এক_সমুদ্র_প্রেম! লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি পর্ব:-০২

0
280

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব:-০২

“ওঠ!”
শাণিত স্বরে পিউয়ের শীর্ণ বক্ষ ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মানুষটা খুব রেগে থাকলে আওয়াজ মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর শোনায়। পিউ শঙ্কিত লোঁচনে চাইল। আস্তে করে উঠতে গিয়ে টের পেলো ব্যথা পেয়েছে কোমরে। হঠাৎ পরায় লেগেছে অনেক!

পিউ কলমি ডগার ন্যায় লতিয়ে,কোনও রকমে উঠে দাঁড়ায়। নিজের প্রতি হতাশায়, দুঃখে বুক ফাঁটছে মেয়েটার। যার ভ*য়ে সারাটাদিন লুকিয়ে রইল ঘরে, খেতে এলো এই এতক্ষণে,শেষমেষ তার খ*প্পরে পরলই। বাহ! ভাগ্যের কী বিরুদ্ধাচারণ!

” কটা বাজে?”
প্রশ্ন শুনে নড়েচড়ে তাকায় পিউ। ডিম লাইটের সবুজ আলোয় ধূসরের শ্যামলা চেহারা স্পষ্ট। স্পষ্ট তার কব্জিতে বাঁধা চকচকে,পরিচ্ছন্ন ঘড়ি। পিউ
মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
” আপনার কাছেইতো ঘড়ি আছে! ”

” তুই বোধ হয় আবার মা*র খেতে চাইছিস! ”
জলদগম্ভীর স্বরে বক্ষস্থল থমকাল। পিউ ফিরে গেল অতীতে। মনে পড়ল আজকে দুপুরেই গালে পড়া সেই দাবাং চড়টার কথা। নীচু কণ্ঠে, বাধ্যের ন্যায় জানাল, ‘ বারোটা বাজে।’

” এ বাড়িতে রাতে খাওয়ার সময় দশটা। তাহলে দুই ঘন্টা কোথায় ছিলিস তুই?”

পিউ মিনমিন করে বলল,
” ঘুমোচ্ছিলাম। ”

ধূসর পুরূ কণ্ঠে বলল,
” একদম মিথ্যে বলবিনা! ভেবেছিলি ঘরের দরজা আটকে থাকলেই বেঁ*চে যাবি? কিছু বলব না?”

পিউ দাঁত দিয়ে নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরে। কথা খোঁজে মনে মনে। ধূসর যা বলল তাতো মিথ্যে নয়। সে ওর ভয়েই দরজা লাগিয়ে বসেছিল। ভেবেছিল মানুষটা বাড়ি ফিরলেও ওকে নাগালে পাবেনা। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বে বোঝেনি।

তার ভাবনার মাঝেই ধূসর টেনে নেয়া কেদারা এগিয়ে দিল। ও তাকালে আদেশ করল,
” বোস।”
শব্দ কম,কণ্ঠ নিরেট। পিউ দ্বিধায় পড়ল ভীষণ। আবার বসতে গেলে চেয়ার টানবে না তো? এইবার পড়লে হাড়গোড় গুড়িয়ে যাবে কনফার্ম।
ধূসর খেই হারাল ধৈর্যের,
” বোসতে বলেছি না তোকে? বোস!”

তড়িৎ বেগে, ধপ করে বসে পড়ল পিউ। ভয়ার্ত,বিভ্রান্ত দুই অক্ষি ধূসরের দিকে তাক হয়। সে আরেকটা চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে বসল ওর। ঠিক চোখের নিকট, মুখোমুখি।
ওমনি ভয়টা কমে এলো পিউয়ের। শুরু হলো চেনাজানা সেই হৃদকম্পন। মুগ্ধতায় ভিড়ে এলো আঁখি। সেই সময় কানে বাজল ধূসরের নরম গলার স্বর,
” তুই কি সত্যিই ওই ছেলেটাকে ভালোবাসিস?”

