এক_সমুদ্র_প্রেম! লেখনীতে : নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি সূচনা পর্ব।

0
618

“ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পিউয়ের বাম গালে শক্তপোক্ত এক চ*ড় বসাল ধূসর। মেয়েটার কান,মাথা,গাল ঝিমঝিম করে উঠল। ভোঁ ভোঁ করে ঘুরল সমগ্র পৃথিবী। হতবাক হয়ে চাইল সে। ধূসরের র*ক্তাভ দুই চোখ নিবদ্ধ ওর ওপর। ক্রো*ধে ফুঁ*সছে চোখা নাক। এই সতের বছরের জীবনে কোনওদিন মা*র না খাওয়া পিউ, আজ যেন বাকরুদ্ধ,স্তব্ধ। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে বাজছে,
” ধূসর ভাই আমায় চ*ড় মারলেন?”
রু*দ্রমূর্তি ধারনকারী ধূসর ভাইকে দেখে পিউয়ের অন্তরা*ত্মা শুকিয়ে যাওয়ার যোগাড়। সে মানুষটা সবেগে, সুদৃঢ় হস্তে কনুই চে*পে ধরল ওর। ধরিত্রীর সবটুকু ক্রোধ কণ্ঠে ঢেলে বলল,
” খুব সাহস বেড়েছে তোর তাইনা?
এতটা নি*র্লজ্জ্ব হয়েছিস যে,আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলতে জিভে আটকালোনা?
ধম*কে পিউয়ের ছোট্ট দেহ ক*ম্পিত। থরথর করে হাত-পা কাঁপে। অথচ তাও,
ভীষণ ক*ষ্টে সাহস যুগিয়ে বলল,
” আমি,আমি কী করব? আপনিইতো সত্যিটা শুনতে চাইলেন। ”
ধূসরের হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো আরো। বড শক্ত করে চেপে ধরেছে ওকে। পিউ ব্যাথায় মুচ*ড়িয়ে উঠলেও ছাড়ল না,তোয়াক্কা দেখাল না। উলটে রা*গে আ*গুন হয়ে বলল,
” তোর জিভ টে*নে ছি*ড়ে ফেলব পিউ। তুই আমায় চিনিস না। ভবিষ্যতে তোর মুখ থেকে এসব যেন না শুনি।”
পিউ দমে গেল না। দমে যাবে বলে কী এতটা ঝুঁকি নিয়েছে আজ? হেরে যাওয়ার পাত্রী সে নয়। ভ*য় পেলেও নীচু কণ্ঠে বিরোধিতা করল,
” কেন বলবনা আমি? আমি কি কাউকে ভভালোবাসতে পারিনা? কাউকে ভালো লাগতে পারেনা আমার? আপনিই বা কেন এত রিয়্যাক্ট করছেন,আপনি বুঝি কাউকে ভালোবাসেন না?”
ধূসরের মোটা ভ্রুযূগল শিথিল হলো সহসা। স্পষ্ট বোঝা গেল তার বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি। কিছুক্ষন অমত্ত হয়ে চেয়ে রইল সে। পরপরই শ*ক্ত চিবুকে, দাঁত খিঁ*চে বলল,
” এক থা*প্পড়ে তোর সব দাঁত ফে*লে দেব বে*য়াদব! তোর বয়স কত? ভালোবাসার কী বুঝিস তুই? পড়াশুনার নাম করে কলেজে গিয়ে এসব করছিস ?
ওকে ফাইন! তোকে তো আমি পরে দেখছি,আগে দেখে আসি, তোকে প্রেমপত্র দেয়া সেই দুঃ*সাহসী আশিককে।”
পিউয়ের চোয়াল ঝুলে পরল ওমনি। ধূসর ওর হাতখানা ছাড়ল না,যেন সজো*রে ছু*ড়ল। রুষ্ট,ক্ষুব্ধ চাউনী নিক্ষেপ করে গটগটিয়ে ঘর ছাড়ল তারপর। এদিকে আত*ঙ্কে ঘাম ছুটে গেল পিউয়ের।
ধূসর ভাইয়া মা*রাত্মক লোক। মা*রপিটে পি-এইচ-ডি প্রাপ্ত। ওনার বিশ্বাস নেই। রা*গের মাথায় কী না কী করবেন!
