‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
আধভিক আজকে একটু আগে আগেই চলে এসেছে এনজিওতে। গাড়ি থেকে নেমে, গাড়িতে হেলান দিয়ে একহাত পকেটে গুঁজলো সে। চারিপাশটা একবার দেখে নিয়ে বাম হাতটা উপরে তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
আধভিক: আজকে কি তুমি একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারো না সিয়ু?
কথাটা ভেবে আধভিক নিজ মনে হেসে ওঠে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে হঠাৎই যখন দেখে সিয়ারা ওর দিকে এগিয়ে আসছে তখন আবারও প্রশ্ন করে নিজেকে,
আধভিক: আমি কি হ্যালুজিনেট করছি তোমায়? নাকি তুমি সত্যি এসেছো? এখন তো সবসময়ই আমি তোমার কথা ভাবি, তোমাকে দেখি চারিদিকে।
সিয়ারা: আমি সত্যিই এসেছি আধভিক।
আধভিক: (সোজা হয়ে) কেন? আমার থেকে দূরত্ব বুঝি সহ্য হচ্ছিলো না তাই এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো আজ?
সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) আপনাকে যাতে আর কোনদিন সহ্য করতে না হয় তাই এসেছি।
আধভিকের হাসিটা নিমিষে মলিন হয়ে যায় সিয়ারার কথা শুনে। সিয়ারা অপেক্ষা করে আধভিকের উত্তরের কিন্তু আধভিক এতটাই হতবাক যে কোনো উত্তর দিতে পারে না। তাই সিয়ারা বলে ওঠে,
সিয়ারা: আপনি গতকাল আমার কাছে যে উত্তরটা চেয়েছিলেন আজ সেটাই দিতে এসেছি আপনাকে। (কিছুক্ষণ থেমে) আমি আপনার জীবনের সাথে জড়াতে রাজি নই আধভিক। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না।
আধভিক: আমি তো বলিনি ভালোবাসতে। (কাতর স্বরে)
সিয়ারা: কাওকে ভালো না বেসে তার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি যদি আপনার মনের কথা না জানতে পারতাম তাহলে বন্ধু হয়ে থাকতাম কিন্তু সবটা জানার পর এটা আর সম্ভব নয়। কারণ আপনি আমাকে এক নজরে দেখবেন আর আমি আরেক।
আধভিক: আই প্রমিজ সিয়ারা তোমার অপছন্দের কোনো কথা আমি বলবো না তোমাকে। তুমি যেমন টা চাও তেমনটাই হবে। বন্ধুর মতোই থাকবো আমি। প্লিজ, প্লিজ এভাবে চলে যেও না।
আধভিকের কাতর অনুরোধ শুনে সিয়ারার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে জল জমেছে তবে তাঁর কিচ্ছু করার নেই।
সিয়ারা: আমার পক্ষে সম্ভব নয় আধভিক! কেন বুঝতে পারছেন না আপনি? আপনিই তো বলেছিলেন আমার ডিসিশনকে রেসপেক্ট করবেন? তাহলে এখন কেন এমন করছেন?
আধভিক: কারণ আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে। আই নীড ইউ ইন মাই লাইফ ভেরি ব্যাডলি! প্লিজ সিয়ারা?
সিয়ারা: আমি আগেই আপনাকে বলেছিলাম আধভিক আপনার আর আমার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। আপনার স্ট্যাটাসের সাথে আমার স্ট্যাটাস যায় না। আপনি একজন নামকরা প্রোডিউসারের ছেলে আর আমি একজন সাধারণ মেয়ে।
আধভিক: আমার স্ট্যাটাসের জন্যই কি তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছো?
সিয়ারা: যদি হ্যাঁ বলি তাহলে কি আপনি আপনার স্ট্যাটাস চেঞ্জ করে ফেলবেন?
আধভিক: হ্যাঁ করব। তাই করবো দরকার পরলে। আমার শুধু তোমাকে চাই সিয়ারা, বাই হুক অর ক্রুক আমার তোমাকে চাই।
সিয়ার আধভিকের পাগলামি দেখে হতবাক হলেও টা বুঝতে দেয় না। আধভিককে কাটানোর জন্য বলে,
সিয়ারা: তার মানে আমি শুধুই আপনার জেদ আধভিক। ভালোবাসা নই। কে বলতে পারে আপনি অন্য ছেলেদের মত আমাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না?