পিউ অদৃশ্য ভাবে সজোরে মাথা নাড়ে। মনে মনে বলে,
‘পাগল হলেন? এই ছোট্টখাট্টো জীবনে মানুষ কী ওরকম ভুল করে? আপনার মত একটা জলজ্যান্ত আইটেম রেখে আমি ওমন গোবর-গনেশের প্রেমে পড়ব কোন দুঃখে?’

কিন্তু কথাখানা আহুতি দেয় ভেতরে। জিভ ঠেলে বেরিয়ে আসার সাহস হয়না। উলটে অবশ অবশ ভাব নিয়ে ঝিমিয়ে থাকল ঠোঁটগহ্বরের আড়ালে। ধূসর একদম কাছে, অতি সন্নিকটে। যেখানে ওকে দেখলেই সপ্তদশীর বুকে তোলপাড় ওঠে, সেখানে এখন কতটা হাঁসফাঁস লাগছে কী করে বোঝাবে? পিউ লজ্জা,নার্ভাসনেসে আড়ষ্ট হয়ে জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল।
” তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি পিউ!”

ধূসরের কোমলতা পালটে গেল আবার। দড় আওয়াজ উবে দিলো পিউয়ের এক সমুদ্র প্রেম প্রেম ভাব। তৎক্ষনাৎ মাথায় পুরোনো সেই জেদটাই চেপে বসল ওর। ধূসরকে একটুখানি বাজিয়ে দেখতে, নিসঙ্কোচে মিথ্যে বলল, ” হ্যাঁ “।

ধূসর চটে গেল ভীষণ! তৎক্ষনাৎ ঘু*ষি বসাল চেয়ারের হাতলে। ভী*তশশ*স্ত্র হয়ে কেঁ*পে উঠল পিউ। সন্দেহী দুই চোখ হকচকিয়ে চাইল। ধূসরের গভীর নেত্র জ্বলছে। চাউনীতে পরিষ্কার রু*ষ্টতা।

ঠিক মিনিট খানেক চেয়েই রইল অমন। পুরোটা সময়ে পিউয়ের গোলগাল মুখবিবরে ঘুরে এলো ধ্যান। সুনিপুণ মনোযোগে নিরীক্ষন করল যেন। হঠাৎই মুচকি হেসে বলল,
” মিথ্যে বলতেও যোগ্যতা লাগে। তোর মত নির্বোধের তাও নেই।”

পিউ থতমত খায় ওই হাসি দেখে । ভ্রু বেঁকে যায় প্রখর কৌতুহলের তোপে।
‘কী মিথ্যে বলেছি আমি?”

ধূসর উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল সামনে। একটু থেকে ঘুরে তাকায় আবার। তর্জন দেয়,
” ভদ্রমেয়ের মত চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পর। এই কথাটা দ্বিতীয় বার বলতে হলে তোর কপালে দুঃ*খ আছে পিউ।”

শীতল স্বরের হুমকিটুকুন কানের লতি ছুঁয়ে গত হলো পিউয়ের। উলটে ধূসরের অযাচিত আচরণে তাজ্জব সে। এমনটাতো আশা করেনি। যা ভেবেছিল তার যে কিছুই হয়নি। ভয়ে সি*টিয়ে থাকা ওকে, ধূসর ভাই কোনও শাস্তিই দিলেন না?

পিউয়ের বুক ভে*ঙে আসে কষ্টে। কৃষ্ণকায় কাদম্বিনী হল্লাহল্লি লাগায় মুখ জুড়ে। অন্যকাউকে ভালোবাসার কথা শুনেই,ধূসরের এই সহজ অভিব্যক্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
কেন উনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না? তখনকার ওই থা*প্পড়টাকেও ভীষণ হাল্কা অনুভুত হচ্ছে এখন। আজ যদি নিজের বোনের সামনেও বলত, ‘ কাউকে ভালোবাসি।’ সেও নিশ্চয়ই এইভাবে মারতো,শাসন করত? ধূসর ভাই কী সে অর্থেই একজন ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করলেন? উনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন না?

