ছায়া মানব ২ ৩৮.

0
133

ছায়া মানব ২

৩৮.
গভীর রাত। অহনা দরজা কিছুটা খুলে উঁকি দেয়। মাহতিম এখনো আসছে না দেখে বিচলিত পায়ে হাঁটতে থাকে। পায়চারির পাশাপাশি দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে।
মাহতিম আসতে কিছুটা দেরি করল। কিছু কাজ ছিল, তা শেষ করেই এলো। এসেই অহনাকে বলল,‘চলো, এবার যাই।’
অহনা আনন্দচিত্তে মাহতিমের হাত ধরে। তারা বের হয়ে পড়ে নির্জন কোথাও সময় কাটাতে। সদর দরজা পার হতেই নিহা আর বর্ষণের মুখোমুখি। অপ্রস্তুত হয়েই মাহতিম জিজ্ঞেস করল,’তোমরা কোথা থেকে আসলে?’

বর্ষণ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,‘একটু বাইরে গিয়েছিলাম। নিহা জোরাজুরি করছিল তাই।’

নিহা তার হাতে মৃদু থা’প্পড় দিয়ে বলল,‘আমি জোরাজুরি করলাম না কি তুমি করেছ? আমি তো যেতেই চাইনি। তুমি জোর করে নিয়ে গেলে।’

বর্ষণ কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,‘সেসব বাদ কিন্তু অহনাকে নিয়ে তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

মাহতিম ভাবতে ভাবতেই নিহা বলল,‘যে কাজে আমরা গিয়েছি সেকাজেই। এতো প্রশ্ন করো কেন? চলে আসো, ওদের সময় দাও।’

‘কিন্তু!’

‘আর কোনো কিন্তু নয়। চলো তুমি।’

নিহা বর্ষণের এক হাত চেপে ধরে নিয়ে গেল তাকে। অহনা কিছুটা অবাক হয়েই মাহতিমকে জিজ্ঞেস করল,‘ওদেরতো বিয়ে হবে। সব ফিক্সড করা, তবুও তারা এত লুকোচুরি করে বের হলো কেন?’

‘ওদেরকেই জিজ্ঞেস করো।’

মাহতিমকের কথার পিঠেই অহনা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মাহতিম ব্রু কুঁচকে শুধায়,‘কোথায় যাও?’

‘তুমিইতো বললে ওদের জিজ্ঞেস করে আসতে‌।’

‘বললেই যেতে হবে? আসো, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘দেরিতো তুমি করলে। আচ্ছা চলো।’

অহনা‌ কিঞ্চিত হেসে মাহতিমের হাত ধরল। তারা গাড়িতে গিয়ে বসল। অহনা জানালার বাইরে নজর আবদ্ধ করে পরিবেশ দেখছে। সবকিছু কেমন শান্ত। নিশাচরের মতো কেবল তারাই জেগে আছে। মাহতিম আচমকা বলল,‘গ্লাসের বাইরে মুখ দিও না।’

‘কেন?’

‘শুনেছি এই রাস্তার ধারে ধারে ভূতেদের আনাগোনা। সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই ঘাড় মটকে দেয়।’

অহনার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঢোক গিলে বাইরে থেকে মুখ সরিয়ে নিল। পরপরই বলল,‘গ্লাস ওপরে তোলো।’

‘ভয় পাচ্ছ নাকি?’

অহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,‘আমি তোমার মতো ভীতু ন‌ই। যথেষ্ট সাহসী আমি। এসব বানিয়ে কথা বলে আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না।’

‘তাহলে চলো, আজ ভূতেদের সাথে ডিনার সেরে আসি।’

অহনার মনে হলো কয়দিন আগের কথা। মাহতিম তাকে প্রচুর ভয় দেখিয়েছিল। আচমকা বলে ওঠল,‘এমন করলে আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়ব। সেদিনের ভয় এখনো যায়নি। তার ওপর তুমি নির্জন রাস্তায় এসব বলছ।’

