দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ২ #আদওয়া_ইবশার

0
345

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২
#আদওয়া_ইবশার

ফুরফুরে এক সকাল। মৃদুমন্দ বাতাসের তোড়জোড়ে রোদের তেজ একদম নেই। তূর্ণার স্বামী সাইফুল তার দুই শালীকা দৃষ্টি, তুসীকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। তিনজনই বিভিন্ন কথার তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার কিণার ঘেষে। কিছুদূর যেতেই দৃষ্টির চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া থমকে যায় এক জায়গায়। তাদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরেই রক্তিম শিকদার তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ধূসর রাঙা ঠোঁট দুটোর ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে ধোয়া উড়িয়ে বিষাক্ত করছে নির্মল বাতাসটুকু। এই দৃষ্টিকটু দৃশ্যটুকুও মুগ্ধতা নিয়ে দেখে যাচ্ছে দৃষ্টি। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে যত সুন্দর দৃশ্য আছে তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো রক্তিম শিকদারের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য। কত সুন্দর দক্ষতার সাথে সিগারেটে এক একটা টান দিচ্ছে! ধোয়া গুলোও কি সুন্দর নিপুণ শিল্পের মতো কুন্ডুলি পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে! কারো সিগারেট খাওয়ার স্টাইল বুঝি এতো সুন্দর হতে পারে? জানা নেই দৃষ্টির। সে শুধু জানে, সবার কাছে গুন্ডা হিসেবে পরিচিত এই রক্তিম শিকদারের প্রতিটা জঘণ্য থেকেও জঘণ্যতম কাজ গুলো তার কাছে নিপুণতার সাথে ধরা দিচ্ছে।

দৃষ্টিকে হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কিছুটা অবাক হয় সাইফুল, তুসী দুজনেই। জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে সাইফুল জানতে চায়,

“কি ব্যাপার শালিকা! দাঁড়িয়ে গেলে যে!”

ধ্যান ভাঙ্গে দৃষ্টির। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও এক পলক রক্তিমের দিকে তাকায়।দৃষ্টির তাকানো অনুসরণ করে তুসী সেদিকে তাকাতেই দেখতে পায় দলবল সহ রক্তিম শিকদারকে। যা বোঝার বুঝে যায়। বিরবির করে বলে ওঠে,

“কাম সাড়ছে! সিন্নিও বাড়া মোল্লাও খাড়া।”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির ঝিলিক নিয়ে দৃষ্টি রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে সাইফুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“একটা গান শুনবেন ভাইয়া?”

সাথে সাথেই নারাজ কন্ঠে বলে ওঠে তুসী,

“তোর কর্কশ কন্ঠের গান শুনে এখন কান পঁচানোর কোনো শখ নাই। দ্রুত হাটা দে। বাসায় যাব।”

ফুসে ওঠে দৃষ্টি। নাক-মুখ কুঁচকে বলে,

“তোর কথা শুনতে যাব কেন আমি? তোকে জিজ্ঞেস করেছি? ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছি। ভাইয়া যা বলবে তাই শুনব আমি। তুই একদম চুপ থাক।”

পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে বুঝতে পারে সাইফুল। তার একমাত্র খালা শাশুড়ির একমাত্র মেয়েটা যে একটু পাগলাটে আর খ্যাপাটে স্বভাবের এটাও জানে। এই রাস্তায় দুজনের মাঝে কোনো ঝামেলা যাতে না হয় এজন্য পরিস্থিতি সামাল দিতে সায় জানায় দৃষ্টির কথায়,

“তুমি গান জানো এটা আগে বলবেনা! দ্রুত একটা গান গেয়ে ফেলো তো। এই সুন্দর ওয়েদারে একটা গান হলে মন্দ হয় না।”

সম্মতি পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে দু-পা এগিয়ে আসে দৃষ্টি। তুসীর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে আবারও দৃষ্টি ফেলে রক্তিমের দিকে। ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসির রেখা ধরে রেখেই গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে,

প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চাই
তোমাকে, ও তোমাকে
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দু’টি নয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও তোমাকে

নিরব পরিবেশ চাপিয়ে হঠাৎ বেসুরা মেয়ে কন্ঠের গান শুনে দলের ছেলেগুলো সব মাথা তুলে তাকায় রাস্তার অপর পাশে। দেখতে পায় এক সপ্তদশী কন্যা তার চিকন গোলাপী ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে সুর ছাড়াই গানের চরণ গুলো আওড়াচ্ছে। বিরক্ত হয় সকলেই। রক্তিমের একদম কাছ ঘেষে দাড়ানো সিয়াম বিরক্তি ভঙ্গিতেই বলে,

“এ ভাই! এই টয়লেট সিঙ্গার কই থেকে আমদানি হলো? কাকের কন্ঠে কোকিলের কুহু কুহু গান গেয়ে পরিবেশ নষ্ট করার জন্য রাস্তায় নেমেছে।”

পাশ থেকে রাকিব হালকা রাগের সাথে বলে ওঠে,

“তুই শুধু কাকের কন্ঠই শুনলি! বড় ভাইদের সামনে কেমন বেয়াদবের মতো গান গায়ছে এইটা দেখছিস না? আমাদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু সয়ং রক্তিম শিকদার উপস্থিত যেখানে, সেখানে এই মেয়ে এমন আবালের মতো গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সাহস পায় কিভাবে? ভাবতে পারছিস দেড় ইঞ্চি মেয়ের কলিজা কত বড়?”

হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে উচ্ছিষ্ট অংশ টুকু পায়ের কাছে ফেলে পিষে দেয় রক্তিম। কাজটা সম্পূর্ণ করে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া উড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এসব ফালতু বিষয়ে মাথা ঘামানোর জন্য রেখেছি তোদের? এই মেয়ের কলিজা কত বড় আমার সেটা দেখার থেকেও জরুরী মাসুম বিল্লার কলিজা কত বড় সেটা দেখা। যে কাজ দিয়েছি মন দিয়ে সেটা কর।”

মুহূর্তেই তৎপর হয়ে ওঠে দলের সকলেই। মেহেদী রাগত স্বরে দাপটের সাথে বলে ওঠে,

“নিশ্চিন্তে থাকেন ভাই। পাতালের নিচ থেকে হলেও খোঁজে এনে ঐ শা’লা’রে আপনার পায়ের কাছে হাজির করব। সাহস আসলেই বেড়ে গেছে মা***।”

চোয়ালদ্বয় শক্ত রক্তিমের। পিচঢালা রাস্তায় দৃষ্টি স্থির রেখে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“দুদিন হলো বাপ ক্ষমতায় এসেছে। এখনই এলাকায় রাজ করা শুরু করে দিয়েছে!দুপুরের আগে আমার সামনে এনে হাজির করবি ঐ জা’নো’য়া’র’কে। যে হাত দিয়ে চাদাবাজি করে বেড়ায়, মেয়েদের ওড়না নিয়ে টানাটানি করে। সেই হাত চিরতরে পঙ্গু না করা পযর্ন্ত আমার শান্তি হবেনা।”

****

বিকেলের শেষ প্রহরে ড্রয়িং রুমে লুডু খেলার আয়োজন করেছে তূর্ণা। দুই দলে খেলা হবে। এক দলে তূর্ণা আর তার হাসবেন্ড সাইফুল। আরেক দলে দৃষ্টি, তুসী। কিন্তু বেঁকে বসে তুসী। সে কিছুতেই দৃষ্টির সাথে দল মিলিয়ে খেলবেনা। সকালের সেই ঘটনার জেড় ধরে সারাদিন দৃষ্টির থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে তুসী। মনে মনে পণ করেছে যে পযর্ন্ত এই মেয়ের মাথা থেকে রক্তিম নামক ভূত না নামবে সে পযর্ন্ত কোনো কথা বলবেনা তার সাথে। অনেকবার চেষ্টা করেছে দৃষ্টি তুসীর রাগ ভাঙানোর। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় তুসী। হেরে গিয়ে একসময় বেঁকে বসে দৃষ্টি নিজেও। সেও আর আগ বাড়িয়ে তুসীর সাথে কথা বলতে যায় নি। দুজনের এই মনোমালিন্য চলাকালিন একসাথে জোড়া বেঁধে খেলার কোনো প্রশ্নই আসেনা। দুটোকে মানাতে গিয়ে হাঁপিয়ে যায় তূর্ণা নিজেই। এক পর্যায় হতাশ ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“তোরা দুটো কি আজীবন এমন সতীনের মতো ঝগড়ায় করে যাবি? কখনো কি একটুও মিল-মিশাদ হবেনা তোদের মাঝে? বড় হচ্ছিস না দিন দিন ছোট হচ্ছিস দুটো!”

বোনের এতো গুলো কথা শুনে গাল ফুলায় তুসী। আড় নজরে তাকিয়ে ভার কন্ঠে বলে ওঠে,

“আমরা না হয় অবুঝ। কিন্তু তুমি তো খুব বুঝদার! তাহলে তুমি এমন করছো কেন? তোমাদের দুজনের দল ভেঙ্গে ভাইয়া আর তোমার সাথে আমাদের ভাগ করে নিলেই তো হয়। একটু তো খেলবোই। তোমার জামাইকে তো আর একেবারে তোমার থেকে নিয়ে যাচ্ছিনা।”

এমন কথায় কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে সাইফুল। স্বামীর দিকে চোখ গরম করে তাকায় তূর্ণা। বোনের রাগটা ঝেড়ে দেয় স্বামীর উপর। বাঁজখায় কন্ঠে খ্যাঁকিয়ে ওঠে,

