ছায়া মানব ২
১২.
অহনা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মাহতিমের বিছানায়। রাত অনেকটা হয়ে গেল। তবুও মাহতিম আসছে না। আনিফা অপেক্ষা করছে ছেলের জন্য। কলিং বাজতেই তড়িঘড়ি হয়ে দরজা খুলে দেয়। মাহতিম ক্লান্ত থাকায় বলল,’আম্মা আমি শাওয়ার নিয়ে আসি। একটু দেরী হবে, খুবই ক্লান্ত আমি।’
আনিফার অনুমতি নিয়েই সে নিজের ঘরে যায়। যাওয়ার আগে একবার মোহনার ঘরের দিকে উঁকি দিল। সে আপনমনে পড়ছে। মাহতিম দ্রুত বাথরুমে গেল। কোনোদিকে খেয়াল করেনি তাই দেখতেও পায়নি অহনাকে। দীর্ঘ সময় শাওয়ার নিয়ে মাহতিম বের হয়ে এলো। গায়ে কিছুই নেই। পরনে তোয়ালে পেঁচানো। হাত দিয়ে মাথার চুল ঝাড়তেই কয়েক ফোঁটা পানি পড়ল অহনার মুখের ওপর। কিছুটা নড়ে ওঠতেই মাহতিম অহনাকে খেয়াল করল। ভেবেছিল অহনাকে হয়ত মোহনার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু সেতো তার ঘরেই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। দেখে তার বড্ডো মায়া হলো। অহনার কাছে গিয়ে বসল। আনমনে হাসল ঘুমন্ত অহনার ভঙ্গি দেখে। কপালে লেপ্টে থাকা কয়েকটা চুল হাত দিয়ে সন্তর্পণে সরিয়ে দিয়ে করো কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। দেখেও যেন ভালো লাগছে। আপনমনে উচ্চারণ করল,
‘ নন্দিনী, তুমি যে ছলনাময়ী
পথহারা পথিকের হৃদকারিণী!’
হৃদস্পন্দনের দ্রুততা অনুভব করতেই সে অহনার আরো কিছুটা পাশ ঘেঁষে বসল। চুল থেকে এক ফোঁটা পানি অহনার চোখের পাতায় পড়তেই সে পিটপিট করে তাকায়। মাহতিমের আবছা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠতেই কিঞ্চিত হাসল। পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবার খুলতেই যেন বিস্মিত হলো। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল,’এটা নিশ্চয় স্বপ্ন।’
এভাবে চোখ বন্ধ করে আবার খুলল কয়েকবার। মাহতিমও দারুণভাবে উপভোগ করল অহনার কান্ড। শেষে হেসেই ফেলল। অহনা মাহতিমের দীর্ঘ হাসি দেখে তার ঠোঁট স্পর্শ করল,’এটা স্বপ্ন নয়? বাস্তব?’
মাহতিম অহনার কোমল হাতজোড়া নিজের আরো কিছুটা সামনে এনে বলল,’স্বপ্ন হোক বা বাস্তব, আমি সর্বদা তোমার সাথেই থাকব।’
অহনার প্রাণভরে শ্বাস নিল। ভেজা কন্ঠে বলল,’স্বপ্নটা দ্রুত শেষ হয়ে যাক।’
বলেই মাহতিমের থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিল। তবুও মাহতিমের কোনো ভাবগতি না দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা হাতে মাহতিমের বুক স্পর্শ করল। সাথে সাথে মনে হলো সে কোথাও হারিয়ে গেছে। অদ্ভুত এক আবেশে জড়িয়ে গেল অহনা। চোখ পড়ল তার মাহতিমের নগ্ন বুকের দিকে। ভেজা শরীরে জল চিকচিক করছে। অহনার এতক্ষণে বোধ হলো তার সামনে থাকা মানুষটি স্বপ্নলোকে নয় বাস্তবেই আছে। ভীষণ চমকে ওঠে। হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেই মাহতিম সেটা শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে,
‘বিশ্বাস হলোতো! আমি তোমার বাস্তবেই আছি, কল্পনা নয়।’
ভয়ে, আতঙ্কে অহনা চিৎকার করতে গেলেই মাহতিম শক্ত বাহু দ্বারা অহনার মুখ চেপে ধরে। অহনা থেমে যায়। ঢ্যাবঢ্যাব করে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘চিৎকার করো না। তুমি আমার ঘরে এখনো কেন?’
