ছায়া মানব ২
১৬.
মোহনা ভীষণ উৎকন্ঠিত। খুব রাগ হচ্ছে ছোঁয়ার ওপর। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অহনার থেকে উত্তর না পেয়ে আর কথা বাড়ালো না। রোস্তমকে কল করল। কল ধরতেই বলল,’আঙ্কেল আপনাকে মেয়েকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
এমন কথায় যে কেউ চমকে যাবে। রোস্তমও চমকে গেল। বলল,’কে তুমি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
‘ম্যাচে অহনাকে সবাই বিরক্ত করে তাই ওকে আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আমি ওর বন্ধু। আশা করি কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘সেটা কী করে হয়? ও কেন তোমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবে? আমি ওকে অন্য কোথাও জায়গা করে দেব। তুমি শান্ত হও। আমি বিকেলেই আসছি।’
‘না, আপনাকে আসতে হবে না। এখানে অহনার সমস্যা হচ্ছে তাই আপনি শুধু পারমিশন দিন আমার সাথে থাকার। প্লিজ আঙ্কেল।’
‘ অহনার কাছে কল দাও তো। আমি ওর সাথে কথা বলব আগে।’
মোহনা কলটা অহনার কাছে দিল। রোস্তমের সাথে খানিকটা কথা বলল অহনা। অহনা দ্বিমত করলেও মোহনার কথা ফেলতে পারেনি রোস্তম। অবশেষে মোহনার কথাই মেনে নিল।
মোহনা নিজেই অহনার সব গুছিয়ে দিল। তারা রওনাও হলো। কিছুদিনের ব্যাপার মাত্র, তেমনটা ভেবেই অহনাও নিজেকে আশ্বাস দিল। রোস্তম আসলে একটা ব্যবস্থা করে দেবে। আপাতত মোহনার সাথে থাকতে তার আপত্তি করার কথা নয়।
চৌধুরী বাড়িতে যেতেই অহনা কিছুটা ভয় পেল। সদর দরজা পার হতেই বর্ষণের সাথে জোরেসোরে ধা’ক্কা খেল। পড়ে যাওয়া আগেই নিজেকে সামলে নিল।
‘তুমি ঠিক আছ?’
অহনা ছোট করে উত্তর করল,’হুম!’
ঘরের ভেতর ঢুকল। আনিফাকে স্বল্প বাক্যে মোহনা সবটা বুঝিয়ে বলল। সেও দ্বিমত করল না। মনে মনে তিনিও অহনাকে বেশ পছন্দ করেন। অহনাকে একটা ঘর দেওয়া হলো। যখন সে নিজের ঘরে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল তখন খেয়াল করল, তার ঘরে কারো একটি ফোন পড়ে রয়েছে। আগ্রহবশত সেটা হাতে নেয়। অন করতেই দেখল মাহতিমের ছবি ওয়ালপেপারে ভাসছে। বুঝতে বাকি রইল না মোবাইলটা কার। কিন্তু এখানে কেন এসেছে? ঘরটাতো একটু আগেই ঠিকঠাক করে ওকে দেওয়া হলো। তার আগে এতে কেউ প্রবেশ করেনি। অহনা কিছুটা গোয়েন্দা হয়েই মোবাইলটা নিজের কাছে রেখে দেয়। তবে অন্যের মোবাইল বলে তার ভেতরটা দেখল না। ফ্রেশ হতেই মোহনা এলো দু’কাপ কফি নিয়ে। অহনা চা খায়না। মোহনা এবং অহনা খোশমেজাজে গল্প করছিল। হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে ওঠে। মোহনা ব্যস্ত হয়ে যায়,’তুমি বসো, আমি দেখে আসি কে এলো! আম্মা একটু অসুস্থতো তাই।’
অহনা মাথা নাড়াতেই মোহনা চলে গেল। দরজা খুলে দিতেই তার চোখ-মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে গেল। যেন কোনো খারাপ কিছু দেখেছে।
‘কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ফুফুকে কি দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি?’
‘হ্যাঁ, মানে না। ফুফু, আপনি আসুন।’
মামুন চৌধুরীর ছোটবোন মাহিনূর এসেছে। সাথে করে নিয়ে এসেছে তার একমাত্র মেয়ে নিহাকে। নিহা এতক্ষণেও মোহনার দিকে নজর দেয়নি। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়েই বলল,’আউ হানি! তুমি কতো কিউট হয়ে গেছ।’
মোহনা হাসার চেষ্টা করল,
‘আমি এমনিতেও কিউট।’
নিহা চারিদিকে তাকিয়েই কাউকে খুঁজতে লাগল,
‘বর্ষণ, মেমে কোথায়? ওদের দেখেছি না কেন? কোথায় তারা হানি?’