“এমন বিটলারি হাসি হাসবেনা আর কত বলতে হবে তোমাকে? তোমার এই কুৎসিত হাসির থেকে শয়তানের হাসিও বেশি সুন্দর।”

সাথে সাথে চুপসে যায় সাইফুল। মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকে এক কোণায়। বউয়ের প্রতি অভিমান জন্মায় অল্প পরিমাণে। দুই শালীর এভাবে না বললেও হতো। বউ নামক দিল্লীকা লাড্ডু দেড় বছরেই তার জীবনটা একেবারে তুলাধুনা করে ফেলেছে। কেন যে মানুষ সুখ ধ্বংস করে দুঃখের সাগরে ডোবার জন্য বিয়ে করতে লাফায়! তার যদি সাধ্যি থাকত তবে বিয়ের পরপরই বউয়ের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ব্যাচেলার লাইফে ফিরে যেতো। সেই সাথে বাংলাদেশের সংবিধানে নতুন এক আইন প্রণয়ণ করতো। সকল বাঙ্গালী অবিবাহিত ছেলেদের সন্নাসী হয়ে জীবন কাটানোর আইন। কিন্তু বেচারা বউয়ের ঝাঝালো কথার ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা মিষ্টি কথার জালে ফেঁসে গেছে। বউকে ভালোবেসে এতোটাই মাথায় তুলে ফেলেছে এখন না পারে এসব অত্যাচার সহ্য করতে। আর না পারে কিছু বলতে।

খেলতে গিয়ে এমন ছোটখাট ঝামেলার মাঝ দিয়েই কেটে যায় সময়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। চারিদিকের মসজিদ থেকে একে একে ভেসে আসে আজানের মিষ্টি সুর। সন্ধ্যার পর খেলা বাদ দিয়ে ঠিক করা হয় কমেডি মুভি দেখবে। মুভি প্রায় শেষের দিকে। ঠিক তখনই বাসায় আসে তূর্ণার বাবা নিয়াজ উদ্দিন। শশুর আসার আভাস পেয়ে তৎক্ষণাৎ সাইফুল টিভি বন্ধ করে ভদ্র জামাইয়ের মতো বসে থাকে চুপচাপ।শিউলী বেগম স্বামীর নিকট এগিয়ে এসে জানতে চায়,

“আজ আসতে এতো দেরী হলো যে! রাস্তায় জ্যাম ছিল না কি?”

“আর বলো না! মেয়রের ছেলেটা দিন দিন যা অশান্তির সৃষ্টি করছে। রাস্তা-ঘাটে বেড়োনোও এখন রিস্ক হয়ে পরছে। দুপুরে না কি এমপির ছেলে মাসুম বিল্লাকে মারতে মারতে আধমরা বানিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এমপির ছেলেকে মেরে সে পাড় পেয়ে যাবে না কি? লেগেছে এখন দুই দলে হাঙ্গামা। যে হাড়ে ছুরি, লাঠি নিয়ে ছেলেপেরা রাস্তায় নেমেছে। আজ একটা রক্তারক্তি কান্ড ঘটবেই দেখে নিয়ো।”

কথাটা শোনা মাত্রই দৃষ্টির বুকের ভিতর অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এক দিনের চোখের দেখা যুবকের প্রেমে পরে মন দিশেহারা হয় তার চিন্তায়। চোখাচোখি হয় তুসীর সাথে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েই জানিয়ে দেয় তুসী,

“বলেছিলাম এই ছেলে ডেন্জারাস। আগুনের দিকে নজর দিস না। এখন বুঝেছিস তো কতটা ভয়াবহ! এসব শুনেও ঐ গুন্ডা ছেলের প্রতি আগ্রহ থাকবে তোর?”

নজর সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে তার। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা একদিনের পরিচয়ে একটা মানুষের বিপদের অশঙ্কায় তার মন এতোটা উতলা কেন হচ্ছে। তবে কি ভালো লাগাটা অচিরেই ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল!

চলবে……

( এই নিয়ে পর্বটা তিনবার লিখেছি। প্রথম একবার ১৭০০ শব্দ লেখার পর এক চাপেই ডিলেট হয়ে গেছে। এরপর সন্ধ্যায় লিখতে বসেছি। তখন ফোন অফ হয়ে আবার কত শব্দ ডিলেট হয়েছে নিজেও জানিনা। দুইবার এমন হওয়াই একদম লেখার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবুও কোনোমতে ১২০০ শব্দ লিখে দিলাম আপনাদের কথা ভেবে। জানি একদম অগোছালো হয়েছে। বানানেও অনেক ভুল থাকতে পারে। রিচেইক দেইনি। একটু মানিয়ে নিবেন আজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here