পিউয়ের বক্ষ হুহু করে ওঠে। উবে যায় ক্ষিধে। ভুলে গেল গাল ব্যথা,কোমড়ের যন্ত্রনা। নিজের প্রতি অভিমানে,রাগে ছড়িয়ে গেল কোটর। এক তরফা প্রেমের যন্ত্রনা ভয়ানক। যে এই ম*রন ফাঁ*দে পা দেয় সে ছাড়া কেউ বুঝবেনা এই অনুভূতি। পিউয়ের এক সমুদ্র প্রেম ফিকে হল আজ। চোখ থেকে জলটা গাল অবধি আসার আগেই মুছে নিল সে। আগের মত খাবার ঢেকে রেখে ঘরের দিকে চলল।

***
“যদি একটিবারও পারতো,
সব চিন্তা ভুলে আসতে,
আমি সব হারাতাম তাকে পেতে হায়!
কবে পায়ের শিকল খুলবে?
আর প্রেমের পর্দা উড়বে?
আমি চেয়ে থাকি সেই দিনের সীমানায়!
বোঝেনা,সে বোঝেনা….
বোঝেনা সে বোঝেনা……

পিউয়ের কানে হেডফোন। ফুল ভলিউমে গান বাজছে সেখানে। সাথে হৃদয় চুরমার করে কা*ন্না পাচ্ছে খুব।
আসলেই সে বোঝেনা। এই গান অরিজিৎ সিং ওর জন্যেই গেয়েছে। ধূসর ভাইয়ের শা*স্তি না পেয়ে মেয়েটার ব্য*থিত হৃদয় ডুব দিয়েছে কূল হারানো পারাবারে। কেন যে ওই পাষণ্ড মানুষটার প্রেমে পড়তে গেল!

হঠাৎ দরজায় জোড়াল করাঘাত পড়ে। পিউ কান থেকে হেডফোন খুলল। অধৈর্য হস্তে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কেউ একজন। কপাল কোঁচকাল সে। এত রাতে ঘরে কে আসবে?

পিউ চটপট বিছানা রেখে দোরের দিক এগোয়। ছিটকিনি টানতেই বেরিয়ে আসে প্রিয় সেই কাঙ্ক্ষিত বদন। ধূসর ভাই! পড়নে কালো হাফ হাতা টিশার্ট,আর চেক চেক ট্রাউজারে যেন পুরো টসটসে স্ট্রবেরি ! পিউয়ের এতক্ষনের মনঃক*ষ্ট ছুট্টে পালাল এই রুপ দেখে।
বিড়বিড় করল, ‘ কী সুন্দর আমার ধূসরভাই! ‘

ধূসর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” সামনে থেকে সর।”

পিউ ভদ্র মেয়ের মত এক পাশ হয়ে দাঁড়াল।
ভেতরে ঢুকল ধূসর। এতক্ষণে ওর হাতের দিকে খেয়াল পড়ল পিউয়ের। ট্রে তে প্লেট বাটি সাজিয়ে এনেছে মানুষটা। ওর জন্যে খাবার এনেছেন ধূসর ভাই? ভাবতেই পিউয়ের চোখ কপালে ঠেকল। ধূসর সোজা গিয়ে টেবিলে রাখল ট্রে-টা। বিছানায় বসে ঘাড় কাত করে চাইল তার দিক। ওমনি মনের আঙিনায় দানবীয় বিদ্যুৎ চমকায় পিউয়ের। এইভাবে কেউ তাকায়? খু*ন হবে নির্ঘাত।

ধূসর কোমল কণ্ঠে ডাকল,
” এদিকে আয়!”
ডাক শুনে পিউয়ের পদযুগল ছুটতে চায়। বিলম্বহীন, দ্রুত হাঁটতে গিয়েই মেঝেতে বিছানো পাপসে হো*চট খেল। মুখ থুবড়ে পড়তে নিলো ফ্লোরে। ধূসর আগত পরিস্থিতি বুঝতেই ত্রস্ত বেগে উঠে আসে। ধরে সামলাতে চায় ওকে। কিন্তু দুরন্ত পিউয়ের গতি রোধ করা গেল না। ধরা-ছোয়ার পূর্বেই পিউ হুমড়ি খেয়ে পডল ওর ওপর। টাল রাখতে না পেরে দুজনেই এক সঙ্গে ঠিকড়ে গেল নীচে। ব্যা*থা জায়গায় ফের ব্যা*থা পেয়ে পিউয়ের জ্ঞান হা*রানোর উপক্রম হলো। গগনবি*দারী চিৎ*কার ছোড়ার কথা ছিল। অথচ সে,ইহজগতের সব কিছু ভুলে বসল তখন ,যখন মাথায় ঢুকল নিজের অবস্থান কোথায়। ধূসরের চওড়া বুকে সে৷ দৃশ্যটা দেখেই পিউয়ের ওষ্ঠযূগল আলাদা হয়, স্বীয় জোর খাটিয়ে৷

ধূসর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধাল,
” ঠিক আছিস?”
পিউ কোনও রকম মাথা দোলাল। বোঝাল ঠিক আছে। কিন্তু আদৌতেও কী তাই? বুকের ভেতর যে মারাত্মক কম্পন হচ্ছে ,সেসব কি টের পাচ্ছেন ধূসর ভাই?
ধূসর বলল,
” ওঠ তাহলে। ”
পিউ ভুলে বসল লজ্জা। খেই হারানো নিবিষ্টের ন্যায় আওড়ে উঠল, ‘ না উঠলে হয়না?
ধূসর কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
” থা*প্পড় খাবি?”

সম্বিৎ ফিরল পিউয়ের। নিজের কথা খেয়াল পরতেই নির্বোধ বনে চাইল। লজ্জ্বায় হাঁ*সফাঁ*স করে উঠে দাঁড়াল তৎপর। ধূসর উঠল,ঠিকঠাক করল টিশার্ট। পিউয়ের কুণ্ঠায় মরিমরি দশা। দ্বিতীয় বার ধূসরের দিকে তাকানোর স্পর্ধাটুকুন হয়না। বরং নিজের মোটা মাথাটা ঠুকতে চাইল দেয়ালে। কী বেহায়ার মত একটা কথা বলল কেবল! কী ভাবলেন ধূসর ভাই?

” একটু সাবধানে চলতে পারিস না? এক্ষুনি একটা অঘ*টন ঘটলে কী হতো?”
” অঘ*টন তো ঘটেই গেছে। এইযে আপনি আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এর থেকে বড় অঘট*ন আর হয় বলুন তো?
” হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?

পিউ নড়ে ওঠে। মেরুদণ্ড সোজা করে চোখ নামায়। ধূসর আরেকদিক চেয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। বলল
” তোকে বলেছিলাম খেয়ে রুমে আসতে,না খেয়ে এলি কেন?”
পিউ মিইয়ে এলো আরো। কী উত্তর দেবে এখন? আপনার শোকে স্তব্ধ হয়ে খাবার নামেনি গলা দিয়ে বলবে এটা? আরেকটা ছ্যাচড়ামো হবে তারপর। আস্তে করে বলল,
” খেতে ইচ্ছে করেনি।”

ধূসর ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল। গিয়ে বসল বিছানায়। সামনের জায়গা দেখিয়ে বলল,,
” এখানে বোস।”

পিউ গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল সেখানে। ধূসর প্লেটের দিক চাইল। ওমনভাবেই কিছুক্ষন থম মেরে থাকল । যেন ভাবল গভীর কিছু।
তারপর হুট করে ভাত ভরা প্লেট পিউয়ের দিক ঠেলে দিয়ে বলল,
” খেয়ে নে।”
মেয়েটা অতি আগ্রহ সমেত চেয়েছিল এতক্ষণ। এক অলীক আশায় বুক বাঁধল, ধূসর ভাই হয়ত খাবার মুখে তুলে দেবেন। খাইয়ে দেবেন স্বযত্নে। কিন্তু এবারেও এমন কিচ্ছুটি হলো না দেখে ঝরঝরে কাঁচের ন্যায় মনটা ভে*ঙে পড়ল তার। চকচকে চেহারা ঝুপ করে কালো হলো।
” পরে খাব।”
ধূসর চোখ পাঁকাল,
” এক্ষুনি।”

পিউয়ের অল্পবিস্তর জেদটা টিকলোনা। ধূসর নিজ উদ্যোগে তার হাত টেনে নেয়, গ্লাস থেকে পানি ঢেলে ধুইয়ে দেয়। পিউ ঠোঁট উলটে, ভাত মেখে মুখে দিল। যদি খাইয়েই না দেবেন,তাহলে ঢং করে খাবার আনার মানে কী?

তীব্র অনিহা নিয়ে খাবার চিবোতে চিবোতে ধূসরের দিকে তাকাল পিউ। আচমকা নেত্রপল্লব কেঁপে ওঠে,সতর্ক হয়। ধূসর যেন চট করে দৃষ্টি ফেরাল সে চাইতেই। পিউয়ের সন্দেহ হলো। উনি কী এতক্ষন আমাকে দেখছিলেন?

ধূসর পকেট থেকে ফোন বের করল। পাশ থেকে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসল। পিউ খেতে খেতে একধ্যানে চেয়ে থাকল তারর সুতনু মুখের দিকে।

ওদের পরিবারে সবাই সুদর্শন বলতে সাদিফকে গোনে। ফর্সা, গোলগাল,স্বাস্থ্যও উন্নত। কিন্তু পিউ? তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুশোভিত পুরুষটি হল ধূসর ভাই। মানুষটার গায়ের রং শ্যামলা। অথচ বাকী সব,বাকী সবটা মনকাড়া। পিউয়ের কাছে ধূসর ভাই মানেই আস্ত একটা ডেইরি মিল্ক!

তিন বছর ধরে এক অদ্ভূত রোগে ধরেছে ওকে। ধূসর বকলে, ধমকালেও কেমন গায়ে লাগেনা। মনে হয়, যেন ভালোবেসে ধম*ক দিল সে। না! এভাবে চললে বেশিদিন বাঁচবেনা ও। এই নি*ষ্ঠুর ধূসরের প্রেমে শ*হীদ হবে নিশ্চিত।
পিউ খেয়েদেয়ে প্লেট গুছিয়ে আবার টেবিলে রাখল। নম্র কণ্ঠে জানাল,
” খাওয়া শেষ।”
ধূসরের বৃদ্ধাঙ্গুল ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত। না চেয়েই বলল,

” শুধুমাত্র প্রথমবার তোকে মে*রেছি বলে খাবার এই অবধি আনলাম। তাই বলে ভাবিস না আমি বলব যে মে*রে ভুল করেছি। পরেরবার যদি এরকম কিছু শুনি বা দেখি আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবেনা।’

শান্ত অথচ ক*ড়া কণ্ঠ৷ তাও পিউয়ের ভেতরটা ছেঁয়ে গেল,অদৃশ্য এক তুলতুলে ভালো লাগায়। একটুখানি যাচাইয়ের আশায় বলল,
” কিন্তু আপনি তো আর কাউকে এতটা ক*ড়াক*ড়ি দেননা ধূসর ভাই। এত গুলো ভাইবোনের মধ্যে কী আমাকেই খুঁজে পেলেন?”

বিরতি টেনে পিউ অপেক্ষা করল। খুব করে চাইল, ধূসর একবার বলুক,
” হ্যাঁ পেলাম।কারন আমি তোকে ভালোবাসি আর কাউকে নয়।”

বিধিবাম! এবারেও তাকে আহত করে দিয়ে ধূসরের উত্তর এলো,
” হ্যাঁ। তোর মত তো বাকিরা বাঁদড় নয় যে প্রেম পত্র হাতে করে বাড়ি ফিরবে। এতটা পাঁকামো এই বাড়ির কোনও ছেলেমেয়েরা করেনি। বয়স সতের অথচ প্রেম ভালোবাসা বোঝে। ইঁচড়েপাকা একটা! ”

