ছায়া মানব ২ ২১.

0
110

ছায়া মানব ২

২১.
মাহতিম মাথা ওপরে তুলতেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভয় এবং লজ্জা জেঁকে বসেছে।
আনিফা নিজের কঠিন মুখশ্রী খুলল,’বাচ্চাদের সামনে এমন বোকামি করলে কেন?’

মাহতিম আমতাআমতা করে বলল,’নূর ভুল দেখেছে। তুমিও কি করে ওর কথা মেনে নিলে?’

‘তাহলে তুমিই ঠিক বলছ তাইতো? এটাই কি সত্যি বলে ধরে নেব? পরে আবার বোঝাতে আসবে নাতো?’

‘না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’

আনিফা আর কথা বাড়ালো না। উঠে গেল দ্রুত। মাহতিম‌ও কোনোমতে নিজের ঘরে গেল। কিন্তু মন টিকল না। একবার অহনার সাথে কথা বলা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। অহনার ঘরের দিকে র‌ওনা দিতেই কোমরে দুহাত রেখে সামনে দাঁড়িয়ে নূর,
‘অহনার কাছে যাচ্ছ তাই না?’

‘ক‌ই নাতো। আমিতো হাঁটছিলাম। অনেকটা খিদেও পেয়েছে তাই আরকি।’

‘বললেই হতো। আমি রান্না করে নিয়ে আসতাম। তুমি নিজের ঘরে যাও, আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি তোমার জন্য খাবার আনছি।’

নূর দৌড়ে যেতেই মাহতিম হাসলো। দৌড়ের সাথে সাথে তার পায়ের নূপুর ঝনঝন করে বাজছিল। মাহতিম এক মুহুর্তের জন্য কল্পনার জগতে পাড়ি দিল। গোলাপি গাউনে আবৃত অহনা। খোলা চুল, ঠোঁটে যেন আস্ত ফুলের দুটো পাপড়ি, জোছনা ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাহতিম তার গলদেশ গভীর ছুঁয়ে দেয়‌। নিজের হাতে থাকা নূপুরগুলো অহনার সামনে ধরতেই তার চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। পা বাড়িয়ে দেয় অহনা। মাহতিম যত্নসহকারে স্পর্শ করে অহনার কোমল দুটো পা। পরিয়ে দেয় অলংকার। পরপর‌ই নিজের সামনে পুরোপুরি সাজিয়ে দাঁড় করায়। থুতনিতে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে। নিজের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে‌। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চুম্বন করতে যাবে তার ঠিক এক সেকেন্ড আগেই তার হুঁশ ফিরে এলো‌। মোহনা চশমা ঠিক করে বলল,’কী একা একা বিড়বিড় করছ? কিসের নূপুরের কথাও বললে মনে হয়‌।’

মোহনার ধা’ক্কা খেয়েই মাহতিমের ধ্যান এসেছে। আর একটু দেরী হলেই হয়ত ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে পারত অহনাকে। অনেকটা রাগ প্রকাশ করল মোহনার ওপর‌। মাথায় গাট্টা মেরে বলল,’নিজের কাজে যা। বারতি বিষয়ে নাক গলাতে আসলে নাক টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’

‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিলে। এখন সেটা আমার দোষ নাকি? মূলত তোমার সাথে কথা বলাও এক প্রকার বোকামি।’

মাহতিম নূরকে পর্যবেক্ষণ করল। ছোট হ‌ওয়ায় রান্নাঘরের কোনোকিছুই নাগাল পাচ্ছে না। মাহতিম এই সুযোগে অহনার ঘরে যায়। অহনা শুয়েছিল। খুব বেশি ঘুমায় সে। সুযোগ পেলেই যেন বিছানা দখল করে নিতে চায়। উল্টো মুখ করে শুয়ে আছে। বিছানার ওপর লাগেজ‌ও দেখা গেল‌। তবে কি সে চলে যাওয়ার চিন্তা করছে? মাহতিম গলা খাঁকারি দিতেই অহনা উঠে পড়ল। মাহতিম ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখল অহনাকে। হাঁটুর নিচ অব্দি গুটানো লেগিংস এবং ছোট জামা গায়ে, চুলগুলো ওপরে করে আঁটকানো। হঠাৎ করেই বর্ষণের আগমন অহনার ঘরে‌। হাতে করে নিয়ে এসেছে এক বাটি বাদাম। একটু আগেও মন খারাপ করে বসে ছিল। কিন্তু সবটা মেনে নিয়ে ভাইয়ের সুখ চেয়ে ভাব জমাতে এলো‌। কষ্ট কিছুটা হৃদয়ে কোণে চাপা রেখেই তার আসা। তাড়াহুড়ো করে বলল,’একা একা ভালো লাগছিল না তাই শেয়ার করতে নিয়ে এলাম।’

অহনা দ্বিমত করল না। মাহতিম‌ও স্বাভাবিক হয়ে বলল,’ভালোই হয়। তোমার শরীর কেমন আছে এখন?’

