ছায়া মানব ২
৩০. (বর্ধিতাংশ) উন্মুক্তরাই পড়বে শুধু-
অহনার চোখজোড়া অসহিষ্ণু, উদ্বিগ্ন, আবেগে আপ্লুত সে। চোখের কোণে পানি জমা হয়েছে। উত্তাল সমুদ্রের মতো তার ম্লান বুকটাও কেমন ফেঁপে উঠল। নিজেকে সামলাতে পারল না। মাহতিমের চোখে চোখ নিবদ্ধ করে বলল,‘হ্যাঁ! আমি তোমাকে ঠাঁই দেব। তুমি একান্তই আমার। কখনোই হারাতে দেব না। এ জীবনের পূর্ণতা তুমি, সঙ্গ তুমি, মান, অভিমান, বিশ্বাস সব তুমি। শুধু তুমি, শুধু তুমি। চারদিকেই তুমি। আমার আত্মার সবটা জুড়ে তুমি। আমি সত্যিই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
অহনা আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। মাহতিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুটি বুকের কম্পন এক হয়ে গেল। মিশে গেল যেন পলকেই। কাঁদল অহনা। হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে। এত সুখ সে আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। একজন পুরুষের বুকে অনুভব করল অতুলনীয় সেই সুখ। এই সুখ ভালোবাসার, আবেগের। মাহতিম মৃদু হাসল। পরম যত্নে অহনাকে নিজের সাথে চেপে ধরল। যদি হৃদয়ের গোপন কোনো দরজা থাকত, তাহলে সেটা ভেঙেচুরে অহনাকে ঢুকিয়ে ফেলত আজীবনের জন্য। কিন্তু নেই। আফসোস হলো মাহতিমের।
অহনার চুলগুলো সে ছেড়ে দেয়। চুলের ফাঁক গলিয়ে ঘাড় উন্মুক্ত করে। মুহুর্তেই বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। অহনার চাঞ্চল্যতা টের পেল সে। লজ্জা পাচ্ছে সে সেটাও আন্দাজ করল। মাহতিম বলল,‘ভালোবাসা কি আজকেই চাও নাকি অপেক্ষা করবে?’
অহনার মুখ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। মাহতিমের বুকেই পরম আবেশে রয়েছে। তবুও লুকানোর রাস্তা খুঁজছে। ইচ্ছে করছে মাহতিমের হৃদয় খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে। আরো কিছুটা শক্ত করে ধরল। মাহতিম পুনরায় বলল,‘আমি আবার লজ্জা পাই না তোমার মতো। সম্মতি পেলে অনেক কিছু করে ফেলতে পারি।’
অহনা তবুও কোনো উত্তর করল না। এতো লজ্জায় ফেলে দিল মাহতিম, সে বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। মাহতিম আবারো বলল,‘যে আগুনে পুড়িয়ে মারছ প্রতিনিয়ত, সে আগুন নিভাই কী করে? উন্মাদ লাগছে নিজেকে। ইচ্ছে করছে সমস্ত সাক্ষ্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে তোমাকে একান্তই নিজের করে নিই।’
চট করেই অহনা বলল,‘এখন কি আমি তোমার থেকে দূরে? আর কতোটা একান্ত চাও?’
‘যতটা পেলে তোমার আর আমার মধ্যে বাধা নামক শব্দটা থাকবে না। বেপরোয়া হয়ে পড়ছি যার জন্য। তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারো না?’
অহনার ঠোঁট টিপে হাসল। হঠাৎ করেই কেমন শীত অনুভব করছে। বলল,‘পারলে তোমার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নাও আমাকে। আমি শীতের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’
মাহতিম চট করেই অহনাকে কোলে তুলে নিল। নরম বিছানায় শুইয়ে দিল। লেপ টেনে দিয়ে ওর ওপর অর্ধেক ঝুঁকে বলল,‘এবার শীত করছে?’
‘চাইলাম কী আর দিলে কী?’
অহনার এহেন কথায় মাহতিম কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিছু না বুঝার ভান ধরে বলল,‘তুমি কি কম্বল চাইছ?’
অহনা দ্রুত বলল,‘তোমার স্পর্শ চাইছি।’ পরপরই চোখ সরিয়ে নিল।
মাহতিম অহনার চোখে চোখ রেখে বলল,‘স্পর্শ নাকি সঙ্গ?’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,‘কিছু চাই না। ঘুম পাচ্ছে! তুমি বেরিয়ে যাও এখন। আমি ঘুমাতে চাই। এত সুন্দর একটা ঘরে এক রাত না কাটালেই নয়। খুব ভালো ঘুম হবে।’
মাহতিম অহনার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। মেয়েটা কি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে নাকি বুঝে না। সেটাই মাহতিমের মাথায় আসলো না। নিজেকে আরও কিছুটা এগিয়ে নিল অহনার দিকে। একদম মুখোমুখি। অহনার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে দ্রুত। কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না। মাহতিম টের পেল অহনার বিব্রতচিত্ত। নিঃশ্বাসগুলোও একে অপরের মুখে বারি খাচ্ছে। অহনা যেন অশান্ত হয়ে পড়ে। মাহতিম মৃদু হাসল। অহনার নরম বুকে মাথা রাখল। মুহুর্তেই অহনা কেঁপে ওঠল। বিছানার চাদর খামচে ধরল। মাহতিম অহনার অস্বাভাবিক হৃদকম্পন টের পেল। সহসাই বলল,‘এই কম্পন কি আমার জন্য?’