‘আমি কিছু বলিনি। তুমি নিজেকে সাহসী বলেছ তাই বললাম। তুমি আসলে ভয় পাও। যদিও আমি সত্যিই বলেছি, এদিকে ভূতের আনাগোনা বেশি। কয়েকদিন আগেও একটা মেয়ে আর তার বয়ফ্রেন্ড যাচ্ছিল। মাঝরাস্তায় মেয়েটাকে ভূতেরা অপহরণ করে নিয়ে যায়।’

অহনার ভেতরে ভয়ের ছাপ দেখা যায়। নির্জনে ভূতের কথা শুনে আত্মা কেঁপে ওঠে। কোনোরকমে বলল,‘মেয়েটাকে অপহরণ করে কী করেছে?’

‘ভূতেদের রাজার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ভূতের রাজার মেয়েটাকে ভালো লাগে তাই তাকে…

‘বিয়ে করল নাকি?’

‘কথা শেষ করতে দেবে তো নাকি? বিয়ে করে না। র’ক্তের স্বাদ ভালো হ‌ওয়ায় ঘাড় মটকেছে।’

অহনার শরীর শিহরিত হয়ে ওঠল। হঠাৎ যেন বাতাসের ঝাপটা লাগল শরীরে। অকপটে বলল,‘ছেলেটা তার গার্লফ্রেন্ডকে বাঁচায়নি?’

‘সেতো আর আমার মতো সাহসী না। তাকে একটা পুঁচকে ভূত এসে খেয়ে নিল।’

‘তুমি সত্যি বলছ?’

অহনা মাহতিমের দিকে কিছুটা সরে আসে‌। বাইরের দিকে তাকাতেই যেন সেই পুঁচকে, ছোট্ট ভূতকে দেখতে পেল‌। ভয়ের চোটে আরো কিছুটা সরে আসে‌। দূরে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,‘ওটা কি ভূত? দেখো, কেমন তাকিয়ে আছে।’

মাহতিম বুঝতে পারল, ভয়ের চোটে অহনা চারিদিকেই এখন ভূত দেখবে। বলল,‘এবার কী হবে? এটাতো সত্যিই সে ভূত। এবার আমাদের কী হবে?’

অহনা চিৎকার করে মাহতিমের শার্ট খামচে ধরে। চোখ বন্ধ করে থাকে। মাহতিম বলল,‘ভূতটা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। তুমি শক্ত করে ধরো আমাকে।’

মাহতিম গাড়ি থামিয়ে দেয়। অহনার কার্যকলাপ দেখছে সে। মৃদু আওয়াজে হাসছেও। এক পর্যায়ে অহনা চোখ না তুলেই বলল,‘ভূতটা গেছে?’

‘না, আমার দিকে এগিয়ে আসছে।’

অহনা কেঁদে ফেলে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মাহতিমকে। ভয়ে তার হৃদস্পন্দন অস্থির। মাহতিম এক হাতে অহনাকে আঁকড়ে ধরে,
‘তুমি না সাহসী? অযথা কেন ভয় পেলে? আমিতো মজা করেছিলাম।

অহনা নাক টেনে মাথা তোলে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে তারা এখনো আগের জায়গাতেই,
‘তুমি আমার সাথে মজা করলে? আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না। এখানেই নেমে যাচ্ছি আমি।’

‘রাগ করো কেন? আমি এমনিতেই বললাম।’

অহনা ফুঁপিয়ে ওঠে,‘আমার মনের অবস্থা কী হয়েছিল জানো? নির্জন রাস্তায় একটা মেয়েকে এনে তাকে ভয় দেখাচ্ছ! এমন বাজে মস্তিষ্কতো তোমার ছিল না!’

