#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৮)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১৫৭)
নিজের রুমে বিছানায় তরুনিমার সাথে বসেছিলো সন্ধ্যা। সেইসময় কামিনী সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“কি নিয়ে কথা বলছো তোমরা!”
তরুনিমা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“৬দিন পরেই তো সন্ধ্যার বিয়ে। হাতে তো আমার সময় খুবই কম। তাই ওর জুয়েলারী, মেকআপ আইটেম আর লেহেঙ্গা-শাড়িগুলো কোথায় থেকে কিনলে ভালো হবে সেসব নিয়েই কথা বলছিলাম আমরা চাচী।”
—“ওহহ আচ্ছা। যাই হোক যেটা বলার জন্য এসেছিলাম সেটা বলি। তোমরা যেহেতু বিয়ের কেনাকাটার বিষয় নিয়েই আলোচনা করছো তাই আমার জন্য কসমেটিকস থেকে শুরু করে জুয়েলারি, শাড়ি এগুলোর জন্য সবথেকে বেস্ট যেগুলো সেগুলো সিলেক্ট করার দায়িত্বও আমি তোমাদের দিচ্ছি। আমার একমাত্র ভাতিজির বিয়ে বলে কথা। তাই বিয়েতে উপস্থিত সবার মধ্যে আমাকেই সবথেকে সুন্দর লাগতে হবে। যথাসময়ে আমার জিনিসগুলো যেনো আমি পেয়ে যাই।”
—“ঠিক আছে চাচী। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। সবথেকে বেস্ট জিনিসগুলো আমরা আপনাকেই দিবো।”
কামিনী ভেংচি কেটে বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে বললো….
—“ঠিক আছে…ঠিক আছে…এসব পরেই দেখা যাবে।”
এই বলে কামিনী সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো….
—“ভাবী তুমি ঐ শ*য়/তা*ন মহিলার জন্য কেনা-কাটা করার দায়িত্ব কেনো নিলে? উনি কি আমাদের নিজের কাজের লোক মনে করেছেন নাকি!”
—“সন্ধ্যা কি করছো! আস্তে কথা বলো।”
সন্ধ্যা নিজের রাগ-বিরক্তকি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ধীরস্বরে বললো…..
—“আমার এদের কাওকে সহ্য হচ্ছে না বিশ্বাস করো ভাবী।”
—“হুম বুঝতে পারছি।
এই বলে তরুনিমা বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে চারপাশ ভালোভাবে দেখে রুমের দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে আবারও সন্ধ্যার পাশে গিয়ে বসে বললো….
—“কামিনী চাচীর কোন আচারণটা তোমার সবথেকে বিরক্ত লাগে?”
—“উনি পুরো মহিলাটাই আমার কাছে বিরক্তির কারণ। আলাদা করে কি বলবো!”
—“আচ্ছা আমি একটা উদাহরণ দেই, এইযে উনি সবসময় বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে প্রতিটি কথা বলেন আমার ইচ্ছে করে ওনার বিনুনীটা ধরে গো*ড়া থেকে একদম খাঁ*চ করে কে*টে দেই বা এমন কিছু করি যেনো ওনার মাথার সব চুল পড়ে যায় উনি পুরোপুরি ভাবে টা*ক*লু কাকুদের মতো দেখতে হয়ে যান।”
তরুনিমার এমন কথা শুনে না চাইতেও সন্ধ্যা শব্দ করে হাসতে শুরু করে। সন্ধ্যাকে হাসতে দেখে তরুর ঠোটেও হাসির রেখা ফুটে উঠে। কিছুসময় পর সন্ধ্যা হাসি থামিয়ে ভাবুক স্বরে বললেন….
—“ওনার নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অধিক বরাই করার বিষয়টা আমার ভিষণ বিরক্ত লাগে ভাবী।”
তরুনিমা কিছুসময় ভাবার পর বললো…
—“এখন তুমি আমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো।”
—“কি প্রশ্ন!”
—“শিকার যদি স্বইচ্ছায় শিকারীর পাঁ*তা*নো ফাঁ*দে পা দিতে চায় তখন শিকারীর কি করা উচিত?”
—“নিশ্চিন্ত মনে শিকার করা উচিত।”
তরু হাসিমুখে বললো…..
—“হুম, এখন থেকে আর মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করো এটা ভেবে যে শ*ত্রু*পক্ষ আমাদের প্র*তি*শো*ধ নেওয়ার রাস্তা নিজ হাতে খুলে দিয়েছেন।”
সন্ধ্যা তরুর কথার ভাঁজ বুঝতে না পেরে বললো….
—“মানে তুমি কি বলতে চাইছো ভাবী! তোমার সব কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।”
—“নিলাদ্র ভাইয়াকে কল করো।”
—“এখন! কিন্তু কেনো?”
—“আহা…বাড়তি প্রশ্ন না করে যেটা করতে বলছি সেটা করো। তারপর সব বুঝতে পারবে।”
সন্ধ্যাও আর কথা না বাড়িয়ে নিলাদ্রকে কল করে। তরুনিমা বললো….
—“ইয়ারফোন লাগাও।”
সন্ধ্যা বালিশের পাশ থেকে ইয়ারফোনটা নিয়ে ফোনে সেট করে। এরপর ওরা দু’জনে দু’টো লাইন নিজেদের কানে লাগায়। নিলাদ্র কল রিসিভ করতেই তরুনিমা ইয়ারফোনের স্পিকারটা মুখের কাছে নিয়ে বললো….
—“নিলাদ্র ভাইয়া…আমি তরুনিমা বলছি।”
—“ভাবী…আপনি! সন্ধ্যার ফোন থেকে কল করেছেন যে! সব ঠিক আছে তো?”
—“হ্যা…হ্যা সব ঠিক আছে। সন্ধ্যা আমার পাশেই আছে। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে কল করেছি।”
—“হুম ভাবী, বলুন কি বিষয়!”
তরুর মুখে পুরো পরিকল্পনা শুনে সন্ধ্যা আর নিলাদ্র দু’জনই কিছুসময়ের জন্য স্ত*ব্ধ হয়ে গিয়েছে। তরুনিমা বললো….
—“কি হলো তোমরা কিছু বলছো না কেনো?”
সন্ধ্যা বললো…
—“কিন্তু এতোটা রি*স্ক নিয়ে কাজগুলো করতে গেলে তো আমরা ধ*রা*ও পরে যেতে পারি মেজো ভাবী।”
নিলাদ্র বললো…
—“ধ*রা পড়ার ভ*য় মনের ভিতর পুষে রাখলে আমাদের প্র*তি*শো*ধের আগুনে আমরাই পু*ড়ে ছাই হয়ে যাবো সন্ধ্যা৷ ভাবী যেই পরিকল্পনা করেছে তা যদি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে আমাদের শ*ত্রু*রা তাদের পা*প কর্মের জন্য উপযুক্ত শা*স্তি পাবে।”
সন্ধ্যা আবারও বললো….
—“আগে মেজো ভাইয়ার সাথে এই পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলা উচিত আমাদের। তারপর ভাইয়া যদি সম্মতি জানায় তাহলেই এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।”
তরুনিমা বললো….
—“তুমি নিশ্চিন্ত থাকো সন্ধ্যা আমি তোমার মেজো ভাইয়ার সাথে কথা বলবো এই বিষয়ে। আর আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে তিনি দ্বিমত পেষণ করবেন না। আর নিলাদ্র ভাইয়া আপনাকে যেই কাজ করতে বললাম সেটা দ্রুত করার ব্যবস্থা করুন।”
নিলাদ্র বললো….
—“ঠিক আছে ভাবী।”
এরপর নিলাদ্র কল কেটে দেয়। তরুনিমা শান্ত স্বরে সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“পরিস্থিতি যতোই বেগতিক হোক না কেনো সন্ধ্যা সকলের সামনে নরমাল থাকার চেষ্টা করবে। নিজের রাগ, আবেগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করো।”
—“আমি চেষ্টা করবো ভাবী।”
—“গুড গার্ল। আচ্ছা শুনো…এখন এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। সামনে তোমার বিয়ে। সেটাও তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে। তাই বিয়েতে ফোকাস করো। পুরো বিষয়টা খুব সাবধানতার সাথে আমি হেন্ডেল করে নিবো।”
—“ঠিক আছে ভাবী।”
এরপর তরুনিমা সন্ধ্যার রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।
(১৫৮)
তালুকদার ভিলায় ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ছিলেন তমিজ, রেবেকা আর হুমায়রা। সেইসময় তাহির ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসতে বসতে বললো….
—“বাবা-মা…! আমি চাই আগামী ২দিনের ভিতর আমার আর হুমায়রার বিবাহকার্য সম্পন্ন হোক।”
তাহিরের এরূপ কথা শুনে হুমায়রা শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাহিরকে একবার দেখে সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হুমায়রার এই চাহনীতে যেনো প্রা*ণ নেই। বিয়ে যতো ভালোলাগা, অনুভূতি, উত্তেজনা হুমায়রার মনে কাজ করছিলো একদিন আগে পর্যন্তও তার কিন্ঞ্চিত পরিমাণ ছাপ ও যেনো এখন ওর মুখশ্রী জুড়ে দেখা যাচ্ছে না। রেবেকা বললেন….
—“এতো তাড়াহুড়ো করলে কি চলে রে বাবা? তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। আর হুমায়রার মা-বাবারও তো ওর বিয়ে নিয়ে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আছে।”
তাহির স্বাভাবিক স্বরেই বললো…
—“শুরুতেই তো বলেছিলাম পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে। আর একান্তই যদি জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মাঝে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাদের থাকে তাহলে খালা-খালুকে বলে দাও মেয়ের জন্য অন্য ছেলের সন্ধান করতে।”
তাহিরের এমন প্রতিত্তুর শুনে হুমায়রার কান্না, খারাপ লাগা গুলো যেনো ওর গলায় দলা পেঁ*কে আসে। হুমায়রা ওর খারাপ লাগা গুলোকে এক ঢোকে গি*লে নিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“খালা আমিও চাই না এতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে করতে। তাহির যেমনটা বলছে তেমনটাই করুন আপানারা।”
—“কিন্তু..!”
—“কোনো কিন্তু না খালা।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে যেমন তোমাদের ইচ্ছে। আমি তোমার বাবা-মাকে আজই বলে দিচ্ছি তারা যেনো পড়শু সকালের ভিতর বাংলাদেশে আসতে পারে।”
—“আচ্ছা।”
এই বলে হুমায়রা সোফা ছেড়ে উঠে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। তাহির একপলকে হুমায়রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। রেবেকা ও উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তমিজ শান্ত স্বরে বললেন….
—“বেটা আমি তোমার বাবা হই ঠিকই কিন্তু সবসময় তোমার সাথে বন্ধুসুলভ আচারণ করেছি। তোমাকে এমন ভাবে শা*স*ণ করি নি কখনও যে তুমি আমার কাছে তোমার পারসোনাল কোনো সমস্যা হলে সেই বিষয়টা লুকিয়ে যাবে। তাই সেই জায়গা থেকেই তোমাকে একটা কথা বলছি, ‘ভালোবাসার মানুষটা যতোদিন বেঁচে আছে তোমার কাছে আছে ততোদিন তাকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবেসো কারণ কখন কার মৃ*ত্যুর ঘন্টি বেজে যাবে তা কিন্তু আমরা কেও বলতে পারবো না, ভালোবাসার মানুষটা যখন আমাদের থেকে চিরতরের জন্য দূরে চলে যাবে যেখানে একবার চলে গেলে আর তাকে ফেরানো সম্ভব হয় না তখন এটা ভেবে যেনো তোমাকে আ*ফ*সোস করতে না হয় যে তুমি চাইলেই তাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে পারতে, চাইলে তাকে ক*ষ্ট না দিয়ে যত্ন করে আগলে রাখতে পারতে, চাইলেই তাকে এতো অ*ব*হেলা নাই করতে পারতে।’ আমার কথাগুলো একটু পজেটিভলি চিন্তা করে দেখো বেটা। কোথাও তুমি এমন কাজ করছো না তো!”
এই বলে তমিজ সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। তাহির মাথা নিচু করে দুই হাটুর উপর দুই হাত রেখে মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে রাখে।
.
.
.
নিজের রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির উপর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে হুমায়রা। পরক্ষণেই দু’চোখ দিয়ে নোনাজল ফেলতে ফেলতে বললো….
—“দুনিয়াটা এমন কেনো বল তো? যে যারে ভালোবাসে সে তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কা*ঙা*ল হয়ে ঘুরলেও কেনো তার ভালোবাসা পায় না! প্রকৃত ভালোবাসার বিনিয়মে কেনো তু*চ্ছ-তা*চ্ছি*ল্য, অবহেলা সহ্য করতে হয়? এই প্রতিচ্ছবি….আমাকে একবার ভালোভাবে দেখে বল না তুই, আমি কি খুব অসুন্দর দেখতে! ওর ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন একটু একটু মনের ভিতর গেঁ*থে আসছি বহু বছর হলো। ওর সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে কা*ঙা*লে*র মতো ঘুরছি। কখনও কখনও ওর আচারণ, কথা বলার ধরণ দেখে মন বলেছে ও হয়তো আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি গুলো উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু পরমূহূর্তেই ওর ভিতর এতোটা পরিবর্তন কেনো আসে! বুকের ভিতরটা ধাঁ*রা*লো ছু*রি দিয়ে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দেওয়ার মতো কথা কেনো বলে ও! আর কি করলে ও আমাকে বুঝবে বল না! আমার যে ভিষণ ক*ষ্ট হচ্ছে। ভিষন….!”
কথাগুলো বলতে বলতে হুমায়রা সেখানেই মেঝেতে বসে পড়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