অহনা চোখ বন্ধ করে নিল। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। মাহতিম অনুভব করল ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিল। চোখ দুটো অপূর্ব আভায় নিয়ে অহনাকে বলল,‘ভুল করে ফেলতে পারি।’
‘হোক না কয়েকটা ভুল। ক্ষতি কী?’
অহনার এমন কথা শুনে মাহতিম বিচলিত হয়ে পড়ল। না চাইতেও অহনাকে ঘিরে ধরল সে। একদম মুখোমুখি সংঘর্ষে যেন। ভারিক্কি ভাব স্পষ্ট অহনার। সে মাহতিমকে কাছে চাইছে আবার বার বার দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বেহায়া মন কী করবে বুঝতে পারছে না। মাহতিম অহনার কপালে জড়িয়ে থাকা চুল সরিয়ে দিল তর্জনী দিয়ে। পরপরই সাহসের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে অহনার কপালে চুম্বন করল। কেঁপে উঠলো অহনা। তার দৃষ্টিতেও কাঁপন লক্ষিত। কপালে মাহতিমের আঁকা ভালোবাসা তাকে সুখের সাগরে নিয়ে গেল। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল পুনরায়। মাহতিম দেখল, অহনার ঠোঁটজোড়া অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে। কিছুটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল। অহনা চোখ খুলতেই মাহতিম বিচলিত হাসল। দুজনেই যেন লজ্জায় মাখামাখি। মাহতিম উদাসীন হয়ে অহনার ঘাড়ে চুমু খেল। অহনা তৎক্ষণাৎ মাহতিমকে জড়িয়ে ধরল। চোখের কোণ বেয়ে কিছুটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বুকের কম্পন বেড়ে গেল। মাহতিম চুম্বন দীর্ঘ করল। প্রতিটি ছোঁয়ায় সে উপলব্ধি করল জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুখ। অহনাও মাহতিমের ছোঁয়া পেয়ে আনন্দিত। তার ভালো লাগছে ভীষণ। হঠাৎ করেই মাহতিম অহনার ঘাড় থেকে অধর সরিয়ে বলল,‘তুমি কাঁদছ?’
অহনা কিছু বলল না। তার কান্নার কারণ যে ব্যথা নয় সেটা বুঝল না মাহতিম। নিজেকে অহনার থেকে সরিয়ে নিতেই অহনার আচমকা বলল,‘সুখেরো কান্না হয়।’
মাহতিম বুঝল অহনার কথার মানে। সে দেরী করল না এই মুহূর্তে এসে সে স্বাভাবিক ধ্যাণে নেই। অহনার কোমল ঠোঁটজোড়ার দিকে চোখ যেতেই না চাইতেও সে স্পর্শ করে। অহনা বাধা দিচ্ছে না। মাহতিম দুজনের মাঝে আর কোনো দূরত্ব রাখল না। সরিয়ে দিল সব। অধরের ছোঁয়ায় অহনা থেকে থেকে কেঁপে ওঠছে। মাহতিমের সাথে নিজেও চুম্বন দীর্ঘ করল। দীর্ঘ সময় কেটে যায় এখানেই। মাহতিম ছুঁয়ে দেয় অহনার কোমল ঠোঁটজোড়া এবং ঘাড়ের সমস্ত অংশ। এক সময় মাহতিম অস্বস্তি বোধ করল। অহনার ওপর থেকে আচমকা উঠে গেল। অহনাও কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করেই বসলো,‘কী হয়েছে তোমার?’
মাহতিম কন্ঠে মলিনতা এনে বলল,‘আমরা অবিবাহিত।’
‘তাতে কী হয়েছে?’
‘এতোটা গভীর হতে পারিনা। উচিত নয়। আমরা ভুল করতে যাচ্ছিলাম। বিয়ের পর সব করতে পারি কিন্তু এখন পারিনা।’
অহনা কোনো কথা বলল না। সত্যিই বলছে মাহতিম। তাদের এতোটা কাছাকাছি আসা উচিত হয়নি। হুঁশ ছিল না তার। অথচ মাহতিম ভেবেছে। অহনার চোখ চিকচিক করে ওঠে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহতিমের মুখোমুখি এসে বলে,
‘কিন্তু এখন যা করলাম তাতে কিছু হয়ে গেলে?’
‘কিছুই হবে না। চুমু খেলে কী এমন ক্ষতি হয়? শুধু তো চুমুই খেয়েছি। আর কিছু না।’
‘ঠিক বলেছ। এখন আমাদের কী করা উচিত?’
‘ ঘুমের দেশে পাড়ি জমানো উচিত।’
অহনা সাথে সাথেই চুলগুলো কোনোরকমে ঠিক করে বলল,’চলো বাড়ি যাই!’
‘এখন না। আর একটু পর ভোর হবে, তার আগেই আমরা পৌঁছে যাব। এখনের সময়টা তোমাকে দেখে কাটাব।’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,‘আমরা অবিবাহিত! এখন দেখা উচিত হবে না। এতো গভীরভাবে দেখা উচিত নয়। বিয়ের পরে যত ইচ্ছা দেখো।’
‘এতদিন অপেক্ষা করতে পারব না।’
‘করতেই হবে।’
মাহতিম কোনো কথা না বলে অহনাকে এক টানে নিজের বুকের কাছে নিয়ে এলো। চেপে ধরে বলল,‘যতক্ষণ এখানে আছি, তোমাকে এভাবেই জড়িয়ে রাখব। বাড়িতে একদম সুযোগ পাইনা। তাই আজকে পুরো দিনের সান্নিধ্য এখন নিয়ে নিই। কী বলো?’
‘ছাড়ো আমায়।’
‘ছাড়ার প্রশ্নই আসেনা।’
মাহতিম অহনাকে নিয়ে সুইমিং পুলের কাছে গেল। পা ঝুলিয়ে দুজনেই কিনারায় বসলো। পায়ের পাতা পানিতে নিমজ্জিত। মাহতিম জাপ্টে ধরে আছে অহনাকে। পরবর্তীতে অহনা মাহতিমের কাঁধে মাথা রাখে। চোখ বন্ধ করে তারা প্রশান্তিতে শ্বাস নেয়। তাদের নতুন ভালোবাসার সূচনা করে তিতলি। সে অহনা এবং মাহতিমের মাথার ওপর ঘুরছে। ক্ষণে ক্ষণে যেন দুজনের এই প্রেমমুহুর্ত রেকর্ড করে রাখছে। হঠাৎ করেই তিতলি নাম দেওয়া প্রজাপতিটি সুইমিং পুলে পড়ে যায়। আওয়াজ হতেই অহনা হকচকিয়ে ওঠে। পানিতে প্রজাপতিকে দেখে আর্তনাদ করে ওঠে,‘তিতলি?’
অহনা সেটাকে তোলার জন্য হাত বাড়াতেই মাহতিম বলল,‘এটা কৃত্রিম! ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ত। তাই পড়ে গেল।’
অহনার যেন বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিতলিকে হারিয়ে ফেলল সে। মনে হচ্ছে সত্যিকারের কোনো বন্ধু হারিয়ে গেল। অহনার মন খারাপ দেখে মাহতিম বলল,‘মন খারাপ করো না। একদিন সত্যিকারের প্রজাপতির মেলা বসাব তোমার জন্য।’
‘লাগবে না।’
‘কেন?’
‘ধরে এনে আমার খুশির জন্য ওদের কষ্ট দেবে কেন? এর চেয়ে ভালো হয় ওরা ওদের মতো উড়াউড়ি করুক। দূর থেকে দেখেও শান্তি পাব।’
মাহতিম পরম আদুরে কন্ঠে বলল,‘একটা জিনিস আনছি দাঁড়াও।’
মাহতিম ঘরে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ফিরে এলো। অহনা পানি থেকে পা উঠিয়ে দাঁড়াল। মাহতিম আচমকা হাঁটু গেড়ে বসলো। হাতে বাহারী গোলাপের একটা তোড়া। সহসাই বলল,
‘হে আমার হৃদয়ের রাণী,
প্রণয়ের প্রজাপতি, আমার মনোহরণী,
বসন্তের শুভ্র ফুলের ভ্রমরাণী!
উতলা হৃদয়ের সুরঞ্জিত অপ্সরী!
বিরতির লগ্নে আমি তোমায় স্মরি!
অন্তিম দহনে তোমাকেই জড়ি!
মোর ব্যাকুল চিত্তের আকুল আহাজারি-
প্রণয়ের সুরে প্রতিবার ভালোবাসি!
বড্ডো বেশি ভালোবাসি!’
অহনা ফুল হাতে নিয়ে বলল,‘আমিও।’
মাহতিম উঠে দাঁড়ায়। অহনা ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলল,‘তোমার বাগানের তাই না?’
‘হুম।’
অহনা ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসল,
‘আজকের রাত কখনোই ভোলার নয়। আমি কখনোই এই রাতের কথা ভুলব না।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership