ছায়া মানব ২ ৯.

0
166

ছায়া মানব ২

৯.
‘ওঠে আসো।’

অহনা‌ কিছুটা সরে দাঁড়ালো,

‘আপনি যেতে পারেন। আমি বাসে করেই যাব। প্রতিদিন কারো দয়া নিতে পারব না আমি।’

‘এটাকে দয়া বলছ কেন? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এর জন্য উপযুক্ত একটা সময় দরকার। মনে হচ্ছে এখনই সেই সময়। তোমাকে বলা উচিত।’

‘এখন বলে ফেলুন। আমিতো কান ঢেকে রাখিনি। শুনতে সমস্যা হবে না।’

‘ বেশি কথা বলো। ওঠে এসো এখন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে।’

অহনা আর দ্বিমত করল না। যদিও মন সায় দিচ্ছে না তাও ওঠল। দু’মিনিট পর নিজে থেকেই বলল,’আপনার কিছু বলার ছিল হয়ত।’

বর্ষণ অনেকটাই সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করল। মুখ ফুটে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। গলা পরিষ্কার করে পুনরায় বলল,’আমি আসলে..!

‘ হ্যাঁ বলুন।’

বর্ষণের গলা ভারী হয়ে আসে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। কোনোমতে বলল,’কিছু বলার কথা ছিল। আমি সেটা বলতে চাই।’

‘ তাড়াতাড়ি বলুন। এভাবে মুখে জড়তার কারণ কী? আমি কি কোনো হিংস্র প্রাণী?’

‘আমি বলতে চেয়েছি, আমি তোমাকে পছন্দ করি।’

অহনা কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল,’এটা নতুন কী? সবাই বলে।’

‘অহংকার করছ নাকি?’

‘ একদম না। বললাম সবাই আমাকে এই কথাটা বলে। আর কিছু কি বলার আছে আপনার? শুধু কি পছন্দ‌ই করেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চান।’

‘ঠিক বলেছ। শুধু ভালো লাগার বিষয় নয় এটা। আমি তোমাকে আরো কিছু বলতে চাই। প্রায় দু’বছর ধরে আমার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। কখনোই মন দিতে পারিনি। কাউকেই তেমন ভালো লাগেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি এমন কাউকে পেয়ে গেছি যাকে ভালোবাসতে পারি।’

‘ এসব আমাকে বলছেন কেন? যাকে ভালো লেগেছে তাকে গিয়ে বলুন। পারলে হাজারটা স্যাড কথা বলে তার ইমোশন জাগিয়ে তুলুন।’

‘তাকেইতো বলছি। সে না বুঝলে কী করব?’

‘ আমি?’

‘হ্যাঁ! তুমিই প্রথম, যাকে আমার ভালো লেগেছে। আমি বাবাকেও তোমার কথা বলেছি। যদি তোমার‌ও আমাকে ভালো লাগে তাহলে আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।’

অহনা রাগ হজম করে বলল,’আপনি কি ভেবেচিন্তে বলছেন?’

‘হুম! বাহানা করতে পারব না আর। তোমার সম্মতি পেলে আজ‌ই আমার পরিবারের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।’

‘গাড়ি থামান।’

‘ কেন?’

‘ আমি নামব। না থামালে চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দেব।’

‘ কিন্তু আমার কথার উত্তর দিয়ে যাও।’

‘ উত্তর সবসময়‌ই না হবে। আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হচ্ছে আপনার থেকে সাহায্য নেওয়া। আপনি এখন আমার সুযোগ নিচ্ছেন।’

বর্ষণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। গাড়ি থামিয়ে বলল,’ভেবে দেখো, আমি তোমাকে ভালোবাসি!’

