ছায়া মানব ২ ৩৬.

0
117

ছায়া মানব ২

৩৬.
জয়ন্তের আদেশেই মাহতিমকে বাড়ি আনা হয়। সে দ্বিমত করেছিল কিন্তু কেউ তার কথা শুনেনি। এই মুহুর্তে একটু রেষ্ট নেওয়াটাই ব্যাটার‌‌। আসার সময় অহনা কথা বলেছে অনুজের সাথে। ছেলেটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় অহনা কিছুটা বিভ্রান্তচিত্তেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অনুজ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অহনা কিঞ্চিত হাসার চেষ্টা করে বলল,‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! আপনার জন্য‌ই মাহতিম রক্ষা পেল।’

অনুজ কথার পিঠে বলল,‘এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই। বন্ধুকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য ছিল। আমি শুধু বন্ধুকে সাহায্য করেছি। সত্যি বলতে ও খুব স্ট্রং, তাই পেরেছে উঠে আসতে। অন্য কেউ হলে কখনোই পারত না।’

‘হ্যাঁ! তবুও, আপনার সাহায্য না পেলে হয়ত..’

‘কিছুই হতো না। আমি ছিলাম তো। আশা করি এবার সুস্থ হয়ে আবার কাজে লেগে পড়বে।’

অহনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। পুনরায় কিছু বলার আগেই বিদায় নিতে হলো। কারণ বর্ষণ, মামুন দাঁড়িয়ে আছে। অনুজকে থাকতে হলো মাহতিমের কাজের প্রেক্ষিতে।

দুপুরের সময় খাবার টেবিলে সবার খুশির জোয়ার ওঠল। বর্ষণ খাওয়ার ফাঁকে টেবিলের নিচ দিয়ে নিহার পায়ে আ’ঘাত করতে চাইল। কিন্তু সেটা অসাধাণতায় মাহতিমের পায়ে গিয়ে লাগল। আচমকা সে হেসে ওঠল। সবাই কিছুটা অবাক। মাহতিম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,‘কিছু না।’

বর্ষণ পুনরায় পা বাড়ালেই মাহতিম তার পায়ের ওপর পা রাখল। বর্ষণ প্রথমে ভেবেছে এটা নিহার পা। পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙল নিহা এবং মাহতিমের দৃষ্টি দেখে। নিহা একমনে খেয়েই যাচ্ছে। তার কোনো ব্রুক্ষেপ নেই। এদিকে মাহতিম মিটিমিটি হাসছে। বর্ষণ দ্রুত ছল করে নিচে তাকাল। দেখল সে এতক্ষণ মাহতিমকে বিরক্ত করছিল। বিষয়টা হজম হতেই আড়ষ্ট হয়ে পড়ে সে। দ্রুত খাবার খেতে শুরু করে। অহনা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে একনজর দেখছে সাথে সাথেই মাহতিমকে দেখছে। হঠাৎ করেই মাহতিম অহনাকে চোখ মারল। অহনা হকচকিয়ে ওঠে। হালকা কেঁশে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। তাদের এই মিলবন্ধন আনিফার নজরে এলো। কিছু মনে করল না। তাদের এখন একটু দুষ্টুমি করার বয়স, করতেই পারে। সবার সামনেই কথা পাড়ল,
‘এখনতো সবাই আছে। আমরা চাইলে কিছুদিনের মাঝেই বর্ষণ আর নিহার বাগদান সম্পন্ন করতে পারি।’

বর্ষণের আগেই মাহতিম বলল,‘যত তাড়াতাড়ি পারো করে নাও।’

সবাই ওর দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে। দ্বিধায় পড়ে যায় মাহতিম। মনে মনে বলল,‘আমি কি কিছু ভুল বললাম? সবাই এভাবে দেখছে কেন আমাকে? আরেকবার বলব?’
সাথে সাথেই বলল,‘ভাইয়ের বিয়েতে খুব মজা হবে তাই আরকি।’

মোহনা বলল,‘সেটা তোমার ভাবার বিষয় নয়। ভাইয়ার পর তোমার সিরিয়াল তাই এত খুশি।’

অহনার কাঁশি উঠে যায়। মোহনা সবসময় মুখের উপর কথা বলে দেয়। অবস্থা বুঝে কথা বলতে পারে না। আনিফা কিছুটা গরম চোখে তাকাতেই মোহনা থেমে যায়।
পরপরই মাহিনূর বলল,‘ভালো কথা বলেছেন। নিহার বাবাও এটেন্ড করতে পারবে। কাল বলল, দুই দিনের মাঝেই আসবে। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে থাকতে চায়।’

মামুন মাহতিমকে বলল,‘মির্জার ছেলেকে বলিস। ডেকোরেশনের কাজটা সেই করবে। আর বাকিটা আমি দেখছি। আশা করছি সবটা সুন্দরভাবেই সমাধান হবে।’

‘জ্বী বাবা!’

তৎক্ষণাৎ বর্ষণ বলল,‘আমার কোনো কাজ নেই?’

সবাই হেসে ওঠল। মোহনা বলল,‘তুমি সবার জন্য শুঁটকির ভর্তা বানাবে, এটাই তোমার কাজ।’

আনিফা পুনরায় মোহনাকে থামিয়ে বলল,‘অনেক কাজ করতে হবে। মাহতিম অসুস্থ, তাই ওকে ভার দিলে চলবে না। তোকেই সব সামলাতে হবে।’

‘আমি পারব। ভাইয়ের এনগেজমেন্ট, আর আমি বসে বসে দেখব? তা হবে না। আমিই সবটা আয়োজন করতে পারব।’

মাহতিমের কথায় আর কেউ দ্বিমত করল না। তিনদিন পরেই আয়োজন হবে। আগেই সব আত্মীয় স্বজনদের বলে দেওয়া হয়েছে।
খাওয়া শেষ করেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক কেনাকাটা করতে হবে। আয়োজনের বিষয়টা ছেলেরা দেখলেও সাজগোজের ব্যাপারটা মেয়েদেরকেই দেখা উচিত। মোহনা প্রথমেই ভাবতে শুরু করল, পোশাক নিয়ে। কে কী পরবে তা নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। সাথে আছে মেকআপ।

বিকেলে একজন স্বর্ণকারকে আসতে বলল আনিফা। যে যার পছন্দমতো নিয়ে নেবে। মাহতিম সোফায় বসে ফেসবুকিং করছিল। এমন সময় স্বর্ণকার আসে। সবাইকে ডাকল মাহতিম। আসতেই নিজে আবারো মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকে। মোহনা দৌড়ে গিয়ে অহনাকেও নিয়ে আসে।
অহনা একপাশে বসে আছে। তার নজর রয়েছে মাহতিমের দিকে। নিহা কয়েকটা গলার হার পছন্দ করল‌। একটু পর খেয়াল করল, পছন্দের পরিমাণ অনেক বেশি। বর্ষণ আসতেই নিহা বিচলিত হয়ে একটা নেকলেস তার দিকে এগিয়ে দিল,‘এটা সুন্দর না? পরিয়ে দাও।’

বর্ষণ কিছুটা নাক কুঁচকে বলল,‘এটা ভালো লাগছে না। তুমি বরং তার পাশেরটা নাও।’

নিহাও ঠোঁট বাঁকা করে অন্যটা নিল। নিহা হারটা রেখে দিতেই আগ্রহবশত অহনা সেটা হাতে নেয়‌। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই আবার রেখে দেয়। আনিফা ওকে বলল,‘তুমিও পছন্দ করো। কোনটা ভালো লাগছে তোমার? যেটা ভালো লাগবে, সেটাই নাও।’

‘না, আমার লাগবে না। আমি এসব ব্যবহার করিনা। মার্কেটে গেলে তখন নিয়ে নেব।’

‘একটা হলেও নাও। তুমি কিন্তু আমাদের বাড়ির সদস্য‌ই। পছন্দ হলেই নিয়ে নাও।’

অহনা আর কথা বলল না। সে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইল। বাঁকা নজরে একবার মাহতিমের দিকে তাকাল। সে মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে আছে এখনো। তবে তার মনোযোগ ছিল অহনার দিকে। কথাবার্তাও শুনেছে।

সবার কেনাকাটা প্রায় শেষ। আনিফা আবার বলল,‘অহনা, তুমি কি নেবে না? পছন্দ হয়নি?’

অহনা ইতস্তত করে বলল,‘আমার লাগবে না। আমি গয়না ব্যবহার করিনা।’

‘আচ্ছা, এসব পছন্দ না হলে আমি আরো কিছু ডিজাইন আনতে বলি। আমারো এসবের মধ্যে ততটা ভালো লাগেনি।’

অহনা চুপ করে র‌ইল। মোহনার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে নিজের ঘরে গেল। নিহাও অহনার কাছে বসে আছে‌। তারা প্ল্যান করছে পুরো দিনটা কীভাবে কাটাবে সেটা নিয়ে। মাহতিম অনেকক্ষণ কানে ইয়ারফোন গুঁজে বারান্দায় পায়চারী করছে। বারবার অহনার ঘরের দিকে নজর দিচ্ছে।
এক পর্যায়ে নিহা এবং মোহনা বের হতেই সুযোগ বুঝে সে অহনার ঘরে গেল। অহনা কথা বলছিল ওসমানের সাথে। মাহতিম আসতেই কলটা রেখে দিয়ে হাসল। দ্রুত এগিয়ে এলো,
‘এখন কেমন আছ? মাথায় ব্যথা আছে এখনো?’

মাহতিম ধীর চোখে তাকাল অহনার দিকে,
‘আমি একদম ঠিক আছি। দৌড়াতেও পারব এখন। তুমি বলো, গয়না নিলে না কেন?’

অহনা কিছুটা ভেবে বলল,‘আমি এসব গয়না ব্যবহার করিনা। আমি বিবাহিত ন‌ই যে স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করব।’

‘বিবাহিত না হলে পরা যায় না?’

‘তেমনটা বলিনি। তবে….’

‘তবে কী? উত্তর নেই তোমার কাছে।’

মাহতিম অহনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। একহাত পেছন থেকে বের করে আনে। অহনা খেয়াল করেনি। একটা বাক্স! মাহতিম ওকে পেছনে ঘুরিয়ে বলল,‘সর্বনাশী তুমি! তোমার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ আমাকে ধ্বংস করে দেয়‌। আমি বিধ্বস্ত হ‌ই বারবার।’

অহনার টনক নড়ে ওঠে। মৌনতা বাড়িয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। মাহতিম ওর গলদেশ স্পর্শ করতেই আরেক দফা কেঁপে ওঠে। মাহতিমের হাতের ওপর হাত রাখতেই বুঝতে পারে তাকে স্বযত্নে অলংকার পরিয়ে দিয়েছে। অহনা বাঁকহারা! অভিভূত হয়ে তাকাল‌। মাহতিম তার মৃদুমন্দ চুলগুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে হারটা পরিয়ে দেয়‌। পরপরই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,‘পছন্দ হয়েছে?’

অহনা আয়নার দিকে না তাকিয়েই বলল,‘তোমার দেওয়া সবকিছুই আমার পছন্দের, সবচেয়ে প্রিয়।’

মাহতিমের ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হয়। অহনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে,
‘দেখো, আমাদের কত সুন্দর মানিয়েছে তাই না?’

অহনা মৃদু হাসল। অহনা বিকেলে হারটা শুধু একবার ছুঁয়ে দেখেছিল, তখন খেয়াল করেছিল মাহতিমের নজর নেই সেদিকে। অথচ সে আলগোছে দেখে নিল সবটা। সেই হারটাই নিয়ে এলো অহনার জন্য।
অহনা বাঁধন ভেঙে বের হতে চাইল। মাহতিম আঁটকে দিয়ে বলল,‘বললে নাতো, আমাদের ভালো মানিয়েছে না?’

‘তুমি পাশে থাকলে প্রকৃতিটাও আমার কাছে নতুন করে সেজে ওঠে। জানো, তখন‌ই ভয়টা জেঁকে বসে। দিশেহারা লাগে। কেমন যেন হারানোর ভয়। আমি চেষ্টা করেও এই ভয় কাটাতে পারিনা। অগোচরে কারো উপস্থিতি টের পাই। কেন হয় আমার সাথে এমন?’

‘বেশি চিন্তা করো তাই। আমরা কখনো আলাদা হব না‌। একে অপরের হয়েই থাকব আজীবন। তুমি আমার, আমি শুধুই তোমার। দেখো, আমাদের মাঝে দূরত্ব নেই। কোনো বাধাই কখনো আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারবে না। মিছেমিছি ভয় করো না।’

‘তাই যেন হয়।’

হঠাৎ করেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে এলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অহনার হৃদয় কেঁপে ওঠে। হঠাৎ প্রকৃতি এত রাগ দেখাচ্ছে কেন? সে কি কোনোকিছুর আগাম সতর্কতা দিচ্ছে? অহনা চোখ সরিয়ে নিল। আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরল অজানা এক ভয়।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here