ছায়া মানব ২ ৩৪.

0
112

ছায়া মানব ২

৩৪.
আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে প্রবল বেগে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদী, কুশিয়ারা নদী এবং আরো কিছু নদীর পানি ক্রমানুগতিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই আতঙ্কে জর্জরিত। সিলেটের প্রায় ছয়টি উপজেলা এর রোষানলে। প্রতিনিয়ত শুরু হয়েছে মানুষের আহাজারি। মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের বাসস্থান, ভূমি‌। ত্রান সংকটে সবাই। আরো পাঁচদিন কেটে যেতেই সব আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে মাহতিমসহ আরো অনেকেই সাহায্যে বেড়িয়ে পড়ে। সে সহযোগী হিসেবে অনুজকে ডেকে নেয়। অনুজের সাথে বেড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ত্রান বিতরণ করে তারা শান্ত হয়নি। রাত গড়িয়ে যায়‌।
অহনা মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার চিন্তা যেন কাটছেই না। সেও খবর শুনেছে সিলেটের। মাহতিমের জন্য চিন্তা হচ্ছিল। বারবার কল করছিল। মাহতিম ব্যস্ততার কারণে ধরল না। দুপুরের সময় একবার ধরেছিল। কথা বলার সাথে সাথেই কেউ তাকে ডাকল। সে একটু পর কল করবে বলে রেখে দেয়। সেই একটু পর আর হয়নি। এখনো অহনা বসেই আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠল,‘অপেক্ষা এতো কঠিন কেন? সময়গুলো যেন নিমেষেই হাজার বছরের রূপ নেয়। বিরক্ত হয়ে উঠছি ক্ষণে ক্ষণে।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারো কল করল। কোনো উত্তর না পেয়ে অহনার‌ও ভয় আসে প্রচুর। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়েই মাহতিম কল ধরল। অহনার বিচলিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই মাহতিম চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। কাজ শেষে সে আর অনুজ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে‌। আজ সবাই মাহতিমের এপার্টমেন্টেই থাকবে। অহনার কন্ঠস্বর অনুজের কানেও আসে। মৃদু হেসে মাহতিমকে জিজ্ঞেস করল,‘তোর বোন নাকি?’

মাহতিম তার মাথায় চাটি মেরে বলল,‘বোন হতে যাবে কেন? আমার হৃদয়ের রাণী। এক কথায় আমার ব‌উ।’

অনুজ হকচকিয়ে ওঠে,‘বিয়ে করলি কবে? আমাদের দাওয়াত দিলি না কেন? এটা ঠিক হয়নি। কবে এই মহৎ কাজ করে ফেললি?’

‘শান্ত হয়ে প্রশ্ন কর। আগে আমি একটু কথা বলে নিই। সারাদিনে একবার‌ও কথা হয়নি।’

‘তুই বিয়ে করেছিস, আমি বিশ্বাস করি না।’

অনুজ ফোনটা কেড়ে নেয়। নিজেই কানে দিয়ে বলল,‘হাই ভাবী।’

অহনা কিছুটা অবাক হয়েই উত্তর করল,‘কে বলছেন?’

‘আপনার স্বামীর বন্ধু। চিনতে পারবেন না। তবে বিয়েটা করলেন কবে?’

অহনাও রসিকতা করে বলল,‘আপনার বন্ধু আপনাকে বলেনি? আমরাতো দু’বছর আগেই বিয়ে করলাম। দুটো বাচ্চাও আছে।’

অনুজ ব্রু কপালে তুলে মাহতিমের দিকে তাকাল। পরপরই বলল,‘দুই বছরে দুইটা? আচ্ছা ভালো। ভালো থাকবেন, বাচ্চাদের যত্ন নেবেন।’

‘অবশ্য‌ই! আমাদের বাচ্চাদের জন্য দোয়া করবেন।’

মাহতিম বলল,‘এবার বিশ্বাস হলো তো?’

অনুজ একটু ভেবে বলল,‘বিশ্বাস পরে আসুক। আগে বল, ব‌উ ছেড়ে এতদিন আছিস কী করে?’

পাশাপাশি তাদের আরেকজন সহচর বলল,‘ব‌উয়ের ক্যাচাল থেকে দূরে থেকে ওনি ভালোই আছেন মনে হচ্ছে। ব‌উয়ের জ্বালায় বাড়ি থাকার উপায় নেই।’

অনুজ বলল,‘এসব বাজে কথা। ব‌উ থাকলে প্রতিদিন স্বর্গীয় সুখে থাকা যায়। প্রশান্তি সবসময় নিজের ঘরেই থাকে। তুমি বাইরে এডিকটেড হলে ভেতরটা বুঝবে কী করে?’