সে তড়িঘড়ি করে ফোন তুলল হাতে। কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজতে গিয়েও হাতের প্রতিটি আঙুল কাঁপছে
। চটপট ডায়াল করল রবিনের নম্বরে। ছেলেটা ধরল না। কোথায় ম*রে গেছে কে জানে! এই মুহুর্তে ফোন না ধরলে ধূসর ভাই সত্যিই ওকে ক*বর দিয়ে দেবেন। টানা কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো ফোন। ওপাশ থেকে রবিন অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
” পিউ! তুমি আমায় ফোন করেছো?”
পিউয়ের যতটা না ভ*য় লাগছিল এর থেকেও অধিক মেজাজ খারা*প হলো রবিনের মুখে তুমি শুনে। এতটা দিন, তুই বলে সম্বোধন করতো ছেলেটা। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে এই তুমিময় নাটক। পিউ খুব তাড়াহুড়ো তে জিজ্ঞেস করল
” কোথায় আছিস তুই?”
” কেন,দেখা করবে না কী?”
” চুপ কর। এই মুহুর্তে যেখানে আছিস পা*লা। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পর। একটা কাজ কর,সেলুনে গিয়ে বসে থাক,ওটা সে*ফ জায়গা।”
রবিন ভ্রু কোঁচাকাল। আগামাথা না বুঝে বলল,
” কেন? কী হয়েছে? লু*কোতে যাব কেন?”
পিউ হা হুতাশ করে বলল,
” না লুকোলে তোর কপালে ভীষণ দুঃ*খ আছে রবিন। ধুসর ভাই তে*ড়ে যাচ্ছেন তোর কাছে। ”
রবিন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” ককেন? আমিতো কিছু করিনি। সেদিনের পর থেকে তোমাকে বির*ক্তও করিনি পিউ। তুমি কি ওনার কাছে আমার নামে না*লিশ করেছো?”
” না*লিশ করিনি। তবে ওনার হাতে তোর লেখা চিঠি আছে। এবার তুই ঠিক কর,পালাবি না ওখানেই বসে থাকবি। আমার সাবধান করার করলাম। জান বাঁ*চানো ফরজ,এই কথা মাথায় রেখে কোনও গর্তে গিয়ে লু*কিয়ে থাক। রাখছি।”
রবিন ঢোক গিলল। আ*তঙ্কিত হয়ে চারপাশ দেখল। কপাল বেঁয়ে দরদর করে পরে যাওয়া ঘামটা মুছেই চট করে দৌড় লাগাল।
পিউ লাইন কাটল ফোনের। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে একটু ধাতস্থ হল৷ গালের হাড় ব্যা*থায় টনটন করছে। কী মা*রটাই না মে*রেছে পা*ষান লোক!
কোমল দুটো আঙুল কপোলে বোলায় সে। ঠিক যেখানটায় স্পর্শ বসেছে ধূসরের। চিনচিনে ব্যথা ছাপিয়ে,আচমকা হেসে ফেলল পিউ।
সত্যি বলতে ধূসর ভাইয়ের এই থা*প্পড় খেয়েও ওর খারাপ লাগেনি, আর না পেয়েছে ক*ষ্ট। সে যে তৈরিই ছিল। আন্দাজ করেছিল, মানুষটার সামনে অন্যকাউকে ভালোবাসি বলতে দেরি হলেও ওর গ*র্দান ছেদে দেরি হবেনা।
কিন্তু, এছাড়া যে উপায়ও ছিলনা। ধূসর ভাইয়ের মুখ থেকে একটা সত্যি কথা শোনার আশায়, আজ তিনটে বছর এভাবেই কাটছে ওর। কীই না করেছে পিউ! কত চেষ্টা, কত পন্থা অবলম্বন করেছে। কিন্তু না,কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায়নি। পিউ আজও বিভ্রমে ভোগে,
