কথা দিলাম ‘ 🌸❤️ ||পর্ব ~ ১৯|| @কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

0
186

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

ছয় মাস পর,

সিয়ারা আর আধভিক বেশ ভালো ভাবেই নিজেদের সময়টা কাটাচ্ছে। দিয়ারা কোনরকম কোনো কথা সিয়ারাকে নিয়ে বলেনি এই বিষয়ে তাই সিয়ারাও কথা বাড়ায়নি। সে আধভিকের কথা মতো সকালে এনজিও, তারপরে কোর্স করা এবং এরপর যে সময়টা বেঁচে থাকে সেটা আধভিকের ফ্যাশন হাউজে দেয়। ফ্যাশন হাউজ জয়েন করেছে যদিও এক মাস হয়েছে। কারণ ফ্যাশন হাউজের জন্য বিল্ডিং আধভিক আগে থেকেই কিনে রেখেছিলো ঠিকই কিন্তু সিয়ারার মন পছন্দ মতো সাজিয়ে নেওয়ার পরেই সেখানে ধীরে ধীরে কর্মচারী নিয়োগ করতে শুরু করে। এমনই একদিন সিয়ারা সকাল সকাল এনজিওতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নীচে নামতেই স্থির হয়ে দাঁড়ালো একজায়গায়। ওর সামনে আভাস বাবু আর আধভিক বসে আছে, পাশে সিয়ারার মা। সিয়ারা আধভিকের দিকে তাকাতেই দেখলো আধভিক চায়ের কাপে একটা চুমুক দিতে দিতে ওকে চোখ মারলো।

আভাস বাবু: সিয়া মা, এদিকে আসো একবার।

সিয়ারার মা: আয় এদিকে এসে বস। ওনারা অনেকক্ষণ ধরে তোর অপেক্ষা করছে। সিয়ারা ধীরে ধীরে ওর মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই ওর মা জিজ্ঞেস করলো ওকে,

সিয়ারার মা: আভাস বাবু চান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আধভিক আর তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে। তোর কি মত আছে?

সিয়ারা: আমি, আমি তো..আসলে আঙ্কেল আমি বিয়ে করে চলে গেলে আমার মায়ের উপর চাপ পড়ে যাবে অনেক। এমনিতেই আমি এখন শুধু এনজিও তে পড়াই, বিকেলে যে টিউশনি করতাম সেগুলো ছেড়ে দিয়েছি। মার একার রোজগারে তো সংসার চলবে না। আর বোন যা রোজগার করে সেটা আমরা নিইনা। ওটা ওর হাতখরচ। তাই…

দিয়ারা: তুই চলে গেলে না হয় আমি আমার হাতখরচটা কমই করবো। তাছাড়া আমার রোজগারটা পুরোপুরি ভাবে ব্যবহার করিনা আমি। তুই অন্তত এমন কিছুই শিখাসনি আমাকে। তাই তুই চিন্তা করিস না, আমার আর মায়ের খুব ভালো ভাবে চলে যাবে।

আধভিক: আমার শালী দেখছি বড়ো হয়ে গেছে অনেক। তা শালী সাহেবা পড়াশোনাটা ঠিকঠাক হচ্ছে তো? রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু…

দিয়ারা: দিই খবর করে দেবে, তোমাকে কিছু করতে হবে না।

দিয়ারার কথায় সিয়ারা চোখ রাঙালে সবাই হেসে ফেলে। সিয়ারা আর কোনো বাঁধা দেয় না যখন ওর মাও বলে বিয়েতে সম্মতি দিতে। সেদিনই পাকা দেখা সেরে বিয়ের ডেটটা জানিয়ে দিয়ে যায় আভাস বাবু যা আগের থেকে ঠিক করেই এসেছিলেন উনি।

রাতে,

সিয়ারা বসে বসে ড্র করছে এমন সময় আধভিকের কল এসে। কলটা রিসিভ করতেই সিয়ারাকে সে বেরিয়ে আসতে বলে রেখে দেয়।

সিয়ারা: বড়ো লাট সাহেব হুকুম যখন করেছেন তখন যেতে তো হবেই। উফ, রাত বিরেতে এই ছেলেটা না ঘুমিয়ে প্রেম করতে এসেছে। বড়ো পাগলের পাল্লায় পরেছি আমি।

সিয়ারা ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আধভিকের দিকে এগিয়ে গেলে আধভিক একটা কিউট স্মাইল দেয়। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সিয়ারা কোমরে হাত দিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে বলে,

সিয়ারা: রাত বিরেতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করতে এসে…

সিয়ারা আর কিছু বলার আগেই আধভিক এক ঝটকায় সিয়ারার কোমরে হাত রেখে, নিজের দিকে টেনে আনে সিয়ারাকে। সে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় দুজনের নিশ্বাস দুজনের মুখে আছড়ে পরছে। নাহলে বেচারি সিয়ারা অনেকটাই নাটা আধভিকের থেকে।

আধভিক: প্রেম করতে এসেছি “বউ!”

সিয়ারার পেটের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয় যখন আধভিক “বউ” শব্দটা উচ্চারণ করে। আমতা আমতা করে বলে,

সিয়ারা: খ..খেয়ে দেয়ে কাজ নেই না ত..তোমার? ক..কি চাই এতো রাতে? যাও বা..

আধভিক: তোমাকে চাই বউ! এখন তাড়িয়ে দিও না।

সিয়ারা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সিয়ারা সরে আসতে চাইলে আধভিক বাঁধা দেয়। সিয়ারার ঘাড়ে এক হাত রেখে মুখটা আর একটু কাছে টেনে আনে। সিয়ারা আধভিক কি করতে চলেছে বুঝতে পেরে ঝট করে সরে যায় আর বলে,

সিয়ারা: এটা আবাসন বলে যে কেউ কিছু দেখে না তা কিন্তু নয় ঠিক আছে? ভাগ্যিস বাবা আবাসনে একটা ফ্ল্যাট রেখে গেছিলো। নাহলে তোমার জ্বালায় অনেক আগেই আমাদের বাড়ি ছাড়া হতে হতো।

আধভিক: ধুর! এর থেকে তো ফরেইন কান্ট্রি ভালো। যখন তখন যেখানে খুশি রোম্যান্স করা যায়। (মুখ বেজার করে)

সিয়ারা: (দু হাত ভাঁজ করে) আচ্ছা? তো তুমি কজনের সাথে রোম্যান্স করেছো? “যখন তখন, যেখানে খুশি?”

আধভিক একটা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যায়। সিয়ারার প্রশ্নটা আরেকবার ভেবে তরাং করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

আধভিক: এই এই! আমি এসব করিনি কখনও। আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল নাকি যে করবো? আমি তো শুধু দেখতাম।

সিয়ারা: লজ্জা করে না তোমার এইসব দেখতে তুমি? আবার সেইটা গর্ব করে বলছো?

আধভিক: তো কি করতাম চোখের সামনে আসলে? গিয়ে বলতাম, তওবা তওবা! এমন ভাবে ওপেনলি রোম্যান্স কেউ করে?

আধভিকের কথা শুনে হেসে ফেলে সিয়ারা। আধভিকও হেসে দেয়। তারপর বলে

আধভিক: তোমার কাছে কোনো কিছু বলতেই আমার লজ্জা লাগে না। আর না লাগে ভেবে চিন্তে কোনো কথা বলতে। (সিয়ারার কাছে গিয়ে)

সিয়ারা: ঠিক আছে ঠিক আছে হয়েছে। হুহ! এবার বাড়ি যাও।

আধভিক: বিয়ের আগে মনে হয় না তোর কপালে রোম্যান্স আছে ভিকি। আর বিয়ের পরেও আদর খাওয়ার জন্য যুদ্ধ করতে হবে যা বুঝতে পারছি। না হলে এতদিন কেউ এতো সুন্দর দেখতে একটা বয়ফ্রেন্ডকে, এতো কাছে পেয়েও নিরামিষ করিয়ে রাখে? (আক্ষেপ করে, নীচের দিকে তাকিয়ে)

সিয়ারা: একটা দেবো! যাও ভাগো। খালি আজে বাজে বকে। (আধভিকের বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে)

আধভিক: চুমু দিতে বললাম থাপ্পড় দিয়ে দিলে। আবার বলছো “এক দেবে?” চুমু হলে নিতে রাজি আছি থাপ্পড় হলে দরকার নেই থাক। কি কপাল আমার, চাইলাম চুমু পেলাম থাপ্পড়! স্যাড লাইফ।

সিয়ারা: ইশ! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না নাকি? (লাজুক ভাবে)

আধভিক সিয়ারার প্রশ্নে সিয়ারার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই ওর কাছে গিয়ে ওর কপালে নিজের ঠোঁটজোড়া রাখে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গভীরভাবে ছুঁয়ে রেখে সরে এসে, সিয়ারার এক গালে হাত রাখে।

আধভিক: না কিছু বলতে আটকায় আর না কিছু করতে। বাইরে সবার কাছে ভদ্র হলেও তোমার কাছে অভদ্রই থাকবো জান। লাভ ইউ! (গালে ঠোঁট ছুঁয়ে)

আধভিক হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিয়ারা মনে মনেই ব্লাশ করতে থাকে ওখানে দাঁড়িয়ে। আধভিক গাড়ির দরজা বন্ধ করলে সিয়ারা জানলার সামনে দাঁড়ায়।

সিয়ারা: সাবধানে যাবে।

কথা শেষ করে আধভিকের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে সরে আসে সিয়ারা। আধভিক হেসে বলে,

আধভিক: যাক কিছু তো পাওয়া গেলো। কষ্ট করে আসাটা বিফল যায়নি একবারে। (দুষ্টু হেসে)

সিয়ারা: উফ! আবার শুরু হলো? ধুর আমি চললাম। তুমি পৌঁছে টেক্সট করবে।

সিয়ারা আর না দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। সিয়ারাকে বাড়িতে ঢুকে যেতে দেখে আধভিক বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। আধভিকের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সিয়ারা বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে, যায়নি নিজের ঘরে। আধভিকের গাড়িটা যতটা দূর দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সিয়ারা। এদিকে আধভিক লুকিং গ্লাসে সিয়ারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে। নিজের ফোনটা নিয়ে সিয়ারাকে কল করে বলে,

আধভিক: ঘরে যান মহারানী। অনেক রাত হয়েছে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না আর।

সিয়ারা টুক করে ফোন কেটে দেয়। ধরা পড়ে গেছে ভেবে জিভ কেটে দৌঁড় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে চলে যায়। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে আসে। বিয়ের দিনই আশীর্বাদ করার কথা তাই বরযাত্রী একটু আগে এসেছে। দিয়ারাকে উপরে পাঠানো হয় সিয়ারাকে ডাকতে। অনেকক্ষণ যাবৎ দিয়ারা না আসলে আরেকজন যায় ওদের ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে বলে,

__সিয়ারা ঘরে নেই। ও চলে গেছে।

আধভিক: চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? এদিক ওদিক কোথাও…

__না! দিয়াকে কনের সাজে সাজিয়ে সিয়ারা পালিয়ে গেছে।

কথাটা শুনে আধভিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আভাস বাবু রেগে গিয়ে বললেন,

আভাস বাবু: এরকম মজা করা ঠিক নয়। এসব কি বলছো তুমি?

সিয়ারার মা: ঠিকই বলছে ও বেয়াই মশাই। সিয়া ঘরে নেই। এই চিঠিটায় ও বলে গেছে সব কথা। (ভাঙা কণ্ঠে)

সিয়ারার মা চিঠিটা এগোতেই আধভিক কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নেয়। ধীরে ধীরে ভাঁজ খুলতেই দেখেই সিয়ারার হাতের লেখা।

“আধভিক! আমি তোমাকে অনেক বার বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারিনি। আমি এই বিয়েটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। চেষ্টা করেছিলাম বিয়েটা আটকানোর কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমার বোন যে তোমায় ভালোবাসে তোমাকে সেটা আগেই জানিয়েছিলাম আমি তাই ঠিক করলাম বিয়ের দিন ওর সাথেই না হয় তোমার গাঁটছড়া বেঁধে দেবো। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তো এটা সম্ভব নয় তাই আমি সরে এলাম। তোমার হাতে নিজের বোনকে তুলে দিলাম আধভিক, সামলে রেখো ওকে এবং আমার মাকে।

ইতি তোমার সিয়ু”

চিঠিটা হাতে মুড়িয়ে নিয়ে হুড়মুড় করে সিয়ারার ঘরে চলে গেল আধভিক। ঘরে গিয়ে দেখলো দিয়ারা কনের সাজে বসে আছে। দিয়ার আধভিককে দেখতেই উঠে দাঁড়ায়।

আধভিক: তুমি জানতে এ বিষয়ে?

