ছায়া মানব ২ ২২.

0
259

ছায়া মানব ২

২২.
অহনা আচমকা ছেঁড়ে দেয় মাহতিমকে। মুহুর্তেই মাহতিম কিছুটা নড়ে ওঠে,
‘তুমি ঠিক আছ?’

অহনা মাথা দুলিয়ে বলল,’আমি ঠিক আছি। তোমার এখন যাওয়া উচিত।’

‘ তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ?’

‘মোটেও না। তবে মনে হচ্ছে ভুল করছি।’

মাহতিম বেশ খানিকটা অবাক হলো। ভুল শব্দটা কখনোই তার মাথায় খেলে না। কারণ সমাধান থাকবেই সবকিছুর। মাহতিম অহনার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,’ভয় পাচ্ছ নাকি অনীহা?’

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব বাজে লাগছে। অনুভূতিগুলো‌ও বাধা দিচ্ছে বারবার। আমি পারছি না মেনে নিতে সময়টাকে।’

হঠাৎ করেই অহনার দরজায় করা’ঘাত হয়। চমকে ওঠে মাহতিম। দ্রুত অহনার হাত ছেঁড়ে দেয়। পরপরই নূরের গলা শুনতে পেল,
‘অহনা, তুমি কি মাহতিমকে লুকিয়ে রেখেছ?’

মাহতিম দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়। হাতে করে খাবার নিয়ে এসেছে নূর। মাহতিমকে দেখতেই কান্না করে দেয়। খাবারের থালা ছুঁড়ে ফেলে দেয়,
‘তুমি খুব খারাপ মাহতিম ভাই। খুব বাজে। পঁচা তুমি। পঁচা অহনার সাথে তুমি। খুব খারাপ তুমি, খুব, খুব।’

মাহতিম ওকে সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু নূর অহনাকে ভেঙচি কেটে দৌড়ে চলে যায়। মাহতিম‌ও তার পিছু করে। নূর দরজা বন্ধ করে দিল। টেবিল দিয়ে দরজা আটকে রেখে নিজে মুখ ভার করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে র‌ইল। কান্নায় পাহাড় হয়ে গেল যেন। ঠোঁট উল্টে কাঁদছে। এক পর্যায়ে হেঁচকি উঠে যায়। মাহতিম দরজা ধাক্কালো বেশ খানিক্ষণ। ভেতর থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নূর বলল,’আমার সাথে কথা বলবে না। চাই না তোমাকে। তুমি মিথ্যে বলো।’

‘মিষ্টি নূর। তুমি ভুল বুঝছ। আমার কথা শুনো।’

‘না শুনব না। তুমি চলে যাও।’

‘আমিও কষ্ট পেয়েছি। খুব খিদে পেয়েছে অথচ তুমি খাবার ফেলে দিলে। আমার বুঝি কষ্ট হয়না? এখন বের হয়ে না এলে আর খাব না কিছুই।’

নূর আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিল। তবে সাথে সাথে বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়াল। মাহতিম নূরের ছোট্ট দুটো হাত ধরে বলল,’এভাবে রাগ করলে হয়?’

‘তুমি অহনার হাত ধরেছ কেন?’

‘তুমি এখনো খুব ছোট। যখন বড়ো হবে তখন কেউ একজন আসবে তোমার জন্য‌ও। তুমি খুবই মিষ্টি। তখন তাকেই তোমার খুব ভালো লাগবে। কথা দিলাম, যদি কখনো কাউকে ভালোবাসো। আমি জোর করে হলেও তোমার সাথে তার মিল করিয়ে দেব।’

‘না, আমি তোমাকেই চাই। তোমার মতো সাহসী আর কেউ হবে না।’

‘ আমার থেকেও সাহসী হবে। খুব আদর করবে তোমাকে। অনেক অনেক চকলেট আর ভালোবাসা দেবে।’

‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না?’

‘বাসিতো। এতো মিষ্টি বোনকে ভালো না বেসে পারি?’