” ধূসর ভাই আমায় ভালোবাসেন? না কি বাসেননা? ”
উত্তরগুলো ওরই মতো বিভ্রান্ত। তারা একবার বলে হ্যাঁ, পরের বার ‘না’। তবে একটা কথা সত্যি। মানুষটা ওকে ভালোবাসুক আর না বাসুক, ও যে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে প্রতিদিন।
ধূসরের প্রতি অনুভূতি তার অতলস্পর্শী বিশালাকার সমুদ্রের ন্যায়।
যে সামনে এলেই সপ্তদশীর হৃদয় কাঁ*পে। কেমন অস্থির অস্থির লাগে সবকিছু । পরিচ্ছন্ন আঁখিতে নামে প্রেমের ঝাপ্সা বর্ষণ। মনে হয় সে নেই,হাওয়ায় ভাসছে। উড়ছে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে। পাড়ি দিচ্ছে একের পর এক পর্বতশৃঙ্গ।
মাঝেমধ্যে তো লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ক্যাবলা বনে চেয়ে থাকে সে মানুষটার পানে। এই সর্বনা*শের শুরু আজ নয়, হয়েছিল সেদিন, যেদিন প্রথম দেখেছিল ধূসর নামক নিরেট ওই মানবকে।
সম্পর্কে ধূসর-পিউয়ের চাচাতো ভাই। এ বাড়ির মেজো কর্তা আফতাব সিকদারের একমাত্র সন্তান। অথচ ভাই-বোনের মধ্যে ধূসরই সবার বড়। একান্নবর্তী পরিবার ওদের। চার কর্তার আন্ডাবাচ্চা ধরলে সে এক মস্ত বড় তালিকা।
ভাইদের মধ্যে সবার বড় হলেন আমজাদ সিকদার। স্বভাবে ধূসরের আরেকজন। বিষয়টা একটু ওলটপালট। হিসেব মত বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়ে বড় হলেও এদিক থেকে তিনি অনেক পিছিয়ে। ভদ্রলোকের পূর্বেই মেজো ভাই আফতাব বিয়ে করে বউ তুলেছিলেন ঘরে। কারণ,ধূসরের মা রুবায়দার অন্যত্র বিয়ের তোরজোর চলছিল সে সময়।
এরকমই আরেকটি গোলমেলে বিষয় হলো আজমল সিকদারের বেলাতেও। তার ছেলে সাদিফ, সেও বড় পিউয়েদের চেয়ে। সম্পর্কে সব কিছু ঠিকঠাক হলেও বয়সটা অতিমাত্রায় কম্পলিকেটেড।
পিউয়ের বয়স যখন আটের কোঠায়? ধূসরকে পড়াশুনার জন্যে নিউইয়র্ক পাঠানো হয়। এর পেছনেও রয়েছে পরিবারের মস্ত বড় এক অতীত। কারণ,বিদেশ থেকে পড়াশুনা তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীতে ধূসরের বেলায় প্রথম। এক প্রকার তার বাউন্ডুলে স্বভাবে বাধ্য হয়েই বাপ-চাচা ঠেলেঠুলে দেশ ছাড়িয়েছেন ওকে।
পাক্কা সাত বছর ভিনদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরল ধূসর। যেদিন সে এলো? কী উৎসবটাই না লেগেছিল বাড়িতে! আত্মীয় স্বজনের উপচে পরা ভীড়ে পা রাখার জায়গা নেই যেন। সকলের উৎকন্ঠিত অপেক্ষার ইতি টেনে ধূসর কদম রাখল চৌকাঠে। বড় বড় মানুষের মধ্যে, কোনওরকমে খরগোশের মত মাথা বের করে উঁকি দিল এক পনের বছরের কিশোরি। দেখতে চাইল মা -চাচীদের দিনরাত নাম জপা সেই মানুষটিকে। অথচ ঠিক যেই মাত্র দেখল, হাহ! বিনাদ্বিধায় নাম লেখাল এই প্রণয় নামক সমূহ বিনা*শের খাতাতে। রীতিমতো পিছলে পড়ল লম্বাদেহী,শ্যামবর্ণ মানুষটার প্রেমে।