দিয়ার নীচের দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। আধভিক রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে চোখ বুজে নেয়।

আধভিক: তুমি নীচে যাও।

দিয়ার সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দিয়ারা বেরিয়ে গেলে আধভিক ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে থাকে। চোখটা জলে ভরে উঠেছে ওর। সিয়ারার একটা ফটোফ্রেম হাতে নিয়ে বলে,

আধভিক: এইভাবে আমাকে ঠকালে সিয়ারা? বার বার অনুরোধ করার পরেও ছেড়ে চলে গেলে?

আধভিক চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সিয়ারার নাম ধরে। নীচ থেকে সবাই সেটা শুনে কেঁপে ওঠে। আভাস বাবু চোখ বন্ধ করে নেন ছেলের আর্তনাদ শুনে। কিছুক্ষণ পর আধভিক নীচে নেমে এসে না দাঁড়িয়ে সোজা আভাস বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আভাস বাবু ছেলের মুখ দেখে বুঝতে পারেন ঠিক কি ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে ওর উপর।

আধভিক: চলো ড্যাড!

সিয়ারার মা: তুমি বিয়েটা করবেনা বাবা?

আধভিক: যাকে বিয়ে করার কথা ছিল সেই তো বিয়েটা করতে চায়নি আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার এবং আপনার মেয়ের কোনো রকম কোনো অসুবিধা আমি বেঁচে থাকতে হতে দেবো না। আসি!

আধভিক বেরিয়ে গেলে আভাস বাবুও বেরিয়ে যান। ধীরে ধীরে সব আত্মীয় স্বজন এক এক করে বেরিয়ে যেতে থাকেন।
________________________________________________________

হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায় পুরো হল। সামনে চলতে থাকা বিগ স্ক্রিনটা অফ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো আলো জ্বলে উঠছে। কিন্তু সিয়ারার সেই হুঁশ নেই সে নিজমনে চোখের জল ফেলছে। ওর চোখের সামনে এখনও শেষের ঘটনটা প্রতিফলিত হচ্ছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে ও পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো আধভিক নেই। সিনেমাটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সিয়ারা বুঝে যায় এটা ওর আর আধভিকের অতীত নিয়ে তৈরী। তখনই ও পুরোপুরি মগ্ন হয়ে যায় পুরনো স্মৃতির মাঝে। আধভিক যে কখন চলে গেছে খেয়ালই নেই।

সিয়ারা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকায় কিন্তু আধভিককে দেখতে পায় না। ঠিক সেই সময় হলে একটা গান বেজে ওঠে। সিয়ারা স্ক্রিনের দিকে ফেরে। নাম দেখানো শেষ করে এখন একটা “এন্ডিং সং” বেজে উঠেছে। সিয়ারা মাথা নীচু করে নিলে ওর চোখের সামনে কেউ একটা ওর পরিচিত বস্তু তুলে ধরে।

সিয়ারা: এটা তো আমার ডায়েরি!

সিয়ারা ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরতেই দেখে আধভিক দাঁড়িয়ে আছে। সে পিছন থেকে ওর চোখের সামনে ডায়েরিটা ধরে ছিলো। সিয়ারা সেটা নিয়ে নিতেই পকেটে হাত গুঁজলো।

আধভিক: হ্যাঁ আপনারই ডায়েরি। আপনার ডায়েরিটা ছাড়া এই সিনেমাটি তৈরীই হতো না মিসেস সান্যাল। থ্যাংক ইউ সো মাচ আমাকে এতটা হেল্প করার জন্য। (তাচ্ছিল্য হেসে)

সিয়ারা: আমি…

আধভিক: উহুঁ! আমার কিছু শোনার নেই আমার থেকে। আপনি যা করে দেখিয়েছেন সেটাই যথেষ্ট। আপনাকে তো পুরস্কৃত করা উচিত কোনো মানুষের জীবন সুন্দর ভেবে নরক বানিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনাকে ঠিক কতবার থ্যাংক ইউ বলবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না।

সিয়ারা কিছু বলে না, চুপচাপ সহ্য করে নেয় আধভিকের কড়া কড়া কথা গুলো।

আধভিক: প্রথমত, বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে, আমিই ঠিক ছিলাম। ভালোবাসা বলে কোনো কিছু হয়ই না। হলেও সেটা একতরফা থাকে। দ্বিতীয়ত, কখনও কোনো মানুষকে তাঁর যোগ্যতার বাইরে কিছু দেওয়া উচিত নয়। কারণ না চাইতেই মানুষ কিছু পেয়ে গেলে তাঁর মূল্য, মর্যাদা দিতে পারে না। তৃতীয়ত, আমার জীবনে না আসার জন্য। আমাকে বিয়ে না করার জন্য।

সিয়ারা মাথা উঠিয়ে আধভিকের চোখের দিকে তাকায়। শেষের কথাটা মেনে নিতে পারছে না সে।

আধভিক: আপনি আমার জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল ছিলেন, বোঝানোর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সিয়ারা: তুমি একবার আমার কথাটা তো শোনো..??

সিয়ারা আধভিকের দিকে এগোলে আধভিক পিছিয়ে যায়।

আধভিক: আমি তোমাকে ঠিক যতটা ভালোবাসতাম তার চাইতেও অনেক বেশি পরিমাণে ঘৃণা করি এখন। আমার জীবনে তোমার কোনো জায়গা নেই মিসেস সিয়ারা সান্যাল! আর আধভিক রায় চৌধুরী যাকে ঘৃণা করে তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না। তাঁর কথা শোনা তো দূরের বিষয়।

সিয়ারা: আমি মানছি আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে চাইনি।

আধভিক: করে তো দেখিয়েছো তাই না? আমার জীবনটাকে নাটক বানিয়ে রেখে দিয়েছো!! (চিৎকার করে) আমার ফিলিংস টা তোমার হাতের খেলনা ভেবেছিলে তাই তো নিজের বোনের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে। ওয়াও! সিয়ারা ওয়াও! (হাত তালি দিয়ে) শেষমেশ যখন এটাই করবে তাহলে প্রথমেই কেন তুলে দিলে না? তখন কেন এসে আমার ভালোবাসা স্বীকার করে মিথ্যে নাটক করেছিলে?

সিয়ারা: তুমি, তুমি বিয়েটা করনি? (কান্না ভেজা কণ্ঠে)

আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) কোনো উত্তর নেই তাই কথাটা ঘুরিয়ে দিলে। যাই হোক কোনো উত্তরের আশা আমি তোমার থেকে রাখিনা ইনফ্যাক্ট কোনো কিছুর আশাই রাখি না কারণ তোমার সাথে আশা রাখার মত সম্পর্ক আমার নেই। সম্পর্ক যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা ঘৃণার।

আধভিক পিছন ফিরে চলে যায়। যাওয়ার পথে দাঁড়ায় কিন্তু সিয়ারার দিকে ফেরে না। মাথা টা সিয়ারার দিকে কিছুটা ঘুরিয়ে আড় চোখে চেয়ে বলে,

আধভিক: একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করাটা আধভিক রায় চৌধুরীর ইমেজ, পার্সান্যালিটির সাথে যায় না। সে বিশ্বাসঘাতক নয়, কথা দিয়ে কথার মূল্য দিতে জানে সে। তাই তাঁর জীবনেও বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের কোনো জায়গা নেই। তুমি আমার জীবনে একটা দুঃস্বপ্ন ছিলে সিয়ারা, যা ভোরের আলো ফুটতেই কেটে গেছে। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি আমি। তুমি এখন না আমার প্রিয়জন আর না প্রয়োজন।

আধভিক চলে যায় আর সিয়ারা কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই বসে পরে। গানের লাইনগুলো কানে পৌঁছালে রিলেট করতে পারে সিয়ারা।

“সোচ লিয়া তু খাব হেইন মেরা,
টুট গায়া জো আয়া সাওয়েরা
সোচ লিয়া হেইন বিন তেরে জিনা
সোচ লিয়া তোহ সোচ লিয়া।”

অনেকক্ষণ পরে সিয়ারা হল থেকে বেড়ালে সোহম এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।

সোহম: চল। তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই।

সিয়ারা: আমি চলে যেতে পারবো সোহম দা।

সোহম: এমন করিস না বোন। অনেক রাত হয়ে গেছে। এইভাবে তোকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমার একটা কথা শোনার সময় যখন তাঁর হয়নি তাহলে কেন তোমাকে দাঁড় করিয়ে রাখার পরেও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছে? যার জীবনে আমার কোনো জায়গাই নেই তাঁকে আমাকে নিয়ে ভাবতে না করো। আসলাম।

