এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ পর্বঃ১৪,১৫

0
380

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
পর্বঃ১৪,১৫

নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। শাঁ শাঁ শব্দ করে ছুটছে সমুদ্রের ঢেউ। ঘড়িতে প্রায় রাত এক’টা ছাড়িয়ে। ফারিশ দাড়িয়ে সমুদ্র থেকে একটুখানি দূরে। সমুদ্রের ঢেউয়েরা তাকে ছুঁতে চাইছে বারংবার কিন্তু পারছে না। তারা আসতেই ফারিশ যাচ্ছে সরে। যার জন্য তারা প্রতিবার তাকে ছুঁতে হচ্ছে ব্যর্থ। ফারিশ একটু সরে এক স্থানে স্থিরভাবে দাঁড়ালো। চোখ দুটো নিলো বুজিয়ে। সে অনুভব করলো প্রকৃতি তার ঠান্ডা বাতাস দিয়ে তাকে বার বার ছুঁইছে। সর্বাঙ্গ করছে শীতল। ফারিশ কিছু কল্পনা করলো। সেই মাঝরাতে ছুটে যাওয়া হসপিটাল, প্রথম দেখা হওয়া, মেয়েটাকে তুলে আনা, ক্ষত সারাতে আবার হসপিটাল যাওয়া, হোটেল রুমে দেখা হওয়া, অনিচ্ছাকৃত কাছাকাছি হওয়া, মেয়েটাকে বেলকনিতে দেখা, সিঁড়িতে মুখোমুখি হওয়া। সবকিছুই এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করছে ফারিশের বক্ষস্থলে। ফারিশ ভাবলো ওই মেয়েটা! মেয়েটার নাম। ফারিশ চেষ্টা করলো মেয়েটার নাম মনে করার। কিন্তু আশ্চর্যজনক মেয়েটার নাম মনে পড়ছে না। অনেকক্ষণ ভেবে ব্যর্থ হওয়ার পর ফারিশ বুঝলো সে মেয়েটার নাম জানে না। জিজ্ঞেস করা হয় নি কখনো। অথচ তাদের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। মেয়েটা কি এই দেখা হওয়ার মধ্যে তাকে একবারও নিজের নাম বলে নি। না ফারিশের মনে পড়ছে না। মেয়েটা সত্যি কি একবারও তার নাম বলে নি নাকি বলেছিল ফারিশের মনে পড়ছে না। কোনটা! ফারিশ ভাবনায় ব্যর্থ হলো। চিন্তা করলো আদিব নিশ্চয়ই মেয়েটার নাম জানবে। ফারিশ ডাক্তার ম্যাডামের নাম জানে না। জানার তো কথা ছিল কিন্তু জানলো না কেন? ফারিশ তার পকেটে হাত দিলো। ফোন বার করলো মেয়েটার নামটা জানার জন্য ফারিশ ব্যাকুল হচ্ছে। অথচ এতটা ব্যাকুল হওয়ার মতো কোনো বিষয়ই নয় এটা। ফারিশ আদিবকে কল করবে ভেবেও কল করলো না। কল করে কি বলবে, ‘আদিব ওই ডাক্তার ম্যাডামের নামটা কি তুমি জানো? এত রাতে এই প্রশ্ন করার কোনো অর্থ হয়। জিজ্ঞেস করলে কাল করবে। তাও ফারিশের সংকোচ হচ্ছে। ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইদানীং তার হাবভাব বদলাচ্ছে। মিনিটে মিনিটে ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। বিশেষ করে কালকের ওই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখার পর থেকে। খোলা চুলে মেয়েটাকে দারুণ দেখাচ্ছিল। ফারিশ অস্থির হয়ে তার চোখ খুললো। তাকে ব্যাকুল দেখাচ্ছে। অস্থিরতায় চারপাশ থমকাচ্ছে। ফারিশ টের পেল সমুদ্রের ঢেউ তার বেশ নিকটে এখনই পা না সরালে তাকে ছুঁয়ে যাবে এক নিমিষে। ফারিশ তার পা সরাতে নিলো। এরই মাঝে এক মেয়েলি কণ্ঠে বলে উঠল এক রমণী,“এত রাতে সমুদ্র বিলাস করছেন বুঝি?”

