ছায়া মানব ২
২৯.
আজ তিনদিন কেটে গেছে। মাহতিম এলো না এখনো। অহনা যেন হাঁফিয়ে ওঠেছে। এই দূরত্ব মেনে নিতে পারছে না। তিনদিনে একবারও অহনার সাথে যোগাযোগ করেনি মাহতিম। মনে মনে অভিমান জড়ো হয়েছে খুব। রাগে না হয় ক’টা কথা শুনিয়েছিল। তাই বলে চলে যেতে হবে? গেলেও একটাবার কলতো করতে পারত। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,’ছেলেগুলো কখনোই মেয়েদের বুঝে না। বুঝলে প্রেমের এই অধঃপতন কখনোই হতো না। সব ক’টা অকর্মা প্রেমিককে জেলে নেওয়া দরকার। যদি কিছুটাও সুবুদ্ধি হয়।’ পরপরই অহনা শক্ত হয়ে যায়। নিজেকেই নিজে বোঝায়,’ভুল মানুষের জন্য এত অনুভূতি আমার। সে এসবের যোগ্যই না। অযথা তাকে ভাবা উচিত নয় আমার।’
মুহুর্তেই খেয়াল করল এসব ভাবতে গিয়ে চোখ চিকচিক করছে। মোহনা আসতেই নিজেকে সামলে নিল। একবার জিজ্ঞেস করেই বসলো,‘মাহতিম কল করেছিল?’
মোহনা বসে ধীরে সুস্থে বলল,‘একটু আগেই আম্মার সাথে কথা বলছিল দেখলাম। আমার সাথে কথা হয়নি। কাল রাতে চ্যাটিং হয়েছিল। আমাকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর কথা হয়নি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
মোহনা অহনার দিকে তাকিয়ে তার বিষন্নতা টের পেল,
‘এভাবে দুজন একে অপরের কষ্ট না দিয়ে কথা বললেই তো পারো। সব মিটমাট করে নিতে পারো। দিনদিন দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। যে সম্পর্কের বেড়াজালে এত সমস্যা, সেটাকে হারিয়ে যেতে দিচ্ছ কেন?’
‘আমি জীবনেও কল করব না। ওর উচিত ছিল আমাকে কল করা। এটা ঠিক, কল করলেই আমি ব্লক করতাম তাকে। কিন্তু বিকল্প পদ্ধতিও আছে অনেক। ও চাইলেই অন্যকিছু বুঝিয়ে দিতে পারত আমায়।’
‘ভাইয়া মিথ্যে বলতে পারেনা। হয়ত কিছু একটা বুঝতে ভুল করেছ। ভাইয়া হয়ত তোমার বোঝার মতো সংজ্ঞায় বোঝাতে পারেনি।’
‘যাই হোক। আমি আর এসব নিয়ে ভাবছি না। আমার চাই না ওকে।’
‘তেমন কিছু না, রাত গভীর হলেই কাঁদবে বসে বসে। চোখের জলে বালিশ ভেজাতে রাজী আছ অথচ সবটা ঠিক করে নিতে রাজি নেই। মিস করছ ঠিকই অথচ দুজনেই নিজেদের জেদের কাছে অনড়।’
হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। আনিফা ক্লিনিকে গেছে। তাই মোহনাই বের হয়। মোহনা বের হতেই দেখল নিহা আর বর্ষণ বের হয়েছে। তাদের পরিপাটি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোথাও রওনা দিয়েছে। মোহনা জিজ্ঞেস করার আগেই নিহা বলল,‘আমরা একটু শপিংয়ে যাচ্ছি।’
মোহনা মৃদু হাসল। দরজা খুলে দিতেই পরিচিত মুখশ্রী ভেসে ওঠল। কিছুটা দূরে সরে গেল। নিহা এবং বর্ষণ বেরিয়ে গেল।
মামুন চৌধুরীর পার্টনার ইসহাক মির্জার বড় ছেলে ইমন মির্জা এসেছে। মাঝে মাঝেই তার আনাগোনা হয়। ইসহাক দরকার প্রয়োজনে আসেন। সাথে অনেকবার এসেছে ইমন। আজ কিছু দরকারি কাগজ দিতেই সে মামুনের কাছে এসেছে। কিছুটা ইতস্তত করেই জিজ্ঞেস করল,‘স্যার ঘরে আছেন?’