‘এই পাগলী, এসব কী বলছ? তুমি কী কোনো অপরিচিত মেয়ে? আমার গার্লফ্রেন্ড তুমি। শুধু তাই নয় কিছুদিন পর বিয়ে করব আমরা। অথচ তুমি এখনো আমাকে পর ভেবে যাচ্ছ। আচ্ছা সরি! আমার মজা করা উচিত হয়নি। আর কখনো এমনটা করব না। এখন চলো, আমরা পৌঁছে গেছি।’

‘কোথায় যাব?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

মাহতিম অহনাকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ায়। অহনা অবাক হলেও কিছু বলল না। কিন্তু অনেকক্ষণ পর বলেই বসল,‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘আর একটু পর জানবে।’

‘না, আগে বলো। আমি আর এক পাও যাব না‌। ভয় হচ্ছে প্রচুর। আমার ইচ্ছে করছে না জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করতে। অদ্ভুত সবকিছু।’

‘আর সামান্য পথ। এক মিনিট লাগবে।’

অহনা পেছন ঘুরে যায়। যাবে না বলেই ঠিক করে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে। অজানা ভয় কাজ করছে মনে। আচমকা মাহতিম ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। অহনা চিৎকার করে ওঠে,‘নামাও আমাকে।’

মাহতিম কোনো কথা বলল না। মূর্তির মতো হয়ে গেল সে। অহনার ভয় বেড়ে গেল। এক মুহুর্তের জন্য মাহতিমকে তার চিনতে অসুবিধা হলো। মনে মনে দোয়া পড়ে বলল,‘তুমি আমার মাহতিম নও। সত্যি কি কোনো ভূত ভর করল নাকি তোমার ওপর? তুমি মাহতিম হতেই পারো না।’

মাহতিম অহনাকে নামিয়ে দেয়,
‘যাও‌। চলে যেতে পারো।’

অহনা ছাড়া পেয়ে কয়েক পা ফেলে পুনরায় ফিরে তাকায়,‘তোমাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না।’

মাহতিম রোবটের মতো বলল,‘পাশে তাকাও।’

অহনা বিচলিত। তার পা দুটোও চলছে না। ঘামছে ভীষণ। পাশে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। এমন কিছু দেখতে পাবে চিন্তাও করেনি। পরপরই দৌড়ে গেল কিছুটা দূরে। মাহতিম তার পেছন পেছন গেল।
একটি ছোট্ট সরোবর। পদ্মফুলের মেলা বসেছে যেন। পুরো সরোবর জুড়ে টলটলে জল খেলা করছে। পূর্ণিমার প্রখর আলোয় দেখা যাচ্ছে পদ্মফুলেদের হেলদোল। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বাতাস ব‌ইছে। মুহুর্তেই অহনার মন-প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে যায়। হালকা শীত‌ও লাগে। মাহতিম পেছন থেকে এসে নিজের শার্টটা অহনার গায়ে জড়িয়ে দেয়। চাঁদের আলোয় তারা দুজন ঘাসের উপর বসে‌। অহনা সরোবরের দিকে চোখ রেখেই বলল,‘সরি! ভুলভাল কতকিছু বলে ফেললাম। বুঝতে পারিনি এতো সুন্দর একটা জায়গায় আনবে।’

মাহতিম হাসল। কোনো উত্তর করল না। অহনা বুঝতে পেরেছে মাহতিম রাগ করেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে অহনা মাহতিমের কিছুটা কাছে এগিয়ে আসে। আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে তার বুকের কাছে এসে ঠেকে। কোনোকিছু না ভেবে বুকে মাথা রাখে। মাহতিম সরোবরের টলটলে জলের দিকে চোখ রেখে বলল,‘তোমার ভালো লেগেছে?’

অহনা মৃদু হাসল,‘এত সুন্দর জায়গা আগে দেখিনি। তুমি কী করে এই জায়গার সন্ধান পেলে?’

