ছায়া মানব ২ ১৯.

0
113

ছায়া মানব ২

১৯.
কলেজ শেষ করে বিকেলে বাড়িতে আসতেই ছোট্ট একটি মেয়ের সাথে ধা’ক্কা খেল অহনা। মাহতিমদের বাড়িতে কোনো ছোট সদস্য নেই , তাহলে এটা কে? জানতেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,’নাম কি তোমার?’

‘আনিকা নূর!’

‘ বাহ খুব মিষ্টি নামতো‌। তুমি এখানে কি করছ? তোমার মা কোথায়?’

‘মাম্মা এখানেই আছে। আগে বলো, তুমি কে? মাহতিম ভাইয়ের বাড়িতে কী করছ? তোমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেইতো?’

মেয়েটার এমন পাকনা কথা শুনে অহনা খুবই অবাক হলো। আশেপাশে দেখতে লাগল কেউ আছে কিনা। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,’কে তুমি খুকী?’

নূর রেগে ওঠে। অহনার থেকে কম নায় সে। মুখ ফুলিয়ে বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে বলল,’তোমার সাহস কী করে হয় এই বাড়ির ব‌উকে খুকী বলার? আমাকে দেখে কি তোমার বাচ্চা মনে হয়? আট বছর চলে আমার।’

অহনা হাসল,
‘আমি আসলে বুঝতে পারিনি তুমি এতোটা বড়ো। মাফ করো আপু। এবার বলো তুমি কে?’

‘এই বাড়ির ছোট ছেলের বউ।’

অহনার চোখ দুটো ছানাবড়া। এতো ছোট একটা মেয়ে এসব কী বলছে? এতোটা পাকা কথা বলতে পারে সে ভাবেনি। মোহনা আসতেই নূরকে দেখে হেসে কাছে আসলো,
‘কিরে, তুই আবার কোথা থেকে আসলি?’

আনিফা বের হয়ে এলো। সাথে মাহিনূর এবং মোহনার ছোট চাচি। নূরকে কাছে ডেকে বলল,’খুব শিঘ্রই নিয়ে যাব‌। দুষ্টুমি করবে না একদম। সবসময় মোহনার সাথে থাকবে। পাকনামো একদম কম করবে। মনে থাকে যেন।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে মহিলাটি চলে যায়। মোহনা সহসাই নূরকে কোলে তুলতে চাইলেই সে আরো ফেঁপে ওঠে,
‘আমি বাচ্চা ন‌ই আপু। আমাকে কোলে নেওয়ার কথা চিন্তাও করো না। কিছুদিন পর তোমার ভাবী হব আমি। মনে রেখো। আচ্ছা বলোতো মাহতিম ভাই এখনো আসছে না কেন?’

‘ খুব মিস করছিস মনে হয়?’

‘হ্যাঁ! আসার পর একবার‌ও দেখিনি। খুব মনে পড়ছে। তুমি কি একটু কল করবে?’

‘অবশ্য‌ই।’

অহনা হা করে তাকিয়ে আছে। ভাবল মেয়েটা ছোট বলে এমন করছে কিন্তু মোহনাও বাচ্চাটার সাথেই তাল মেলাচ্ছে। অহনা মোহনাকে জিজ্ঞেস করল কী হচ্ছে এসব?
মোহনা হেসে বলল,’আমার চাচাতো বোন এটা। ছোট থেকেই মাহতিম ভাইয়ের প্রতি একটু দুর্বল। মনে মনে বিয়েও করে নিয়েছে। বড়ো হলে ভাইয়াকেই বিয়ে করবে ও। এমনটাই মনে করে। কেউ বোঝাতে আসলে তার সাথে ভুল করেও আর কখনো কথা বলেনা।’

‘ওকে একা রেখে ওর মা চলে গেল?’