মাহতিম বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক শব্দ করে,‘থামবি এবার? একটু কথা বলতে দে। কেউ কথা বলার সময় বিরক্ত করতে নেই। তোদের সেনাবাহিনী বানালো কেন কে জানে!’

অনুজ সাথে সাথেই মুখে তালা দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাল। সবাই একটু ব্যক্তিগত জীবনে মন দেয়। মাহতিম কথা বলার এক পর্যায়ে বলল,‘বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?’

অহনা আড়ষ্ট হয়ে বলল,‘আমিতো এমনি বললাম।’

‘আমার বাচ্চাদের নিয়ে কোনো হেঁয়ালি চলবে না। ওদের ঠিকমতো যত্ন নিচ্ছ তো?’

অহনাও পাল্টা বলল,‘তারা তাদের পাপাকে দেখতে চায়। মিস করছে খুব। তুমি কবে আসবে?’

‘ওদের বলে দাও, পাপা খুব শিগগিরই ওদের আদর করতে আসবে সাথে ওদের মাম্মাকেও। মাম্মা নিশ্চয় আদর না পেয়ে খুব কষ্টে আছে।’

অনুজ সাথে সাথেই কাঁশি দিয়ে বলল,‘ভাই, আমরা সিঙ্গেলরা পাশে আছি, একটু সাবধানে কথা বল‌।’

মাহতিম রেগে যায়,
‘তোর কানটা কেন আমার ফোনের স্পিকারের দিকে? সমস্যা কী?’

‘ভলিউম বেশি তোর। একটু কমিয়ে কথা বল, আমরা কান দিলেও শুনব না।’
সবাই হু হু করে হেসে ওঠে। মাহতিম অহনাকে বলল,‘আমি না হয় বাসায় গিয়েই কথা বলব। ওরা বিরক্ত করছে।’

‘ওখানে বুঝি তারা থাকবে না? এতরাতে ফিরবে কোথায়? তুমি বরং তোমার সাথেই নিয়ে যাও। এতরাতে আবার তাদের বাড়ি ফেরা বা থাকার জায়গা খুঁজতে সমস্যা হবে।’

‘ওদের কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। হ্যাঁ! আমার সাথেই থাকবে‌। ধরে নাও, কাবাবে হাড্ডি আরকি।’

‘সে যাই হোক, তোমার বন্ধুইতো তাই না?’

মাহতিম কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,‘রাতে খেয়েছ?’

‘হুম! তুমিও দ্রুত খেয়ে নিও।’

‘আমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজের যত্ন নাও।’

‘তোমার চিন্তা কি রাইশান করবে?’

মাহতিম দুষ্টুমি করে বলল,‘করলেও করতে পারে। মেয়েটা কিন্তু অসাধারণ।’

রাগে অহনার নাকের পাটা লাল হয়ে যায়। রাইশানকে কেন জানি সহ্য করতে পারে না। একটু খবর নিয়েছিল মাহতিমের সহচর সেনা মিশু থেকে। অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটা। অহনার কয়েকবার তাকে দেখার সখ‌ও হয়েছিল। কিন্তু আর ইচ্ছে পোষণ করেনি। কারণ মাহতিমের প্রতি তার বিশ্বাস আছে। গাল ফুলিয়ে বলল,‘আমার সামনে এসে কথাটা বলতে পারবে?’

‘কেন পারব না?’

‘ঘু’ষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেব একদম। আমার ছাড়া আর কোনো মেয়ের রূপের প্রশংসা করবে না কখনো।’

‘তার রূপের প্রশংসা ক‌ই করলাম? আমিতো বললাম সে অসাধারণ, সেটা কাজেকর্মে। সে একাই অনেকের সাথে ফাইট করার ক্ষমতা রাখে। বিচক্ষণতার সাথে সব মোকাবেলা করে। অসম্ভব সাহসী একটা মেয়ে। তার প্রতিভা….’

‘থামবে তুমি?’

মাহতিম চুপ করে যায়। তার উদ্দেশ্য সফল। সে চেয়েছিল অহনাকে ক্ষেপাতে‌। অহনা ক্ষেপে গিয়ে বলল,‘আমিও সাহসী, শক্তিশালী, বুদ্ধিমতী। আমি যদি তোমার সাথে থাকতাম, তবে একাই সবার সাথে ফাইট করতাম, তোমাকে রক্ষা করতাম।’

‘বিপদের পূর্বাভাস দিতে তাই না? সেটা আমি জানি। তুমি কখনো এইটা মাছিকেও মেরেছ?’

অহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে কোনো শক্তির প্রয়োজন হয়না‌। দরকার একটুখানি ভালোবাসা। প্রিয়জনকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মরে গেলে, সে মরাতেও শান্তি থাকে। ওসব তুমি বুঝবে না‌।’

‘আমি বুঝি। এটাও জানি, আমি সঠিক মানুষটাকেই জীবনে গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের সফলতা তুমি। তোমাকে পেয়ে বাকিসব হারিয়ে ফেললেও আফসোস থাকবে না।’

হঠাৎ করেই গাড়ি থেমে যায়। পাহাড়ি একটা খাদের কাছে এসেই গাড়িটা থামল। আর একটু হলেই গাড়িটা পড়ে যাবে। গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। পেছনে থাকা দুইজন সেনা বাইরে বের হয়ে আসে। গাড়িটা অস্বাভাবিকভাবে দুলছে। কটকট শব্দ হতেই মাহতিম ওপাশে অহনাকে বলল,‘লাইনে থাকো, বাইরে বের হয়ে নিই।’

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অনুজ নেমে পড়ল। অনুজের অনুপস্থিতিতে গাড়িটা নিচের দিকে ঝুঁকে যায়। মাহতিম কিছুটা চিৎকার করে উঠতেই অহনার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ফোনের ওপাশ থেকে বলল,‘এই তুমি ঠিক আছ? কী হয়েছে?’

মাহতিম বের হ‌ওয়ার জন্য হাত বাড়ায় অনুজের দিকে। সেও গ্লাসের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে। মাহতিম অনুজের এক আঙুল স্পর্শ করতেই গাড়িটা নিচের দিকে পুরোপুরি ধাবিত হয়। মাহতিমের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতেই অহনা আঁতকে ওঠে। কল কেটে গেছে। সাথে সাথেই সে চিৎকার করে ওঠে‌। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। তার নিনাদ শুনে মুহুর্তেই সবাই দেখতে আসে। আনিফা আসতেই অহনা তাকে জাপটে ধরে। মামুন‌ও দরজার বাইরে দাঁড়ায়। জানার চেষ্টা করে কী হয়েছে। অহনা সাথে সাথেই বলল,‘আমি কথা বলছিলাম মাহতিমের সাথে। ওর গাড়ি একটা খাদের কিনারে আঁটকে গিয়েছিল। এরপর কথা বলার আগেই ফোন কেটে যায়। এখন ফোন বন্ধ বলছে‌‌। কী হয়েছে কিছুই জানি না।’

মামুন সাথে সাথেই বের হয়ে যায়‌। আনিফাকে হালকা গলা উঁচিয়ে বলল,‘আমি আসছি।’

অহনাও সাথে সাথেই বলল,‘আমাকেও নিয়ে চলুন। আমিও ওর কাছে যাব।’

মামুন আনিফাকে বলল,‘মেয়েটাকে সামলাও‌।’

অহনা আঁতকে ওঠে। কিছুতেই সে ঘরে থাকবে না। উদাসীন হয়ে পড়েছে। বারবার বলছে,’আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মাহতিমের কাছে যাব। ওকে নিজ চোখে দেখার আগে আমি শান্ত হতে পারবনা।’

আনিফা নিজেও ভয়ে আছেন। হঠাৎ করেই বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাকে সামলাবে তারা? বর্ষণ দ্রুত ডাক্তারকে কল করে। পরপরই মোহনা আর নিহাকে বলল,‘আম্মার বুকে ব্যথা করছে। ডাক্তার আসলে দেখবে। আম্মার খেয়াল রাখবে। আমি আসছি।’

অহনাও সাথে সাথে বের হয়ে পড়ে। মোহনার বাধা মানল না। হাতজোড় করে বর্ষণকে বলল,‘প্লিজ আমাকেও নিয়ে চলুন।’

বর্ষণ না করল না,
‘ঠিক আছে, আসো।’

বর্ষণ দ্রুত গাড়ি বের করে। অহনাকে বলল লোকেশন দেখাতে মাহতিমের। রাস্তা দীর্ঘ, তবুও তারা আশাহত না হয়েই র‌ওনা দিল। অহনার চক্ষু চঞ্চল‌, বিচলিত‌। ইচ্ছে করছে গাড়িটাকে আকাশে উড়িয়ে এখনই মাহতিমের কাছে চলে যাক।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here