পিউ ঠোঁট ওল্টাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রত্যেকবার ভাবে এক,হয় আরেক। ধূসর ভাই এমন এমন চমকে দেয়া কাজ করেন,যা তার আশা ভরসা ধূলিসাৎ করতে যথেষ্ট।
ধূসর উঠে এলো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে ওষুধের বাক্স বের করল। খুঁজে খুঁজে একটা পাতা তুলে ওষুধ ছিড়ল সেখান হতে।
গ্লাসে পানি আর সেটা পিউয়ের হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল,
” রাত অনেক হয়েছে! খেয়ে ঘুমা। সকাল হতে হতে ব্যা*থা সেড়ে যাবে।”

চটক কাটার ন্যায় চাইল পিউ। একবার ওষুধ দেখল একবার ধূসরকে। এতক্ষন ভাবনায় এতটাই মজে ছিল যে,খেয়ালই করেনি। এর মানে
ধূসর ভাই ঠিক বুঝেছেন সে ব্যথা পেয়েছিল তখন?

প্রকান্ড বিস্মিত হয় পিউ। ধূসর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সেদিক চেয়ে এতসময়ের সাদা কালো চেহারাটা পূর্নিমার চাঁদের ন্যায় ঝল্কে উঠল ওর। কোথাও গিয়ে সেই পুরোনো প্রত্যাশাই নড়ে উঠল ফের। ভাবল,
” আমি না বলতেই যদি উনি আমার ব্যা*থা বোঝেন,তবে ভালোবাসাটাও তো বোঝার কথা। ”

***
সেই রাতটা পিউয়ের ভালো কাটার কথা ছিল। অথচ কাটেনি। ধূসর ভাইয়ের দিয়ে যাওয়া ছোট্ট একখানা আশার আলোয় ঝল*সে গেছে ওর রাতের ঘুম। ছট*ফট করতে করতে শেষ রাতে ঘুম এলো একদম। উঠেলোও বেলা করে। ঠিক কলেজ যাওয়ার আগে আগে। কারন এই বাড়ির নিয়ম আছে,খুব অ*সুস্থ না হলে ক্লাশ মিস দেয়া যাবেনা। আর এই নিয়ম স্বয়ং আমজাদ সিকদার এর তৈরি। যিনি এই বাড়ির ঘোষিত কর্তা! অথচ ওই মানুষটির সঙ্গেই ধূসরের, অদৃশ্য, অবাধ প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকে যেখানে লোকটার ভ*য়ে তটস্থ থাকে, ধূসর সেখানে গা ভাসানো ছেলে। আমজাদের ধমক,চোখ রা*ঙানো সবতেই নিরুৎসাহিত, নিরুদ্বেগ।

আমজাদ সিকদারের দূর্দান্ত অপছন্দের পেশা হলো রাজনীতি। আর ধূসর এই রাজনীতিতেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ঠিক এই কারণেই ওকে একদিন দেশ ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু না,ফেরানো আর গেলনা। তবে একটা কথা সত্যি, ধূসরের এই নি*র্ভীক ভাবভঙ্গিটাই এক পলকে মন পাখিটা ফুরুৎ করে উড়িয়ে নিলো পিউয়ের।

ভীষণ তাড়াহুড়োতে,তৈরি হয়ে নিচে নামল পিউ। বাড়ির সবাই তখন নাস্তার টেবিল ঘিরে। অবশ্য কর্তারা নেই। তারা কাকভোরেই প্রস্থান নেন অফিসের উদ্দেশ্যে। পিউ শুক্রবার ছাড়া কবে বাবার সাথে সকালে নাস্তা খেয়েছে মনে পড়েনা।

পিউ চেয়ারে বসে আশেপাশে চাইল। ধূসর ভাই কোথায়? তক্ষুণি হাজির হলো সে।
নিদ্রিত ভাব চেহারায় লেপ্টে তখনও। কী কিউট লাগছে! পিউয়ের ইচ্ছে করছে গিয়েই গালটা টিপে দিতে।