অহনা বড়োবড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে মাহতিমের দিকে। কিছু বলতেও পারছে না। মাহতিম পুনরায় বলল,’একদম চেঁচামেচি করবে না। সবাই ভাববে আমি হয়ত তোমার সাথে কিছু করেছি।’
পরপরই অহনাকে ছেড়ে দেয়। অহনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বারকয়েক শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ আর একটু হলে মরেই যেতাম। আপনি এমন কেন?
ভয় পেয়েছি যেহেতু চিৎকার করব না?’
‘ আমি কি কোনো জন্তু? কেন আমাকে ভয় পেতে হবে?’
‘ রাতের বেলা একটা মেয়ের ঘরে আপনি, আবার বলছেন ভয় পাব কেন! কী করছিলেন এখানে? চুরি করতে ঢুকেননিতো আবার? আপনাকে দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছিল। আমি ঠিক ধরেছিলাম, আপনি চোরই হবেন।’
‘ আমার ঘরে বসে তুমি আমাকেই চোর বলছ? নিজের ঘর থেকে কী চুরি করব আমি? প্রশ্নটা আমার। আমার ঘরে তুমি কী করছ?’
‘ আপনার ঘর মানে! বাড়িটা কি আপনার নাকি আমার পিছু নিয়েছেন?’
‘ পুরো ঘরটা ভালো করে দেখো। আমার ঘরে এসে আমাকেই কথা শুনাচ্ছ।’
‘ মোহনার কে হন আপনি?’
‘মোহনা আমার ছোটো বোন।’
‘তার মানে বর্ষণ স্যার আপনার ভাই?’
‘হুম!’
অহনা ঢোক গিলল। মনে মনে বলল,’সবশেষে কিনা দুটো সাপের রোষানলে আমি! নাহ! এখানে থাকা যাবে না। বাড়ি যেতেই হবে।’
‘ কী মনে মনে বিড়বিড় করছ?’
অহনা চমকে ওঠে,
‘ কই কিছু নাতো। সরুন, আমি ওঠবো।’
মাহতিম সরলো না। ঠাঁয় বসে রইল। যেন অহনার কথা সে শুনতেই পায়নি। মুখ ফুলিয়ে অহনা বলল,’আমাকে যেতে দিন।’
‘ পারলে আমাকে টপকে যাও।’
‘পারব না। আপনি ওঠে দাঁড়ান। আমি অনায়াসেই যেতে পারব।’
‘এত রাতে কোথায় যাবে?’
‘ জাহান্নামে। তবুও আপনার বাড়িতে আর এক মুহূর্তও না।’
মাহতিম হাসল। এক মুহুর্তের জন্য কিছু একটা চিন্তা করেই বলল,’বড়ো ভাইকে কি তুমি পছন্দ করো?’
অহনা কিছুটা বিচলিত হয়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। তবে মাহতিমের যে হিংসে হচ্ছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তবুও মাহতিমকে কিছুটা রাগানোর জন্য বলল,’হুম!’
তারপর একধ্যানে গালে হাত দিয়ে বলল,’কতটা পছন্দ করি তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। ওনাকে দেখলেই আমার খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করে। কতো সুন্দর, কিউট আপনার ভাই। দেখেই আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আর কাউকে দেখে আমার এমন মনে হয়না। ওনাকে দেখলেই ইচ্ছে করে…’
মাহতিম অহনার মুখ চেপে ধরে,’আর একটাও কথা নয়। আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও। তোমাকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই না।’
অহনা ঠোঁট টিপে হাসল। মাহতিমকে জ্বালিয়ে তার বেশ মজা হচ্ছে। মাহতিমকে পাশ কাটিয়ে ওঠে যেতে চাইলেই কোমরে কারো হাতের স্পর্শ লেগে যায়। সাথে সাথেই মাহতিম বলল,’সরি! আমি দেখতে পাইনি। ভুল করে হাত লেগে গেছে।’
অহনা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,’ঠিক আছে!’