ফারিশ চমকালো। পা আঁটকে পড়লো ওখানেই। অতঃপর বহু প্রচেষ্টার পর সমুদ্র তাকে ছুঁয়েই দিলো। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। সমুদ্রের ঠান্ডা শোয়ায় তার শীত লাগলো। গায়ে পশম বুঝি গেল দাঁড়িয়ে। অথচ সমুদ্রের পানি শরীর কাঁপানোর মতো ঠান্ডা ছিল না। ফারিশের কান্ডে মৃদু হাসলো আদ্রিতা। শীতল স্বরে শুধালো,“আপনার কি শীত লাগছে মিস্টার বখাটে?”

ফারিশ চোখ খুললো। মিনিট দুই চুপ থেকে চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
“আপনাকে কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

আদ্রিতা কিঞ্চিৎ হাসলো। ফারিশকে সামান্য রাগানোর জন্যই বখাটে শব্দটা উচ্চারণ করলো। ছেলেটাকে রাগাতে তার বেশ লাগে। আদ্রিতা মৃদু হেসেই বললো,
“রাগ করবেন না। আমি জাস্ট মজা করে বলেছি।”

ফারিশ নিশ্চুপ। কথা নেই। আদ্রিতাও নীরব। ফারিশ আদ্রিতার মুখশ্রীর পানে তাকালো। দ্বিধাহীন স্বরে বললো,
“তা এত রাতে আপনি এখানে কি করছেন?”

আদ্রিতা সরাসরি ফারিশের দিকে চাইলো। ফারিশ চোখ সরালো। কেমন যেন মেয়েটার চোখে চোখ রাখা যাচ্ছে না। আদ্রিতা বললো,
“আপনি যা করছিলেন?”
“কি করছিলাম আমি!’

কথাটা বলে ফারিশ থতমত খেলো। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। বললো,
“আপনাকে অস্থির দেখাচ্ছে। আপনি কি ঠিক আছেন?”

ফারিশের বুঝি কথা আটকে গেল। সে থমকে গেল হঠাৎ! মেয়েটার আচমকা আগমনের জন্য ফারিশ বুঝি প্রস্তুত ছিল না। ফারিশকে চুপ থাকতে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে আবারও বললো আদ্রিতা,
“আচ্ছা আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন?”

ফারিশ বিস্মিত হলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো পুরোপুরি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললো,
“কেমন করি?”
“আপনি জানেন না।”
“আমি ধরতে পারছি না।”
“আপনি অদ্ভুত আচরণ করেন যা আসলে একটা মানুষ করে না।”
“আমি কি তবে মানুষ নই?”

ফারিশের আচমকা প্রশ্নে আদ্রিতা আঁটকে পড়লো। কি জবার দিবে বুঝচ্ছে না। সে বললো,
“আমি তা কখন বললাম?”
“কি বলেছেন তবে?”
“আমি আসলে বুঝাতে পারছি না।”

ফারিশ হাসলো। আদ্রিতার সেই হাসিতে চোখ আটকালো। আদ্রিতা বরাবরই ফারিশের এই হাসিতে আঁটকে পড়ে। শ্যামবর্ণের এই পুরুষটির সবচেয়ে মুগ্ধনীয় হলো তার হাসি। আদ্রিতা বললো,
“আপনি হুটহাট হাসবেন না তো?”

ফারিশের চাহনি বদলালো। সে বললো,
“কেন হাসলে কি সমস্যা?”
“কারণ বলবো না।”

ফারিশ কিছু বলে না চুপ থাকে। মেয়েটা তাকে অদ্ভুত বলে অথচ সে নিজেই যে অদ্ভুত তা বুঝচ্ছে না। অনেকক্ষণ নীরবতা চলে দুজনের মাঝে। হঠাৎ আদ্রিতা বলে,
“সমুদ্রে নামবেন?”

ফারিশের একরোখা জবাব,
“সমুদ্র আমার পছন্দ নয়।”

আদ্রিতা যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছালো ফারিশের কথা শুনে। বিস্ময়কর চেহারায় বললো,
“কি বলেন সমুদ্র আপনার পছন্দ নয়?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না।”
আদ্রিতা বিষম খেয়ে বললো,
“আপনাকে আমি সাধে অদ্ভুত বলি। আমার জানা মতে পৃথিবীতে এমন মানুষ নেই যার সমুদ্র পছন্দ নয়।”
“আপনি ভুল জানেন?”
“আপনি একটা বোকা মানুষ।”
“যা মনে করেন।”

আদ্রিতা কোনো কথা না বাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। ফারিশ আওয়াজ করে বলে,
“এত রাতে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। ফিরে আসুন সমুদ্রের স্রোত প্রবল আপনায় ভাসিয়ে নিতে পারে।”

আদ্রিতা ঘুরে তাকালো। মৃদুস্বরে বললো,
“সমুদ্র আমার দারুণ লাগে। আর দারুণ জিনিসে মরণ হলে আরো দারুণ বিষয়। আপনি বুঝবেন না।”

ফারিশ কিছু বলতে পারে না। আদ্রিতা একটু একটু করে এগোচ্ছে সমুদ্রের ভিড়ে। আদ্রিতা ঝিনুক কুড়াবে। যে শুনেছিল মাঝরাতে প্রবল সমুদ্রের স্রোতে নাকি বিশাল ঝিনুক শামুক পাওয়া যায়। যদিও কথাটা কতটুকু সত্য জানা নেই তার। তবে এই মাঝরাতে ঝিনুক কুড়ানোর অন্যরকম মজা আছে। এছাড়া মাঝরাতে সমুদ্র বিলাসেরও দারুণ টেস্ট। অথচ বদ্ধ উন্মাদ ছেলেটি বলে কি না তার নাকি সমুদ্র পছন্দ নয়। আদ্রিতার কেন যেন মনে হলো এই কথাটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিরি মিথ্যে কথা। আদ্রিতা তার ফোনের লাইট অন করলো। ভেবেছিল মৃদুল ওদের নিয়ে আসবে। পরে ভাবলো এতরাতে ডাকা ঠিক হবে না। মুনমুনকে আসার জন্য বলেছিল কিন্তু ঘুমে বুদ থাকায় আর আসলো না। আদ্রিতা বড় কোনো ঝিনুক, শামুক খুঁজছে। কক্সবাজার এসে বিশাল শামুক ঝিনুক কুড়িয়ে পাওয়া এ যেন ভাগ্যের ব্যাপার। আদ্রিতা সেই ভাগ্যটা লুফে নিতে চায়। যদিও জানে না আধও পাবে কি না। আদ্রিতা মাথা নুইয়ে দেখতে লাগলো কিছু পাওয়া যায় কি না। সমুদ্রের পানি পা ছুঁতেই আদ্রিতার ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি আসছে। আনন্দ আনন্দ অনুভব হচ্ছে। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। অদ্ভুত ব্যাপার ফারিশের আজ রাগ লাগছে না। উল্টো মেয়েটাকে দেখে ভালোই লাগছে। আদ্রিতা ধীরে ধীরে আরো সামনে এগোচ্ছে। তার হঠাৎ মনে হলো সমুদ্র বুঝি তাকে টানছে। পানির দিকে যত এগোচ্ছে ততই যেন গভীর ভাবে তাকে ডাকছে। ফারিশের বিষয়টা কেমন যেন লাগলো। সে আচমকাই তার মন্দ লাগাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল আদ্রিতার দিকে। অন্যদিকে সমুদ্র বেয়ে বিশাল এক স্রোত আসছে। শক্ত হয়ে দাঁড়াতে না পারলে এ স্রোত আদ্রিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। আদ্রিতা এক ধ্যানে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে। আর একটু এগোবে এরই মাঝে তার হাত ধরে নিজের দিকে টানলো ফারিশ। ফারিশের আচমকা টানে নিজেকে সামলাতে না পেরে আদ্রিতা এসে পড়লো ফারিশের অনেকটা কাছে। মাথা ঠেকলো বুকের বাম পাশে। এরই মাঝে এক বিশাল স্রোত তাদের দুজনকে ছুঁইয়ে দিলো। খানিকটা সরেও গেল দুজনে। আদ্রিতা ঘাবড়ে গেল। শক্ত করে চেপে ধরলো ফারিশের শার্ট। ফারিশ এবার রেগে গেল। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো,
“এই মেয়ে আপনার সমস্যা কি? এখনই তো মরতে বসে ছিলেন।”

আদ্রিতা নিরুত্তর। সে ভয় পেয়েছে। ফারিশ আদ্রিতাকে টেনে কিনারায় নিয়ে এলো। ঝাঁজালো গলায় বললো,“বড় বড় কথা সবাই বলতে পারে, সত্যি সত্যি ঘটে গেলে তখনই ঘাবড়ানো ভাব দেখা যায়।”

আদ্রিতা নিজেকে সামলালো মিনিট দুই চুপ থেকে আমতা আমতা করে বললো,
“আমি ঘাবড়াই নি। সে তো আপনি আচমকা টান দেয়ায় সামান্য ভয় পেয়েছিলাম।”

ফারিশের ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু মারলো না। সে আদ্রিতার থেকে সরে আসলো। হোটেল ফেরার প্রস্তুতি নিলো। ফারিশ কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই আদ্রিতা বললো,
“একদম ভালো লাগে না বলতে মুখ খুলবেন না। আমাকে আপনার ভালো লাগাতে হবে না। এমনিতেও শীঘ্রই বিয়ে করছি। মানছি আগে কথা বলতে এসেছি এর মানে এই নয় আপনায় আকৃষ্ট করাতে চাচ্ছি। ওই ধরনের মেয়ে আমি নই।”

ফারিশ কিছু বললো না। তার অস্থির চোখ। অন্তরে আকুলতা। সে অনুভব করলো তার বুকে বুঝি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। মেয়েটার বিয়ের কথা শুনে। হবে হয়তো!’

ফারিশ বুকে হাত দিলো। তা দেখে আদ্রিতার অস্থির লাগলো। সে দ্রুত এগিয়ে এলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“কি হলো আপনার?”

ফারিশ কেমন করে যেন একটু চাইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার অস্থিরতায় ঘেরা আঁখিযুগল দেখলো। আদ্রিতা আবার প্রশ্ন করলো,
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”

ফারিশ শীতল স্বরে শুধালো,
“ধরতে পারছি না। তবে আমি বুঝচ্ছি আমার ভিতরটা জ্বলছে ডাক্তার ম্যাডাম।”

#চলবে…..

