ছায়া মানব ২ ৭.

0
159

ছায়া মানব ২

৭.
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। অনেকক্ষণ পরেও বাস আসার নাম নেই। বিরক্ত হয়ে যায় প্রচুর। এমন সময় তার সামনে একখানা গাড়ি থেমে যায়। গ্লাস খুলে কেউ একজন বলল,’সাহায্য করতে পারি?’

অহনা দেখল লোকটাকে। বর্ষণের চেহারা ভেসে ওঠতেই মুখ বাঁকিয়ে বলল,’নো থ্যাঙ্কস্। আমি বাসে যেতে পারব।’

‘ সম্ভবত ক্লাস সাড়ে এগারোটায়। আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। পৌঁছাতে পারবে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বরং গাড়িতে এসো, নামিয়ে দিই।’

অহনা বর্ষণের কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে করল। এই মুহুর্তে আর কোনো উপায়‌ও নেই। কথা না বাড়িয়ে ওঠে বসল গাড়িতে। পেছন থেকে সেটা খেয়াল করল মাহতিম। সে শামস্ মলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সেখানকার দায়িত্বে থাকবে সে। তার ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত শপিং মলগুলোর শেষেই এটা অবস্থিত, তাই প্রথম হামলা এটাতেই হতে পারে।
এই মুহুর্তে বর্ষণের গাড়িতে অহনাকে ওঠতে দেখে খানিকটা অবাক হলো। প্রশ্ন জাগল মনে, তারা কি পূর্ব পরিচিত? তাদের কি আগেও দেখা হয়েছিল? কেমন হিংসে অনুভব হচ্ছে মাহতিমের। কারণ বুঝতে পারল না। দুইদিন আগে পরিচয় হ‌ওয়া মেয়েটার প্রতি সে এতো কেন ভাবছে? প্রশ্নগুলো ঘোরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে। কিন্তু এখন দেরী করা যাবে না। বিষয়টা পরে দেখা যাবে। এখন তাকে দ্রুত যেতে হবে। মাহতিম গাড়ি স্টার্ট করে।

বর্ষণ অহনাকে জিজ্ঞেস করল,’সবসময় এমন গম্ভীর থাকো নাকি আমার ক্ষেত্রে শুধু?’

অহনা জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরটা দেখে বলল,’আমি গম্ভীর ন‌ই। তবে সবার সাথে কথা বলি না।’

‘ আমার অপরাধ?’

‘ কিসের অপরাধ?’

‘ বললে সবার সাথে কথা বলো না। তার মধ্যে আমি একজন। কোন অপরাধে আমার সাথে কথা বলো না?’

অহনা নিশ্চুপ। কিছু বলল না। মনটা ভালো নেই ততটা। কিছুক্ষণ পর বলল,’গাড়ি থামান। পৌঁছে গেছি আমরা।’

বর্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অহনা গাড়ি থেকে নেমেই পা বাড়ালো সামনে। পুনরায় ফিরে এসে বলল,’ধন্যবাদ আপনাকে।’

বর্ষণ মুচকি হাসল। তমা গেইটের সামনেই ছিল। অহনার সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,’স্যার চলে গেল কেন? ক্লাস নেই ওনার?’

‘ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘ কেন?’

‘ আমি জানি না।’

তমা থেমে যায়। পেছন ফিরে দেখল বর্ষণের গাড়ি নেই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’তাহলে কি আর দেখা হবে না?’

‘দেখা না হলে তোমার কী? এমনিতেও স্যারের নজর আমার কাছে সুবিধার মনে হয়নি।’

‘অনেক ভালো। আমারতো খুব ভালো লাগে। কেমন প্রেম করতে ইচ্ছে করে।’

‘ কি বলো এসব? শিক্ষক ওনি।’

‘ তাতে কী? শিক্ষক কি কখনো কাউকে বিয়ে করবে না? সেকি কোনো কলেজের স্টুডেন্ট হবে না? নাকি ওনি অশিক্ষিত কাজের মেয়ে জরিনা, সখিনাকে বিয়ে করবেন?’