‘তাহলে আমি বড়ো হয়ে তোমাকেই বিয়ে করব।’

নূরের চোখ লাল। গোল গোল চোখে আশা নিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতিম মিষ্টি মুখের নূরকে কষ্ট দিয়েও কথা বলতে পারছে না। কী করে এতো ছোট একটা মেয়েকে সবটা বোঝাবে? তবুও বলল,’তুমি বড়ো হতে হতে আমি তখন বুড়ো হয়ে যাব। তুমি সুন্দরী হবে, আর আমার দাঁত পড়ে বৃদ্ধ হয়ে যাব। তখন তোমার সাথে আমাকে মানাবে? তোমার সাথে মানাবে আরো সুন্দর, সাহসী, সুঠাম ছেলেকে।’

‘সে কি তোমার মতো হবে?’

‘আমার থেকেও হাজার গুণ ভালো হবে।’

‘না, হাজার গুন না। তোমার মতো হবে?’

মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’হ্যাঁ হবে। আমার মতোই হবে।’

‘তোমার মতো শক্ত হাত থাকবে?’

মাহতিম হেসে বলল,’হ্যাঁ থাকবে।’

‘তোমার মতো চুল, নাক, কান, ঠোঁট সব থাকবে?’

‘থাকবে।’

নূর কিছুক্ষণ ভাবলো। গালে হাত দিয়ে ভাবছে। এক আঙুলে ফুলকো গালে গর্ত তৈরি করল। মায়াবী লাগছে ভীষণ। সহসাই বলল,’না, চাইনা তোমার মতো কাউকে। আমার তোমাকেই লাগবে।’

হতাশ হয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। এতক্ষণ বুঝিয়েও কোনো লাভ হলো না। মেয়েটা কিছুই বুঝল না। দিনদিন তার পাগলামো বাড়ছে। এটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। মাহতিম কিছু বলার আগেই নূর ওকে জড়িয়ে ধরল,’তুমি অহনার কাছে যাবে না। ও পেত্নির মতো। আমাকে দেখো, আমি সুন্দর, হাতগুলোও সুন্দর। আরো বেশি সুন্দর হতে মেকআপ লাগাব দেখে নিও।’

মাহতিম কোনোমতে বলল,’ঠিক আছে, আমার মিষ্টি পরী।’

মুহুর্তেই নূরের মুখে হাসি ফুটল। মাহতিমের দু’গালে চুমু খেল তৎক্ষণাৎ। আবারো জড়িয়ে ধরে ভুবনমোহিনী হাসির রেখা তুলল।

বর্ষণ রাতের বেলা ছাদে বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অহনাকে সে ভুলতে পারছে না। ভেতর থেকে কষ্টরা বেরিয়ে আসছে। দেয়ালে আঘাত করল হাত দিয়ে। অনেকটা অংশ কেটে গেল। ঘামছে খুব। কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না।
নিহা বর্ষণকে খুঁজছে। তার জন্য মায়া হচ্ছে। অনেকক্ষণ খুঁজেও পেল না। মোহনাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল ছাদে গেছে। নিহা আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। দ্রুত ছাদে চলে গেল। বর্ষণ ছাদে বসে পড়েছে। একা একা কান্না করতেও যেন সুখ। কষ্ট পেলে কান্না করে হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করা উচিত প্রকৃতির কাছে। সেও তার ব্যতিক্রম করছে না। হঠাৎ করেই তার কষ্টের পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। পেছন থেকে নিহা তার কাঁধ স্পর্শ করতেই বেশ চমকে ওঠে। কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ঝরঝর করে কেঁদে দিল। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আচমকা নিহাকে জড়িয়ে ধরল। নিহা অবাকের চরম পর্যায়ে। যে ছেলেটা তাকে দূরে সরিয়ে দিত। আজ সে নিজেই তাকে আপন করে নিল। নিহাও কাঁপা কাঁপা হাতে বর্ষণকে জড়িয়ে ধরল। এতদিন সে অনুভব করতে পারেনি জড়িয়ে ধরার উষ্ণতা। আজ হঠাৎ করেই তার অনুভূতিরা জেগে ওঠল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো। বর্ষণ নাক টেনে বলল,’ও আমাকে ভালোবাসেনি। আমি বলেছিলাম, ওকে চাই আমি। আমার কথা একটুও ভাবল না।’

