#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১২
অন্ধকার রাত। আকাশে অল্প স্বল্প তাঁরার মেলা।
ঘড়িতে প্রায় রাত দশটা ছাড়িয়ে। সামনেই সমুদ্রের ঢেউয়ের শাঁ শাঁ করে শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘন্টার মতো ঝনঝন করে কতক্ষণ পর পর কানে বাজছে সেই শব্দ। মৃদুল বসে আছে সমুদ্র থেকে খানিকটা দূরে ছাতাযুক্ত চেয়ারে। তার প্রবল মন খারাপ। মৃদুল প্রায় ১৫ মিনিট যাবৎ একটা মেয়েকে লাইন মারার চেষ্টা করছিল কিন্তু ঠিক পনের মিনিট পর মৃদুল বুঝতে পারলো মেয়েটি বিবাহিত সঙ্গে বাচ্চাও আছে। ঠিক দু’মিনিট আগেই মেয়েটি তার স্বামীর হাত ধরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেল। সেই থেকে মৃদুলের মন খারাপ। মৃদুলের সাথে ঘটে যাওয়া এই বিরহের ঘটনা দূর থেকে পুরোটাই দেখেছে আশরাফ, মুনমুন, আদ্রিতা, রনি আর চাঁদনী। তারা মিটমিটিয়ে হাসছে। আদ্রিতা সবাইকে থামিয়ে বললো,“হাসিস না। বেচারা, মেয়েটাকে নিয়ে সিরিয়াস ছিল?”
আদ্রিতার কথা শুনে আশরাফও বললো,“ঠিক বলেছিস। চল যাই, শালার মুডটা ঠিক করতে হবে।”
রনির হাতে ছিল গিটার। সে বললো,“চল ভিন্ন কিছু করি।”
রনির ইশারা বুঝি সবাই বুঝলো। তারা এগিয়ে গেল। মৃদুল তখন সেই রাস্তার পানে তাকানো যে রাস্তা দিয়ে সেই বিবাহিত মেয়েটি চলে গেল।
শুরুতেই রনি গিটার বাজাতে বাজাতে মৃদুলের সামনে গিয়ে বলে উঠল,’লাললালালা লালালালালা’
রনির দেখাদেখি আশরাফও বলে উঠল,
‘লালালালালালালালালালালালালা।’
মৃদুল আচমকাই চমকে উঠে ওদের সবার দিকে তাকালো। সবার মুখ হাসি হাসি। আদ্রিতা আর মুনমুন বসলো মৃদুলের সামনে থাকা আরেকটা ছাতাযুক্ত চেয়ারে। হাতে তালি দিচ্ছে তারা। চাঁদনী মাঝখানে দাঁড়ানো। আশরাফ আর রনি দুজন গিয়ে বসলো মৃদুলের দুপাশে। রনি গিটার বাজাতে বাজাতে গেয়ে উঠল,
‘যদি বারেবারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়’
রনির পরই আশরাফ বলে উঠল,
‘তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়?'(আশরাফ)
‘যদি দিশেহারা ইশারাতে প্রেমই ডেকে যায়'(মুনমুন)
‘তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়?'(চাঁদনী)
‘যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা'(রনি)
‘যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা'(আদ্রিতা)
‘যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা'(রনি)
‘যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা'(আশরাফ)
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!(সবাই একসাথে)
‘লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।’
মৃদুলের তাল উঠে গেল সবার গান শুনে। সে তার নিজস্ব মুডে চলে এলো। হাসি ফুটে উঠলো মুখে। রনি গভীর ধ্যানে গিটার বাজাতে মগ্ন হলো। কতক্ষণ যেতেই সবাই একসাথে গেয়ে উঠলো আবার,
‘যদি প্রতিদিন সেই রঙিন হাসি ব্যাথা দেয়
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে শুধু কথা দেয়'(২)
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের গানও অসহায়।’
‘লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।’
প্রকৃতির বুকে তখন উপচে পড়া ঢেউ। মানুষগুলো তা দেখছিল না কেউ। তাদের দৃষ্টি তখন সমুদ্রের কিনারায় জোট বেঁধে গান ধরা ছ’জন মানুষের দিকে। কি উল্লাস তাদের মাঝে? মনে হচ্ছে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু নেই। কিছুই না। দূরের মানবগুলোও তিন জোড়া মানুষের উল্লাসে নিজেরাও উল্লাসিত হচ্ছিল। প্রকৃতি জুড়ে ছুটছিল মিষ্টি বাতাস। আহা! জীবন সুন্দর!’