‘কিই? বিষয়টা বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো? ক্লাসে চলো, এসব ভাবার আরো অনেক সময় পাবে।’

মাহতিম শামসের সিসিটিভি ফুটেজ দেখল গত দুদিনের। অস্বাভাবিক কিছুই পেল না। সবগুলো ফুটেজ চালিয়ে দিয়ে বসে র‌ইল। প্রায় দুই ঘন্টা পর খেয়াল করল মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে কেউ এসেছে। মাহতিমের কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হলো। কেউ শপিং মলে বোঝা নিয়ে আসবে কেন? মাহতিম ঝুম করে দেখল বিষয়টা। লোকটার চাওয়াচাওয়ি আরো তিনজনকে খেয়াল করল, তারা তার‌ই কোনো ইশারা বহন করছে। চোখাচোখি হচ্ছে বারবার। যেন চোখ দিয়েই কিছু বলে যাচ্ছে অনবরত। মাহতিম সাথে সাথেই কল করল ইনচার্জদের। চারজন লোককে শনাক্ত করে বলল, তাদের আলাদা করে ধরে নিতে। তাই করা হলো। মাহতিম সিসিটিভি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সন্দেহভাজন চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাহতিম এগিয়ে এলো। পরপর চারটা থা’প্পর বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কেঁদে ওঠল তারা। কিছুই জানে না বলছে বারবার। মাহতিম রেগে গিয়ে মারল আরো কয়েকবার। তাদের মাঝে একজন হঠাৎ করেই বলল,’সাহেব, আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের বলা হয়েছে এমন অদ্ভুত সেজে বোঝা বয়ে এখানে আসতে। এর পরিবর্তে হাজারখানেক টাকাও দিল।’

‘ কেন বলেছে এসব করতে? নাম কি তার?’

‘ আমরা জানি না। লোকটার মুখ ঢাকা ছিল।’

‘না জেনেই কারো থেকে টাকা দিয়ে নিলে?’

‘ এতকিছু দেখার আছে আমাদের? সারাদিন কাজ করে দু’পয়সা পাই না। যদি সামান্য কাজে ঢের টাকা পাই ,মন্দ কিসে? তবে স্যার লোকটাকে বলতে শুনেছি। আমরা ঘোরাঘুরি করলে আপনারা আমাদের দিকেই নজর রাখবেন, ওনারা অনায়াসেই কোনো কাজ করে ফেলতে পারবে।’
মাহতিম কথাটা শোনার সাথে সাথেই দ্রুত গতিতে শপিং মলের ভেতরে প্রবেশ করল। কিছু হয়ত আন্দাজ করেছে। কিন্তু তার আগেই সতর্ক সংকেত বেজে ওঠল। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চোর তাদের কাজ করে নিয়েছে। ভাবার বিষয় হলো, কেউ তাদের দেখেনি। মাহতিম চিন্তায় পড়ে যায়। অভিজ্ঞ লোক যে চোরদের লিডার তা বুঝতে দেরী হয়নি। সবটা এখন বুঝতে পারল। সাধারণ চারজন লোককে সন্দেহভাজন করে প্রোটেকশন সরিয়ে সহজেই চুরি করেছে। বোকা বানানো হলো। অনুজ বুকে দু’হাত ভাঁজ করে নিচু চোখে মাহতিমের দিকে তাকাল। নিজেদের বোকামির জন্য লজ্জিত‌ও হয়। মাহতিম‌ও কিছুটা মাথা নুইয়ে ছিল। কিছুই করতে পারেনি সে। জয়ন্ত তৎক্ষণাৎ বলল,’হাল ছাড়ার জন্য এখানে কেউ আসোনি। পরের ব্যবস্থা গ্রহণ করো। আশা করি আজকের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে।’

মাহতিম উত্তর দিল,’জ্বী স্যার! পরবর্তীতে আমরাই সফল হব, ইনশা’আল্লাহ!’

মাহতিম অনেকটাই ক্লান্ত অফিসের দিকে র‌ওনা দিল। কিছু নমুনা পেয়েছে সে। সেগুলো একান্ত নিজ দায়িত্বে রেখে সে গমন করল। সাথে আশিশকে সঙ্গী করল।

কলেজ শেষে অহনা বাড়ি ফেরার জন্য গেইট পার হতেই বর্ষণের গাড়ি এসে থামল। মনে হলো অহনার আসার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। পাশ কাটিয়ে অহনা যেতে চাইলেই বর্ষণ জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,’ওঠে এসো।’

অহনা হকচকিয়ে যায়,’আমাকে বলছেন?’