‘শব্দটাকে এতটা মামুলি করে ফেলবেন না। দয়া করে আর কখনো আমার সামনেও পড়বেন না। দুদিন একটু হেসে কথা বলেছি বলে আপনার সাহস বেড়ে গিয়েছে। চাই না সময়টা আরো দীর্ঘ হোক। বলে দিচ্ছি, আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। আর কখনো হবেও না। ভুলে যান আজকের বিষয়টাও। আপনার জন্য মঙ্গল হবে।’

অহনা নেমে গেল। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকল তাকে বর্ষণ। কোনো উত্তর দিল না। বর্ষণের চোখ লাল হয়ে আসে। এই প্রথম কাউকে ভালো লাগল এবং সে’ই রিজেক্ট করল। ঠিক মেনে নিতে পারল না সে। কষ্ট পেল অনেকটাই। সোজা বাড়ি চলে গেল।

মাহতিম অনুজকে কল করে আসতে বলল তার আগে বলল আশিশকে। যেকোনো কাজ সে আশিশকে না জানিয়ে করে না। তার বিশ্বাসের একমাত্র স্থান আশিশ। খুব বেশি বিশ্বাস করে।
আজ তাদের মিশন আলিপুরে। পৌঁছেই দেখে অনুজ অপেক্ষা করছে। তারা তাদের ব্যক্তিগত কিছু ব্যবস্থাও নিয়ে নেয়। মাহতিম চোখ-কান খোলা রাখল চারদিকে। আজ আর কোনো ভুল হলো না। সে সিসিটিভিতে খেয়াল রাখল। দুপুর একটার সময় তার মনে হলো কোনো অসঙ্গতি রয়েছে। সেই মুহুর্তে শপিংয়ের জন্য তিনজন মহিলা ঢুকল। তাদের জুতার দিকে খেয়াল করল মাহতিম। বোরকার সাথে রানিং সু পরেছে। কেমন খটকা লাগলো মাহতিমের। আর একটু খেয়াল করেই বুঝল তিনজনের বেশভূষা এক‌ই। গতদিনের মতো ভুল যেন না হয় তার জন্য অনুজকে খেয়াল রাখতে বলে সে নিজে বের হয়ে যায়। তিনজন মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তারা ঘাবড়ে যায়। মাহতিম বলল,’সাইডে আসুন।’

তিনজন মহিলাই ক্ষেপে যায়। একজন বলেই বসল,’মেয়েনোককে আড়ালে ডাকতে নজ্জা করে না? মোরা খরচ করতে এয়েছি বাপু। সরে দাঁড়াও।’

মাহতিম সাথে সাথেই মহিলাটির গালে থা’প্পর বসিয়ে দেয়। এতে উপস্থিত সবাই তেড়ে আসে তার দিকে। একজন পর্দাধারী মহিলার গায়ে হাত তোলার অপরাধে মারতে আসে তাকে। মাহতিম তার কার্ড দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল, সে সাধারণ কেউ নয়, একজন আর্মি অফিসার। লোকজন সরে যেতেই তিনজন মহিলা পালাতে চাইল। মাহতিম দু’জনের হাত খপ করে ধরে ফেলল। আশিশকে ডেকে বলল অপরজনকে ধরতে এবং সাথে সাথে নিকাব খুলে ফেলল একজনের। সবাই দেখতে পেল বোরকার আড়ালে একটা ছেলে। মাহতিম আগেই তা আন্দাজ করেছিল। কয়েকটা ঘু’ষি মে’রে দ্রুত তাদেরকে হাতকড়া পরানো হয়। মাহতিমের কঠোর হাত থেকে রক্ষা পেল না তারা। জয়ন্ত দূর থেকে সেটা দেখল। কাউকে কল করে বলল,’এবার বিশ্বাস হলোতো? মাহতিম পেরেছে। আমি জানতাম ও ছাড়া আর কেউ উপযুক্ত নয়।’
মৃদু হেসে বাইরে গেল। মাহতিম আসতেই তার কাঁধে হাত রাখল,’সাবাস! তুমি বরাবরের মতো এবারেও আমার মান রাখলে। তবে এবার আরো বড়ো দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

মাহতিম ঘেমে একাকার। মুখের ঘাম মুছেই বলল,’আপনার দোয়া থাকলে আমি অবশ্যই সব পারব।’

পুরো বিষয়টা আশিশের ভালো লাগল না। সে সবসময় চেয়েছে জয়ন্তের প্রিয় হতে কিন্তু পারল না। সবসময় সুযোগ শুধু মাহতিম পায়। হিংসেটা প্রকাশ করল না। মাহতিমের কাছে গিয়ে তাকে শুভকামনা জানাল।

বিকেলে মাহতিম বাড়ি ফিরে গেল। নিজের ঘরে যাওয়ার আগে একবার বর্ষণের ঘরের দিকে উঁকি দিল। শুয়ে রয়েছে সে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে নিভৃতে কিছু ভাবছে। তাকে ভাবুক দেখে মাহতিম গেল। মাহতিমকে দেখেই বর্ষণ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে বসল‌। হাসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। মাহতিম নিজের থেকেই বলল,’ভাই, তোমার কিছু হয়েছে?’

