#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২০
রাতের জোৎস্না ভরা আলো ফুটিয়েছে ধরনী জুড়ে। ঘড়ির কাটায় প্রায় রাত দশটা ছাড়িয়ে। অন্ধকারে টুইটুম্বর চারপাশ। ফারিশ নীরবে ড্রাইভ করছে। মাঝে একবার থামিয়ে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়েছিল শুধু। আদ্রিতা ঘুমানো। কপাল জুঁড়ে ছড়ানোর তার অবাধ্য কেশ। বাতাসের ছোঁয়া বিন্দুমাত্র নেই গাড়িতে। জানালা কপাট সবই বন্ধ। ফারিশের নজর বার বার যাচ্ছে আদ্রিতার চুলগুলোর দিকে। তার ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতে। কিন্তু দিচ্ছে না। মন তার সরাতে চাইলেও বিবেকে বড্ড আটকাচ্ছে। এমন চাঁদনীভরা রাতে পাশে ঘুমন্ত মেয়ে মানুষ নিয়ে ড্রাইভ করা যেন খুবই বিশ্রী একটা ব্যাপার। ফারিশের মাথায় বিচ্ছিরি সব চিন্তা আসছে। শয়তানে লাড়া দেয়ার মতো বিশ্রী কান্ড। গাড়িতে লাইট জ্বলছে। আদ্রিতার মুখখানা আধো আধো দেখা যাচ্ছে চুলের কারণে। ফারিশ চোখ সরিয়ে নিলো। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। ফারিশ গাড়ি থামালো। বার কয়েক নিশ্বাস ছাড়লো। এত বেশি অস্থির লাগছে কেন! এতক্ষণ তো সব ঠিক ছিল। ফারিশ কোনো উপায় না পেয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলো আদ্রিতাকে। বললো,
“এই যে ডাক্তার ম্যাডাম। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’
আদ্রিতার হেলদোল আসলো না। ফারিশ চরম বিরক্ত নিয়ে আবার ডাকলো। বললো,“এই মেয়ে শুনছেন। উঠুন দ্রুত।”
আদ্রিতা তাও উঠলো না। সে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। ফারিশের কেমন বিতৃষ্ণা লাগলো। গাড়িতে থাকা পানির বোতলটা হাতে নিলো। আটপাঁচ কিছু না ভেবেই মুখে পানি ছুঁড়ে মারলো আদ্রিতার।
.
ঠান্ডার মধ্যে আচমকা চোখে মুখে পানি পড়তেই ভূত দেখার মতো লাফ মেরে উঠলো আদ্রিতা। তার সামনের চুল গেছে ভিজে। চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে হাত দিয়ে মুখের পানিটুকু মুছলো। আতঙ্কিত কণ্ঠে ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি হয়েছে? কি হয়েছে? ডাকাতে কি আটক করেছে আমাদের?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“ডাকাত না ভূতে।”
আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,
“মানে?”
“খিদে পেয়েছে আমার। একটানা গাড়ি চালিয়ে আমি ক্লান্ত।”
আদ্রিতা ফ্যাল ফ্যাল চোখে ফারিশের পানে তাকিয়ে। অদ্ভুত তো খিদে পেয়েছে সে ক্ষেত্রে সে কি করতে পারে। অবশ্যই গাড়িতে বসে রান্নাবান্না করে খাওয়াতে পারবে না। আদ্রিতা কতক্ষণ ফারিশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমি কি আপনায় রান্না করে খাওয়াবো?”
“না। আমার সাথে ওই সামনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে উদ্ধার করবেন।”
আদ্রিতা তার বামপাশে তাকালো। আলোকিত একটা রেস্তোরাঁ দেখলো। সে বললো,
“আমার পায়ের যা অবস্থা তাতে ভিতরে যাওয়া সম্ভব না।”
“আপনায় এখানে একা বসিয়ে রাখবো না। তাই তো ডেকে তোলা।”
“কিন্তু,
“কোনো কিন্তু নয় চলুন আমার সাথে। খিদে টিদে পেয়েছে তো নাকি।”
কথাটা বলে গাড়ি থেকে বের হলো ফারিশ। আদ্রিতা সিটব্লেট খুললো। খিদে অবশ্য একটু পেয়েছে। আদ্রিতা তার পায়ের দিকে তাকালো। পায়ের অবস্থা জটিল। খুলে আরেকবার ব্যান্ডেজ করতে পারলে ভালো হতো। সঙ্গে একটা ব্যাথার ঔষধ দরকার। ফারিশ দরজা খুলে দিল। আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি হলো? বের হচ্ছেন না কেন?”