পিউ ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়েছিল কতক্ষণ। পরতে পরতে মনোযোগ ঢেলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেল ধূসরকে। চোখজুড়ে তখন বিমোহের বারিধারা। এত সুদর্শন,সুপুরুষ ওর চাচাতো ভাই,ভাবতেই নাক সিটকাল মেয়েটা। মনে মনে চরম প্রতিবাদ জানাল এই আমূল সত্যির।
ধূসরের পাশে ‘ ভাই’ শব্দটা বেমানান, কুৎসিত। কেন এই লোক ওর ভাই হবেন? পরিবারের বাকীরা ওনাকে ভাইয়া, ভাইয়া বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও পিউ কখনোওই ওকে ভাইয়া বলে ডাকেনি। ছয় ফুটের অত বড় একটা লোককে ‘ ‘ধূসর ভাই ‘বলে সম্বোধন করে এখনও। এভাবে তো মানুষ পাড়াপড়শিকেও ডাকে তাইনা? পিউয়ের বিশ্বাস, সম্বোধনের দিক দিয়ে যত দূরে ঠেলবে ওনাকে, মনের দিক দিয়ে উনি তত কাছে আসবেন।
কিন্তু সে! সেই উনি একটা ফা*লতু লোক। একটা গ*র্দভ, বোকারাম! আজ তিন তিনটে বছর পিউ চোখের সামনে ঘুরঘুর করছে। প্রতিটা মুহুর্ত দুহাত ভর্তি প্রেম ঢেলে দিচ্ছে, অথচ ওই মানুষটার চোখেই পড়েনা? সে দুনিয়ার সব বোঝে,বোঝেনা শুধু ওকে। যেন প্রেম কী আদৌ জানেইনা। ছেলেদের বেশি সুন্দর হতে নেই,হলেই তাদের অহংকার বেড়ে যায়। এই যেমন ধূসরের আকাশচুম্বী ভাব। যে মিষ্টি দেখতে পিউকে ড্রেনের ময়লা পানি ভাবে। যা দেখলে সবাই কুঁচকে ফেলবে চেহারা। যাকে ধ*মকানো যাবে,রা*গানো যাবে,আজকের পর মা*রাও যাবে, কিন্তু ভালোবাসা যাবেনা।
কখনও ভালো করে , একটু স্পষ্ট চোখে তাকায়নি। সে সাজল,না সাজল,কী জামা পরল, কেমন করে চুল বাঁধল আজ অবধি লক্ষ্য করেছে কী না সন্দেহ।
পিউয়ের মুখটা ছোট হয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাসে ওঠানামা করে রুগ্ন বুক। কাঁ*দোকাঁ*দো চেহারায় ঘর থেকে বের হয় সে। একটু-আধটু চিন্তায় আই-ঢাই লাগছে কেমন! রবিনটাকে পেলে ধূসর ভাই কী করবেন,কে জানে! তার পরীক্ষা আর যাচাইয়ের যন্ত্রনায় ছেলেটাকে শুধু শুধু ফাঁসাল।
পিউ মনমরা হয়ে হাঁটছিল। আচমকা সামনে পড়লেন মিনা বেগম। বেখেয়ালে ওকে একবার দেখে আবার সতর্ক চোখে চাইলেন।
” কী রে,গালটা ওমন লাল হয়ে আছে কেন?”
পিউ চট করে গালে হাত বোলাল। আমতা-আমতা করে বলল,
” কই,না তো।”
মিনা এগোতে নিতেই,সে ত্রস্ত বেগে এক পা পেছনে চলে গেল। বলল,
” মশা কাম*ড়েছে আম্মু,সত্যি বলছি।”
” মশা কাম*ড়ালে এমন দেখাবে কেন?”
পিউ গাল চেপে মাথা নোয়াল। কী করে বলবে এখন, আমাকে তোমাদের আদরের ধূসর আকাশ বাতাস কাঁ*পিয়ে এক চ*ড় মেরেছে। এই কথা কী বলা যায় কখনও? দোষতো ওরই ছিল। কেন যে পাঁকামো করতে গিয়েছিল তখন?