বর্ষণ ঢোক গিলে বলল,’যা হবার তাই হলো।’

‘ কী হয়েছে বলো।’

‘ অহনা! যে মেয়েটাকে ভালো লেগেছিল, সে রিজেক্ট করেছে। বলেছে আমার প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। আমাকে বুঝতেই চাইল না‌।’

‘ এটাতো ভালো কথা।’

বর্ষণ মাহতিমের কথায় বেশ চমকে গেল,
‘ কী বললি?’

‘ না মানে, আমি বলতে চেয়েছি, যে ভালোবাসেনা তার জন্য তোমার মন খারাপ থাকবে কেন? তোমার জন্য আরো কতো মেয়ে অপেক্ষা করছে।’

‘ কিন্তু আমার তাদেরকে চাই না। আমার ওকেই লাগবে।’

‘ বাদ দাওনা ওর কথা। ও তোমার যোগ্য না। আমি তোমার জন্য আরো ভালো ভালো মেয়ে দেখব। ওর থেকে হাজার গুন সুন্দরী। নায়িকাদের থেকেও সুন্দরী মেয়েদের আনব, দেখে নিও। মন খারাপ করে থেকো না।’

‘বাদ দে এসব কথা। আমার ভালো লাগছে না।’

মাহতিম আর কথা বাড়ালো না। অনেকটা খুশি হয়েই নিজের ঘরে ফিরে গেল। ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তার আনন্দ হচ্ছে। ভীষণ খুশিতে ফেটে পড়ছে। মনটাও ফুরফুরে হয়ে আছে। আজ একসাথে এত খুশি আসবে সে ভেবে পায়নি। পরক্ষণেই কিছুটা মন খারাপ হয়। ভাইকে যেভাবে রিজেক্ট করেছে তাকেও যদি করে। তবে তো আর কোনো আশাই থাকলো না। চিন্তায় পড়ে যায়।

কলেজ ছুটির পথেই অহনা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে বলল,’তুমি অন্যমনস্ক ছিলে। ওঠে আসো এখন।’

মোহনা অহনার সাথেই পড়ে। তবে সাইন্স ডিপার্টমেন্টে। সাহায্য করার জন্য মোহনাকে ধন্যবাদ জানালো। অহনাকে পুরোপুরি দেখেই মোহনা বললো,’বাহ তোমাকে দেখতে একদম পুতুলের মতো। তুমি আমার বন্ধু হবে?’

হঠাৎ এমন প্রশ্নে অহনা হকচকিয়ে ওঠে। মোহনার কথা ফেলতে পারল না, বলল,’ঠিক আছে।’

‘ তোমার নাম কী?’

‘ অহনা তামিয়া। তোমার নাম?’

‘ আমি আঞ্জুমা চৌধুরী মোহনা। সংক্ষেপে মোহনা ডাকতে পারো।’

ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই মোহনা এবং অহনার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারা কথা বলতে বলতেই রাস্তায় হাঁটতে থাকে। মোহনার গাড়ি এসে থামল। ড্রাইডার নত মুখে বলল,’সরি ম্যাম। একটু দেরী হয়ে গেছে। রাস্তায় সমস্যা হয়েছিল।’

মোহনা হেসে বলল,’এটা কোনো ব্যাপার না। তুমি যাও, আমি আসছি।’

পরপর‌ই অহনাকে বলল,’তুমি আমাদের বাড়ি যাবে? যেহেতু তুমি ম্যাচে থাকো, কেউ কিছু বলবে না।’

‘ তা কী করে হয়? আজকেই পরিচয়, আজকেই যাব?’

‘ ধরে নাও হাজার বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। চলো প্লিজ। আমার আম্মা তোমার মতো মিষ্টি পুতুলকে দেখে খুব খুশি হবে।’

অহনা আর অমত করতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন মেয়েটা ভাব জমিয়ে ফেলল। অহনা বেশ খানিকটা অবাক‌ও হয়।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here