আদ্রিতা আস্তে আস্তে বের হলো এই ফারিশের আচমকা এমন আচরণে সে বেশ বিরক্ত। ফারিশ আবারও আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিলো। আদ্রিতা থতমত খেল আবার। এই ছেলেটা করছেটা কি! আদ্রিতা ফারিশের গলা ধরলো এবার। ফিসফিস করে বললো,
“কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“আমার ভালো লাগছে।”
কথাটা বলে হন হন করে রেস্তোরাঁর ভিতরে চলে গেল। রেস্তোরাঁর মানুষদের চোখ ছানাবড়া। তবে পরক্ষণেই আদ্রিতার পায়ের অবস্থা থেকে বেশি ভাবলো না। আদ্রিতার লজ্জা লাগছে এভাবে রেস্তোরাঁ ভর্তি মানুষের সামনে দিয়ে কিভাবে যাচ্ছে। আদ্রিতার বললো,
“এমন করছেন কেন আমি বিব্রত হচ্ছি।”
“এত বিব্রত হওয়ার কি আছে! আমরা যা নই মানুষ সেটাই ভাবছে।”
আদ্রিতা কিছু বললো না। ছেলেটা কি বললো তাই ভাবছে। ফারিশ আদ্রিতাকে নিয়ে এসে বসলো চেয়ারে। একজন ওয়েটার দৌড়ে আসলো দ্রুত। বললো,
“কি খাবেন স্যার? ভাত, মাংস, বিরিয়ানি।”
ফারিশ আচমকাই আদ্রিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তুমি কি খাবে বলো ওনাকে?”
তড়িৎ চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম আদ্রিতার এই প্রথম ফারিশ তাকে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করলো। কেন বললো? ওয়েটার আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“কি খাবেন ম্যাম?”
আদ্রিতা যেন শুনতেই পেল না ওয়েটারের কথা সে তাকিয়ে তখনও ফারিশের দিকে। ফারিশ গ্লাসে পানি ঢাললো। এক চুমুক দিয়ে বললো,
“কি হলো তুমি কিছু বলছো না কেন?”
আদ্রিতার এবার হুস আসলো। আমতাআমতা করে বললো,“জি।”
ওয়েটার মৃদু হেসে আবার বললো,
“ম্যাম অর্ডারটা?”
আদ্রিতা থরথর করে বললো,
“আলু ভর্তা আর ভাত নিয়ে আসেন সঙ্গে একটা ডিম ভাজা।”
“আচ্ছা ম্যাম।”
ওয়েটার এবার ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি খাবেন স্যার?”
ফারিশের দ্বিধাহীন জবাব,
“ম্যাম যা বলেছে স্যারও তাই খাবে।”
ওয়েটারের ঠোঁটে আপনাআপনি মিষ্টি হাসি হাসলো। মৃদুস্বরে বললো,“আচ্ছা স্যার।”
ওয়েটার চলে গেল। আদ্রিতার তীক্ষ্ণ চাহনী। সে ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,“এগুলো কি হচ্ছিল? আপনি হঠাৎ তুমি তুমি করছেন কেন?”
ফারিশ খানিকটা এগিয়ে আসলো। আদ্রিতাও এগোলো। ফারিশ আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“আমরা যেভাবে এন্ট্রি নিয়েছি তাতে সবাই ভেবে নিয়েছে আমরা স্বামী-স্ত্রী। এখন এখানে বসে আপনি-আঙ্গা করলে তাদের সন্দেহ হতো। যেটা আমি মটেও চাচ্ছি না। তাই বেশি না বকে খাবার এলে খেয়েদেয়ে বের হন। বুঝেছেন। আর তাছাড়া মানুষের ভুলটা ভাঙলে আমার চেয়ে আপনায় নিয়ে কথা হতো বেশি। কেউ আপনার চরিত্র নিয়ে কিছু বলুক তা আমি মটেও চাচ্ছি না।”
ফারিশ সরে এলো। আদ্রিতা চুপ করে রইলো। তার মনে হলো কোথাও গিয়ে কথাগুলো ভুল বলে নি ফারিশ। মিনিট বিশ যেতেই গরম গরম ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজা নিয়ে হাজির ওয়েটার। আদ্রিতা ভেবেছিল এইসব খাবার খেতে ফারিশের বুঝি অসুবিধা হবে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ফারিশ তৃপ্তি পেরে খাচ্ছে। আদ্রিতা বিষয়টায় মুগ্ধ হলো। এত বড় ঔষধ কোম্পানির মালিক আলু ভর্তা আর ভাত এভাবে তৃপ্তি পেরে খাবে এটা যেন সে আশা করে নি।”
ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বাজতে ছ’মিনিট বাকি। আদ্রিতা আর ফারিশ রেস্তোরাঁ থেকে বের হলো। ফারিশ আবারও তাকে কোলে নিয়ে বেরিয়েছে। আদ্রিতার এবার আর কোনো দ্বিধা কাজ করে নি। রেস্তোরাঁ থেকে বের হতেই আদ্রিতার নজরে আসলো একটা ফার্মেসীর দোকানের দিকে। সে তাড়া দিয়ে বললো,“ওই ফার্মেসীতে একটু চলুন না। আমার পায়ের ব্যাথার জন্য একটা ঔষধ কিনতে হবে।”
ফারিশ আর দ্বিধা করলো না। বিনা বাক্যে চললো সেখানে। আদ্রিতা প্রায় পনের মিনিট সময় নিয়ে তার পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে পুনরায় চিকিৎসা করলো পায়ের। জখম হয়েছে বেশ। তার জুতো পুরো ছিদ্র হয়ে গেছিল। ফারিশ বেশ ধৈর্য্য নিয়ে পুুরোটা সময় অপেক্ষা করলো আদ্রিতার জন্য। অবশেষে তার শেষ হলো। ফারিশ এগিয়ে গেল তার গাড়ির কাছে। গাড়িটাকে এগিয়ে আনলো ফার্মেসীর দরজার মুখে। অতঃপর আদ্রিতাকে ধরে বসালো গাড়িতে। তারপর দম ফেললো। যাক এবার নিরদ্বিধায় গাড়ি নিয়ে ছোটা যাবে। ফারিশ গাড়ির ভিতর ঢুকলো। দরজা আঁটকে সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বেশ হুকুমের স্বরে বললো,
“বাকি রাস্তায় আপনি আর ঘুমাবেন না।”
আদ্রিতা চরম অবাক হয়ে বলে“কেন?”
যার বিনিময়ে ফারিশের জবাব আসে,“সব কেনোর উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি। তাই কথা কম বলে জেগে থাকুন।”
আদ্রিতা বেশি ভাবলো না। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। পথ তাদের এখনো অনেক বাকি। আদ্রিতার গান গাইতে মন চাইলো হঠাৎ। মনে মনে গেয়েও উঠলো দুই লাইন,
“এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”
—-
কুয়াশাছন্ন এক মিষ্টি পরিবেশ। ফজরের আজান দিতে বোধহয় খুব বেশি দেরি নেই। আদ্রিতা আর ফারিশ এসে থামলো আদ্রিতাদের বাড়ির সামনে। শীতে কাঁপাকাঁপি অবস্থা আদ্রিতার। আদ্রিতা গাড়ির সিটব্লেট খুললো। ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,,
“এতটা পথ সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনায় অসংখ্য ধন্যবাদ মিস্টার বখাটে।”
ফারিশ অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আদ্রিতার দিকে। বললো,“আপনায় কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”
আদ্রিতা মৃদু হেঁসে বললো,“জানি তো। তাও আপনায় এই নামে ডাকতে আমার দারুন লাগে। ভালো থাকবেন। আমাদের আর দেখা না হোক।”
বলে গাড়ি থেকে বের হতে নিলো আদ্রিতা। ‘আমাদের আর দেখা না হোক’ কথাটায় ফারিশের বুকে বুঝি ব্যাথা উঠালো। সে বুঝলো। কিন্তু অবুঝের মতো একখানা কান্ড করে বসলো। সে হাত ধরলো আদ্রিতার। আদ্রিতা ভড়কালো। জিজ্ঞাসাসূচক চাহনি নিয়ে তাকালো ফারিশের দিকে। ফারিশ এগোলো। আদ্রিতার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
“আপনার চোখে আমি যা দেখি তা যদি সত্যি হয়। তবে আমাদের রোজ সাক্ষাৎ হবে।”
ভূমিকম্পের মতো ফারিশের কথাটায় কেমন কম্পন ধরালো আদ্রিতার শরীরে। ভিতরটা কেঁপে উঠলো আচমকা। কিছু বলার শক্তই পেল না আর। সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ঠায় দাঁড়ালো। ফারিশ আর অপেক্ষা করলো না ছুট লাগালো দূরে। আদ্রিতা তার যাওয়ার পানে তাকানো। হঠাৎ মৃদু হেঁসে উঠলো আপনাআপনি। মনে মনে আওড়ালো,“তাহলে আমাদের রোজই সাক্ষাৎ হোক মাফিয়া সাহেব।”
ঠোঁটে কামড় দিলো আদ্রিতা। বললো,“থুঁড়ি মিস্টার বখাটে।”
#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️