ছায়া মানব ২
৩৩.
মাহতিমের অনুপস্থিতিতে বর্ষণ বিয়ে করতে চাইল না। এমনকি সবারই একটা আপত্তি ছিল। তাই এনগেজমেন্টটা মাহতিম আসলেই হবে বলে ঠিক করে।
অহনা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন পেছন নিহা গেল। অহনা খেয়াল করেনি তাকে। যখন সে দূরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তখনই নিহা একটি চকলেট এগিয়ে দিয়ে বলল,‘মন খারাপে চকলেট খেলে ভালো লাগে।’
অহনা মৃদু হেসে বলল,‘কিন্তু, আমি চকলেট পছন্দ করিনা।’
‘ওহ।’
তাদের মধ্যে আবারো নীরবতা ভর করে। নিহা আবারো বলল,‘আজ পাঁচদিন ধরে খেয়াল করছি, তুমি মন খারাপ করে বসে থাকো। এমনটা হলেতো অসুস্থ হয়ে পড়বে। মাহতিমের জন্য তোমার এই কষ্ট তাই না?’
অহনা মাহতিমের নাম শুনতেই ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসল,
‘ওকে ছাড়া সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে। আশেপাশের সবকিছু থেকেও যেন নেই।’
‘কথা হয়েছে আজ?’
‘সকালবেলা, তাও আবার এক মিনিট। খুব বেশি ব্যস্ত থাকে।’
‘রাতে কথা বলতে পারো। তখনতো সে ফ্রি!’
‘রাতে ফ্রি হতে একটা বেজে যায়। তখন ও কথা বলতে চাইলেও আমি রেখে দিই। ওর শরীরের ক্ষতি করা ঠিক হবে না। সারাদিন কাজ করে ঠিকমতো না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।’
নিহা মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
‘নিজের অযত্ন করলে তুমি কি সুস্থ থাকবে?’
‘আমি নিজের খেয়াল নিতে পারছি। কিন্তু কাজের চাপে পড়ে মাহতিমের অবস্থা কাহিল। ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করতে পারছে না। এসব শুনলেই খুব কষ্ট হয়।’
নিহা অহনার কাঁধে হাত রাখল। তাকে নিজেকে সামলাতে বলল।
মাহতিম আজ একটু তাড়াতাড়িই ফ্রি হলো। এপার্টমেন্টে এসে শাওয়ার নিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে বসল। ভাবলো, অহনাকে কল করবে। এমন সময়েই তার এপার্টমেন্টে আসে রাইশান। মেয়েটি এই কয়দিনে মাহতিমের খুব খেয়াল রাখছে। আসার পর থেকেই তার পাশে পাশে থাকছে। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকবার নিজেও বিপদে পড়েছে তখন আবার মাহতিমই বাঁচিয়েছে। এখনও বাহানা দিয়েই ভেতরে ঢুকল। কিছু পুরাতন কাগজপত্র নিয়ে এলো, যেগুলো এখনো পেন্ডিং-এ পড়ে আছে। তারা সোফায় বসে একে একে সব দেখতে থাকে। রাইশান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিমের দিকে। চুলের পানি কিছুটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই মাহতিম বলল,‘সব ঠিক আছে। আর এগুলো আনলেন কেন? আপাতত দরকার বলেতো মনে হচ্ছে না।’
মেয়েটা মাথা চুলকে বলল,‘আসলে রওনক স্যার বলেছে এসব আপনাকে দেখাতে।’
‘ঠিক আছে। দেখে নিয়েছি।’
‘এত তাড়াতাড়ি?’
মাহতিম মুচকি হাসল। সে উঠে যেতেই রাইশান বলল,‘একটু পানি খাওয়াবেন?’