‘বড়ো ভাই চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছে ছোট ভাই কোথায় গেছে আমায় বলে যায়নি।’
‘ কখন আসবে জানো?’
মোহনা অনেকটা ঠোঁট বাঁকিয়েই বলল,’তুমি ডাকলেই চলে আসতে বাধ্য হবে।’
মোহনাকে অনেকক্ষণ না দেখে অহনাই বের হয়ে এলো। নিহার সাথে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিহার চোখ গেল অহনার ওপর,
‘ওয়াও! হাউ সুইট! হু আর ইউ বিউটিফুল গার্ল?’
অহনা উত্তর দেওয়ার আগেই মোহনা বলল,’আমার বন্ধু।’
আনিফা আসতেই মোহনা অহনাকে নিয়ে চলে গেল। মোহনার কপালে হাত। অহনাও সন্দিহান,
‘ওনারা কারা? ওনাদের দেখে তুমি এতো চিন্তিত কেন?’
‘ সেটা তুমি দুইদিনেই টের পাবে। নিহা একদম আমার মাথা খেয়ে নেবে। আর আমার দুই ভাই আছে না? তাদের পেছনে পড়বে। বর্ষণ ভাইয়ের পেছনে পড়েছিল প্রথমে। পাত্তা পায়নি বলে পরে মাহতিম ভাইয়ের পেছনে পড়েছিল। তার পরপরই চলে গিয়েছিল। জানি না, এবার কার পেছনে পড়ে। বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছিল আম্মার। নিহাকে আম্মা কখনোই ঘরের বউ করবে না। ও বাংলার কোনো কালচারই জানে না। বিদেশ থেকে এসে দু-একটা ইংরেজি বলেই আমার ভাইয়ের যোগ্য মনে করছে নিজেকে। যে কয়দিন থাকবে, তেজপাতা করে দেবে বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে।’
‘এতটাও খারাপ না। তুমি অযথাই চিন্তা করছ।’
‘ঠিক আছে। তুমি নিজেই দেখে নিও।’
সন্ধ্যা হতেই বর্ষণ ফিরে আসে। বারান্দা পেরিয়ে নিজের ঘরের কাছে আসতেই অহনার দিকে চোখ যায়। সে ঘর থেকে বের হচ্ছিল। চোখ সরিয়ে যেতে নিতেই দেখল নিহা এসে হাজির। অহনার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। বর্ষণ নিহাকে দেখেই যেন পালানোর পথ খুঁজছে। তার আগেই মেয়েটা তার বুকে তর্জনী রাখে। বর্ষণ অহনার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় নিহাকে দেখল।
‘ কী হচ্ছে এসব?’
নিহা ঠোঁটে কামড় দিয়ে বলল,’কিছুই না। অনেকদিন দেখিনি তোমায়, তুমি কি আমি আসাতে খুশি নও?’
‘তেমন কোনো ব্যাপার নয়। তবে আশা করছি অতীতের মতো হবে না।’
‘আমি নিজেকে চেঞ্জ করে নিয়েছি।’
বলেই তর্জনী আঙ্গুল আস্তে আস্তে বর্ষণের বুক ভেদ করে নিচে নিয়ে আসে। বর্ষণ এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিল। অহনা আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না। সেও চলে গেল। বর্ষণ বাধা দিতে পারল না। যেন সে বুঝাতে চাইছে নিহার সাথে তার কোনো কানেকশন নেই। নিহা বর্ষণকে কিছুটা ধা’ক্কা মেরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে,
‘হানি, আমি তোমাকে খুব মিস করেছি। তোমার কি কখনো এই সুন্দরীর কথা মনে পড়েনি?’
‘ কখনো না।’
রেগে যায় নিহা। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বর্ষণকে চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করে। বর্ষণ কিছুটা বিরক্তও হয়। তার জানা ছিল না বিদেশে গিয়ে নিহার এতোটাও অধঃপতন হবে। নিহা আস্তে আস্তে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেল বর্ষণের দিকে। চোখ বন্ধ করে চুমু খেতে চাইলেই বর্ষণ তার মুখে একটা পাতা গুঁজে দেয়। পাশে থাকা ফুলদানি থেকে নিয়েছে।
‘তুমি কখনো পরিবর্তন হবে, আমি আশা করিনা।’
পরপরই ঝটকা মেরে নিহাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
অহনা বর্ষণকে এমন নাকানিচোবানি খেতে দেখে বেশ হাসল। মোহনা এবং অহনা একসাথেই পড়তে বসল। হঠাৎ করেই নিহা আসায় বিরক্তি প্রকাশ করল মোহনা। তবে অহনা খুশিই হলো।
‘বসো আপু!’