‘নেই! আপনি ভেতরে আসুন।’
ইমন ভেতরে আসতে চাইল না। দ্রুত কাগজগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,‘আপনার বাবাকে দিয়ে দেবেন। আমার বাবা অর্থাৎ ইসহাক মির্জা পাঠিয়েছেন।’
‘আমি বুঝতে পেরেছি।’
‘আমি তবে আসি?’
‘সিউর!’
মোহনা কিছুটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ছেলেটাকে তার কেমন হ্যাংলা মনে হয়। দেখতে শুনতে মন্দ না, ফর্সা গায়ের রং, চুলগুলো সবসময় গোছানো, হালকা ছাপ দাঁড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। সহজ-সরল, বাধ্য ছেলে মনে হয়। কারণ যতবারই চৌধুরী বাড়িতে এসেছে ততবারই দেখেছে সে বাবার কথাতেই হ্যাঁ অথবা না মেলাতে ব্যস্ত। নিজের থেকে একটা শব্দ যে বলবে তাও তার জানা নেই যেন। বারবার নাকের ওপরে চশমা ঠেলে দেওয়ার কাজটাই করে। আর কোনোদিকে তার নজর থাকে না। মোহনা কাগজগুলো খুলে দেখল। পরপরই আবার ভাঁজ করে মামুনের বিছানার পাশে রেখে এলো।
মাহতিম বসে আছে নিরালায়। অফিসের পেছনেই একটা ছোটোখাটো পুকুর রয়েছে। অনবরত ঢিল ছুঁড়ে মারছে পানিতে। হঠাৎ করেই আশিশ এসে তার পাশে বসলো। মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের মতোই পানির দিকে মনোযোগ দিল। আশিশ আগ বাড়িয়ে বলল,‘মনের মধ্যে অন্ধকার নেমেছে মনে হচ্ছে।’
মাহতিম কোনো উত্তর দিল না। আশিশ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল,‘এই নে, এটা খেলে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’
মাহতিম আশিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল,
‘এখানে ধুমপান করা নিষেধ। আর আমি ধুমপান করিনা।’
‘এটাকে ধুমপান বলে না। এটাকে বলে ভালো থাকার মূলমন্ত্র।’
‘কিছু সময়ের জন্য মূলমন্ত্র হলেও সারা জীবন ধ্বংস করতে যথেষ্ট। তোর মরার সখ হয়েছে তুই খা। আমাকে বিরক্ত করিস না।’
আশিশ বলল,‘ওকে! তবে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিতে পারি।’
‘কিসের জন্য?’
‘ভালো থাকার জন্য। পাশেই একটা …’
‘কথা বলতে ভালো লাগছে না।’
মাহতিম উঠে যায়। পকেট থেকে ফোনটা বের করেই অন করল। অহনার আইডিতে গিয়ে তার কিছু ছবি দেখল। আচমকাই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিছু একটা চিন্তাও করে নিল ঝটপট। পরপরই মেসেজ টাইপ করে। কিন্তু সাহসের ঘাটতির কারণে সেন্ড করতে পারেনি। আজ তিনদিন ধরেই টাইপ করছে, কিন্তু একবারও পাঠায়নি। কোনো বাধা যেন জাপটে ধরে আছে। কিছুতেই পারছে না নিজ তাগিদে কথা বলতে।
সিলেটের নাম দিয়ে এসেছে কিন্তু তিনদিন ধরেই আশিশের সাথে তার বাড়িতেই আছে। তবে ট্রেইনিং-এর জন্য সিলেট যাওয়ার কথা ছিল, পরবর্তীতে সেটা বাতিল করা হয়েছে। অথচ মাহতিম আর বাড়ি যায়নি। অহনার প্রতি অভিমান জমা হয়েছে অনেকটা। তবে আজ ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। বাড়ির সবাইকে খুব মনে পড়ছে।
আশিশ পুনরায় আসলো। নিজ দায়িত্বে কথা বলাই যেন তার কাজ। বলল,‘মেয়ে মানুষকে কন্ট্রোলে রাখা একটু টাপ। তবে আমি সাহায্য করতে পারি।’
‘কিন্তু কীভাবে?’