‘সে অনেক কথা।’

‘বলো।’

‘বললে ভুল বুঝতে পারো। তবে তোমার জানা উচিত বলে মনে করছি। কেননা ভালোবাসায় বিশ্বাস না থাকলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না।’

অহনা কিছুটা অবাক হয়েই বলল,‘তোমাকে বিশ্বাস করি।’

‘একটু আগে তা মনে হলো না‌।’

অহনা মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরে,‘ভয় পেয়েছি তাই ভেবেছি আবার ভয় দেখাতেই কোথাও নিয়ে যাচ্ছ। যা সব উদ্ভট কাণ্ড ঘটালে, এর জন্য ভয় পাওয়া উচিত নয়? বিশ্বাসের আগে ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসি তোমায়। তাই তোমার এক কথায় চলে এলাম। নিজেকে তোমার কাছে সঁপে দিলাম।’

মাহতিম বলল,‘সবসময় তুমি আমাকে হারানোর ভয় পাও। আজ কেন জানি আমার ভয় হচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি তোমাকে হারিয়ে ফেলার।’

‘দেখো, সরোবর থেকে একটা দৈত্য বের হয়ে আসছে। সে এখন আমার মনের তিনটা ইচ্ছে পূরণ করবে। প্রথমটায় আমি তোমাকে চাইব। দ্বিতীয়টায়‌ও আমি তোমাকে চাইব। তৃতীয় এবং শেষ চাওয়াতেও আমি তোমাকেই চাইব। এবার বলো, আমাদের আলাদা করবে কে?’

মাহতিম ফিক করে হেসে দিল। অহনাও হাসল। মাহতিম পরপরই বলল,‘দেখো, দৈত্য উঠে আসছে।’

অহনা ভয় পেয়ে যায়। মাহতিমের বুকে মুখ গুঁজে থাকে। মাহতিম পুনরায় হাসল,‘সত্যিই! তুমি আছ বলেই আমি ভয় পেতেও ভয় পাই।’

অহনা পিটপিট করে চোখ খুলে মাহতিমের হাতদুটো নিজের কোমর বরাবর রাখে,‘সুন্দর করে জড়িয়ে ধরো আর বলো এই সরোবর কীভাবে খুঁজে পেলে?’

মাহতিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,‘আমার শত্রু অগণিত। কেউ চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল।তোমার সাথে সম্পর্কের আগের ঘটনা। বাড়ি ফেরার পথে একটা মেয়ের চিৎকার শুনি এদিকে। কেউ বিপদে আছে ভেবে সাহায্য করার জন্য এলাম। কিন্তু পরবর্তীতে জানলাম এটা একটা চক্রান্ত। কোনো মেয়ের সম্মানহানি করছি, এমনটা প্রমাণ করতে চেয়েছিল আমার সেই গোপন শত্রু। মেয়েটার পেছনে দৌড়াতে গিয়েই এক পর্যায়ে এই সরোবর চোখের সামনে পড়ে। তখন ততটা ভালো করে দেখিনি। তবে স্পষ্ট মনে থাকায় ভাবলাম তোমায় নিয়ে আসি।’

‘এতে অবিশ্বাসের কী ছিল? কেউ তোমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। আচ্ছা, তুমি কি জানতে পেরেছ, কে তোমার সে শত্রু?’

‘না, জানতে পারিনি। জানার আগেই মেয়েটাকে কেউ খু’ন করেছে। প্রমাণ রাখেনি। জানতে পারিনি কে সে, যে আমার ক্ষতি করতে চায়?’

অহনা দেখল মাহতিমের মন খারাপ। রসিকতা করে বলল,‘মেয়েটা কি সুন্দর ছিল?’

‘হুম। ভালোই ছিল।’

অহনা রাগ দেখিয়ে বলল,‘মেয়ে মানুষের দিকে নজর দাও কেন? সুন্দর ছিল যেহেতু প্রেম করতেই পারতে।’

মাহতিম হেসে বলল,‘ঠিক বলেছ। আমার উচিত ছিল শিমলার প্রেমে পড়া।‘

‘নামটাও মনে রেখেছ। তোমার সাথে কথা নেই।’
মাহতিম অহনাকে রেগে যাওয়ার সুযোগ দিল না। তার কোমল ঠোঁটজোড়া সহজেই নিজের অধরের জোরে চেপে ধরল। তাদের মোহনীয় ভালোবাসার আরো কিছুটা সময় কেটে গেল। সাক্ষী র‌ইল লুকায়িত সেই সরোবর, তার টলমলে জল, নির্বাক, শীতল প্রকৃতি এবং জোৎস্না রাত।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here