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৫

সমুদ্রের প্রবল স্রোতে উপচে পড়া ঢেউ। ঝনঝন করে শব্দ হচ্ছে ঘনঘন। ফারিশ বসে ছাতাযুক্ত চেয়ারে। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। তার বুকের ভেতর হঠাৎ ওঠা ব্যাথাটা এখনও থামছে না। মেয়েটার বিয়ে কথা শুনে ফারিশের ভেতর এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত নয় ফারিশ। ফারিশ বরাবরই মেয়েদের থেকে দূরে থাকে। তার এই সাতাশ বছরের জীবনে তেমন কোনো মেয়ে মানুষের আগমন ঘটে নি। এই ডাক্তার ম্যাডামই প্রথম। ফারিশের মনে প্রশ্ন জাগলো সেই রাতের এক পশলায় ঝুম বর্ষায় সে বাঁচতে গিয়েছিল নাকি মরতে। প্রেমারোগে আসক্ত হলো নাকি ফারিশ। ফারিশ চমকালো। নিজের ভাবনায় নিজেই ভড়কালো। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ফারিশ অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। নিজেকে যথাসম্ভব সংযোত করার প্রচেষ্টা চালালো কিন্তু সে ব্যর্থ। ফারিশ পকেটে হাত দিলো দেশলাই আর একটা সিগারেট বের করলো। সিগারেট ধরিয়ে মুখে পুড়তেই আদ্রিতার কণ্ঠ শোনা গেল। হাতে পানির বোতল। মূলত ফারিশের জন্য পানি আনতেই ওদিকটায় গিয়েছিল। আদ্রিতা দৌড়ে এলো। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেললো বার কয়েক। ফারিশের দিকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নিন পানি খান।”

ফারিশ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়েছে অনেক আগেই। ফারিশ আদ্রিতার হাত থেকে পানির বোতলটা নিল। ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে নিশ্বাস নিলো। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,
“এখন ঠিক লাগছে?”

ফারিশ উপর নিচ মাথা নাড়ালো। আদ্রিতা সস্থির নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“যাক ভালো হয়েছে। আচ্ছা এমন ব্যাথা কি আপনার সবসময় হয়?”

ফারিশ ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। বললো,
“আগে হতো না কিন্তু ইদানীং হচ্ছে।”

আদ্রিতাকে চিন্তিত দেখালো। থমথমে কণ্ঠে বললো,
“শুনুন বুকে ব্যাথা ওঠাটা ভালো লক্ষণ নয়। ঢাকা গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নিবেন।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা ফারিশের পাশে বসে৷ নিস্তব্ধ স্বরে বলে,
“হোটেলে যাবেন না?”
“যাবো আপনি আগে যান।”

আদ্রিতা পিছন দিকটায় তাকালো। কিছু ছেলে দাঁড়ানো। কতক্ষণ আগে থেকেই ছেলেগুলোকে লক্ষ্য করেছে আদ্রিতা। পানি আনার পথেও তাকে অনুসরণ করছিল। আদ্রিতা খানিকটা ঘাবড়ানো স্বরে বললো,
“একই জায়গাতেই তো যাবো চলুন না একসাথে যাই।”

ফারিশ চেয়ে রয় মেয়েটার দিকে। আদ্রিতা বলে,
“এভাবে তাকিয়ে থাকার মতো কিন্তু কিছু বলি নি।”
“আপনার কি ভয় লাগছে?”

আদ্রিতা দ্বিধা ছাড়াই বলে উঠল,
“বেশি না একটু।”

ফারিশ হাসলো। আদ্রিতা বললো,
“আপনাকে হাসতে বারণ করেছিলাম কিন্তু।”

ফারিশ শুনলো না। সে বিস্তর হাসলো। বললো,
“আপনার বারণ শুনতে আমি তো বাধ্য নই।”
“হুম জানি জানি এখন চলুন।”

ফারিশ আর দ্বিধা করলো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পানির বোতলটা চেয়ারে রেখেই অগ্রসর হলো আদ্রিতার পিছু পিছু। আকাশে তখন কোনো তাঁরা নেই। বিশাল আকাশটা পুরোই শূন্য। তবে আরো আগে দু’একটা ফানুস উড়ে ছিল। সমুদ্রের কিনারায় জমিনের বুকে ছড়িয়ে থাকা দোকানগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছিল বন্ধ। সমুদ্রের পানি ধীরে ধীরে আরো প্রবল হলো। বালির ভিড়ে জমিনের বুকে সাজিয়ে রাখা চেয়ারগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছিল প্রতিনিয়ত।’
—-
মাঝরাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে আদ্রিতা আর ফারিশ৷ দুজনেই চুপচাপ। নীরব। কোনো কথা নেই। বীচ থেকে হেঁটে হেঁটে হোটেল যেতে প্রায় পনের মিনিট সময় লাগে। গাড়িতে গেলে পাঁচ সাত মিনিট। আদ্রিতাই শুরু করলো আগে,“তা আপনিও কি কক্সবাজার ঘুরতে এসেছেন নাকি?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না। ঘুরতে নয়।”
আদ্রিতা আগ্রহ নিয়ে বললো,
“তাহলে?”
ফারিশের দ্রুত জবাব,
“খুন করতে।”