—–
রাগী রাগী মুখ নিয়ে হোটেলে পা রাখলো ফারিশ। তার তীব্র ক্ষোভ সেই মানুষটা কে তা জানার। কেউ তো আছে যে তার কাজকর্মের কিছুটা হলেও অনেকটা জানে। আর ফারিশকে সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করতে হবে। ফারিশের পিছনেই হাঁটছে আদিব। কতক্ষণ আগেই মোশারফকে খুন করে এসেছে ফারিশ। ফারিশের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই অথচ আদিবের বুক দুরুদুরু করছে। জোরে জোরে নিশ্বাসও ফেলছে কতবার। ফারিশের কাছে বেইমানদের জায়গা নেই। তাই অপরাধ করা মানুষটা যতই তার কাছে মিনতি করুক তার ফল মৃত্যুই হয়। ফারিশ বড় বড় পা ফেলে তার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। গোডাউনে দেরি হয়ে যাওয়ায় গাছের কাছে যেতে পারে নি ফারিশ। তবে কাল সকালে যাবে ভেবে নিয়েছে। ফারিশ আদিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কাল সকাল সকাল আমরা বের হবো আদিব। দ্রুত খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
আদিবও দ্রুত জবাব দিলো,“আচ্ছা ভাই।”
আদিব ফারিশের রুমটা খুলে তার রুমে ঢুকে পড়লো। ফারিশ তার কক্ষে ঢোকার আগে উপরটা চেক করলো। রুম নাম্বার ঠিক করা হয়েছে। ফারিশ ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার ভীষণ রাগ লাগছে।’
—-
প্রকৃতি তখন নীরব। সমুদ্র বিলাস করে, গান বাজনা হই-হুল্লোড় করে সাথে সামুদ্রিক মাছ রান্না খেয়ে রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে হোটলে ঢুকলো আদ্রিতা, আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। সবাই সবাইকে বাই জানিয়ে দ্রুত রুমে ঢুকে পড়লো। আদ্রিতা আর মুনমুন ঢুকলো রুম নাম্বার ছ’য়ে। আদ্রিতা রুমে যাওয়ার পথে ফারিশের রুমটা দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো ফারিশ আর তার বিছানায় লেপ্টে পড়ার ঘটনা। ছিঃ কি লজ্জার একটা বিষয়। আদ্রিতা হাসলো। লোকটাকে কেন যেন আদ্রিতার ভালো লেগেছে। ভিন্ন রকম কিছু একটা আছে লোকটার মাঝে। রাগটাও প্রবল। এই প্রবল মনের রাগ থাকা মানুষটার মাঝে লুকিয়ে রাখার মতো কি আছে জানতে খুব ইচ্ছে করছে আদ্রিতার। কিন্তু জানার উপায় নেই। আফসোসের নিশ্বাস বেরিয়ে এলো আদ্রিতার।’
—-
অন্ধকার রাতটা তখন খুবই গভীর। ঘড়িতে প্রায় রাত দু’টো ছাড়িয়ে। মুনমুন বিছানায় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে আর আদ্রিতা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। তার ঘুম আসছে না। কেন আসছে না ধরতে পারছে না। রাতটা শীতল। ঠান্ডা ফুড়ফুড়ে বাতাস বইছে চারিপাশে। প্রকৃতিতে শীতের আভাস ঘুরছে। আদ্রিতার গায়ে পাতলা চাদর জড়ানো। বিশাল আকাশটায় এক সুন্দর চাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। রাতের এই সময়টা তার খুব ভালো লাগে। কেমন চারপাশ চুপচাপ, ঠান্ডা, কোনো শোরগোল নেই। পুরোই নির্জীব আর নির্জন।
আদ্রিতার এই সময়টায় চারপাশ দেখলে মনে হয়, এই পুরো পৃথিবীতে বুঝি সে একাই আছে।
আদ্রিতার মনে হলো এই মুহুর্তে হাতে এক কাপ কফি থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু হোটেল রুমে এই সময় কফি কই পাবে? আদ্রিতা তার ঘন কালো লম্বা চুলগুলো খুলে দিল। মাথা নাড়িয়ে সেগুলো এলেমেলো করলো। পুরো পিঠ ছুয়ে ফেললো তার চুল। বাতাসে সেগুলো দুলছে। এক শীতল হাওয়া তাকে নাড়িয়ে দিলো। আদ্রিতা রেলিং এ হাত রাখলো। তাকিয়ে রইলো ওই বিশাল আকাশের দিকে মনে মনে বললো,“তুমি এত সুন্দর কেন?”