নিহা কিছু বলল না। বলার মতো শব্দ হয়ত গুছিয়ে উঠতে পারেনি। বর্ষণ পুনরায় বলল,’আমার মধ্যে কিসের অভাব ছিল, যার জন্য আমাকে ভালোবাসতে পারেনি? আমি কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না? এতোটা পথ পাড়ি দিলাম ওর জন্য। আম্মাকে নিজ মুখে নিজের বিয়ের কথা বললাম। ওকে ভালোবাসি বললাম। কিন্তু ও মুখ ফিরিয়ে নিল। কেন করল এমনটা?’

‘শান্ত হ‌‌ও। মূলত ও তোমার যোগ্য ছিল না। তার কথা ভেবে কেঁদো না যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। ভুলে যাও সব। একটা দুঃস্বপ্ন মনে করো সবটা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি সহ্য করতে পারছি না এই বিরহ। বুকের ভেতর খুব ব্যথা হচ্ছে‌।’

নিহা বর্ষণকে শান্ত করার জন্য বলল,’শুনেছি মন খারাপের সময় খাবার খেলে মন ঠিক হয়ে যায়। আমার কাছে চকলেট আছে তুমি খাবে?’

বর্ষণ শান্ত হলো না। নিহা ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বর্ষণ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। নিহা মৃদু হেসে ওর মুখে চকলেট পুরে দিল।’

চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,’কান্না করেছ, একদিক থেকে ভালোই হলো। মনটা হালকা হয়েছে। এবার সব ভুলতে সহজ হবে তোমার জন্য। এখন হাসো!’

বর্ষণ হাসার চেষ্টা করল,’থ্যাঙ্কস্! আমার মন খারাপে পাশে থাকার জন্য।’

‘উঁহু! নো থ্যাঙ্কস্! আমিতো তোমার বন্ধু হতে পারি তাই না?’

বর্ষণ মুহুর্তেই হাসল। তারা দুজনেই চন্দ্রবিলাসে মনোযোগ দেয়। বর্ষণ হাজারো অভিযোগ করছে নিহার কাছে। বিভোর হয়ে নিহা তার কথাগুলো শুনছে। আজ আর আকর্ষণ নয় বিমুহিত মনে হচ্ছে। আপন মনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে আওড়ে নিল,’ভালোবাসা কখনো প্রাণ বিনে হয়না। তবে তার সত্তাটাই মহৎ। সত্তা হতে সত্তার মিলনেই ভালোবাসা হয়। যদি তুমি বুঝে নাও, আমিও মিলিয়ে নেব।’

অহনা দ্বিধায় আছে। চলে যাবে নাকি থাকবে বুঝতে পারছে না। মাহতিমের প্রতি আকাশ সমান অনুভূতি থাকলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে না। বুঝতে পারছে না সত্যিকারের ভালোবেসেছে নাকি সবটাই মোহ! অথচ মাহতিমের চোখে-মুখে নিজের জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছে। মনে হয়না সেটা মিথ্যে ছিল। লাগেজটার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল। পুনরায় সেটা খাটের ওপর তুলল। প্রয়োজনীয় ব‌ইগুলোও গুছিয়ে নিল। আপাতত সব সমাধান। সকালেই বিদায় নেবে বলেই ঠিক করে। হঠাৎ করেই খেয়াল করল আনিফা এসেছে। সে একা নয় সাথে মামুন চৌধুরী‌ও রয়েছে। মৃদু হেসে মামুন বলল,’ভেতরে আসতে পারি?’

অহনা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দ্রুত ওঠে গিয়ে লাগেজটা নিচে রেখে বলল,’আসুন। এটাতো আপনাদের‌ই বাড়ি। পারমিশন নিতে হবে কেন?’

ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই আনিফা বলল,’এখন তুমিও আমাদের বাড়ির সদস্য।’

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

গল্প সম্পর্কে জানতে সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here