‘তুই বাড়ি না গিয়ে…!’
কথাটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই মিটিংয়ের জন্য কল করল অনুজ। দুজনেই দ্রুত চলে গেল।
জয়ন্ত কুমার যেকোনো কাজই মাহতিমের ওপর দিয়ে কিছুটা শান্তি পান। তাই অধিক কাজের ভারই থাকে মাহতিমের ওপর। এতে সবাই ক্ষেপে থাকে। কারণ তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদেরকে অবহেলা করা হচ্ছে। কিন্তু জয়ন্তের মতে যোগ্যতম ব্যক্তিকেই কাজ দেওয়া উচিত। যেন কোনো ভুল না হয়। এক্ষেত্রে মাহতিমের আন্ডারেই কাজ করতে হয় সবাইকে। আশিশ মাহতিমের দিকনির্দেশনা মানতে নারাজ। তবে মুখেও প্রকাশ করেনা। অফিস থেকে বের হতেই মাহতিম বলল,‘চলে যাচ্ছিস নাকি? এখনই যাওয়া উচিত।’
আশিশ কিছুটা হাসার চেষ্টা করল বহু কষ্টে,
“তুই গেলে মনে হয় না আর কাউকে যেতে হবে। আমি রেষ্ট নিলেই বরং ভালো হয়। বাড়ি গেলাম আমি। তুই পরে আসিস!”
‘এটা কেমন কথা হলো? স্যার আমাদের ছয়জনকেই বলেছে। এছাড়া, তোকে ছাড়া আমি সমস্তটা সামাল দিতে হিমশিম খাব।’
“বিরক্ত করিস না।”
‘স্যারকে কী বলব?’
‘কিছু বলার দরকার নেই।’
আশিশ আর কথা বাড়ালো না। সে সোজা চলে গেল নিজের এপার্টমেন্টে। গিয়েই হয়ত ড্রাঙ্ক হয়ে পড়ে থাকবে অনেক সময়। রাত হলেই শুরু হবে বদমতলব।
_
রাত একটার কাছাকাছি। অথচ অহনার চোখে ঘুম নেই। সে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। অজানা এক কষ্ট ভর করেছে মনে। বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। তার ঘরের সাথে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। বারান্দা থাকার কারণেই মাহতিম মাঝে মাঝেই এই ঘরটায় সময় কাটাতো। নিরিবিলিতে কাজ করতেই সে আনন্দ পায়, কেউ বিরক্ত করার থাকে না।
অহনা বারান্দায় যেতেই আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। আজ ঘন অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ নেই। সবকিছু অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আচমকা তার পেছনে কেউ আছে বলে মনে হলো। অহনা পেছনে তাকাতেই কিছুই দেখতে পেল না। বরং বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে যখনই ঘরের দিকে যাবে, হঠাৎ করেই কেউ তার সমানে এসে দাঁড়ায়। মুখোশধারী লোকটাকে কোনোমতেই পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। চিৎকার করার আগেই তার মুখ চেপে ধরে। অহনা ছটফট করতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকটার সাথে আরো একজন এসে যোগ দিল তাকে সাহায্য করার জন্য। দুজন মিলে অহনাকে বাইরে নিয়ে এলো। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে টের পেল না অহনা। সে অচেতন।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership