দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ১৪ #আদওয়া_ইবশার

0
310

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৪
#আদওয়া_ইবশার

সময় বহমান। প্রতিটা সূর্যাস্তের সাথে গত হচ্ছে এক একটা দিন। দৃষ্টি, তুসীর ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তুসী বহু সাধনার পর নিজের জন্য একটা আসন জয় করে ফেলেছে। কিন্তু ব্যর্থ দৃষ্টি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের জন্য আসন তৈরী করতে পারেনি। তবে এই নিয়ে দৃষ্টির মনে কোনো প্রকার আফসোস নেই। কিন্তু মেয়ে চান্স পায়নি এই নিয়ে সাদেক সাহেব আর দিলশান আরা’র আফসোসের অন্ত নেই। একই সমবয়সী দৃষ্টি তুসী দুজন খালাতো বোন। তুসীর বাবা সামান্য একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা গৃহিনী। আর দৃষ্টির বাবা ব্যবসায়ী মানুষ হলেও যথেষ্ট উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। মা একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক। এই বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে গেলে আত্মীয়-স্বজন সবাই নিশ্চিত দিয়ে বলতো তুসী চান্স না পেলেও দৃষ্টি ঠিকই চান্স পেয়ে যাবে। কিন্তু হলো তার সম্পূর্ণ উল্টোটা। মেয়ের এই ব্যর্থতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দিলশান আরা। মেয়ে চান্স পায়নি এই দুঃখের থেকেও বড় দুঃখ কর্মস্থলের পরিচিতদের, আত্মীয়-স্বজনের সামনে মুখ দেখাবে কিভাবে? মেয়েটা যে শেষ মুহূর্তে এসে এতো বড় একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির মাঝে ফেলবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি দিলশান আরা। চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরে আছে বিছানায়। বিকেলের দিকে দৃষ্টি দিহানকে সাদেক সাহেব গিয়ে নিয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। বাড়িতে এসেই অপরাধি মুখে মায়ের সামনে উপস্থিত হয়েছিল দৃষ্টি। তবে মেয়ের সাথে একটা শব্দ পযর্ন্ত উচ্চারণ করেনি দিলশান আরা। কতক্ষণ মা’কে মানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি দিলশান আরা। বাবা কথা বললেও তার কথায় মন খারাপের লেশ ঠিক বুঝতে পেরেছে দৃষ্টি। দিহানটাও আসার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। বাড়ির থমথমে পরিস্থিতি দেখে লাফালাফির সাহস পাচ্ছেনা।

নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে বুক ফুলিয়ে দম ছাড়ে দৃষ্টি। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য মনে মনে সম্পূর্ণ দায়ী করে রক্তিম শিকদারকে। ঐ পাতি নেতার চিন্তায় বিভোর থেকেই তো দৃষ্টির এডমিশন প্রস্তুতি খারাপ হয়েছে। হবে নাই বা কেন!সর্বক্ষণ মাথার মাঝে পোকার মতো ঘুরঘুর করেছে। এমনকি পরীক্ষার হলে গিয়ে পর্যন্ত ঐ গুন্ডাটার কথা ভেবেছে। এসবের মাঝে দৃষ্টির রেজাল্ট বড়সড় একটা লাড্ডু হবেনা তো কি হবে! পাষাণ পুরুষটা তার আলাভুলা মনটা কেড়ে নেবার পাশাপাশি শান্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এরপরও তার প্রতি একটু দয়ার নজর দিচ্ছেনা। কোন আদলে গেলে দৃষ্টি ঐ পাষন্ড পুরুষটার অমানবিক আচরণের সুষ্ঠ বিচার পাবে?

গোটা একটা সন্ধ্যা কেটে যাবার পর রাতের খাবারের সময় গম্ভীর মুখাবয়বে মেয়ের দিকে তাকায় দিলশনা আরা। মায়ের ফোলা চোখ দুটো দেখে এবার একটু মন খারাপ হয় দৃষ্টির। সর্বক্ষণ সব কিছু নিয়ে দাম্ভিকতার চূড়ায় রানীর হালে বসে থাকা মা’টা যে তার এমন রেজাল্ট কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা বুঝতে পারে দৃষ্টি। অপরাধবোধে মায়ের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারেনা। মাথা ঝুকিয়ে তাকিয়ে থাকে প্লেটের দিকে। ক্ষণকাল পর শুনতে পায় মায়ের গম্ভীর্য আওয়াজ,

“পাবলিকে হয়নি তাই বলে এটা ভেবোনা আর কোনো চেষ্টা না করেই তোমাকে আমি সাধারণ কোনো কলেজে ভর্তি করিয়ে দিব। সাত কলেজের জন্য প্রস্তুতি নাও। এবার অন্তত আমার মান-সম্মানের দিকটা ভেবে হলেও পড়াই একটু মনযোগ দিয়ো।”

হতাশার একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে দৃষ্টির বুক চিড়ে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় নিরবে খেয়ে যাচ্ছেন সাহেব সাহেব। নিরব থেকেই যেন মেয়েকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ওনি নিজেও স্ত্রীর কথায় একমত। এই মানুষ দুটো আজীবন শুধু সম্মান আর টাকার পিছনেই ছুটল। একটাবার হয়তো কখনো ভাবেনি ছেলে-মেয়ে দুটো কি চায়। স্কুল,কলেজ এমনকি সাবজেক্ট পযর্ন্ত নিজেরা বাছাই করে দিয়েছে। একবারও এটা ভাবেনি তাদের চাপিয়ে দেওয়া সাবজেক্টে মেয়েটা কতটুকু পারদর্শী। উল্টো যদি নিজে থেকে কিছু বলতে যেতো তখন শুনিয়ে দিতো সেই চিরপরিচিত কথা, “বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায়না। আমরা যা করি তোমাদের ভালো ভেবেই করি।” দৃষ্টি বুঝেনা এই চাপিয়ে দেওয়া জিনিস গুলোতে তারা সন্তানের ভালো কোথায় খোঁজে পায়! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। কারণ জানে সে মুখে একটা কথা উচ্চারণ করলে সেটা নিয়ে পরবর্তীতে বাবা-মায়ের মাঝে তর্কবিতর্ক এক পর্যায়ে ঝগড়ায় রূপ নিবে। তার থেকে ভালো চুপ থাকা।

****

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন আজ। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে নির্বাচনী আমেজ। প্রতিটা কেন্দ্র থেকে শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় আইন শৃংখলা বাহিনী টহল দিচ্ছে। সকলের একটাই আশা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হোক ভোটদান। সুষ্ঠ একটা নির্বাচন হোক। রক্তিম সহ তার দলের সকল ছেলেরা প্রতিটা কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখছে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কি না। তবে এখন পযর্ন্ত সব ঠিকঠাক। নিয়মতান্ত্রিক ভোটদান চলছে প্রতিটা কেন্দ্রে। লিয়াকত বিল্লার লোকজন এখন পযর্ন্ত কোনো ব্যঘাত ঘটায়নি। বিষয়টা রক্তিমের কাছে ঠিক লাগছেনা। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। ২ নং ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই ভাবছিল রক্তিম। ঠিক তখনই মেহেদী এসে উপস্থিত হয়। রাস্তার এক পাশে বাইক রেখে চিন্তিত মুখে অগ্রসর হয় রক্তিমের দিকে। মেহেদীর চিহ্নিত মুখ দেখে রক্তিম নিজেও একটু চিন্তিত হয়। জানতে চায়,

“ঐদিকে সব ঠিকঠাক? না কি কোনো ভেজাল করেছে?”

“আপাতত সব শান্ত। কিন্তু চিন্তার বিষয় তো এটাই। তোর কি মনে হয় লিয়াকত বিল্লা এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ! যে একটা হাঁচি দিতে গেলেও নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে সে কি না নির্বাচনের দিন গুহাই বসে আছে! আর ঐ শু’য়’র মাসুম বিল্লাও ভ্যানিস।”

এতোক্ষন নিরবে যা নিয়ে ভাবছিল সেই একই চিন্তা মেহেদীর মাথায়। ডান হাতে ঘন দাড়িতে আবৃত গাল চুলকে রক্তিম বলে,

“ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতি শান্তই থাকে। সবাইকে সচেতন থাকতে বল। শা’লা কা পু রু ষে র জাত কা পু রু ষ। এদের কাজই হলো পিছন থেকে ছুরি মা রা।”

রক্তিমের কথায় সম্মতি জানায় মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“হয়তো ভেবেছে প্রথমে শান্ত থেকে আমাদের বুঝাবে কোনো ঝামেলা করবেনা। এটা নিশ্চিত হয়ে যখন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব তখনই হামলে পরবে। শা লা র এতো বুদ্ধি থাকে কোথায়?”

