ছায়া মানব ২ ১১.

0
164

ছায়া মানব ২

১১.
বর্ষণ আনন্দচিত্তে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই দেখল তার পাশে অহনা নেই। সে আপন মনে সামনের দিকে হাঁটছে। কিছুটা অবাক হয়েই বর্ষণ দৌড়ে যায় অহনার সামনে।
‘এদিকে কোথায় যাচ্ছ? গাড়িতো ওদিকে।’

অহনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,’আমি আপনার গাড়িতে যাব না।’

‘ একটু আগেই আম্মার সমানে আজই হলে আর এখন না করছ। অদ্ভুত মেয়ে তুমি!’

‘আমি ওনার কথা ফেলতে পারিনি। তাই রাজি হলাম। কিন্তু এখনতো আর ওনি দেখবেন না। বায়, অনেকটা দেরী করে ফেললাম।’

‘তুমি এমনটা করতে পারো না আমার সাথে।’

‘ আমি সবকিছুই করতে পারি।’

আড়াল থেকে সবটা দেখে মাহতিম মুখ চেপে ধরে হাসছে। তার খুব আনন্দ হচ্ছে বর্ষণের অবস্থা দেখে। এমন সময় কল আসলো জয়ন্তের। তাকে দ্রুত যেতে বলল। মাহতিম পা বাড়ালো যাওয়ার জন্য।

অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যেতে চাইলেই ইটের সাথে পা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই বর্ষণ ধরে নেয়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অহনা। বর্ষণের ছোঁয়া লাগতেই কেমন বিরক্ত লাগল তার। দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলেই বর্ষণ আরো চেপে ধরে নিজের সাথে। অহনার পালানোর রাস্তা থাকে না। তবুও পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে অহনা ধা’ক্কা মারে বর্ষণকে। সে কিছুটা দূরে গিয়ে থামে। অহনা রেগে যায় প্রচন্ড,
‘আপনি আপনার লিমিট ক্রস করছেন।’

‘ সরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি।’

অহনা শান্ত হয় কিছুটা। দম নিয়ে বলল,’ঠিক আছে, আমি আসছি। আর শুনুন, ভুল করেও সুযোগ নিতে আসবেন না। দেশে মেয়ের অভাব পড়েনি।’

‘ সবাইতো আর তুমি ন‌ও। তোমাকে পেতে হলে কী করতে হবে সেটা বলো। তুমি যা বলবে তাই করব। শুধু বলেই দেখো।’

‘ যা বলব সব করবেন? সত্যিতো!’

‘ একদম! তুমি শুধু বলো।’

‘ আমার জন্য মরতে পারবেন? তাহলে বেশি নয় পাঁচতলা ভবনের উপর থেকে ঝাঁপ দিন।’

বর্ষণের মুখটা শুকিয়ে আসে,
‘তাহলেতো মরে ভূত হয়ে যাব। আমি মরে গেলে তোমাকে পাবে কে? তোমাকে পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেব, যদি মরেই যাই তাহলে তুমি অন্যকারো হয়ে যাবে। আমার লাভটা কী?’

‘ বললেই হতো, আপনি পারবেন না।’

‘ এটা পারার মতো কোনো বিষয় বলোনি। অন্য একটা বলো।’

‘ ঠিক আছে, তাহলে ঐযে দূরে একটা তালগাছ দেখা যাচ্ছে না! সেটার অন্তিম ডালে একটা বাজপাখি বসে আছে। পাখিটার লেজের অংশ থেকে অন্তিম পালকটা আমার জন্য নিয়ে আসুন। তাও আবার দুমিনিটের মধ্যে।’

বর্ষণ ব্রু উঁচিয়ে ওপরে তাকাল। বিকেলের শেষ সময়ে আকাশ একদম পরিষ্কার, সবকিছু অনেকটাই আবছা দেখা যাচ্ছে। তালগাছতো ঠিক‌ই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তার অন্তিম ডাল বোঝা যাচ্ছে না। যেখানে ডাল শনাক্ত করতেই ব্যর্থ সেখানে বাজপাখি খোঁজা বিলাসীতা ছাড়া কিছুই নয়। বর্ষণ অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেও তেমন কিছুই দেখল না। অসফল মুখে বলে,’তালগাছ ঠিক‌ই দেখতে পেলাম কিন্তু বাজপাখি ছাড় কোনো চড়ুই পাখির অস্তিত্ব‌ও টের পেলাম না।’

‘ জানতাম আপনি পারবেন না। আপনার দ্বারা কিছুই হবে না। তবে আমি যাই! আপনি হেরে গেলেন।’

বর্ষণ এখনো ভাবছে পুরো বিষয়টা। অসম্ভব কিছু বললে কিভাবে সে পূরণ করবে? মেয়েটা যে তাকে বোকা বানিয়ে গেল তা তার বুঝতে আর বাকি র‌ইল না।