‘আগের থেকে ব্যাটার।’
বলেই বাদামগুলো খাটে রাখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ফেলে দেয়। বর্ষণের মুখটা মলিন হয়ে যায়,
‘সরি! দেখতে পাইনি‌!’

‘ইটস্ ওকে! আমি তুলে নিচ্ছি।’
অহনা দ্রুত সেগুলো তুলতে লাগে। মাহতিম, বর্ষণ‌‌ও সাথে সাহায্য করল‌ কিছুটা‌। কিন্তু পারল না শেষ পর্যন্ত। প্যান্ট পরার একটা বাজে অসুবিধে, ভালোমতো মাটিতে বসা যায় না দুই ভাই বাহানা দিয়ে অহনাকেই সব তুলে নিতে বলল‌। তেমন কিছু মনে করল না অহনা। সে আপনমনে একটা একটা করে বাদাম তুলতে লাগল।
হঠাৎ করেই মাহতিম খেয়াল করল, বর্ষণের নজর অহনার পিঠের দিকে। পিঠের অনেকটা অংশ খোলামেলা। বর্ষণের নজর সেখানেই স্থির থাকল। মাহতিম সেটা সহ্য করতে পারল না। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো তার। দ্রুত অহনাকে আড়াল করে দাঁড়াল। মুহুর্তেই চোখ সরে যায় বর্ষণের। ইচ্ছে করে সে তাকায়নি। কিন্তু বেহায়া মন এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি‌। শত হোক, অহনার প্রতি এখনো সে দুর্বল।
মাহতিম অহনাকে বলল,’হয়েছে, আর তুলতে হবে না‌। উঠে যাও।’

‘ আর কয়েকটা শুধু।’

‘লাগবে না‌‌।’
মাহতিমের কঠিন গলা শুনে কেঁপে উঠল অহনা। সহসাই উঠে গেল। মুখ গম্ভীর করে সামনে দাঁড়াল। বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। বর্ষণের মনে হলো, মাহতিম অহনার একান্ত সময় দরকার। সে মূলত কাবাবে হাড্ডি হতেই এসেছিল। বিষয়টা বুঝতে পেরেই সে অনেকটা বিচলিত ভঙ্গিতে বলল,’আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমাকে কিছু লিফলেট তৈরি করতে হবে‌। অন্যদিন খাব, আজ যাই।’

বর্ষণ চলে যেতেই মাহতিম দরজাটা বন্ধ করে দিল। সাথে সাথেই আবার অহনার দিকে এগিয়ে এলো।
‘চলে যেতে চাইছ নাকি?’

অহনা নিজেকে শান্ত রেখেই বলল,’হুম! অন্যের বাড়িতে বেশিদিন থাকতে নেই। আমার যাওয়া উচিত বলে মনে করছি‌।’

‘আমি যেতে দেব না। তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।’

‘ আপনার সাথে কেন আমি থাকব? আমার বাড়ি রয়েছে গ্রামে‌। হয়ত আপনাদের মতো এতো বড়ো বাড়ি নেই। তবে ছোট্ট একটা বাড়ি রয়েছে। আমার মা-বাবার তৈরি করা। আমাদের জন্য ওটাই ঢের। বিলাসবহুল বাড়িতে অন্তত আমার থাকার কথা নয়।’

মাহতিম অহনার হাত চেপে ধরে। এতোটাই শক্ত করে যে অহনার কোমল চামড়ায় দাগ বসে যাওয়ার উপক্রম,
‘একটা বাচ্চা মেয়ের কথায় তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে? তোমার দিলে কি একটুও বাঁধবে না? নাকি কোনো মায়া নেই তোমার?’

অহনা হাতে ব্যথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করল। মাহতিমের খেয়ালে আসতেই সে হাত ছেঁড়ে দেয়। দাগ বসে গেছে অনেকটা। মাহতিম মাথা নত করে ফেলল,’সরি!’