আর, যদি ও বা বলেও, তখন ধূসর ভাই সবাইকে সত্যিটা বলে দিলে? এই একটা মারের সাথে আরো কত মার যে পরবে পিঠে।
সে যে ওসব মানুষটাকে রা*গাতে বলেছিল, তা তো আর উনি জানেন না।
পিউ মনে মনে বিরক্ত হলো নিজের ওপর। রবিন আর সে একই ক্লাশে পড়ে। বেশ কয়েকদিন যাবত ওর পেছনে ছুঁকছুঁক করছিল ছেলেটা। পিউ বুঝলেও, কিছু বলেনি। কারণ রবিন সীমায় ছিল,বাড়াবাড়ি করেনি। আর না প্রস্তাব দিয়েছে প্রেমের। কিন্তু আজকেই যেন সেই সীমা অতিক্রমের ভয়ানক ইচ্ছে জাগল ওর। কলেজ ছুটির পরপরই হঠাৎ ছুটে এসে একটা চিঠি গুঁজে দিল হাতের মুঠোয়। পিউ কিছু বলার, বোঝার আগেই দৌড়ে পালাল।
কিন্তু সে তো চিঠি বয়েও আনেনি। পড়েও দেখেনি অনীহায়। উলটে রেগেমেগে ছিড়ে ফেলে দিলো রাস্তায়।
কিন্তু সেই কথা চাপা রইল না। বাতাসের গতিতে,এক অলৌকিক শক্তি দ্বারা ধূসর ভাইয়ের কানে ঠিক পৌঁছে দিয়েছে কেউ।
বাড়ি ফিরে পিউ কেবল ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখল ধূসর দাঁড়িয়ে কামড়ায়। একেবারে সটান একটা দীর্ঘ দেহ। পিউ অবাক হয় ভীষণ। ধূসর ওর রুমে পা ফেলেনা সহজে। জিজ্ঞেস করার আগেই, উল্টোদিক থেকে কটমটে কন্ঠের প্রশ্ন এলো,
” ছেলেটা কে?”
পিউ বেশ কয়েকটি উপন্যাসে পড়েছিল, এমনকি সিনেমাতেও দেখেছিল, নায়ক জেলাসিতে মুখ ফস্কে বলে দেয় ভালোবাসার কথা। সেই ট্রিক্স কাজে লাগাতে কথার এক পর্যায়ে ইচ্ছে করে বলল ‘রবিনকে ভালোবাসি ‘আমি।
কিন্তু এর শেষটায় কী হলো? ধূসরের মুখ থেকে কিছুতো বের হলোইনা, উলটে প্রকান্ড থা*প্পড় খেয়ে মাথা চক্কর কাটল ওর। গালে ব্যথাও লাগল ওর। পিউ দীর্ঘ ব্য*থিত এক নিঃশ্বাস ফেলল পুনরায়।
মিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
” কী ব্যাপার? কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে বললি না? কেউ মেরেছে নাকী? ‘
সম্বিৎ ফিরল পিউয়ের। কথা ঘোরাতে বলল,
” কে মারবে? কী যে বলোনা! তুমি কী কাজে যাচ্ছিলে যাওনা আম্মু। আমার অনেক তাড়া,দাঁড়ানোর সময় নেই।”
মিছিমিছি ব্যস্ততা দেখিয়ে একরকম পালিয়ে এল সে। পেছন থেকে মিনা অনেকবার ডাকলেও, দাঁড় করানো গেল না।
পিউ সিড়িঘরের, করিডোরে কতক্ষণ পায়চারি করল। ধূসর এই মুহুর্তে কোথায় আছে জানতে পারলেও একটু আঁচ করা যেত সবটা। কিন্তু ও শতবার ফোন করলেও উনি ধরবেননা। অবশ্য ওই ফোনটুকু করার সাহসও যে নেই এখন।
তারপর হঠাৎই মাথায় এলো সাদিফের কথা। পিউ চকচকে চেহারায় ঘরের দিক চলল তার। দরজা আগলে, উঁকি দিল ভেতরে। আস্তে করে ডাকল,
” ভাইয়া! ও ভাইয়া!”
না,সাড়া এলোনা। আজ রবিবার,সাদিফের অফিসের ছুটির দিন। ঘরে নেই যখন,ছাদে থাকবেন। পিউ ঘুরতে গেল, ওমনি একটা প্রসস্থ বুকের সঙ্গে ঠুকে গেল নাকটা। পিউ এতটাই ভড়কেছে, হেলেদুলে পড়ে যেতে ধরল। ওমনি সাদিফ এক হাত টেনে ধরল ওর। টালমাটাল মেয়েটার বাহু ধরে, সোজা দাঁড় করিয়ে বলল,
” তুই কি সত্যিই এত পুষ্টিহীনতায় ভুগছিস পিউ ? সামান্য একটা ধা*ক্কা খেয়ে কেউ এভাবে পরে যায়?”
পিউ নাক ডলতে ডলতে চাইল। চাশমিশ, ফর্সা, গোলাকার চেহারার ছেলেটাকে সরু চোখে নিরীক্ষন করে বলল,
” আমি কি জানতাম আপনি আসবেন? উফ,ওটা শরীর না লোহা!
সাদিফ কপাল গুঁটিয়ে বলল,
” আমি তো তোর মত তুলো খাইনা যে ফুঁ দিলে উড়ে যাব। যাকগে,ঘরে উঁকি মারছিলি কেন? ”
‘ উঁকি মারব কেন? খুঁজছিলাম আপনাকে। একটা হেল্প চাই আমার।
ভ্রু উঁচাল সাদিফ।
” কী হেল্প?”
” ধূসর ভাইকে একটা ফোন করবেন।”
” করলে?”
” শুনতাম উনি কোথায়,বাড়ি কখন আসবেন।”
” তোর ফোন থেকে কর।”
পিউ মিনমিন করে বলল, ‘ ব্যালেন্স নেই। আর আমি কি আমার জন্যে বলছি,আম্মু বলেছেন করতে।”
সাদিফ ঘরের ভেতর ঢুকল। পিউ পেছনে আসে। সে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
” কিন্তু এখন তো ভাইয়াকে ফোন করা যাবেনা। সামনে ওদের দলের নির্বাচন, ব্যাস্ত থাকতে পারে।”
পিউ কণ্ঠ করুণ করল,
” একটা কল দিয়েই দেখুন না প্লিজ!”
সাদিফ সোজাসুজি চাইল ওর মুখের দিক। পিউ ইচ্ছে করে চেহারা আরো কালো বানাতেই,দম ফেলে বলল,
” দিচ্ছি।”
পিউ ঝলমলিয়ে উঠল। দাঁত কপাটি বের করে বলল
” আপনি খুব ভালো! ”
সাদিফ সেই একইরকম ঠান্ডা চোখে চাইল। পূর্ন দৃষ্টিতে পরোখ করল সপ্তদশী রাঙা মুখবিবর। চোখ সরিয়ে, নাকের ডগায় চশমা ঠেলে,ফোন তুলল হাতে।
লাউডস্পিকার দিলো সে। রিং হতে শুনল পিউ। কিন্তু কয়েকবার বাজতেই লাইন কাটল ধূসর। সাদিফ বলল,
” কেটে দিয়েছে। বললাম না,ব্যস্ত ।”
পিউয়ের অনুচিন্তন এবার লাগাম ছাড়ায়। রবিনটাকে কী খুঁজে পেলেন উনি? ছেলেটা শুধু শুধু কেলানি খাবে। সে না হয় ধূসর ভাই ফেরার আগে আগে দোর দিয়ে রুমে বসে থাকবে। ভাণ করবে অসুস্থতার। কিন্তু ও?
পিউয়ের চিন্তিত মুখস্রী সাদিফের নরম মনে দাগ কাটল। এগিয়ে এলো কাছে।
” কিছু হয়েছে তোর? ”
তাকাল পিউ। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘না’। তারপর আস্তে করে বলল,
” আসি।”
উত্তরের প্রতীক্ষায় না থেকে বেরিয়ে গেল পিউ। সাদিফ ফোস করে শ্বাস ফেলল। বিছানায় বসে ল্যাপটপ মেলে ব্যস্ত হলো কাজে।
পিউ সারা রুমজুড়ে পায়চারি করছে। কী হবে এখন? কী করবে সে? কোনও একটা উপায় না পেয়ে, হতাশ,বিধ্বস্ত ভঙিতে দুহাত মেলে শুয়ে পড়ল বিছানায়। না, আর ভালো লাগছে না। এত অ*শান্তি নেওয়া যায়না।
পিউ চোখ বুজল। কী আশ্চর্য! এখানেও ধূসর ভাইয়ের তামাটে চেহারার হানাহানি। লোকটা ফর্সা নন,কিন্তু দেখতে মারাত্মক। সব থেকে মারাত্মক ওনার হাঁটাচলা,ওনার এটিটিউড,ওনার কথা বলার ভঙ্গি। নাহলে কী এক দেখাতেই প্রেমে পড়ত ও? পিউ বালিশে মুখ পুরোটা গুঁজে দিলো। বিড়বিড় করল,
উফ! এই লোক আমায় মে*রেই ফেলবে।
একটা সময় গভীর ঘুম হামলা চালায় চোখে। টানা চার ঘন্টা মহিষের ন্যায় ঘুমাল পিউ।
যখন চোখ মেলল, বাইরে তখন ঘুঁটঘুঁটে তিঁমির। হাই তুলে উঠে বসল সে। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা বাজে। ভ্রু কপালে তুলল পিউ।
‘এইরে,এতক্ষন ঘুমিয়েছি?’