আধভিক এক কদম পিছিয়ে গেলো সিয়ারার কথা শুনে। সিয়ারা নিজে কথাটা বলে নিজের জামাই মুঠ করে ধরলো। আধভিক ধীরজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
আধভিক: তোমার মনে হয় আমি তোমার সাথে টাইম পাস করছি?
আধভিকের গলার স্বর শুনে সিয়ারা আন্দাজ করতে পারছে সে কতটা আঘাত পেয়েছে। কতটা আহত হয়েছে। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে সিয়ারার। সে এড়িয়ে যায় আধভিকের প্রশ্ন।
সিয়ারা: প্লিজ আর আমার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না মিস্টার রায় চৌধুরী। আশা করবো আপনি আমার এই রিকুয়েস্টটা রাখবেন।
কোনো মতে কথাটা বলে সিয়ারা হনহন করে এনজিওর ভিতরে চলে আসে। ভিতরে এসেই দু হাত দিয়ে মুখ চেপে কান্নায় ভেঙে পরে সিয়ারা। নিজেকে একটু সামলে মনে মনে বলে,
সিয়ারা: আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে চাইনি আধভিক। না চেয়েছিলাম এসব কিছু বলতে। কিন্তু আমি যদি এগুলো না বলে আপনাকে বলতাম “আপনি আমার বোনকে ভালোবাসুন” তাহলে তাতে আরো বেশি আঘাত পেতেন আপনি। আমি পারবো না এভাবে আপনাকে অন্যকাওর হাতে তুলে দিতে। এতে যে আপনার অনুভূতি, ভালোবাসাকে অপমান করা হয়। অসন্মান করা হয়।
সিয়ারা নিজের চোখ মুছে চোয়াল শক্ত করে বলে,
সিয়ারা: আমি আমার বোনের জেদ সম্পর্কে জানি। ও যখন একবার ঠিক করেছে ও আমাকে আপনার জীবনে থাকতে দেবে না তখন ও কিছুতেই দেবে না। ও কিছুতেই আপনাকে ভালো থাকতে দেবে না তাই আমি বাধ্য হলাম আপনার থেকে দূরে সরে আসতে। এই সুযোগে যদি ও আপনার মন জয় করতে পারে তাহলে তো ভালোই আর না পারলে ও নিজেই শিক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যাবে আমি জানি। তখন আর চেয়েও আমি আপনাকে পাবো না। তবে যদি আপনি আমাকে ছাড়া কষ্টে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে ঠিক মানিয়ে নেবো।
ডুকরে কেঁদে ওঠে সিয়ারা। কিছুতেই তাঁর কান্না থামছে না আজ। যেহেতু অনেক সকালে সে এনজিওতে এসেছে তাই বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। ওরই পরিচিত একজন এসে ওর কাঁধে হাত রাখে যাকে ও দিদি বলে সন্মোধন করে।
__কি হয়েছে সিয়া? এতো সকালে আজকে এখানে কি করছিস? আর এভাবে কাঁদছিস কেন তুই?
সিয়ারা জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। কিছুক্ষণ কাঁদার পর মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখেই প্রশ্ন করে,
সিয়ারা: আমার সাথেই এমন কেন হয় দিদি? প্রথমে নিজের মায়ের ভালোবাসা হারালাম তারপর বাবার। সৎ মা যদিও আমাকে ভালোবাসার অভাব বুঝতে দেয়নি তবে আজ যখন আধভিকের ভালোবাসা অনুভব করেছি তখন ভীষন নিজের মনে হচ্ছিলো জানো? মনে হচ্ছিলো অবশেষে আমি নিজের একটা মানুষ পেয়েছি। কিন্তু দেখো? সেইটাও সইলো না আমার কপালে।
__আধভিকের সাথে সব তো ঠিকই চলছিলো তাহলে হঠাৎ এসব কেন বলছিস?
সিয়ারা ধীরে ধীরে সবটা খুলে বললে ওর দিদি দিয়ারার উপর ভীষণ রেগে যায়।
__তুই যে বলছিস তুই আধভিককে কষ্ট পেতে দিবি না তাহলে এখন কি আধভিক কষ্ট পাচ্ছে না? তোর উচিত ছিলো এই বিষয়টা আধভিককে জানানো।
সিয়ারা: না দিদি। ওনার যা মাথা গরম, উনি যদি শুনতে পান আমাকে ওনার থেকে সরানোর চেষ্টা করছে কেউ তাঁকে তিনি আস্ত রাখবেন না। আমার বোন ওদের প্রোডাকশন হাউজের হয়ে কাজ করছে, এসব জানতে পারলে উনি ওকে বার করে দেবেন। কোনো কনট্র্যাক্ট কোনো কিছুর পরোয়া করবেন না। আমি এটা কি করে হতে দিতে পারি দিদি?
__যেই বোন তোর কথা ভাবছে না তুই এখনও তার কথা ভাবছিস? এতো মহান হওয়া ভালো না সিয়া। ছোটো থেকে ওর কথা ভেবে এসেছিস তুই। ওর জন্য নিজের স্বপ্ন পূরণ করলি না, পড়াশোনা করলি না। নিজের জিনিস ওকে দিয়ে এসেছিস সবার আগে আর ও কি করলো? তোর ভালোবাসার মানুষটাকে তোর কাছ থেকে কেড়ে নিলো।
সিয়ারা: আমি ওর কথা ভাবছি না দিদি। আমি ভাবছি মায়ের কথা। যেই মা কি না কখনও আমাকে বাবা মায়ের ভালোবাসার অভাব টের পেতে দেয়নি। তাঁর কথা ভেবেই আমি দিয়া কে একটা সুযোগ দিলাম। আমার ধীর বিশ্বাস, আধভিক দিয়াকে কখনওই ভালোবাসবেন না। উনি শুধু আমাকেই ভালোবাসেন। তবে এটা আমি দিয়াকে বোঝাতে পারিনি, ও জেদ ধরেছে আমাদের আলাদা করবে। তুমি তো জানোই ওর জেদের কথা?
__তাই বলে তোরা দুজন এভাবে কষ্ট পাবি?
সিয়ারা: আমি যদি ওনাকে অন্যকাওর হাতে তুলে দিতাম সেই কষ্ট এই কষ্টের থেকে দ্বিগুণ হতো। সব তো এক-দুটো মাস হয়েছে আমার সাথে ওনার পরিচয়ের। এতো কিছুর পর আমি যদি ওনার মন থেকে মুছে যাই তাহলে হয়তো কষ্টটাও কমে যাবে।
__এমন কিছুই হবে না সিয়া। আমি বলছি তোকে দেখিস, তোরা দুজন ঠিক এক হবি। তোর মুখে আধভিকের যা বর্ণনা আমি শুনেছি তাতে ও কখনোই তোকে ভুলতে পারবে না। অভিমান করতে পারে তবে ভুলতে পারবে না। তুই বললি না, বাবা মায়ের ভালোবাসা হারানোর পরেও সেই ভালোবাসা ফিরে পেয়েছিস তোর সৎ মায়ের থেকে। এক্ষেত্রেও দেখবি তুই আধভিকের ভালোবাসা আবার ফিরে পাবি। এইবার চোখ মোছ তো, ইশ কি অবস্থা করেছিস চোখ মুখের।
সিয়ারাকে জোর করে তুলে নিয়ে দাঁড় করায় দিদি। তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে আসতে বলে। সিয়ারা যাওয়ার আগে একবার দরজার দিকে তাকাতেই দেখে আধভিক এখনও ঠায় ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের জল মুছে নেয় সে, আর গাড়িতে ওঠে।
সিয়ারা: (মনে মনে– না জানি কি পাগলামি করবে এরপর ছেলেটা? উনি আবার ওনার বাবাকে ভুল বুঝবেন না তো?)
__কি হলো? যেতে বললাম তো আমি?
সিয়ারা দিদির কথা মতো চোখে মুখে জল দিয়ে এলে দিদি জোর করে ওকে একটু কিছু খাইয়ে দেয়। বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারতো সে চাইলেই কিন্তু বাড়িতে গেলে একা থেকে আরো বেশি মন খারাপ করবে সিয়ারার। তার থেকে বাচ্চাদের সাথে থাকুক কিছুটা সময়।
অন্যদিকে,
আভাসবাবু আধভিককে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখে ঘাবড়ে যান। উনি ভাবেন ছেলে হয়তো নেশা করে ফিরেছে কিন্তু কাছে গিয়ে দেখেন না! আধভিক কোনরকম নেশা করেনি। আধভিক গিয়ে সোফায় চুপ করে বসে পরলে আভাস বাবু জিজ্ঞেস করেন,
আভাস বাবু: কি হয়েছে ভিকি? তোকে এতটা বিদ্ধস্ত লাগছে কেন?
আধভিক: আমি কি খুব খারাপ ড্যাড? সবাই কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায় বলো তো?
আভাস বাবু: সি..সিয়ারা তোকে ছেড়ে চলে গেছে? (আতঙ্কিত কণ্ঠে)
আধভিক: ও ছাড়া আর কে’ই বা ছিলো আমার জীবনে ড্যাড? আচ্ছা তুমি আমাকে জন্মের পরেই তো মেরে ফেলতে পারতে? কেন বাঁচিয়ে রাখলে আমাকে?
আভাস বাবু: ভিকি!! (জোরে)
আভাস বাবু ছেলের মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ।
আধভিক: মম আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। তারপর তুমিও আমাকে সময় দিলে না। আর এখন? এখন সিয়ারা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। কেন আমি এতটা একা ড্যাড? কেন?
আভাস বাবু: আমি, আমি কথা বলবো সিয়ারার সাথে। তুমি এসব বলো না বাবান! এমন বলতে নেই। কে বলেছে তুমি একা? আমি আছি তো? আমি থাকতে তুমি কখনওই একা হবে না। যে ভুল একবার করেছি আমি সে ভুল দ্বিতীয় বার করবো না। তোমার ড্যাড সব সময় তোমার পাশে আছে।
আভাস বাবু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। ছেলেকে এভাবে ভেঙে পরতে দেখে, চোখের জল ফেলতে দেখে আভাস বাবুও ভীষণ ভেঙে পরেন। সে আগে কখনও আধভিককে এভাবে ভেঙে পরতে দেখেননি। আভাস বাবুর স্নেহে আধভিকও শান্ত হয়ে যায় ধীরে ধীরে আর চোখ লেগে যায় ওর। আভাস বাবু আস্তে করে আধভিককে সোফায় শুয়ে দিয়ে কাজের লোককে বলে কম্বল নিয়ে আসতে, কম্বলটা গায়ে দিয়ে উনি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
আভাস বাবু: এমনটা কেন করলে সিয়ারা? আমি তো তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার ছেলেটাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য? তুমি সেই কাজটাই করলে?
রাতে,
সিয়ারা বাড়িতে আসলে ওর মা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে, চোখ মুখ কেন শুকিয়ে আছে। পরিবর্তে সিয়ারা “কিছু না বলে” ঘরে চলে যায়। সিয়ারা চলে যেতেই উনি দিয়ারাকে দেখতে পান, সেও ঘরে চলে যায়।
মা: কিছু তো একটা হয়েছে সিয়ার। মাঝে মধ্যেই দেখছি রাতে খাওয়া দাওয়া করছে না। এই যে গিয়ে ঘরের দরজা দিলো আর বেড়াবে না, সেই সকালে। দেখি, এইবার কথা বলতে হবে আমায় ওর সাথে।
ঘরে,
সিয়ারা: সোহমদাকে ফোন করেও তো ওনার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। শুধু বললেন বাড়ি ফিরেছেন, নেশাও করেননি। আচ্ছা কোনো ভুলভাল কিছু করে বসবেন না তো? আজ যেভাবে পাগলামী করছিলেন তাতে ভুলভাল কিছু করে বসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। উফ! কেন ঠাকুর কেন? কেন আমার সাথেই এমন করো তুমি? শুধু শুধু মানুষটা আমাকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছেন।
এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সিয়ারার মাথা যন্ত্রনা উঠে যায়। মাথায় বাম লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে শুতেই ঘুমিয়ে পরে সে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]