অহনা কিছুটা বিভ্রান্ত। তার পা দুটো কেমন অবশ হয়ে আসছে। কিছুদিন ধরেই তার এই সমস্যাটা হচ্ছে। একটু আগে বর্ষণের স্পর্শে সে আরো কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিল বলে এলোমেলো পা জোড়া সঠিকভাবে ফেলতে পারছিল না। রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছে সে। কোনোদিকে নজর নেই। একটি ট্রাক ক্রমশ‌ই এগিয়ে আসছে তার দিকে। অথচ তার ব্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। ট্রাক তার একদম সম্মুখে। হঠাৎ করেই কেউ তাকে সরিয়ে নিল গাড়ির সামনে থেকে। খেয়াল করতে পারল না অহনা। ছিটকে দূরে পড়ে যায়। ভয় এবং উত্তেজনার কারণে জ্ঞান হারায়। এতক্ষণে খেয়াল করল বর্ষণ। মাহতিম অহনাকে পাঁজাকোলে করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়। অহনাকে দ্রুত নিজের ঘরে নিয়ে পালঙ্কে শুইয়ে দেয়। আনিফা, মোহনা মাহতিমের ঘরে আসে। অহনাকে এমন অবস্থায় দেখে অনেকটা ঘাবড়ে যায় তারা। মোহনা কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে ওর? ওরতো বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল! তোমার কোথায় পেলে? কিভাবে অজ্ঞান হলো?’

মাহতিম কোনো কথা বলল না। বর্ষণের দিকে গরম চোখে তাকাল। কিছু শক্ত কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়। বর্ষণ ব্যস্ত হয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। মাহতিম অহনার চোখে-মুখে পানি দেয়। হাত-পায়ের তালু ঘষে গরম করার চেষ্টা করল। তাও জ্ঞান না ফেরায় আরো চিন্তিত হয়ে পড়ে মাহতিম। সে দ্রুত ডাক্তারকে কল করে।
ভীষণ উত্তেজনায় সে বর্ষণকে বলেই বসল,’যে দায়িত্ব পালন করতেই পারো না, তবে সে দায়িত্ব নাও কেন? তুমি দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য ন‌ও।’

বর্ষণ রেগে যায় মাহতিমের কথায়। তবে শান্ত হয়ে নিজেকে সামলে নেয়। সে এখানে বিবাদ চায় না। আনিফা মাহতিমের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়।
আনিফা তাকে জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে ওর?’

মাহতিম বর্ষণের দিকে তাকিয়ে বলল,’আম্মা, ভাইয়ের গাফেলতির কারণে অহনার এক্সি’ডেন্ট হতে যাচ্ছিল। আমি ঠিক সময় উপস্থিত না হলে কি যে হতো, বলা মুশকিল। ওর জন্য‌ই আজ অহনার এমন অবস্থা।’

মোহনা কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,’অহনাকে তুমি চিনলে কী করে?’
কথার পিঠে মাহতিম কিছু বলতে পারল না। ডাক্তার এসেছে। মাহতিম সরে যায় অহনার পাশ থেকে। ডাক্তার অহনাকে পরীক্ষা করে বলল,’তেমন কিছুই হয়নি। দুর্বলতা এবং ভয়ের কারণেই সাময়িক জ্ঞান হারিয়েছেন ওনি। একটু পরেই জ্ঞান আসবে আশা করছি। সময়মতো খাওয়া এবং বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। শরীরের যত্ন নেন না মনে হয়। নিয়মতান্ত্রিক চলতে হবে। তাছাড়া ভয়ের কিছুই নেই।’
মাহতিম বিচলিত ভঙ্গিতে বলল,’জ্বী অবশ্যই।’

মাহতিমের কল আসলো পুনরায়। জয়ন্ত খুব রেগে গেছে। দ্রুত তাকে উপস্থিত হতে বলল। মোহনা বলল,’তুমি এতো ব্যস্ত হচ্ছ কেন ভাইয়া? আমরাতো আছি অহনার পাশে। তুমি তোমার কাজে যাও। তাছাড়া আম্মা থাকতে ওর যত্নের অভাব হবে না।’

মাহতিমের মন মানছে না। তবুও বলল,’ঠিক আছে। সমাধানে রাখিস। ওর খেয়াল রাখিস।’

‘ সেটা তোমাকে বলতে হবে না। আমরা আছিতো।’

মাহতিম চলে যেতেই অহনার জ্ঞান ফিরে আসে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই বর্ষণকে প্রথম দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে। ওঠার চেষ্টা করলেই আনিফা বাধা দেয়,’এখন ওঠার দরকার নেই। বিশ্রাম নাও, আমি তোমার জন্য গরম স্যুপ নিয়ে আসছি। একদম ওঠবে না বিছানা ছেড়ে।’

অহনা চিন্তিত হয়ে পড়ে। রাত হয়ে গেছে দেখে আরো খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। মোহনাকে বলল,’আমি এখনো বাড়িতে কল করিনি। বাবা-মা চিন্তায় আছে হয়ত।’

‘ অসুস্থতার খবর দেওয়ার দরকার নেই। তুমি কথা বলো।’
মোহনা ফোন এগিয়ে দিতেই অহনা কল করল। অহনার মা সুমা মেয়ের কল পেতেই খুশিতে গদোগদো। কিছুক্ষণ কথা বলতেই অহনার হাত থেকে মোহনা ফোনটা নিয়ে নিল। সালাম জানাতেই সুমা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। চিনল না মোহনাকে। পরিচয় দিতে মোহনা বলল,’আমি অহনার বন্ধু। আজকে ও আমাদের বাড়িতে থাকবে। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?’