‘ আ’ঘাত করে সরি বললেই সব সমাধান হয়ে যায়? কী মনে করেন নিজেকে? খুব শক্তিশালী? খুব বেশি না, একটু শক্তিশালী। আমিও আপনার সাথে পারব। খুব ব্যথা দিলেন। আমার জ্বালা করছে।’

মাহতিম ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই অহনা সরে যায়,’ব্যথা দিয়ে এখন করুণা দেখাতে আসছেন। লাগবে না আপনার এই বড়লোকি করুণা। চলে যান আমার সামনে থেকে।’

‘ সরি বললাম তো। মাথা ঠিক ছিল না‌। চাইলে শাস্তি দিতে পারো।’

অহনা সাথে সাথেই বলল,’তাহলে আমার সাথে ঠিক যা করেছেন আমিও তাই করব।’

‘তার আগে তুমি বলাটা একটু প্রাকটিস করো।’

অহনা বারবার ভুলে যায়। আপনি থেকে তুমিতে উন্নীত হতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে হয়তো। অহনা মাহতিমের মুখোমুখি দাঁড়াল। হালকা করে মাহতিমের দুহাত চেপে ধরল। হঠাৎ করেই এমন স্পর্শে শরীরে দোলা লেগে গেল। কিছুটা পিছিয়ে গেল অহনা। মাহতিম খানিকটা অবাক,
‘কী হলো? শাস্তিটা কী…!’

‘ দাঁড়াও! আমিতো শাস্তি দেওয়ার জন্য হাত ধরলাম। ভালোবেসে ধরিনি তাহলে আমার ধুকপুকানি বেড়ে গেল কেন?’

মাহতিম অবুঝ কথা শুনে হাসল,
‘হয়ত শরীরটাকে সংযত করে রেখেছ আমার থেকে কিন্তু মনকেতো আর বেঁধে রাখা যায় না। সে আমাকে অনুভব করছে!’

‘মোটেও না‌‌। বাজে কথা সব।’

অহনা পুনরায় মাহতিমের হাত ধরল। পুরো শরীরের শক্তি প্রয়োগ করেও কিছুই হলো না। উল্টো নিজেই ব্যথা পেল। ছলছল চোখে মাহতিমের দিকে তাকাল,
‘আর একবার ট্রাই করি?’

‘অবশ্য‌ই! যেমন‌ই হোক, তোমার ছোঁয়া আমার জন্য ভীষণ আনন্দের।’

অহনা পুনরায় মাহতিমকে ব্যথা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। জিম ধরা বডিকে কাবু করতে গিয়ে নিজেই কাবু। পুনরায় ব্যথা পেল‌। তবুও ক্ষান্ত হলোনা। কয়েকটা কিল ঘুষি বসিয়ে দিল মাহতিমের বুকে। টু শব্দ‌ও করল না সে। হেসেই উড়িয়ে দিল। অহনা হঠাৎ থেমে যায়। মাহতিমের বুকের বাঁ পাশে হাত রাখে। কান পেতে শুনল তার হৃদস্পন্দন। আচমকা বলে ওঠল,’তুমি কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখো?’

মাহতিম সাথে সাথেই বলল,’ভেতরে তোলপাড় চলছে‌। অনুভব করতে পারবে?’

অহনা কিছুটা সরে আসলো। বুকে হাত দিয়ে দেখল হৃদয় কেঁপে ওঠছে। থেকে থেকে অসহ্য এক পীড়া হচ্ছে। সহ্য করার মতো নয়‌।
‘আমি অনুভব করতে চাই।’

মাহতিম উজ্জ্বল বদনে অহনার সম্মুখে এগিয়ে আসে‌। আবেগঘন স্পর্শ করে তার কপোলদ্বয়। চোখ বন্ধ করে নেয় অহনা‌। মাহতিম হাত ক্রমশ অহনার গলদেশ ছাড়িয়ে কাঁধে নিয়ে যায়। অনুভূতিতে তলিয়ে যেতে থাকে অহনা‌। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য যেন। মাহতিমের পরশে ব্যাকুল সে। আজ রাত যদি সেজে উঠে স্পর্শে তবুও তার আপত্তি নেই। মাহতিম অহনার লতার মতো দেহখানি জড়িয়ে ধরে। চোখ বুঁজে প্রশান্তি অনুভব করে। মনে মনে উচ্চারণ করল,’এই স্পর্শের সমাপ্তি কখনোই শেষ না হোক।’

অহনার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যেতে চাইল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়‌। খিঁচে আসে চোখ-মুখ। নিজেও মাহতিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে‌। মনে হলো, চোখ বুঁজে প্রেম বিনিময় করতে থাকা দুটি বেনে ব‌‌উ পাখি। মাহতিমকে অবাক করে দিয়েই অহনা আচমকা বলল,’ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না‌। যুগ যুগ ধরে এভাবেই থাকতে ইচ্ছে করছে।’

‘ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন যদি আসে, তবে সেটা হবে মৃ’ত্যু।’

অহনা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ছাড়তে চায়না কোনোমতেই। প্রকৃতির চিরন্তন সত্যটাকে মেনে নিয়েই যারা যুগ যুগ ধরে একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখে তারা কি শেষপর্যন্ত পারে? কখনোই না। তবুও একটা মনোইচ্ছা। ভাবতে ভালো লাগে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মানুষ দুটির ভবিতব্য হয়ত জানা নেই। তবুও তারা কেমন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

গল্প সম্পর্কে জানতে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here