আদ্রিতা থতমত খেল উত্তর শুনে। পরমুহূর্তেই উচ্চশব্দে হেঁসে উঠলো। ফারিশ সেই হাসি দেখলো অনেকক্ষণ। বললো,
“এখানে হাসার কি ছিল?”
“ছিল না বুঝি। বোকা পেয়েছেন আমাকে।”
“হবে হয়তো।”

আদ্রিতা দমে গেল। ছেলেটা তাকে কি সুন্দর শান্তভাবে গালি দিল। আদ্রিতা আবার বললো,
“আমাকে কি সত্যি আপনার পাগল মনে হয়।”
“মনে হবার কি আছে আপনি তো পাগলই।”

ফারিশের এবারের কথা শুনে আদ্রিতার চক্ষু বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বললো,
“আপনি আমায় অপমান করছেন?”
“সত্যি করেছি আমি ধরতে কেন পারলাম না।”

আদ্রিতা চুপ হয়ে গেল। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। মেয়েটাকে চটাতে তার দারুণ লাগছে। আদ্রিতা চোখ মুখ ফুলিয়ে হাঁটছে। ফারিশ শব্দ করে বললো,
“আপনি কি রাগ করলেন ডাক্তার ম্যাডাম?”
“মটেও না। মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার কাছের মানুষদের ওপর রাগ করে। আর আমি যতদূর জানি আপনি আমার কাছের মানুষ নন।”

ফারিশের মুখ ফ্যাকাশে হলো। তাও মেনে নিলো। কথাটা তো মিথ্যে নয়। ফারিশ বললো,
“আমি কেন আপনার চোখে আমার প্রতি রাগ দেখছি। কাছের মানুষ তো নই। তাহলে?”
“আমি রাগ করি নি।”
“আপনার চোখ তো বলছে রাগ করেছেন, ফোলা ফোলা থমথমে মুখ বলছে আপনি রাগ করেছেন, আপনার উল্টে রাখা ঠোঁটখানাও বলছে আপনি ভীষণভাবে রাগ করেছেন।”

আদ্রিতা এবার সরাসরি চাইলো ফারিশের চোখের দিকে। ফারিশের চোখের পাশে থাকা কাটা দাগটা সরাসরি নজরে পড়লো তার। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,
“আপনার কপালের দাগটা কিসের?”
“কিছু একটার হবে হয়তো জানা নেই।”

আদ্রিতার এবার বিরক্ত লাগলো লোকটা সব প্রশ্নের ত্যাড়া উত্তর দিচ্ছে। আদ্রিতা বিরক্ত নিয়েই বললো,
“আপনি মানুষটা খুব বাজে।”

ফারিশ মৃদু হেসে বললো,
“আমি জানি তা।”

অতঃপর সারা রাস্তায় আর কোনো কথা হলো না দুজনের। হোটেলের সামনে আসলেই নাইট গার্ড হোটেলের দরজা খুললো। সে এই দুজনেরই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। ফারিশ কিছু টাকা গুঁজে দিলো গার্ডকে। বললো,“ধন্যবাদ এতক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য।”

গার্ডটি খুশি হলো। সে ভাবে নি ফারিশ তাকে উপহার হিসেবে টাকা দিবেন। গার্ডটি মুচকি হেসে বললো,“এটাই আমার কাজ স্যার।”

আদ্রিতা আর ফারিশ উপরে উঠলো। ফারিশের পরে আদ্রিতার রুম আসে। হঠাৎই নিজের রুমের সামনে আসতেই আদ্রিতার হাত ধরে বসলো ফারিশ। আদ্রিতা এতে চমকালো, ভড়কালো, অবাক হলো খুব। জিজ্ঞাসাসূচক তাকিয়ে রইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ শীতল স্বরে বললো,
“একটা কথা রাখবেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

ফারিশের কণ্ঠটা ঠিক কেমন যেন শোনালো। আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকিয়ে বললো,
“জি বলুন।”
“আমার থেকে একটু দূরে থাকবেন আমার সত্যি আপনাকে ভালো লাগে না।”

আদ্রিতার হাত ছাড়লো ফারিশ। নিজের রুমের দরজা খুলে ঢুকে পড়লো হঠাৎ। ঘুরেও দেখলো না। আদ্রিতা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। মুখ ফসকে বললো শুধু,“ফাজিল লোক।”
—-
সূর্যটা তখন কেবল উঠেছে। মৃদু মৃদু কুয়াশায় ভরপুর চারপাশ। মাস তখন নভেম্বর ছাড়িয়ে পহেলা ডিসেম্বরে পড়েছে। বাতাসে বাতাসে শীতের প্রবল গন্ধ ছেড়েছে। আদ্রিতা গায়ের কম্বলটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে চেপে ধরলো। শীতের পোশাক তেমন আনা হয় নি। পাতলা একটা চাদর এনেছে শুধু। আদ্রিতার ঘুমের ঘোরে মনে পড়লো ফারিশের বলে যাওয়া শেষ কথাটা“আমার থেকে একটু দূরে থাকবেন আমার সত্যি আপনাকে ভালো লাগে না।”

আদ্রিতা ঘুমের ঘোরেই বলে উঠল,“আপনার মতো পাঁজি লোক আমি দুটো দেখিনি।”

এমন বার কয়েক কথা ঘুমের ঘোরে আরো বললো আদ্রিতা। আদ্রিতার কথা শুনতে পেল মুনমুন। সে ঘুমের ঘোরেই বললো,“আদু কি হয়েছে তোর একা একা বিরবির করছিস কেন?”

আদ্রিতার টনক নড়লো। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। থমথমে কণ্ঠে বলে ফেললো,“তেমন কিছু না তুই ঘুমা।”

মুনমুন শুনলো। জবাবে কিছু না বলে উল্টোদিক ঘুরে ঘুমালো। আদ্রিতা সস্থির নিশ্বাস ফেললো। নিজেও আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো। মিনিট পাচেক যেতেই আবারও ঘুমে ভর করলো আদ্রিতাকে।’
—-
নিজের রুমের বেলকনিতে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। হাতে সিগারেট। মুখে বিরক্তির ছোঁয়া। গায়ে জড়ানো শার্ট। এলেমেলো চুল। বিচ্ছিরি চিন্তা ভাবনা মগজে। ফারিশ সিগারেটে টান দিলো। ধুঁয়া উড়ালো। কাল রাত থেকে ফারিশ বেলকনিতে বসা ছিল। সারারাত ঘুমায় নি। কিছুক্ষণ আগেই বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। ফারিশের কালকের পুরো রাতটা জুড়ে ছিল আদ্রিতা। সে মেয়েটাকে ভুলতে পারছে না। মেয়েটার বিয়ে হবে এটাও মানা যাচ্ছে না। ফারিশ সিগারেটে লাস্ট টান দিলো। বিরক্ত নিয়ে বললো,
“মেয়েটার বিয়ে হোক বা না হোক তাতে তার কি? কিছুই না। ফারিশ ভুলে কেন যাচ্ছে তার এই বিচ্ছিরি অনিশ্চিত জীবনে কোনো মেয়ে মানুষের জায়গা নেই।”

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here