‘ সে কী কথা? কী হয়েছে ওর?’

‘ কিছু হয়নি। আজ ফিরতে রাত হয়ে গেল তাই বাড়ি যেতে দিচ্ছি না। আমার আম্মাও বলছে আজ থেকে যেতে। আপনার অনুমতি পেলেই থাকবে। না হয় এতো রাতে ম্যাচে ফিরতে কষ্ট হবে ওর।’

‘ঠিক আছে। তুমি যেহেতু ওর বন্ধু তাই থাকতেই পারে।’

আনিফা অহনার জন্য গরম স্যুপ আনতে গেল। এই ফাঁকে বর্ষণ অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’আমার কি তোমাকে সরি বলা উচিত?’

‘ অবশ্যই! এক্ষুনি বলুন।’

‘ সরি! আমি বুঝতে পারিনি। না হয় এমনটা হতো না তোমার সাথে। যদি আজ ভাই না থাকতো তবে কী‌ যে হতো..!’
অহনার পুরো শরীরে কেমন শীতলতা বয়ে গেল। চারিদিকে কেমন পরিচিত গন্ধ পাচ্ছে। অদ্ভুত এক ভালো লাগা শরীরজুড়ে। আবছা কাউকে মনে পড়ছে। বুঝতে পারছে না কে সে! বর্ষণকে বলল,’আপনার ভাই কে?’

বর্ষণ কেন জানি বিষয়টা চেপে গেল। বলল,’কিছু না। আমি সরি, আমি হুঁশিয়ার হলেই আজ এতো কিছু ঘটত না।’

‘যাই হোক। আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু সরি বলছেন কেন বারবার?’

‘ অপরাধের জন্য।’

‘দোষটা আপনার নয়। আমার নির্বুদ্ধিতার জন্য‌ই সব হয়েছে। আপনি নিজেকে দোষী করছেন কেন?’

‘ তার মানে মাফ করে দিয়েছ?’

‘হুম।’

‘তাহলে কাছে আসতে পারি?’

অহনা আচমকা এমন কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে,
‘কী বললেন?’

বর্ষণ আমতা আমতা করে বলল,’কিছু না। আম্মা এসেছে।’

আনিফা স্যুপ নিয়ে এলো। জোর করে পুরোটা খাইয়ে দিল অহনাকে।

জয়ন্ত কুমার এবং প্রফেসর মোঃ আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী একটি টিম তৈরি করেছেন। দেশের প্রায় পঞ্চাশটি প্রতিষ্ঠান এতে যুক্ত। পাঁচজনকে এর পরিচালক হিসেবে রাখা হয়েছে। আশিশ, নিমো, নাজ, অমৃতা, অরোরা এই পাঁচজনকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে বিসিএ নামক একটি দল। তাদের প্রধান এবং অন্যতম কাজ নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিক রেখে দেশকে রক্ষা করা। মাহতিমকে করা হলো বিসিএ এর প্রধান। এতে খুশি হতে পারল না অনেকে। তারা মাহতিমকে লিডার হিসেবে মেনে নিল না। তবে প্রকাশ করল না। বিসিএ এর পাঁচজন সদস্যের মধ্যে নিমো সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী। মাহতিমকে সে নিজের ছেলের মতোই আদর করে। আশিশ এবং নাজ গোপন ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের কাজ হচ্ছে দেশের তথ্য চুরি করে বিক্রি করা। অন্যদিকে অমৃতা এবং অরোরা দেশের বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। যারা অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত। অথচ লোকচক্ষুর কাছে তারা উত্তম।
সবাই মাহতিমকে শুভেচ্ছা জানাল। অথচ তার মন পড়ে র‌ইল অহনার কাছে। তার ঘুমন্ত মুখশ্রীর মায়ায় পড়ে গেছে। এই মুহুর্তে সে শান্তির আর কিছুই ভাবতে পারছে না। সবাই তাকে বলল সময়টাকে উপভোগ করতে এবং রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে। সে রাজি হলো না। বাহানা দিয়ে বের হয়ে গেল। মনটা তার আঁকুপাঁকু করছে অহনাকে দেখার জন্য।

চলবে…..

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

গল্পটা সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করুন সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here