” কীরে পিউ! কাল রাতে কী হয়েছিল তোর?”
পিউয়ের মনোযোগ ঘুরে গেল। সুমনার দিক চেয়ে বলল,
” কই কী হবে?! ”
জবা বললেন,
” কিছু নাহলে খেতে এলিনা কেন? কতজন ডাকলাম কতবার, উঠলিনা।”
সাদিফের ছোট ভাই রাদিফ। বয়স দশের কোঠায়। সে দাঁত কেলিয়ে বলল,
” পিউপু মনে হয় ছ্যাকা খেয়েছে।”

পিউ পানি খাচ্ছিল। অবোধ বালকের মুখে কথাটা শুনেই সদ্য গেলা জল বেরিয়ে এলো বাইরে। প্রত্যেকে অবাক চোখে চাইল ওর দিকে।
খুকখুক করে কেশে উঠল পিউ। জবা বেগম ধমকে বললেন,
” চুপ। কোত্থেকে শিখেছিস এসব কথা? ”

রাদিফ কাচুমাচু করে বলল,
” টিভিতে দেখেছিলাম,নায়িকারা দুঃখ পেলে ঘর আটকে বসে থাকে।”
সাদিফ রেগে বলল, ” আজ থেকে তোর টিভি দেখা বন্ধ।”
রাদিফ কিছু বলতে হা করল, জবা পথিমধ্যেই বললেন,
” আর কোনো কথা না। প্লেটের খাবার তো এক ফোটাও নড়ছেনা। চুপচাপ খা।”
দুঃখী দুঃখী মুখ করে চুপ করল ছেলেটা। সে তখনও বোঝেনি এক ঘর মুরুব্বির সামনে কী বলে বসেছে!

এদিকে পিউ তাকিয়ে আছে সামনে বসা ধূসরের দিকে। যার ইহজগতের কোনকিছুতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। একমনে খাচ্ছে শুধু । একটা কথা অবধি বের হচ্ছেনা মুখ দিয়ে। রুবায়দা কখন থেকে জিজ্ঞেস করছেন
” আর একটু ভাজি দেই? একটু জুস দেই? ”
সে শুধু মাথা দোলাচ্ছে দুদিকে।

পুষ্প ব্যস্ত ভঙিতে এসে বসল ওর পাশের চেয়ারে। খানিক উঁচু কণ্ঠে বলল,
” আম্মু, আমাকে এক কাপ চা দাও।”

রান্নাঘর থেকে উত্তর পাঠালেন মিনা,
” সময় লাগবে বোস।”
রুবায়দা জিজ্ঞেস করলেন,
” শুধু চা খাবি কেন পুষ্প? নাস্তা করবিনা?”
” না মেজো মা ,আমার পেটের অবস্থা ভালো নয়। আপাতত স্যালাইন খেয়ে বেঁচে আছি।”
” সেকী আমাদের তো কিছু বলিসও নি। ”
” সামান্য ব্যাপার তো, তাই।”

” তোর পড়াশুনার কী খবর পুষ্প?”
এই এতক্ষনে কথা বলল ধূসর। এতেই যেন পিউয়ের তনুমনে ছেঁয়ে এলো ক্ষোভে। এইযে সে মানুষটা এত সময় ধরে বসে আছে ওর সামনে, কই ওকে তো কিছু জিজ্ঞেস করল না। পড়াশুনা তো সেও করে তাইনা?

হঠাৎ প্রশ্নে পুষ্প ঘাবড়াল খানিক। তাও হেসে বলল,
” এইতো,ভভালো ভাইয়া।”

” তোর ক্লাশ শেষ হয় কখন?”
” একটায়। ”
” কাল বাড়ি ফিরলি চারটায়, কোথাও গিয়েছিলি?”
একটা প্রশ্নও ধূসর ওর দিক তাকিয়ে করেনি। অথচ বাকীদের প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি শশব্যস্ত আছড়ে পড়ল পুষ্পতে। ভড়কে গেল মেয়েটা। কী বলবে বুঝে না পাওয়ার মতন অবস্থা হল মুখের। মিনমিনিয়ে বলল,
” রাস্তায় জ্যাম ছিল।”
” রাস্তার জ্যাম নদীর পাড়ে থাকেনা। ফুচকা খেলে ভালো জায়গা থেকে খাওয়া উচিত। তাহলে আর দরকার হবেনা স্যালাইনের।’

ধূসর মুখ মুছতে মুছতে উঠে গেল । তার খাওয়া শেষ। তবে সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পর পিঠে দুম করে চ*ড় বসালেন মিনা। ধূসরের কথাগুলো শুনেই রান্নাঘরের সব কাজ ফেলে এসেছেন তিনি। হঠাৎ হামলায়
ব্যাথায় মু*চড়ে উঠল পুষ্প। চাইল কাঁদোকাঁদো চোখে। তিনি খেকিয়ে বললেন,
” এই তোর এক্সট্রা ক্লাস? আসুক তোর বাবা। ক্লাশ শেষে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়ানো বার করবে।”

মিনার তপ্ত দৃষ্টি থেকে রুবায়দা ওকে আড়াল করে বললেন,
” থাক থাক আপা, ছোট মানুষ! ”

ব্যাপার গুলো বাকী সবার মাথার ওপর দিয়ে যায়। ছেলে আ*সামী বানিয়ে রেখে গেছে, আর মা উকিল হয়ে বাঁ*চাতে আসছে।
পিউ হাসল, ভাবল,
‘ না। আমার হবু শ্বাশুড়ি মা কিন্তু ফার্স্টক্লাস! বিয়ের পর ধূসর ভাইয়ের সাথে আমার ঝ*গড়া হলে এইভাবে মিটমাট করিয়ে দেবেন নিশ্চয়ই? ‘

আপু ছ*লছ*ল চোখে মাথা নোয়াল। পিউয়ের মায়া হলো ভারী। ধূসর ভাইটা এমন করে কেন? নিজেতো একটা পান্তাভাত। বাকীরা কী একটুও ঘুরবেওনা?
ঠিক এই কারণেই মানুষটাকে সবাই সমঝে চলে। চোখ দুটো যেন জ্যান্ত বাজ পাখি। কখন, কোনদিকে থাকে কেউ জানেনা। এই যে পুষ্পটা ক্লাশ শেষ করে সামান্য একটু ফুচকা খেতে গিয়েছিল, সেটাও চোখে পড়ল তার।

পিউ কলেজ ব্যাগ পিঠে চড়িয়ে উঠতে যেতেই সাদিফ বলল,
” পিউ দাঁড়া,আমি যাব।”
” আপনার অফিস তো উল্টোদিকে ভাইয়া।”
সাদিফ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
” সমস্যা নেই, ঘুরে যাব আজ। সোজা রাস্তাটায় জ্যাম পরে খুব। তুই চল,তোকে এগিয়ে দেই।”

পিউ খুশি হয়ে গেল। সাদিফের সাথে যাওয়া মানে বাইকের ফুরফুরে হাওয়া গা মাখানো। গাড়িতে চড়তে একটুও ভালো লাগেনা ওর। ভালোই হবে।

পার্কিং লট থেকে সাদিফ বাইক বের করে গেটে আনল। পিউ ওর কাঁধ ছুয়ে উঠতে উঠতে বলল,
” জানেন ভাইয়া,আমার না গাড়ির থেকে বাইক পছন্দ৷ গাড়ির চারপাশ আটকা তো,দমবন্ধ লাগে।’

সাদিফ হাসল। বলল,
‘ অফিসের রাস্তাটা ওদিকে হলে তোকে রোজ আমিই পৌঁছে দিতে পারতাম।’
পিউ মাথা দোলাল।
সাদিফ বাইক স্টার্ট দেয়। আচমকা পিউয়ের চোখ পড়ল দোতলায়,ধূসরের ঘরের দিকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে। চোখ এদিকেই,ওদের ওপর।
সাদিফ বাইক ছুটিয়ে গেট পার হলো। তখনও পিউ চেয়ে রইল ওর দিক। অত দুরুত্বেও যেন ধূসরের নিরেট,কটমটে চিবুক স্পষ্ট বুঝল সে। প্রশ্ন জাগল,
ধূসর ভাই কী রা*গ করলেন? বা হিংসে?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here