‘ হ্যাঁ তোমাকেই। এসো আমি পৌঁছে দিই!’

‘ আজকে কি অবরোধ নাকি?’

‘না, তবে সাহায্য করতে এলাম। এতে তোমারই ভালো হবে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবে।’

‘ তাহলে ভালোই হয়।’

অহনার খুল খিদে পেয়েছিল। তাই ওঠে বসে সে গাড়িতে। কয়েকজন শিক্ষার্থী সেটা খেয়াল‌ও করল। তাতে অহনার কিছু আসে যায় না। সে কখনো কারো ভাবা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিপত্তি হলো একটু পর। র‌উফ নামক একটা ছেলে এসেই গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। অহনাকে কঠোর গলায় বলল,’তোমার নাকি কোনো ছেলের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই। তাহলে ওনার সাথে কী করছ?’

অহনা রেগে যায়। দাপাদাপ বলে ওঠল,’মুখ সামলে। ওনি আমাদের শিক্ষক।’

‘ এখন আর নন। যদি শিক্ষক‌ই হয় তাহলে তুমি তার গাড়িতে কেন? তাও আবার পাশাপাশি সিটে! সকালের বিষয়টা ভেবেছিলাম স্বাভাবিক। হয়ত স্যার দয়া করে লিফট দিয়েছেন। কিন্তু এখন কেন? আমাকে কি বোকা মনে করো?’

‘ বেশ করেছি। তাতে আপনার কী? আমি কার গাড়িতে ওঠব সেটা কি আপনি ঠিক করে দেবেন?’

অহনা বর্ষণকে বলল,’গাড়ি স্টার্ট করুন।’

র‌উফ রাগে ফুঁসে ওঠে। অনেকদিন ধরেই সে অহনার আকর্ষণ পেতে চেয়েছিল। শেষবার অহনা বলেছিল, কোনো ছেলের প্রতি তার ইন্টারেস্ট নেই। তাই প্রেম বিষয়ে জড়াবে না। র‌উফ তার কয়েকজন বন্ধুকে কল করল। আজ রাতেই অহনার উপর হামলা চালাবে বলে ঠিক করল।

বর্ষণ ছেলেটার সম্পর্কে অহনাকে জিজ্ঞেস করল। অহনা বলল,’বয়ফ্রেন্ড!’

একদফা কাঁশি ওঠে গেল বর্ষণের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’সে রেগে গেল কেন?’

‘ আপনি না বুঝলে আমার কিছু করার নেই। বোঝাতে পারব না।’

তাদের কথোপকথনের মাঝেই ট্রাফিক সিগন্যাল জ্বলে ওঠে। থেমে যায় বর্ষণের গাড়ি। পাশেই মাহতিমের গাড়ি থামে। সে আশেপাশে তাকাতেই বর্ষণের গাড়ি দেখতে পেল সাথে খেয়াল করল অহনাকে। সারাদিনের ক্লান্তি থেকেও এ বিষয়টা তার হৃদয় কাঁপিয়ে দিল। কোনো অজানা চিনচিনে ব্যথা ভর করল মনে। বর্ষণের সাথে অহনাকে পুনরায় দেখতে পেয়ে কিছু একটা আন্দাজ করল। ভাবল, বর্ষণের প্রেমিকা হবে হয়ত অহনা। না হয় সকাল বিকাল তাকে নিয়ে বের হতো না। অজানা উৎকণ্ঠায় মাহতিমের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অহনার প্রতি তৈরি হ‌ওয়া সব অনুভূতি তাড়ানোর চেষ্টা করল। কেননা অন্যের প্রেমিকার দিকে সে নজর দিতে পারে না। নিজেকে কয়েক কদম বুঝিয়েও দিল। কখনো কাউকে ভালো লাগেনি। যাকে ভালো লেগেছে, সে আগেই অন্যের হয়ে গেছে। মাহতমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here