সিয়ারা বেরিয়ে যায় মাল্টিপ্লেক্স থেকে। রাত হয়ে গেছে। কিন্তু কেমন জানো এটাই ভালো লাগছে সিয়ারার। সে চেনে এখানকার রাস্তা তাই কোনো ক্যাব বুক করলো না। হাঁটা শুরু করলো। নিজের ডায়েরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, চলে আসার সময় ফেলে রেখে এসেছিলো এটা। হঠাৎই ওর মনে হয় ওর পিছনে কেউ একটা আসছে। ও দাঁড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে নিজের জায়গায়। কোনো সাড়াশব্দ না এলে সিয়ারা তাচ্ছিল্য হেসে এগিয়ে যেতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে,

সিয়ারা: রাগ দেখানোর বেলায় যেমন আছে তেমন চিন্তা করার বেলায়ও আছে। মুখেই খালি বড়ো বড়ো কথা, ঘৃণা করে। তা এতই যখন ঘৃণা তখন গাড়ি ছেড়ে হেঁটে হেঁটে পিছু নেওয়ার কি দরকার? না ভাবলেই তো চলে?

মনে মনে হাসে সিয়ারা। একসময় নিজের বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ি গিয়ে দরজা দিয়ে, কায়দা করে দরজার ফাঁকে চোখ রাখে। আধভিক একটু ভালো ভাবে দেখে নিয়ে, সিকিউরিটির সাথে কথা বলে চলে যায়। সিয়ারা বেরিয়ে সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে আধভিক কি বললো তাঁকে। সিকিউরিটি বলে, “স্যার আপনার খোঁজই নিচ্ছিলেন ম্যাডাম। আপনি বাড়িতে ঠিক ভাবে ঢুকে গেছেন কি না।”

সিয়ারা: (মনে মনে– হম! তার মানে মিস্টার আধভিক রায় চৌধুরীর পাহাড় সমান অভিমান হয়েছে। সেটাই এখন ধীরে ধীরে ভাঙতে হবে। যতই হোক, ভুল তো আমার। এখন আমিই যদি রাগ দেখাই তাহলে কীভাবে হবে? আমাকে যে করেই হোক ওকে মানাতে হবে। আমার নিজেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর নেওয়া বাকি।)

পরেরদিন সকালে,

আধভিক বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের কেবিনে, চেয়ারে বসে আছে উপরের দিকে তাকিয়ে। চোখের কোণে থাকা জল গাল গড়িয়ে পরার প্রমাণ রেখেছে শুকিয়ে গিয়ে। এমন সময় কেউ ওর দরজার লকটা খুললে আধভিক বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। উঠে বসতেই দেখে সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।

সিয়ারা আধভিকের কেবিনে আসতেই আধভিককে এহেন অবস্থায় দেখে স্থির হয়ে যায়। শার্টের উপরের বোতামগুলো খোলা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট। সেটা দেখেই সিয়ারা নীচে তাকালো। যা ভেবেছিলো, অনেকগুলি সিগারেটের প্যাকেট পরে আছে। আশে পাশে তাকাতেই দেখলো সেন্টার টেবিলে ব্র্যান্ডেড হুইস্কির বোতল, সেখানেও সিগারেটের ফিলটার পরে আছে।

সব দেখে সিয়ারা একটু একটু করে আধভিকের দিকে এগিয়ে যায়। আধভিক নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায়, ততক্ষণে সিয়ারা আধভিকের সামনে এসে উপস্থিত। আধভিকের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, বুজে আসছে রীতিমতো। হঠাৎই সিয়ারার চোখ যায় আধভিকের বুকের বাম দিকে। শার্টের ফাঁক দিয়ে নিজের নামটা উঁকি দিচ্ছে। সিয়ারা চোখে জল নিয়ে নিজের নামটার উপর হাত রাখলে আধভিকও চোখ বুজে নেয় আর সিয়ারা নিজেও চোখ বুজে নেয়। সাথে সাথে সিয়ারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। ধীরে ধীরে অনেকটা কাছে চলে যায় ও আধভিকের। আধভিক চোখ খুলে সিয়ারাকে নিজের এতো কাছে দেখতে পেয়ে ওকে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে নিজের হাতটা তুলতে থাকে কিন্তু সে সময়ই….

__ভিকি দা?? ক্লাইন্ট এসে গেছে মিটিংয়ের জন্য। তুমি যাব….

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here