আদ্রিতা চোখ বুজলো। সাথে সাথে আদ্রিতার সামনে ফারিশের চেহারা ভেসে উঠলো। সে চমকে উঠলো। চোখ খুললো দ্রুত। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“বজ্জাত ছেলে একটা খালি রাগ দেখায়।”
বেশ কিছু সময় আদ্রিতা একা একা পার করলো। আচমকাই আদ্রিতার নজর গেল তাদেরই হোটেলের এক রুম ছাড়িয়ে তার পরের রুমের বেলকনিতে কেউ বসে আছে তার দিকে। তড়িৎ চমকে উঠলো আদ্রিতা। ভালো মতো খেয়াল করতেই আদ্রিতা বুঝলো বসে থাকা মানুষটা আর কেউ না ফারিশ। আদ্রিতা অবাক হলো লোকটা এখনও ঘুমায় নি।
হাতে সিগারেট নিয়ে তা খেতে খেতে মোবাইল দেখছে ফারিশ। আদ্রিতা দ্রুত ওখান থেকে সরে গেলো। কি জানি তাকে দেখতে পেলে না ফারিশ আবার চেচামেচি শুরু করে দেয়।’
অন্যদিকে,
আদ্রিতা যেতেই ফারিশ তাকালো আদ্রিতার বেলকনিতে। সে অনেক আগেই আদ্রিতাকে লক্ষ্য করেছিল। এতরাতে মেয়েটা সজাগ ভেবে বেশ অবাকও হয়েছে। তবে খুব একটা ভাবে নি। মেয়েটাকে ফারিশ মটেও দেখতে চায় না কিন্তু সেই দেখা হয়েই যায়। যেমন এখন হলো। মেয়েটা না চাইতেও বার বার সামনে আসছে ফারিশের। যেটা ফারিশের মটেও ভালো লাগছে না। ফারিশের কল্পনায় আসলো সকালের ঘটনা। আদ্রিতার সেই ভয়ার্ত মুখশ্রী, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ, গলায় দৃঢ়তা। ফারিশ আনমনা বলে উঠল,
“মেয়েটার চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর।”
কথাটা বলেই ফারিশ চরম ভাবে চমকালো। এটা কি বলে উঠল? সে আবার কবে থেকে মেয়েদের চোখ মুখ দেখতে শুরু করলো। ফারিশ তার মাথা ঝাকড়ালো। এসব কি হচ্ছে তার সাথে?
—-
পরেরদিন খুব সকালে ফারিশ বের হলো তার গাছের উদ্দেশ্যে। তার একটা বিশেষ গাছের বাগান আছে। যে বাগানের কথা খুব কম মানুষই জানে। কক্সবাজার থেকে অনেক অনেক দূরে এক গুপ্তনীয় স্থানে তার বসবাস। বর্তমানে সেই গাছ দেখতেই যাচ্ছে ফারিশ….
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]