মাহতিম দ্রুত তাকে পানি এনে দিল। ধীরে সুস্থে মেয়েটি পানি পান করে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। বার কয়েক মাহতিমের দিকে তাকিয়ে বলল,‘আপনি সিউর, সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ! তবে এগুলো কাজে লাগবে না। স্যারের ইচ্ছাকে আমি সম্মান করছি, আশা করি অন্য কাজে নিচ্ছেন তিনি।’
‘আমি তাহলে আসি।’
‘আচ্ছা।’
রাইশান ছোট ছোট পা ফেলে চলতে থাকে। মাহতিম পুনরায় ঊরুতে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। অহনাকে কল দিতে যাবে ঠিক তখনই চিৎকার ভেসে এলো কানে। রাইশান পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। মাহতিম ওকে তোলার আগেই অফিসে কল করতে গেল। রাইশান সাথে সাথেই বলল,‘আমাকে সাহায্য করুন।’
মাহতিম দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল। মাহতিম সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতেই মেয়েটি তার কোলে ঢলে পড়ল। মাহতিম দ্রুত তাকে সোফায় শুইয়ে দিল। তার রক্তচলাচল পরিক্ষা করল। সবকিছু তাঁর কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। সাথে সাথেই বলল,
‘জেগে থাকলে চোখ খুলতে পারেন।’
মাহতিম উঠে দাঁড়ায়। পুনরায় বলল,
‘আপনি এখন সুস্থ। হয়ত পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। আমি কাউকে কল করছি, আপনাকে নিয়ে যেতে।’
চট করেই রাইশান বলল,‘লাগবে না। আমি নিজেই যেতে পারব।’
রাইশান ল’জ্জায় পড়ে যায়। চলে যাওয়ার জন্য এগুতেই মাহতিম বলল,‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন?’
রাইশান কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। তার মনে হলো মাহতিম তাকে পছন্দ করে। তাই বলেই ফেলল,
‘হ্যাঁ! আমি আপনাকে পছন্দ করি।’
‘কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।’
রাইশানের একটু মন খারাপ হলেও বলল,
‘তাতে সমস্যা নেই।’
‘আমি বিবাহিত। আমার বউ প্রেগন্যান্ট!’
রাইশানের চোখ ছানাবড়া। বলল,
‘একটু আগে বললেন গার্লফ্রেন্ড আছে শুধু।’
‘সে আমার গার্লফ্রেন্ড, বউ, বাচ্চার মাও। আপনার কি আর কিছু বলার আছে?’
‘আমি কি তাকে দেখতে পারি?’
‘আপনি এখন আসতে পারেন। আশা করি আর কখনো দরকার হলে অন্যকেউ আসবে।’
রাইশান বুঝতে পারল। ইনডিরেক্টলি তাকে আসতে মানা করল। আর এক মুহূর্তও দেরী করল না সে। দ্রুত চলে গেল। মাহতিম মৃদু হেসে পুনরায় গিয়ে বসল। অহনাকে কল করার সাথে সাথেই ব্যাক করল। এই পাঁচদিনে মাহতিম একটুও সুযোগ পায়নি ভালো করে কথা বলার। আজ কিছুটা সুযোগ। অনেকদিন দেখা হয়নি। তাই ভিডিও কল করল। অহনা ক্যামেরা অফ করে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর দেখে মন-প্রাণ শান্তিতে ভরে গেল। মাহতিম ডেকে বলল,‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় তুমি?’