এদিকে খিদেও পেয়েছে। মোচড় দিচ্ছে পেট। সন্ধ্যায় নাস্তাও খায়নি আজ। আনাচে-কানাচে ইঁদুর ছুটছে এখন। পিউ দ্রুত বিছানা হতে নামল।
ধূসর বাড়ি ফেরে এগারটায়। ইদানিং ব্যস্ততায় আসতে একটা /দুটো বাজে। আজকেও নিশ্চয়ই ওরকম সময় আসবেন? সে আসার আগেই যদি খেয়েদেয়ে রুমে ঢুকে খিল লাগাতে পারে,তবে আর মুখোমুখি হতে হবেনা।
ওর যে এখন উভয় সংকট! রবিনকে না পেলেও রাগ ঝাড়বে ওর ওপর। পেলেতো কথাই নেই।
সকালে ধূসর ওঠার আগে কলেজে যাবে। আবার আসার আগে আগে এমন লুকিয়ে পড়বে কামড়ায়। সপ্তাহখানেক পার হলে ঘটনা ঠান্ডা হবে নিশ্চয়ই? তখন আর ভয় থাকবেনা কোনও।
পিউ আস্তেধীরে দরজা খুলল। বসার ঘরে নিভু নিভু আলো জ্বলছে। এছাড়া সারা বাড়ি অন্ধকার। সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমোতে গিয়েছে। ওকেও ডেকেছে নির্ঘাত। মরার মতো ঘুমোলে শুনবে কীভাবে?
পিউ ধীর কদমে খাবার টেবিলের কাছে এল। পাশাপাশি দুটো প্লেটে ভাত বেড়ে ঢেকে রাখা। একটা ধূসরের সে জানে। ফিরে খায় উনি। এখনও ওমন রাখা যেহেতু,ফেরেনি তাহলে? যাক,ভালোই হোলো,একটু নিশ্চিন্তে,আরামসে খাওয়া যাবে এখন।
পিউ বেসিন থেকে হাঁত ধুয়ে এলো।
সাদা ভাতের ওপর ইলিশ মাছের বড় টুকরোটা খিদে বাড়ালো দ্বিগুন।
ঝটপট চেয়ার টেনে বসতে গেল সে। অথচ বসার আগেই, আচমকা চেয়ার খানা টেনে নিল কেউ একজন। ফলস্বরূপ, পিউ ধপাস করে পড়ে গেল ফ্লোরে। টাইলসের মেঝেতে অতর্কিত আক্রমন, কোমড় থেকে পা অবধি ধরিয়ে দিলো ব্যা*থায়। হকচকিয়ে,তৎপর পেছন ঘুরে চাইল পিউ। সম্মুখে ধূসরকে টানটান হয়ে দাঁড়ানো দেখেই বুঝে ফেলল,
” যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যে হয়।”
চলবে
#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে : নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সূচনা পর্ব।
দীর্ঘদিন ইচ্ছে ছিল কাজিন লাভস্টোরি লিখব। মাথার মধ্যে থিমটা খুব করে ঘুরছিলও। লিখে ফেললাম আজ। কেমন হয়েছে জানাবেন!
চলমান গল্প “তোমার মত কাউকে নয়” আপাতত বন্ধ রাখতে চাইছি। সব ঝামেলা মিটিয়ে একসাথে দুটো কন্টিনিউ করব ইনশাআল্লাহ 🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here