মাহতিমের ঘর থেকে চলে যেতেই সে পিছু ডাকল,
‘বলছি, আর একটু থেকে যাও। তোমার উপস্থিতি আমার ভালো লাগে।’
অহনার বুকের ভেতরটা উচ্চস্বরে কিছু জানান দিয়ে গেল। কেমন অদ্ভুত এক মায়াময় অনুভূতি হলো তার। না চাইতেই পা থেমে গেল। নিজেও ভেবে পেল না, কেন তার সাথে এমন হচ্ছে। কই আর কেউ সামনে এলেতো এমন হয়না। শুধুমাত্র মাহতিমের স্পর্শেই কেন নিজেকে উদাসীন লাগে। বোকা মস্তিষ্কে অহনা বলল,’আপনি অন্যরকম।’
মাহতিম তার কাছে এসে দাঁড়াল। ছোঁয়ার কিছুটা ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
‘প্রেমে পড়বে কখনো?’
‘উঁহু!’
‘ তবে হেরে যাবে তুমি।’
অহনা ছোট ছোট চোখ করে তাকাল। ভীষণ লজ্জায় তার চোখ-মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেল। ভেজা কন্ঠে বলল,’আমি হারলে আপনিও হারবেন।’
পরপরই অহনা চলে গেল। মাহতিম অহনার কথার ঠিক মানে বুঝে ওঠতে পারল না। তবে সাঁয় দিল বলেই বোঝা যায়। সেও হয়ত কিছু অনুভব করে। মাহতিম আপনমনে ভাবছে অহনার কথা।
অহনা এখনো যায়নি। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে মাহতিমকে দেখছে। মাহতিম পেছন ফিরতেই চলে গেল মোহনার ঘরে। আনিফা এলো মাহতিমের কাছে। মাহতিম দ্রুত শার্ট গায়ে দিয়ে বলল,’আম্মা, অহনা আমার ঘরে ছিল কেন?’
‘এটা কেমন কথা! মেয়েটাকে বুঝি বের করে দিলি? অসুস্থ ছিল বলে আর জায়গা পরিবর্তন করতে বলিনি। আজ একদিন অন্য ঘরে থাকলে তোর কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত?’
মাহতিম কিছু বলার আগেই আনিফা পুনরায় বলল,’ও এখন কোথায়?’
‘মোহনার ঘরে গেল।’
‘ খেতে আয়।’
মাহতিম যাওয়ার আগে আরো একবার অহনাকে দেখার চেষ্টা করল। মোহনার ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় দেখতে পারল না।
ভোর হতেই অহনা এবং মোহনা বের হলো কলেজের উদ্দেশ্যে। মাহতিমের ওঠতে কিছুটা দেরী হলো। ওঠেই সে বিচলিত হয়ে পড়ল। ফ্রেশ হয়েই বারান্দায় গেল। দেখল অহনা বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ছে। ওপর থেকেই মাহতিম চিৎকার করে ওঠল,’একদম ছুঁবে না।’
অহনা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। সকালেই আনিফা ফুলের গাছে পানি দিয়েছিল বলে মাটি কিছুটা কর্দমাক্ত। অহনা পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় তার জামাটাও নোংরা হয়ে যায়।
মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরী না করে নিচে নামে। সোজা অহনার সামনে যায়। কাদায় মাখামাখি হয়ে সে বসেই আছে। পাশে ছিঁড়ে পড়ে আছে একখানা সাদা গোলাপ। অহনা হাত বাড়ায়। মাহতিম ধরল না। উল্টো গোলাপটা হাতে নিয়ে সেটাকে পরিষ্কার করতে লাগল। অহনার রাগে ফেটে পড়া অবস্থা। তাকে না তুলে সামান্য একটা ফুল নিয়ে এতটা মাতামাতি।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্পটা সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করুণ সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership