কথা দিলাম ‘ 🌸❤️ ||পর্ব ~ ১৮|| @কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

0
186

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৮||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

আধভিক সিয়ারার বাড়ি থেকে বের হয়ে যে বড়ো রাস্তা পরে সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। সিয়ারা ঠিক যেই সময় বের হয় সেই সময় আধভিক গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পায় সিয়ারা বড়ো রাস্তায় এসেছে। নিমিষে সে আধভিকের চোখের আড়াল হয়ে যায় কারণ ও স্কুটিতে ছিলো। আধভিক সাথে সাথে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় সিয়ারার এনজিওর উদ্দেশ্যে। সিয়ারার এনজিওতে থাকাকালীন পুরো সময়টা আধভিক এনজিওর বাইরে দাঁড়িয়ে কাটায়। সিয়ারা বেরানোর সময় তাড়াতাড়ি স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যায়, আধভিককে দেখতে পায় না।

এক মাস পর,

আধভিকের একমাস এভাবেই কেটে গেছে। রোজ সে সকাল থেকে দুপুর সিয়ারার বাড়ি থেকে এনজিও ও এনজিও থেকে বাড়ি অবধি করেই কাটায়। তবে একদিনও সিয়ারার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি এই কয়দিনে। এমনই একদিন এনজিওতে,

__সিয়া! তুই এতটা পাষাণ কীভাবে হলি বল তো?

সিয়ারা বাচ্চাদের কাজ দিয়ে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ঠিক সেই সময়ে দিদি এসে কথাটা বললো। কিন্তু সিয়ারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না, সে একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

__কি হলো টা কি? কি দেখছিস বাইরে এতো মন দিয়ে একটা কথা…

দিদি সিয়ারার কাছে গিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে সিয়ারার চাহুনি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই চুপ করে যায়। ছলছল চোখে আলতো ভাবে সিয়ারার কাঁধে হাত রাখতেই সিয়ারা ভাঙা কণ্ঠে বলে ওঠে,

সিয়ারা: না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কি অবস্থা করেছো দেখেছো শরীরের? চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে দেখো?

সিয়ারা জানলা দিয়ে আধভিককে দেখছিলো। এটা ওর প্রতিদিনের কাজ। প্রথম দিন থেকেই ও লক্ষ্য করেছে আধভিক ওকে ফলো করে। তবে টের পেতে দেয়নি আধভিককে যে ও’ও তাঁকে দেখে।

__এভাবে আর কদিন কষ্ট পাবি বল তো তোরা? শুধু কি আধভিকের চোখ মুখ শুকিয়েছে, শরীরের অবস্থা খারাপ হয়েছে? তোর হয়নি?

সিয়ারা উত্তরে চুপ করে থাকে। চোখটা জলে ভরে উঠেছে ওর। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে ওর।

__তোর মনে হচ্ছে না এইভাবে আধভিককে কষ্ট দিয়ে তুই ভুল করছিস? তুই এটা ভালো ভাবেই জানিস তাই অপরাধ বোধে শেষ হয়ে যাচ্ছিস ভিতরে ভিতরে। তুই কি বুঝতে পারছিস না সিয়া তুইও আধভিককে ভালোবেসে ফেলেছিস?

সিয়ারা এইবার দিদির দিকে তাকালে দিদি বলে,

__এখনও সময় আছে সিয়া।

সিয়ারা আবারও আধভিকের দিকে তাকালো। আধভিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একমনে নীচের দিকে তাকিয়ে, গাড়িতে হেলান দিয়ে। অতিরিক্ত সুন্দর দেখতে ছেলেটা কেমন জানো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সিয়ারার চোখের সামনে আধভিকের সাথে প্রথম দেখার দৃশ্য ভেসে উঠলো। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং একটা ছেলে ক্যামেরার পিছনে বসে ছিলো। তারপর যখন বৃষ্টির দিনে বাস স্ট্যান্ডে বসে কথা বলছিলো? একটা আলাদাই উজ্জ্বলতা মেখে ছিলো পুরো মুখটায়। আর আজ? সেই মুখেই বিষন্নতার ছাঁপ।

__এইভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে ছেলেটার একটা বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে সি…

দিদির কথা শেষ হওয়ার আগেই সিয়ারা বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। দিদির মনে কেমন জানো একটা আশার আলো সঞ্চার হলো। সিয়ারা এনজিওতে থেকে বেরোতেই জানলার বাইরে চোখ রাখলো দিদি।

আধভিক: হ্যাঁ ড্যাড, বলো!

আভাস বাবু: তুমি কি আজও…

আধভিক: (নীচের দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ।

আভাস বাবু: আজ একটা প্রশ্ন করবো উত্তর দেবে?

আধভিক: হম, বলো।

আভাস বাবু: গত একমাসে আমি তোমার যেই ব্যবহার, আচরণ দেখেছি তাতে আমার মাথায় একটা জিনিসই এসেছে যা তুমি কখনও স্বীকার করনি আগে আমার কাছে। আজ কি তুমি স্বীকার করবে? (কিছুক্ষণ থেমে) ভিকি, আর ইউ ইন লাভ?

আধভিক চোখ বন্ধ করে নেয় আভাস বাবুর প্রশ্নে। তার চোখটা জলে ভরে গিয়ে লাল হয়ে উঠেছে। সে নিজেকে একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক করে বললো,

আধভিক: আই রিয়েলি, রিয়েলি লাভ হার ড্যাড! আমার মনে হয় না আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো বলে, থাকার মতো থাকতে পারবো বলে।

আভাস বাবু: আমাকে তাহলে কেন কথা বলতে দি…

আধভিক: আমি তোমাকে পরে কল ব্যাক করছি ড্যাড।

আধভিক আকস্মিক ব্যবহারে অবাক হয়ে যান আভাস বাবু। এভাবে কথার মাঝে হুট করে ফোন কেটে দিলো কেন সে? চিন্তিত হয়ে পরেন আভাস বাবু। এদিকে আধভিকের চোখের সামনে সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ারাকে দেখে সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে আধভিক নিজের যুক্তি রাখে।

আধভিক: তুমি যোগাযোগ করতে বারণ করেছিলে। তোমাকে দেখতে তো বারণ করনি তাই…

আধভিক আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই সিয়ারা ওর শরীরের সাথে মিশে গেলো। আধভিক শুধু টের পাচ্ছে তাঁর প্রেয়সী তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে সে দেখতে পাচ্ছে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে সে নাগাল পেয়েছে তাঁর। সেটা দেখে ধীরে ধীরে আধভিক দু হাতে সিয়ারার কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে। এই দৃশ্য দেখে সিয়ারার দিদি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানলা থেকে সরে যায়।

সিয়ারা: আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ আধভিক!

আধভিকের একদম কানের কাছেই কথাটা বলায় ওর কানে বাজতে থাকে কথাটা। নিজের হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে সিয়ারার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয় আধভিক।

আধভিক: এই একটা কথা শোনার জন্য আমার জীবন বেরিয়ে যাওয়ার যোগান হবে আমি ভাবতেও পারিনি।

সিয়ারা সরে আসে আধভিকের থেকে। ওর চোখদুটোসহ মুখটা এখনও জলে ভেজা।

সিয়ারা: কি অবস্থা করেছেন এটা নিজের? কে বলেছে আপনাকে এভাবে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে?

আধভিক: কি করবো? ঘরে বসে থাকলে এতদিনে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতাম নিজের।

সিয়ারা: চুপ করুন! এটা মোটেও গর্ব করে বলার মতো কথা নয়। পাগল একটা! (আধভিকের বাহুতে ঘুষি মেরে)

আধভিক: কেন? আমি আমার প্রেমিকার জন্য দেবদাস হয়ে গেছি এটা গর্ব করে বলবো না?

সিয়ারা: এই এক মিনিট আপনি তো নেশার জিনিস ছুঁয়েও দেখেননি এই এক মাসে তাহলে দেবদাস কীভাবে হলেন?

আধভিক: (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে) আর তুমি কীভাবে জানলে সেটা?

সিয়ারা: আব না মানে.. (আমতা আমতা করে)

আধভিক: মানে এটাই যে তুমিও আমাকে দেখতে লুকিয়ে লুকিয়ে তাই তো? আর বাকি সময়ের খোঁজ নিশ্চয় আমার অ্যাসিস্টেন্ট কম তোমার অ্যাসিস্টেন্ট বেশি সোহমের থেকে নিতে? (বাঁকা হেসে)

সিয়ারা মুখটা কাচুমাচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে ওড়নায় আঙুল প্যাঁচাতে থাকে। একবারে ঠিক জায়গায় নিশানা লাগিয়েছে আধভিক। বেচারি বাজে ফাঁসান ফেঁসে গেছে। সিয়ারা চুপ করে থাকলে হঠাৎই আধভিক ওর কোমরে হাত রেখে তা নিজের দিকে এক ধাপ টেনে আনে। ফলে সিয়ারা আধভিকের কাঁধে হাত রেখে ওর দিকে তাকালে আধভিক জিজ্ঞেস করে,

আধভিক: এই একটা মাস শুধু আমি না তুমিও কষ্ট পেয়েছো। সেটা তোমার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে। কেন করলে এমন সিয়ু? কি লাভ হল এভাবে কষ্ট পেয়ে? সেই তো আমার ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হলো তাই না?

সিয়ারা কোনো উত্তর না দিয়ে আধভিকের বুকে মাথা রেখে গুটিয়ে যায়। আস্তে করে বলে,

সিয়ারা: সবটা বলবো তোমাকে, কেন করেছি আমি এমন। আমি তোমার থেকে কিছু লুকাবো না আভি।

আধভিক: (সিয়ারাকে সোজা করে) কি বললে আরেকবার বলো? (উত্তেজিত হয়ে)

সিয়ারা: কি বললাম?

আধভিক: কি নামে ডাকলে আমায়?

সিয়ারা: উমম..আর সি কোলা! (মজা করে)

আধভিক: সিয়ু প্লিজ? বলো না?

সিয়ারা আস্তে করে আধভিকের চোখে চোখ রেখে ওর দিকে এগিয়ে যায়। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলে,

সিয়ারা: আই..লাভ..ইউ..আভি!

আধভিকের হার্টবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো সিয়ারার ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া নিজের কানে অনুভব হতেই। সিয়ারা সরে এসে আধভিকের চোখে চোখ রাখতেই দেখে আধভিক এখনও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। সিয়ারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে আধভিক নিজের ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বোকার মতো মাথা চুলকায়।

আধভিক: চলো।

সিয়ারাকে নিয়ে আধভিক গাড়িতে উঠে বসে। সিয়ারা কোনো প্রশ্ন করে না আধভিককে যে সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওরা উপস্থিত হয় আধভিকের ফ্ল্যাটে। আসার পথে অনেক ভয় নিয়েই আধভিককে ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে দেয় যে কেন সে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো ওকে। দিয়ারার উপর রাগ হলেও অনেক কষ্টে আধভিক সেটা গিলে নেয় একপ্রকার। সিয়ারা সেটা বুঝতে পেরে সাথ দেয় আরও আধভিকের। নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর আধভিক দরজা বন্ধ করতে গিয়েও যখন থেমে গিয়ে দরজাটা উল্টে খুলে দেয় তখন সিয়ারা জোরে হেসে ফেললো।

আধভিক: না বাবাহ! আর একই ভুল করবো না।

হাসতে হাসতে সিয়ারার হঠাৎই চোখ গেলো একটা ফটো ফ্রেমের উপর। সিয়ারা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রেমটা হাতে নিতেই আধভিক ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

সিয়ারা: আভি, তোমার সাথে এই ছেলেটা কে ছবিতে? সোহমদা বলে তো মনে হচ্ছে না।

আধভিক: মাই ব্রাদার…

সিয়ারা: (অবাক হয়ে) তোমার ভাই আছে?

আধভিক: ব্রাদার ফ্রম অ্যানাদার মাদার!

সিয়ারা কথাটা শুনে চুপ করে গেলো। অপেক্ষা করতে থাকলো আধভিকের আরো কিছু বলার কারণ ও যেটা ভাবছে সেটা নাও হতে পারে। বেস্ট ফ্রেন্ডও তো হতেই পারে, সৎ হতে হবে এমন কোনো কথা আছে?

আধভিক: মাই স্টেপ ব্রাদার।

সিয়ারা চোখ বুজে নেয়। ও আশা করছিলো ওর ধারণা হয়তো মিথ্যে হবে কিন্তু নাহ, সেটাই সত্যি দাঁড়ালো। সিয়ারা চোখ খুলে ফ্রেমটা রেখে দিতেই পাশের যে ফ্রেমে চোখ পরলো সেটাই ওর চোখ আটকে গেলো। ছবিটা, ছোট্টো আধভিক আর ওর মায়ের। আধভিক বুঝতে পারলো সিয়ারা ওই ছবিটার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আধভিক: আমার মম! এই মানুষটাকে আমি হারাতে চাইনি কখনও। আমি কল্পনাও করিনি মমের সাথে আমার জার্নিটা এতটা শর্ট হবে। তুমি বলেছিলে না? আমি কীভাবে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে পারছিলাম?

সিয়ারা: আণ্টি শিখিয়েছিলেন?

আধভিক: হম। অনেক ছোটো বয়সে। আসলে, ড্যাড কখনও মমকে নিয়ে কোথাও যেতো না। তাই মম আমাকে নিয়ে এদিকে সেদিকে বেরিয়ে পড়তো। আমার ঠাম্মি মমকে পছন্দ করে এনেছিল ড্যাডের পছন্দ ছিলো না। তাই কখনও আমার মমের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনি, কখনও না। আর আমার মম? সবসময় ভালো ভাবে কথা বলেছে, ভালোবেসে গেছে। বদলে পেয়েছে শুধু কষ্ট। আমি নিজে দেখেছি প্রতি রাতে আমার মমকে চোখের জল ফেলতে কিন্তু আমার কিচ্ছু করার ছিলো না। কিচ্ছু করতে পারিনি আমি।

সিয়ারা নিজের কাঁধে আধভিকের কাঁপা নিশ্বাস অনুভব করতেই ও পিছন ফিরে আধভিকের দু হাতের মাঝে চলে যায়। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: আণ্টি কীভাবে…

আধভিক: সুইসাইড। শি ওয়াজ কমিটেড সুইসাইড।

সিয়ারা দমে গেল। ও ভেবে উঠতে পারছে না ওর ঠিক কি বলা উচিত। আধভিক নীচের দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও। সে আবার বলতে শুরু করে,

আধভিক: মম জানতো যে ড্যাড মমকে পছন্দ করে না। তাই কষ্ট পেতো, চোখের জল ফেলত। কিন্তু একটা সময় যাওয়ার পর মম জানতে পারে…ড্যাডের জীবনে অন্য কেউ আছে। সেইদিন…সেইদিনটার কথা আমার মনে আছে। মমের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু মম কোনো উত্তর দেয়নি। চুপ করে পাথরের মতো বসে ছিলো। কাঁদছিলো পর্যন্ত না। বিয়ের পর থেকে মম আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে ছিলো ড্যাডের পছন্দের হয়ে ওঠার কিন্তু সেদিন গিয়ে জেনেছিল যে সেটা আর কখনও সম্ভব নয়। ইউ নো সিয়ু, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম বিষয়টা। মমের পরিস্থিতি আমাকে ফীল করিয়েছিল, যে ঠিক কতটা কষ্ট হয় নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকাওর সাথে দেখলে। এইজন্যেই হয়তো তোমাকে সেদিন অন্য একজনের সাথে দেখে এতটা রিয়্যাক্ট করেছিলাম। ঠিক এই কারণেই আমি এতটা ওভার পজেসিভ। আমার ওই সিচুয়েশনটা ফেস করার মত সহ্য ক্ষমতা নেই। আ’ম, আ’ম রিয়েলি স্যরি ফর দ্যাট।

সিয়ারা: আমি বুঝতে পেরেছি আভি। প্লিজ ডোন্ট ফীল স্যরি ফর দ্যাট। আমি মনে করি তোমার ওখানে কোনো দোষ ছিলো না। (ছলছল চোখে)

আধভিক: আমি, আমি ড্যাডের একটা কথা এখনও ভুলতে পারি না জানো? তখন কথাটার মানে বুঝিনি। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পেরেছি তখন নিজেকে ভীষণ হেল্পলেস মনে হতো।

সিয়ারা: এমন কি কথা বলেছিল আঙ্কেল তোমাকে?

আধভিক: আমাকে না, মমকে। ড্যাডের অ্যাফেয়ার সম্পর্কে জানার আগে প্রথমবার মম ড্যাডের মুখের উপর কথা বলেছিলো। আমি চুপ করে বিছানায় বসে ছিলাম। মম বলেছিল যে কেন ড্যাড এমন করছে। আমার কথাটা একবার ভেবে, নতুন ভাবে সবটা শুরু করা যায় না?

সিয়ারা: আর আঙ্কেল কি বলেছিল?

আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) অ্যাট দ্যা টাইম হি ওয়াজ ড্রাংক। সো মমকে একটি চড় মেরে বলেছিলো, “আধভিক আমার জীবনে একটা মিসটেক। সেদিন তুমি আমার ড্রাঙ্কড অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলে। যাতে এই বাড়িতে থাকতে পারো। আজ যদি আধভিক না থাকতো কবে তোমাকে তাড়িয়ে দিতাম। শুধুমাত্র আধভিকের কথা ভেবেই তোমাকে এখানে রেখেছি।” মম পরিবর্তে বলেছিলো, “আধভিকের কথা ভেবেই আমি রয়েছি। নাহলে অনেকদিন আগেই চলে যেতাম।”

সিয়ারার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। সে আন্দাজ করেছিলো আধভিকের ভিতরে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে কিন্তু এতটা কষ্ট? ধারণার বাইরে ছিলো সিয়ারার। এতো কিছু সহ্য করেছে ছেলেটা ওইটুকু বয়সে? ওর মনে হয় হয়তো এখানেই শেষ নয়।

আধভিক: বড়ো হয়ে কথাটা যখন মনে করতাম তখন এটাই মনে হতো আমি এমন একজন মানুষ যাকে কেউ চায় না, যার কেউ নেই। ছোটবেলায় বুঝিনি দেখেই তো যেই মানুষটার কাছে আমি একটা মিসটেক ছিলাম তাঁকেই আকড়ে ধরতে চাইছিলাম। (তাচ্ছিল্য হেসে)

সিয়ারা: তোমার সৎ ম…

আধভিক: উনি আমার মা নন! আমি মনে করি না ওনাকে নিজের মা। উনি আমার মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। উনি জানতেন ড্যাড বিবাহিত তারপরেও সরে যাননি। যেদিন মম জানতে পারলো সত্যিটা তারপর থেকেই আর কথা বলেনি ড্যাডের সাথে ইভেন কাওর সাথে। জানি না কেন, প্রথম হয়তো ড্যাডের চোখে অনুতাপ দেখেছিলাম। ড্যাড এসেছিলো মমের সাথে কথা বলতে। মম শুধু শুনেছে, কোনো উত্তর দেয়নি। ড্যাড ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই যে দরজা দিলো আ..আর বেরিয়ে এলো না, যেভাবে গেছিলো সেভাবে। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরেও যখন দরজা খুলছিল না তখন জানলায় গিয়ে দেখলাম মম…

সিয়ারা আরেকটু শক্ত করে ধরে আধভিককে। আধভিক ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হয় তাঁর এই কথাগুলো মনে পরলে।

আধভিক: দেখলাম মম, একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে। অনেক বার বলেছিলাম মমকে, অনেক চিল্লিয়ে ছিলাম যে “মম! এমনটা করো না। দরজা খোলো। আমি তোমার কাছে যাবো।” মম তাকায় পর্যন্তনি আমার দিকে। যখন তাকালো তখন শেষবারের মতো চোখে জল নিয়ে একগাল হেসেছিল আর তারপর…

আধভিক ঘুরে গেলো অন্যদিকে। সিয়ারা নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে অবিরাম কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে আধভিকের কাঁধে হাত রাখলে আধভিক ফটো ফ্রেমটা দিকে তাকিয়ে অভিযোগ আর অভিমান মিশ্রিত সুরে বললো,

আধভিক: মম নিজের কথা রাখেনি। মম ভাবেনি আমার কথা। শুধু ওই লোকটার কথা ভেবেছে যে কি না প্রথম থেকে মমকে কষ্ট দিয়েছে। ওই লোকটার দেওয়া কষ্ট মনে করেই মম আমায় একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমার কথা ভাবলে এমনটা করতে পারতো না। সারাজীবন কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু পায়নি মম। প্রথমে নিজের মামাবাড়িতে মামা মামীর দেওয়া কষ্ট আর বিয়ের পর স্বামীর।

সিয়ারা: তোমার ঠাম্মি? উনি নিশ্চয় ভালোবাসতেন আণ্টিকে?

আধভিক: ভীষণ ভালোবাসতো। মেয়ের সখ ছিলো তো খুব তাই আমার মমকে নিজের মেয়ে মনে করতো। নিজের মেয়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেনি। আমাকেও ভীষণ ভালোবাসতো, সব সময় খালি দাদান আর দাদান।

আধভিক চোখে জল নিয়েই একটু হাসলো। তারপর ঠোঁট চেপে ফেললো। সিয়ারা চোখ বুজে নিলো কারণ সে আন্দাজ করতে পারছে এইবার আধভিক কি বলবে।

আধভিক: আমার চিৎকার শুনে যতক্ষণে ঠাম্মি উপরে এসেছে ততক্ষণে সব শেষ। চোখের সামনে মমকে ছটফট করতে দেখলাম কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। একটা আট বছরের ছেলে কি বা করবে চিৎকার করা ছাড়া? ড্যাড বাড়ি এসে সবটা জানার পর ঠাম্মিকে যখন জানালো সে মমকে বিয়ে করার এক দুবছর পরেই আরেকটা বিয়ে করেছে এবং তাঁর একটা সন্তানও আছে সেঘরে। সেটা শোনার পর …. ঠাম্মি হার্ট অ্যাটাক করে। মেয়েকে একা ছাড়েনি, কিন্তু নিজের দাদানকে একা ছেড়ে গেছে।

সিয়ারা নিজের ওড়না দিয়ে আধভিকের চোখের জল মুছিয়ে দিলে আধভিক সিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে। আধভিকের কাঁধে মাথা রেখে সিয়ারা মনে মনে সেদিকে বলা আভাস বাবুর কথা মনে করে। উনি বলেছিলেন “সব শেষে এই বুড়ো মানুষটাকে জানো ভুলে যেও না।” উনি অপরাধ করেছেন দেখেই কথাটা বলেছিলেন।

সিয়ারা: আভি, একটা কথা বলবো?

আধভিক: (আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে) হম।

সিয়ারা: আঙ্কেলকে এখন দেখলে বোঝাই যায় না উনি তোমাকে অপছন্দ করতেন। ওনার তোমার প্রতি কেয়ার, ভালোবাসা দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না এমন একটা ইতিহাস আছে। এমন কেন? উনি কি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন?

আধভিক: এইসবই হয়তো ওনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমি জানি না হঠাৎ করেই উনি কেন আমাকে নিয়ে এতটা ভাবতে শুরু করেছেন। আমার তো এটাই মনে হয়, মম আর ঠাম্মির সাথে সেদিন আমারও কিছু একটা হয়ে গেলে ভালো হতো।

সিয়ারা: (সোজা হয়ে) আভি! কি আজে বাজে কথা বলছো?

আধভিক: ঠিকই বলছি। তুমি আসার আগে আমার জীবনটা জীবন ছিলোই না। ভালোবাসা জিনিসটাকেই বিশ্বাস করতাম না আমি। তখন যদি উনি আমাকে মেরে ফেলতেন ভালো হতো। সব ল্যাটা চুকে যেতো একবারে। এতো কষ্ট পেতে হতো না প্রতিনিয়ত আমাকে।

সিয়ারা: (দু গালে হাত রেখে) চুপ, একদম চুপ! আমি এখন এসে গেছি তো তোমার জীবনে? তাহলে একদম এসব কথা ভাববে না আর।

আধভিক: না সিয়ু। যখন তুমি আমাকে আমাদের স্ট্যাটাস নিয়ে বলেছিলে তখনও আমার এটাই মনে হচ্ছিলো ড্যাড কেন আমাকে নিজের পরিচয় দিল। আমি যখন একটা মিসটেক তখন কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে পারতো। নিজের পরিচয় নিজে তৈরী করে নিতাম আমি। আই সোয়্যার তুমি যদি আমার কাছে ফিরে না আসতে তাহলে এই পরিচয় রাখতাম না আমি। নিজের অস্তিত্বই রাখতাম না তো সেখানে পরিচয়।

সিয়ারা: এতোটা ভালোবাসলে কবে আমাকে আভি? (চোখে চোখ রেখে)

আধভিক: যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম বা তুমি যখন সময় চেয়ে ছিলে একে অপরকে চেনার কিংবা গত এক মাসে। জানি না আমি। আমি শুধু জানি তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি আবার একা হয়ে যাবো। আর সেই একাকীত্ব টা সহ্য করার ক্ষমতা হয়তো আমার মধ্যে নেই। বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না আমি।

সিয়ারা আধভিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর আধভিক সরে এসে বলে,

আধভিক: তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো চলো। আধভিক আর সিয়ারা ওদের ঘরের মধ্যে থাকাই এক কোণে থাকা ঘরের মধ্যে গেলো। জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই সিয়ারা অবাক হয়ে গেলো। কি দারুন দারুন সব স্কেচ।

সিয়ারা: এগুলো কি তোমার করা স্কেচ আভি? (অবাক হয়ে)

আধভিক: হম। ভালো লাগছে এগুলো?

সিয়ারা: খুব সুন্দর এগুলো। তুমি স্কেচ, অয়েল পেন্টিং এগুলো আলাদা করে রেখেছ?

আধভিক: আরেকটা জিনিস আলাদা করে রেখেছি।

আধভিকের দিকে সিয়ারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আধভিক ওকে টেনে নিয়ে নিজের স্টাডি টেবিল থেকে একটা ড্রয়িং কপি হাতে দেয়। সিয়ারা সেটা খুলে দেখতেই একপ্রকার টাস্কি খায়।

সিয়ারা: তুমি তো পুরো প্রফেশনাল ডিজাইনার আভি?

আধভিক: হম, এটাই আমার প্যাশন। আমি কখনওই একজন প্রোডিউসার হতে চাই না। ড্যাডের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ছোটো ছেলে আছে তো? আমি না হয় আমার মমের স্মৃতিটাই আকড়ে ধরে বাঁচলাম।

সিয়ারা: আণ্টি কি তোমাকে..??

আধভিক: মম খুব ভালো আঁকতো। আমি তো মনে হয় অ-আ লেখার আগে সূর্য এঁকে ছিলাম। (হেসে উঠে)

সিয়ারাও হেসে ফেলে আধভিকের হাসি দেখে। সিয়ারা টোন কেটে আধভিককে বলে,

সিয়ারা: আন্টিকে দেখলেই বোঝা যায় আন্টি খুব মিষ্টি, শান্তপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তাহলে তুমি এত করলার মতো তেঁতো আর বদমেজাজি হলে কীভাবে ওনার সাথে থেকে?

আধভিক বেচারা বাচ্চাদের মতো মাথা নীচু করে মাথা চুলকে বলে

আধভিক: আই হেইট করলা! আমি কেন করলার মতো হতে যাবো? হ্যাঁ শর্ট টেম্পার তবে…

সিয়ারা: (ধমক দিয়ে) চুপ! এই শর্ট টেম্পারের চক্করে কোন দিন দেখবে তোমার মাথার শর্ট সার্কিট হয়ে যাবে।

আধভিক: কথায় কথায় খালি ধমক দেয়। (খুব ধীরে)

সিয়ারা মনে মনে হাসে আধভিকের মুখের অবস্থা দেখে। আরও কিছুক্ষণ ওখানে থাকার পর আধভিক সিয়ারাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে,

আধভিক: সিয়ু, আমি ঠিক করেছি আমি নিজের একটা ফ্যাশন হাউজ করবো।

সিয়ারা: এটা তো খুব ভালো বিষয় আভি। (খুশি হয়ে)

আধভিক: এর থেকেও একটা ভালো বিষয় আছে।

সিয়ারা: কি?

আধভিক: আমার ফ্যাশন হাউজের মেইন ডিজাইনার হবে…তুমি!

সিয়ারা: (চমকে উঠে) আমি? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আভি? আমি ডিজাইনার..কি বলছো এসব?

আধভিক: ঠিকই বলছি।

সিয়ারা: না ঠিক বলছো না। আমার কোনো ডিগ্রি নেই। আমি তো সখের বশেই…

আধভিক: নেশাকে পেশা বানাতে কতক্ষণ? আর আমার ফ্যাশন হাউজে কাকে ডিজাইনার হিসেবে রাখবো আর কাকে নয় সেটা আমার ব্যাপার। তুমি চিন্তা করো না, তোমাকে আমি কোর্সে ভর্তি করে দেবো কাজ করার পাশাপাশি। আর তুমি সকালে যেমন এনজিওতে আসো তেমনই আসবে। এরপর আর আমি কিছু শুনতে চাই না, তোমার বাড়ি এসে গেছে।

সিয়ারা মুখটা কাঁচুমাচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সময় নষ্ট না করে গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলে আধভিক পিছন থেকে ওকে ওর নাম ধরে ডাকে। ও মাথা আধভিকের দিকে কিছুটা ঘোরাতেই, আধভিক সিয়ারার মাথার নীচটা বাম হাতের মাঝে নিয়ে সিয়ারাকে আচমকাই নিজের একদম কাছে টেনে আনলো। সবটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়ার সিয়ারা কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারলো না। বুঝতে পারলো তখন যখন নিজের কপালে আধভিকের ঠোঁটের ছোঁয়া পেলো। আবেশে নিজের চোখ বুজে নিলো ও। কিছুটা সময় ওভাবে থাকার পর আধভিক নিজের ঠোঁট সরিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো।

আধভিক: আমি বাড়ি পৌঁছে, ফ্রেশ হয়ে কল করবো। ওকে? আর আগামীকাল থেকে যেমন আমি নিতে আসতাম তেমনই আসবো। তোমাকে এনজিওতে ড্রপ করে আমি চলে যাবো দ্যান ফেরার সময় নিয়ে আসবো। মনে থাকবে?

সিয়ারা কোনো কিছু না বলে আধভিকের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে চলে যায়। আধভিক কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে সিয়ারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সিয়ারা বাড়িতে ঢুকে গেলে স্টিয়ারিং এ মাথা ঠেকিয়ে বসে হাসে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

বিঃদ্রঃ এতো বড়ো পর্ব দিলাম, বলতে পারেন দুদিনের পর্ব একদিনে দিলাম। এইবার আশা করবো একটু গঠনমূলক মন্তব্য পাবো। বেশি রেসপন্স পেলে রোজ দেওয়ার চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here