এই প্রেক্ষিতে আর কিছুই বলেনা রক্তিম। ভাবুক হয়ে জানতে চায়,

“ধামসোনা ইউনিয়নের দিকে কারা কারা আছে? ঐদিকে কিন্তু ভোটার বেশি। সব ঠিকঠাক আগাচ্ছে কি না খোঁজ নে।”

***
বিকেল চারটা পযর্ন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের পর এখন একে একে সকল কেন্দ্রে ভোট গণনা চলছে। আস্তে আস্তে একেক কেন্দ্র থেকে ফলাফল প্রকাশ পাচ্ছে। এক কেন্দ্রে একজন জয়ী হলে অপর কেন্দ্রে হচ্ছে অন্যজন। সঠিক খবর এভাবে জানা সম্ভব না। যতক্ষণ পযর্ন্ত মোট ভোট গণনা শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পযর্ন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তুমুল উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তার সাথে পার হচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। নির্বাচন অফিসের সামনে খোলা জায়গায়, স্কুল মাঠে, কলেজ মাঠে প্রতিটা খোলা জায়গায় ভীর জমিয়েছে সকল দলের লোকজন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা সময় প্রকাশিত হয় ফলাফল। পাঁচ লক্ষ পয়তাল্লিশ হাজার সাতশত শুরুটি ভোটের মধ্যে তিন লক্ষ একুশ হাজার ছয়শত তিরাশি ভোট পেয়ে জয় লাভ করেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজীজ শিকদার। অন্যদিকে ক্ষণকালীন সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত বিল্লা পেয়েছে এক লক্ষ বাইশ হাজার নয়শত নিরানব্বই ভোট। বাকি ভোট গুলো পেয়েছে অপজিট তিন দলের প্রার্থীরা।

ফলাফল ঘোষণার পরপরই উল্লাসে মেতে ওঠে আজীজ শিকদারের দলের লোকজন। রাকিব, শান্ত, জাবির সহ দুই-একজন মিলে আজীজ শিকদারকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। ছেলেদের এমন পাগলামিতে মুচকি হাসে আজীজ শিকদার। চোখে-মুখে প্রাপ্তির উচ্ছাস নিয়ে তাকায় দূরে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। পাষাণ হতে হতে ছেলেটা এতোটাই পাষাণ হয়ে গেছে যে এতো বড় একটা জয়ের পরও কেমন শান্ত স্থির নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে সকলের অলক্ষ্যে। আজীজ শিকদারের দৃষ্টি লক্ষ্য করে মেহেদী তাকায় সেদিকে। এগিয়ে গিয়ে মুখে হাসি নিয়ে কাঁধ চাপড়ে বলে,

“কি রে বেটা! জিতে গেলি তো। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মিষ্টির অর্ডার দে তাড়াতাড়ি।”

“হার-জিতের কিছুই তো এখনো হয়নি। খেলা সবে শুরু। ভুলে গেছিস ঠিক কোন উদ্দেশ্যে মেয়র সাহেবকে এমপি বানালাম? তাছাড়া আমার কাছে কিছুই ঠিক লাগছেনা। দেখিস নি ফলাফল জানার পরও কেমন শান্ত ভঙ্গিতে জায়গা ছাড়ল লিয়াকত বিল্লা। নিশ্চিত কোনো না কোনো নিরব ফাঁদ পেতে রেখেছে।”

“কিন্তু কি সেটা?”

মুখ থেকে হাসি সড়িয়ে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে মেহেদী। তার এমন বোকার মতো প্রশ্নে কপাল কুঁচকায় রক্তিম,

“সেটা জানতে পারলে কি এখনো এভাবে বসে থাকি? তুই যেখানে আমিও সেখানে। তবে জানব কিভাবে ঐ শা লা কোন ফাঁদ পেতেছে? না কি আমি তার মেয়ের জামাই যে আমাকে সব বলে দিবে!”

ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। মাথা ঝাকিয়ে বলে,

“দেখ ভাই!শুধু শুধু ঐ দৃষ্টি নামের বাচ্চা মেয়েটার মন ভেঙ্গে লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ের দিকে নজর দিস না। পরে দেখা যাবে বাচ্চা মেয়েটার অ ভি শা পে বাসর রাতেই লিয়াকত বিল্লার ডা ই নি মেয়ে তোর রক্ত চু ষে খাবে।”

হুট করে দৃষ্টির প্রসঙ্গ আসতেই বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে মনে মনে এও ভাবে আজ কিছুদিন যাবৎ মেয়েটা একদম বিরক্ত করছেনা তাকে। এমনকি চোখের সামনেও আসছেনা। আধ পাগল মেয়েটার আবার কোনো বিপদ হলো না তো! রক্তিমকে নিশ্চুপ দেখে মিটিমিটি হাসে মেহেদী। টিটকারি মেরে বলে,

“কি রে! বাসরের কথা শুনে আবার কল্পনা করা শুরু করে দিয়েছিস না কি? তা সেই কল্পনার বাসরে তোর সাথে বউ সাজে কে? দৃষ্টি!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here