‘নো নো, ডোন্ট কল মি আপু, অনলি নিহা।’
‘ আচ্ছা, নিহা বলেই ডাকব।’
‘কী করছ তোমরা? আমি ভীষণ বোরিং ফিল করছিলাম একা একা।’
‘আমাদের সাথে বসে গল্প করো।’
ওদের সাথে যোগ দিতে বর্ষণও এলো। তবে নিহাকে আশা করেনি। তবুও সে বসলো। হঠাৎ করেই মোহনা বলল,’সে যাই হোক, অনেকদিন পর আমার একাকীত্ব গুছালো। আমরা যদি এখন কোনো খেলা খেলি তাহলে কেমন হয়?’
অহনা বলল,’মন্দ না। তবে কী খেলা যায়?’
বর্ষণ বলল,’এখটা খেলা আছে, যেটা সবাই খেলে। ট্রুথ অর ডেয়ার।’
নিহা কিছুটা অনিচ্ছা প্রকাশ করল,’কিভাবে খেলতে হয়?’
অহনা হেসে বলল,’একদম সোজা! ট্রুথ নিলে সত্যি বলতে হবে এবং ডেয়ার নিলে আমাদের কথা মানতে হবে অর্থাৎ যা করতে বলব তাই করতে হবে।’
‘ ইন্টারেস্টিং! আই অলসো ওয়ান্ট টু ট্রাই।’
খেলা শুরু হতে যাবে তখনই খেয়াল করল তাদের পেছনে মাহতিম দাঁড়িয়ে আছে। মোহনাকে কড়া গলায় বলল,’তোর পড়া শেষ হয়েছে? আর ভাই, তুমিও কিনা সঙ্গ দিচ্ছ?’
অহনা এবং নিহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’তোমরা কখন এলে?’
নিহা সাথে সাথেই ওঠে গেল,’আই অউন্ট প্লে। বাই হানি।’
বলেই সে মাহতিমের কাছে চলে গেল। মাহতিমের অযথা রাগের পেছনের কারণ কেউ আন্দাজ করতে পারল না। আজ আরো তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছে। রেগে আছে আগে থেকে নাকি বাড়ি ফিরে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অহনা এবং মোহনা পড়ায় মনোযোগ দিল। বর্ষণ বের হওয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করছিল মাহতিম। সে বেরিয়ে যেতেই মাহতিমও বেড়িয়ে গেল। তার সঙ্গ নিল নিহা। বিষয়টা খেয়াল করল অহনা। মোহনা নিহাকে উদ্দেশ্য করে একবার বলেই ফেলল,’ছেলেবাজ কোথাকার।’
নিহা এবং মাহতিম একসাথে যাওয়ায় অহনার কিছুটা খারাপ লাগল। অকারণে সন্দেহও জন্মালো। পরপরই গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’তাতে আমার কী?’
অথচ মাহতিম ঘরে এসেই নিহাকে বলল,’তোমাকে আমাদের বাড়িতে ওয়েলকাম। এখন আমি শাওয়ার নেব। তুমি পরে এসো।’
‘না। আমি তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। এতো দেরী করলে কেন?’
‘ আমার কাজ ছিল।’
‘ কাজতো সারাজীবনই দেখলাম। জানো, তুমি আগের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছ। আমিতো চোখ সরাতেই পারছি না।’
‘অথচ একজন সেটা বুঝতে পারছে না।’
নিহা ব্রু কুঁচকে তাকাল,’অনেকদিন দেখিনি। একটু হাগ করি?’
বলেই মাহতিমকে জড়িয়ে ধরতে গেলে সে সরে যায়। একহাতে ধরে নিহাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়,’আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি অপেক্ষা করো।’
বলেই মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। নিহা রাগে ফুঁসে ওঠল। দুই ভাইয়ের থেকে অবহেলা সে আশা করেনি। তবে সেও নাছোড়বান্দা! যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা নেবেই। শান্ত হয়ে বসে থাকার মেয়ে সে নয়।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
গল্পটা সম্পর্কে নিজের মতামত জানাবে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership