাইসিলাম। সেই ট্যাশ ছিল। করলার আব্বা। আমি আর কিছু কইলাম না। চুপচাপ চা বিস্কুট খেয়ে রুমে চলে গেলাম। বিকালে বারান্দায় বসলাম। সেখান থেকে মাঠ দেখা যায় যেখানে আমার ক্রাশ খেলতে যায়। দূর থেকে দেখতে লাগলাম খেলা। আজকাল গাজর আমার বন্ধু হয়ে গেছে। এখনও হাতে দুইটা গাজর। একটার মাথায় কামড় দিয়ে চিবাতে চিবাতে ভাবতে লাগলাম, আরেকবার গাজরের হালুয়া বানাইয়া নিয়া যামু কিনা? নাহ্, এত বার গেলে সন্দেহজনক মনে হইবো। তাইলে কি করা যায়!!! এমন সময় আম্মা এসে বলল, তুই যাবি? আমি মাঠ থেকে চোখ না সরাইয়া গাজরে আরেক কামড় দিয়ে বললাম, কোথায়?

– তোর জ্বর ছিল দেখে বলি নাই। আজকে ভাবির ছেলের জন্মদিন। আমাদের যেতে বলেছে। তুই যাবি?

শুনেই আমি চিল্লাই কবললাম, তুমি এতক্ষণে বলতেসো! আরো আগে বলবা না? আমি আলমারির দিকে ছুটলাম। কোনটা পরমু, কোনটা পরমু করতে করতে পুরা বিছানা গোয়াল ঘর বানাই ফেললাম। আম্মা তো এসে কয়েকবার বকে গেলেন। আমি কান দিলাম না। আমি গাজর খাচ্ছি আর জামা চুজ করতেসি। শেষ পর্যন্ত আমার গাজর শেষ হইলো আর একটা ফ্রক চুজ করলাম। ফ্রকটার উপরের অংশে কালো মখমলের উপরে লাল কাজ করা। আর নিচের অংশ লাল জর্জেট কাপড়ের। জামাটা পরে চুল আঁচড়ে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলাম। ফ্রেন্ডরা বলে আমার স্ট্রেট চুলগুলা খোলা রাখলে নাকি সেই লাগে। তাই করলাম। একপাশে একটা লাল ফুলের ক্লিপ আটকে দিলাম। ফ্রকের গলায় কলার আর হাত পর্যন্ত ঢাকা। তাই কিছু পরা লাগলো না। কানে লাল ছোট ঝুমকার কানের দুল পরলাম। চোখে কাজল দিলাম। ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দিলাম। তারপর আয়নায় নিজেকে দেইখা নিজেই ক্রাশ খাইলাম। আম্মা দরজার কাছে দাঁড়াই বলল, তোর সাজোন গুজোন হলে বের হবি?

– হ্যাঁ, আম্মু।

আমি রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। আম্মা আব্বা আমার দিকে তাকাই আছে। আমি কইলাম, কি হইসে? এভাবে তাকাই আছো কেন? আম্মা বলল, এত সাজচিস কেন? বার্থে পার্টিতে যাইতেছিস নাকি বিয়েতে?

– আহা, মেয়েরা একটু সাজার শখ হইসে। থাক না। চলো।

আমরা নক করতেই কেউ একজন দরজা খুলল। আমি ঢুকে বেকুবের মতো দাঁড়াই আছি। এত মানুষ!!! পুরো রুম গিজগিজ করতেসে। আমি এদিকওদিক তাকাই আমার বার্থডে ক্রাশরে খুঁজতেসি। দেখলাম এক কোনায় বন্ধুদের সাথে দাঁড়াই গল্প করতেসে। আমার ক্রাশটারে তো হেব্বি লাগতেসে। সাদা শার্ট, হালকা নীল জিন্স, শ্যাম্পু করা চুলগুলো চোখের সামনে পড়ে আছে। ইচ্ছা করতেসে গিয়া সরাই দিয়ে আসি। আমি আগাই গেলাম। আমি যাওয়ার আগেই একটা মেয়ে দৌঁড়ে এসে ওকে জড়াই ধরলো। আমি থমকে গেলাম। মেয়েটা আসতেই আমার ক্রাশ একটা কিটকাট ধরিয়ে দিল। আমার যাইতে অস্বস্তি লাগতেসে। আমি ফেরত যেতে লাগলে আমার ক্রাশ ডেকে বলল, কি হলো, গাজরের হালুয়া। কই যাচ্ছো? আমি পিছন ফিরতেই দেখলাম সে দাঁত কেলাই হাসতেসে। একটা মানুষ এত কিউট হয় কেমনে? ও কাছে এসে বলল, আমার গিফট কই? আমি আমতা আমতা করে বললাম, আনিনি। আসলে জানতাম না। মনে মনে বললাম, আমি আসছি যে হয় নাই? আরও গিফট লাগবো? সে বলল, ওমা, না জানলে আসলে কি করে? ওর ফ্রেন্ডরা বলল, এ কে রে? ও হেসে বলল, গাজরের হালুয়া। মেয়েটা এসে জিজ্ঞেস করল, গাজরের হালুয়া মানে? তখন ক্রাশ রাঙিয়ে চাঙিয়ে আমার হালুয়ার কাহিনী বলতে লাগল। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ তুলতে ভয় লাগল যদি চোখের পানিটা কেউ দেখে ফেলে!!! এতটা অপমানিত আমি জীবনেও হই নাই। ওদের কথার মাঝেই ‘আমি যাচ্ছি’ বলে চলে আসলাম। একি কি করল আমার ক্রাশ!!! ক্রাশ!!!? আমি নিজেকে নিজে বিদ্রুপ করলাম। চোখ মুছে আন্টির কাছে গেলাম। আন্টি কয়েকজনের সাথে কথা বলছিল। আমি গিয়ে সালাম দিতেই আন্টি বললেন, আরে আমার ছোঁয়া মা যে। কি মিষ্টি লাগছে!!!! আমি বললাম, আন্টি আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।

– কি হয়েছে?

– তেমন কিছু না। একটু মাথা ব্যাথা করছে।

– আচ্ছা যাও।

আমি চলে আসলাম। বাসায় ঢুকেই চোখের পানির বাঁধ ভাঙলো। আমি দৌঁড়ে গিয়া বাংলা সিনেমার নাইকাদের মতো নিজের রুমের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরলাম। টানা দুই ঘন্টা পার হইয়া গেল। আমি কাইন্দা কাইটা এক সার হইসি। কাজল লেপ্টে ফুলা চোখগুলো কালো হয়ে পেত্মী হয়ে গেসি। ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানি দিলাম। সাবান দিয়ে ভালো কইরা ঘইষা মাইজা সব ক্লিন করে ফেললাম। আয়নায় তাকাই দেখি মুখটা ঝকঝক করতেসে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে একটা সুতি জামা পরে সবে শুবো, এমন সময় কলিং বেল বাজলো। আমি ভাবলাম আব্বা আম্মা চলে আসছে। আমি না দেখেই দরজা খুলে রুমের দিকে এগিয়ে বললাম, চলে আসছো? পার্টি শেষ? আমি রুমে যাইতেসি। রাতে খাবো না। আমাকে আর ডাকিও না। আমি রুমে ঢুকে লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। কান্না করায় নাক ভারি হয়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতে পারতেসি না। কোনোমতে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। হালকা আলো আসছে বাইরে থেকে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। কতক্ষণ পর মনে হইল কেউ আমার দিকে তাকাই আছে। তারপর কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই জেগে উঠলাম। আমি ডাকলাম, আব্বু… আম্মু… কোন সাড়া নাই। বিছানা থেকে নেমে পুরো ঘর ঘুরে দেখলাম ঘর ফাঁকা। দরজা খোলা। আমি মনে মনে বললাম, কি হইল ব্যাপারটা! আমি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় এক টুকরো কেক। তার উপরে লাভ ইমোজি। কেউ যেন আলাদা করে পিসটা কেটে দিয়েছে। আমি একটু ভাবতে বসলাম, কে এসেছিল!!! কে? আব্বু নাকি আম্মু না অন্য কেউ!!! কোনো ভুত আসছিল নাকি!!! খেয়াল হতেই দেখলাম আমি কেকটা খেয়ে ফেলসি। হায় হায়!!!! ভাবছিলাম একটা ছবি তুইলা রাখমু। ক্রাশের জন্মদিনের কেক। প্লেটের দিকে তাকাই আবার ভাবলাম, আমি খাইসি তো নাকি কোনো পেত্নী এসে খেয়ে চলে গেছে!!!
.
.
.
.
আবার শুক্রবার চলে আসলো। এই কয়দিন ঠিক মতো ঘুম হইতেসে না। ক্রাশের জন্মদিনের পর থেকে যতসব ভয়ানক ভয়ানক স্বপ্ন দেখতেসি। একবার তো দেখলাম, বাসর ঘরে আমার কাছে এসে ঘোমটা তুলে ক্রাশ বলতেসে, কি রে গাজরের হালুয়া বউ, আমার গিফট কই? দেখেই লাফাই উঠছি ঘুম থেকে। আম্মা আজকে আবার কাপড় ধুইসে। আমারে আবার ছাদে পাঠাইলো। আজকে না গান বাইর হইতেসে না বিরক্তি আসতেসে। মাথায় শুধু স্বপ্নটাই ঘুরতেসে। মনে মনে কইলাম, এত কিছু থাকতে গাজরের হালুয়া বউ? বাসর রাতে হালুয়া আমি যদি তোমারে গুইলা না খাওয়াইসি তাহলে আমার নামও ছোঁয়া না। আমি বিড়বিড় করতে করতে ছাদে উঠে টাসকি খাইলাম। ঐদিনের মেয়েটা আমার ক্রাশের গা ঘেঁষে দাঁড়াই আছে আর হেসে হেসে কথা বলতেসে। তাদের হাসি দেইখা আমার সারা শরীরের লোমে দাবানল লাইগা গেল। নরম মনটা বলল, গাজরের হালুয়া বৌ ডাকো তবু আমার কাছে ফিইরা আসো। আমি মনরে ধমক দিয়া কইলাম, এখন পিরিতের সময় না। আগে আচ্ছা মতো ঝাঁটার বাড়ি তারপর পিরিত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here