‘এই বিচ্ছু মেয়ের কথা চিন্তা করার কিছু নেই। ও সবাইকে জ্বালিয়ে খাবে, ওর কিছুই হবে না। তবে ওকে রেখে গেল কেন আমার জানা নেই।’

মোহনা আনিফাকে জিজ্ঞেস করল কেন নূরকে রেখে গেছে তার মা‌। আনিফা কিছুটা নরম কন্ঠে বলল,’ভাইজানের অপারেশন আগামী দিন। মেয়েটা খুব জ্বালাতন করে‌‌। তোর চাচি মেয়েকে আর স্বামীকে একা কী করে সামলাবে? জানিসতো মেয়ের খবর। তাই কয়েকদিনের জন্য রেখে গেল।’
_
অহনা গোসল করে আসলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। পেছন ঘুরতেই মাহতিমকে আবিষ্কার করল। গলা খাঁকারি দিয়ে মাহতিম বলল,’এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।’

‘ ভেতরে আসুন।’

মাহতিম আসতে নিতেই নূর এসে তার হাত টেনে ধরল। নূরকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলো মাহতিম। অহনার ঘরে আসলো দুজনেই। নূর অহনাকে বলল,’তোমার ঘরে আসতে চাইছে কেন ভাইয়া? আমার সাথে যেতে বলো।’

অহনা সাথে সাথেই বলল,’অবশ্য‌ই! মাহতিম ভাই, আপনার উচিত ছোট্ট, মিষ্টি নূরের সাথে সময় কাটানো। আপনি কিন্তু তাকে অবহেলা করছেন। সে বড়ো হলে আপনাকে বিয়ে করবে, এখন থেকেই সময় দেওয়া উচিত।’

মাহতিম হা করে পুরো কথা শুনল। বুঝতে পারল, অহনা সবটাই জানে। কিছু করার নেই। নূরকে সাথে নিয়ে বের হয়ে গেল। তবে অহনার ভাই ডাকা তার সহ্য হলোনা। মনে মনে বিড়বিড় করল কিছু একটা।

আনিফা অবাক হলো মাহতিমের ফিরে আসা দেখে। সবসময় অনেক দেরী করে। অথচ আজকাল খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসছে। আনিফা খাবার বাড়লো মাহতিমের জন্য। হঠাৎ করেই বর্ষণের কথা মনে পড়ছে। সাথে সাথেই কল করল। ওপাশ থেকে সালাম আসতেই আনিফা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বর্ষণের গলা ভেজা। কন্ঠ নড়বড়ে। তার কথা যেন থেমে আসছে। আনিফা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে বাবা? তোর শরীর ভালো আছে তো? এমন শোনা যাচ্ছে কেন?’

‘ আমি ঠিক আছি আম্মা। কল রাখো এখন।’

‘না! কী হয়েছে বল আগে।’

বর্ষণ শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। মাথা ঘুরছে। মোবাইলটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। আনিফা অনেকক্ষণ ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। কাঁদো কাঁদো হয়ে মাহতিমকে ডাকল। কোনো কিছু না বলেই বর্ষণকে আনতে বলল। নিশ্চয়ই সে বিপদে আছে। মাহতিম শুধু জিজ্ঞেস করল,’কোথায় আছে ভাই?’

আনিফা বলতে পারল না। মাহতিম তবুও ব্যস্ত হয়ে বের হলো। অনুজকে কল করে বলল বর্ষণের লোকেশন বের করতে। বেশী দেরী হলো না। কাছেই একটা ক্লাবে বর্ষণের লোকেশন দেখা গেল। মাহতিম দ্রুত সেখানে প্রবেশ করল। বর্ষণ টেবিলে মাথা রেখে পড়ে আছে। তার পাশে বসে থাকা দুজন মাহতিমকে দেখে পালালো দ্রুত। বর্ষণ তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। মাহতিম তাড়াতাড়ি তাকে সামলানোর জন্য গেল। ওয়াইন খেয়েছে অনেক। মাহতিম আঁতকে ওঠল‌‌। বর্ষণ কখনোই এসব খায় না। আজ তাহলে কেন খেল? তাকে এখানে নিয়ে এলোই বা কে? আশেপাশে সব ফাঁকা হয়ে গেল মাহতিমকে দেখে। সাহায্য করার মতোও কাউকে পেল না। এই অবস্থায় তাকে বাড়ি নেওয়াও সম্ভব হয়। আনিফা কষ্ট পাবে ছেলের অধঃপতন দেখে। মাহতিম বর্ষণের চোখে-মুখে পানি দিল। হালকা জ্ঞান আসতেই জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে ভাই? তুমি এখানে এলে কেন? জানো, আমাদের আম্মা কতোটা চিন্তা করছে? তুমি এমন বাচ্চাদের মতো কাজ করলে কী করে? এসব খেয়েছ জানলে কী হবে জানো?’

বর্ষণ ঝাঁপসা দেখতে পেল মাহতিমকে। হাসল ভীষণ। নেশা এখনো কাটেনি দেখে মাহতিম একের পর এক দশ গ্লাস পানি মারলো বর্ষণের মুখে। তারপর তার সম্বিৎ এলো। দ্রুত ওঠে দাঁড়াল,
‘কী হয়েছে এখানে?’

মাহতিম বিচলিত,’সেটা আমার প্রশ্ন, তুমি এখানে কী করছ? নেশা করেছ কেন? আম্মা না করেনি? আর তুমিতো এসব খাও না। আজ কেন?’

‘মন ভালো ছিল না। আজিজ বলল আসতে। তাই এলাম। ভালোই ছিল।’

‘এসব ভালো? এখন চলো, তার আগে এসব পরিবর্তন করতে হবে। আম্মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।’

বর্ষণকে প্রস্তুত করেই মাহতিম তাকে বাড়ি নিয়ে গেল। ছেলেকে সুস্থ, সবল পেয়ে আনিফা নিশ্চিন্ত হয়।

মাহতিম নিজের ঘরে চলে গেল। অনেকটা খাটাখাটনি গেল। এখনো কিছু মুখেও তুলেনি। নিহা তার জন্য খাবার নিয়ে এলো। আনিফা তাকে দিয়েই পাঠাল। বলল, ঘরেই পৌঁছে দিতে। নিহা আসতেই মাহতিম তাকে বসতে বলল। কিন্তু মেয়েটা সহজ কথা বোঝার নয়। মাহতিমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’আজ তোমাকে আমি খাইয়ে দেব‌।’

মাহতিম ওকে ছাড়িয়ে নিল,
‘তোমাকে একটা কথা বলি, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। তুমি চাইলেও কখনো আমার হতে পারবে না।’

‘কে সে?’

‘অহনা।’

‘এ বাড়িতে যে মেয়েটা থাকে সে?’

‘হুম!’

নিহা চলে যেতে চাইলেই মাহতিম তাকে আটকালো। নিহা তার চোখের দিকেও তাকাল না এবার। মাহতিম হেসে বলল,’এই যে তুমি যাকে পাও তার‌ই পিছু নাও, এটা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসতে হলে মনকে প্রাধান্য দিতে হয়। মন সবাইকে দেওয়া যায়না। এটা একজনের জন্য‌ই বরাদ্দ থাকে। যদি কাউকে দেখে তোমার হৃদস্পন্দন থেমে যায়? তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেও ভালো লাগেনা কিংবা শুধু তাকে ছাড়া নিজেকেই বৃথা মনে হয়, ভেবে নিও তুমি প্রেমে পড়েছ। প্রেম ছাড়া ভালোবাসা, বিয়ে এসব এক্সি’ডেন্টের মতো। আশা করি তুমি সবার পেছনে না পড়ে, সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজবে।’

নিহা আর একটা কথাও বলল না। চলে গেল মাহতিমের ঘর থেকে।

হঠাৎ করেই নূর এলো অহনার কাছে। অহনা চুল ঠিক করছিল। নূরের জন্য পারল না,
‘আমার বিষণ্ণ লাগছে। তুমি কি আমাকে ছাদে নিয়ে যাবে? মাহতিম ভাই‌ও গেল দেখলাম। আমি একা গেলে বকা খাব, তাই তুমি যাবে আমার সাথে?’

অহনা রাজি হয়ে গেল। চুলটা ঠিক করেই নূরের হাত ধরে ছাদের উদ্দেশ্যে র‌ওনা দিল।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here