অহনা একটু অগোছালো ছিল। চুল ঠিক করে ঠোঁটে সামান্য পরিমাণ লিপস্টিক দিয়ে নিল। ওঁড়নাও জড়িয়ে নিল গলায়। সাথে সাথেই ক্যামেরা অন করল। মাহতিমের চক্ষুদ্বয় শীতল হয়ে এলো। সে ঠিক যেভাবে অহনাকে দেখতে চেয়েছে সেভাবেই দেখল। মাহতিম বলল,
‘ঘোমটা দিলে আরো ভালো লাগবে।’
অহনা লজ্জা পেল। ঘোমটা দিতে গেলেই মাহতিম খেয়াল করল অহনা টিশার্ট গায়ে দিয়েছে। সে ভেবেছিল অহনা হয়ত কোনো গাউন পরেছে। এই মুহুর্তে তার ব্রু কুঁচকে এলো,
‘সুন্দর লাগছে না। ওঁড়না কখনোই টিশার্টের সাথে যায় না।’
‘আমিতো কিছু একটা গায়ে দিয়েছি, তুমিতো খালি গায়েই বসে আছ।’
মাহতিম এতক্ষণে খেয়াল করল সে গোসল করে এখনো নিজেকে পরিপাটি করেনি। খানিকটা লজ্জায় পরে গিয়ে বলল,
‘আমি আর তুমি এক নই। তুমি নিজের সাথে আমার তুলনা দিচ্ছ কেন?’
‘ঝগড়া করার জন্যই এতদিন পর কথা বলছ?’
‘না, মনে পড়ছিল। এই কয়দিন আমার কাছে বছরের সমান লেগেছে। বারবার মনে পড়েছে তোমাকে।’
অহনা ফ্লাইং কিস করে বলল,‘আমারো। কখন এলে?’
‘সন্ধ্যায়!’
‘তাহলে আমাকে এত দেরীতে কল করলে কেন?’
মাহতিম কিছুটা ভেবে বলল,‘রাইশান এসেছিল।’
অহনার কপাল কুঁচকে আসে,
‘রাইশান কে?’
‘আমার একজন সহপাঠী। সে আমাকে পছন্দ করে। তাই নানা বাহানা দিয়ে কাছে আসতে চায়।’
অহনার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে রাগে।
‘তুমি তাকে সুযোগ না দিলে সে কী করে তোমার কাছে আসতে চায়? তুমি আমাকে ভুলে গেলে তাই না? এজন্যই আমি তোমাকে যেতে দিতে চাইনি। এবার কী হবে? ও যদি তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নেয়? ও কি তোমার সাথেই কাজ করে? সারাক্ষণ সাথে থাকে?’
‘হ্যাঁ!’
‘আমি আজই তোমার কাছে যাব।’
‘পাগলামি করো না। তোমার কি আমার প্রতি বিশ্বাস নেই?’
‘আছে!’
‘তাহলে?’
‘মেয়েটার থেকে দূরে থাকবে।’
‘কাছে গেলাম কখন? তুমি ছাড়া আর কাউকে কাছে আসতে দেই কী করে? আমার হৃদস্পন্দনের শব্দ একমাত্র তোমার জন্যই বরাদ্দ করা। আর কিছু কাছে আসলেও হৃদয় তার স্পন্দন বন্ধ করে দেবে।’
‘সত্যি বলছ তো?’
মাহতিম কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে বলল,‘ভালোবাসি আহি!’
অহনা সাথে সাথেই বলল,‘আমিও।’
তাদের দুজনকেই নীরবতা গ্রাস করে নিল। কোনো কথা বলল না। একে অপরকে দেখতে থাকে শান্তিতে। সমস্ত আবেগ ঢেলে দিচ্ছে তারা দূর থেকেই। মাহতিমের চিত্ত চঞ্চল। একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে অহনাকে। দূরত্বের কারণে একে অপরকে ছুঁতে পারছে না। ভীষণ আক্ষেপ ঘিরে ধরে দুজনকেই। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে।
_
রাত তিনটা বাজে তখন। মোহনা কাঁদছে ভীষণ। একটু আগেই তাকে কল করেছিল বিহান। ছেলেটার সাথে তার সম্পর্ক ছিল প্রায় এক বছরের। হঠাৎ করেই মাঝখানে ছেড়ে চলে যায় অন্যকারো হাত ধরে। মেনে নিতে পারেনি মোহনা। এখনো পারে না। কিন্তু একবার যদি মনে ঘৃণা জন্ম নেয়, তবে প্রেমিক পায়ে এসে পড়লেও তার জবান খুলবে না। একটু আগেই বিহান কল করে বলেছিল,
‘আমি আবার তোমার কাছে ফিরতে চাই!’
মোহনা তাকে ভালোবাসে মন থেকে। ছাড়ার কথা কখনো চিন্তাও করেনি। কিন্তু যে পুরুষ একবার ছেড়ে গিয়েছে অন্যকাউকে পেয়ে সে পরবর্তীতে যাবে না তার গ্যারান্টি কী? মোহনার মন এখন শক্ত হয়ে গেছে। হয়ত কষ্ট পায় বিহানের কথা ভেবে কিন্তু এখন আর মেনে নেবে না। সম্পর্কের ছয় মাস পর ছেলেটা সব ঠিক করে নিতে চায়। সে সত্যিই বোকা। মোহনা বলে দিল,
‘সব শেষ। আমি কোনো প্রতারকের সাথে আবার জড়াতে চাই না। তুমি আর কখনোই আমাকে কল করবে না।’
‘আমি ভুল করেছি। ক্ষমা করা যায় না? কথা দিলাম, এবার আর ছেড়ে যাব না।’
‘আফসোস হচ্ছে তোমার? হোক! আমি আর সায় দেব না। তুমি বড়লোক মেয়ে পেয়েছিলে না? আমার থেকেও সুন্দরী, বড়লোক রাইমাকে পেলে না? অবশেষে সেও কি ছেড়ে গেল?’
‘ও আমার ভালোবাসা বুঝেনি। অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে।’
‘তোমার সাথে এটাই হওয়ার ছিল। এখন উপায় না পেয়ে আমার কাছে? তোমার কোনো যোগ্যতা আছে আমার পাশে দাঁড়ানোর? রিজেক্ট করেছ আমাকে, আমি সহ্য করতে পেরেছিলাম? মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে আছি। এখন আমি সুখী! দয়া করে আমার সুখের মুহূর্তটা নষ্ট করো না। দোহাই তোমার।’
‘একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না? আর ছেড়ে যাব না।’
‘বিশ্বাস করতে পারছি না। সুযোগের একটা সময় থাকে, তুমি সেটা অতিক্রম করেছ। এখন নিরুপায় হয়ে আমার কাছে এসেছ, ভালোবেসে না।’
‘তোমার কি বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেছে? শুনলাম এখনো রিলেশনে যাওনি। আমাকে সুযোগ দিতেই পারো।’
‘কে বলল তোমাকে, আমার বয়ফ্রেন্ড নেই? আছে, সে তোমার থেকেও সুদর্শন, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বাসী। তোমার থেকে কোটিগুন ভালো সে। আমার জন্য উত্তম। সে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য আর তুমি ঘৃণা। সময় পেলে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে যেও।’
‘তুমি মিথ্যে বলছ। তেমন কেউ নেই।’
‘তোমার মতো মিথ্যেবাদী অন্তত না। কথা বলাও ভুল আমার। জঘন্য মানসিকতার লোকের সাথে কখনোই কথা বলা উচিত নয়। তারা নিজেদের নোংরা মস্তিষ্কের সাথে অন্যেরটা তুলনা করে।’
মোহনা আর একটাও কথা শুনল না। সাথে সাথেই ব্লকলিস্টে ফেলল বিহানকে। মন এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। কোনোভাবেই সেটা গলবে না। থাকতে মূল্য না দিলে হারিয়ে যায়। আর একবার হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া দায়। কখনোই সম্ভব নয়। মোহনাও তেমনই। সে ভালোবাসা চেয়েছিল, কপটতা নয়। মনে মনে বলল,‘তোমার মতো বয়ফ্রেন্ডের থেকে আজীবন সিঙ্গেল থাকা অনেক ভালো।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership
চলবে….