ফুলকৌড়ি (২৮) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
313

#ফুলকৌড়ি
(২৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ের নিমন্ত্রণে বাড়িতে ছোটোবড়ো বিভিন্ন মানুষে ভরপুর।এই দুমাসে এবাড়ির সবার সাথে সুপরিচিত হয়ে গেলেও,হঠাৎ এতো অচেনা মানুষের মধ্যে কৌড়ির একটু চলতে ফিরতে অস্বস্তি হচ্ছে।ভিতরে ভিতরে খুবই দ্বিধা, অস্বস্তি অনুভব করছে।আর সবচেয়ে বড় অস্বস্তি দিচ্ছে,এবাড়ির অতি পরিচিত আত্মীয় স্বজনেরা যখন তাকে নিয়ে প্রশ্ন,কৌতুহল দেখাচ্ছে।সে মেয়েটা কে?কার মেয়ে!নিজের সামনে বারংবার প্রশ্নটা করতে দেখে মনেমনে ভিষণ বিব্রতবোধ অনুভব করছে।তাই যেখানেই মানুষের আনাগোনা কম সেখানেই নিজের উপস্থিতি রাখছে সে।তবুও বিয়ে বাড়ি বলে কথা।বললেই কি আর নিজের মতো স্বস্তিতে থাকার জায়গা মেলে।কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতে ছাদের উদ্দেশ্য যাওয়ার জন্য এগোচ্ছিলো কৌড়ি।হঠাৎই বাহুতে ধাক্কা খেয়ে দুকদম পিছনে সরে যেতেই সামনে নজর পড়লো তার।অচেনা তবে সল্প সময়ের মুখ চেনা একটা ছেলে।দেখতে শুনতে সুদর্শন ছেলেটা মান্যতার আপুর মামাতো ভাই।যাদেরকে সকালের দিকে আসতে দেখেছে,এবং তখনই পরিচয় জেনেছে কৌড়ি।

‘স্যরি স্যরি, আমি দেখতে পায়নি।

কথাটা বলেই মাথা উঁচু করতেই হা হয়ে কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা।অপরিচিত মেয়েটাকে ফুফুবাড়িতে নতুন দেখে মনে প্রশ্ন বিঁধলেও,নজর বিঁধে গেলো কৌড়ির শুভ্র নির্মল শোভিত মুখখানায়। ঘনোপল্লবযুক্ত ডগরডগর আঁখিজোড়া দ্বিধাহীনভাবে কয়েকবার ঝাপটাতেই,ছেলেটার মুগ্ধ নজরজোড়া যেনো আর-ও মুগ্ধতায় ডুবে গেলো।দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে শেষ অব্দি সেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া দৃশ্যাবলী খুব শান্ত আর মনোযোগ সহকারে কেউ একজন দেখলো।তার ধারালো নজর জানান দিচ্ছে,সেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া অঘটনা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। তন্মধ্যে কৌড়ি রিনরিনে গলায় বললো।

‘স্যরি, আমি-ও খেয়াল করিনি।

কথাটা বলেই ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সে। হুঁশ ফিরলো যেনো ছেলেটার।তড়িৎ পিছে ফিরলো। দেখলো সিড়ি বেয়ে কৌড়িকে উপরে যেতে।ছটফটিয়ে ছেলেটাও পা বাড়ালো সেদিকে। সিঁড়ির মাথার ধাপে গিয়ে পা রাখতেই,বলিষ্ঠ শরীর অবয়বে সামনে হাজির হলো কেউ। নিভানকে সামনে দেখতেই মাথা চুলকিয়ে, মুখে মিষ্টি হাসি এনে বললো।

‘তাড়াহুড়ায় সামনাসামনি পড়ে গেলাম,স্যরি ভাইয়া।

কথাটা বলে পাশ কাটাতে গেলেই,পুনরায় ছেলেটার পথ রোধ করে দাড়ালো নিভান।এবার ছেলেটার মুখের হাসি মুছে তড়িৎ বললো—কিছু বলবে ভাইয়া?

নিভান ছেলেটার হাত ধরে সামনে এনে দাড় করালো।
ছেলেটা তার ছোটোমামার একমাত্র ছেলে আনাফ।বয়সেও তার অনেক ছোটো।কৌড়িকে নিয়ে কথাগুলো বলতে ভিতরে ভিতরে ভিষন দ্বিধা হচ্ছে।ছোটো ভাইবোনদের সামনে সে এসব বিষয়ে কখনো কথা বলতে বা এসব বিষয়ে আলোচনা করতে কমফোর্টেবল নয়।তবু-ও বলতেই যে হবে তাকে।কৌড়ি মানে,সেখানে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কার-ও আগমন নয়।আগমন ঘটতে চাইলেও,সেই সংযুক্ত লাইন তাকে পার করে কৌড়ি পর্যন্ত পৌঁছানোর দুর্বোধ্য বিষাক্ত কাটাতার সে।কৌড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে সেই যন্ত্রণাদায়ক কাটাতার পার করতেই হবে।আর সেই কাটাতর পার করা যে-কারও জন্য সহজ হতে দেবে না সে।সেটা যেই হোক না কেনো।ছেলেটার মাথার সিল্কি এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতেে দিতে বেশ ঠান্ডা গলায় বললো।

‘এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় ছুটেছিস?

এতোসময় নিভানের গম্ভীর মুখের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো আনাফ।কিন্তু নিভানের ঠান্ডা গলার প্রশ্নটা শুনতেই উত্তর দিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে।ভাইয়া যদি জানতে পারে যে,সে ওই মেয়েটার পিছু নিচ্ছিলো তবে বিষয়টা মোটেই তারজন্য ভালো দাঁড়াবেনা।আবার এই মানুষটার সামনে মিথ্যা বলেও পার পাবেনা সে।তাই কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললো

‘আসলে ওই মেয়েটা কে এটাই জানতে চাইছিলাম।

কৌড়ির সমবয়সী ছেলেটা।সামনে ইন্টার পরিক্ষা।তার মুগ্ধ নজর আর আবেগ বুঝতে সময় লাগলো না নিভানের।তবুও জিজ্ঞেস করলো।– কেনো?মেয়েটা কে, জেনে কি করবি?

স্বাভাবিক গলায় সহজ প্রশ্ন।সামনের ছেলেটা যেনো আশকারা পেলো কিছুটা।বললো—মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে ভাইয়া।শহরের মেয়েদের মতো শুধু মুখ সুন্দরী নয়,হাত পায়ে-ও সুন্দরী।কি সুন্দর তার চোখদুটো।

আনাফকে কষে একটা নয় পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো নিভানের।কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের সংযম সহজে বিচ্যুত হতে দেয়না, সংযাত রাখতে পারে বলে ছেলেটা তার হাতের কঠিন থাপ্পড় থেকে বেচে গেলো।আর স্নেহের ভাই বলেও কথা।ছেলেটার মাথার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে এবার টিশার্টের খোলা বোতামে হাত রাখলো নিভান।বেশ স্নেহশীল হাতে খোলা বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বললো।

‘যে মেয়েটার পিছু নিতে চাইছিস।সে বাদে বিয়ে বাড়িতে আরও অনেক মেয়ে আছে।তাদের পিছু ঘুরে বেড়া এমনকি দৌড়ে বেড়া,ভাইয়া কিচ্ছুটি বলবে-না।একদম কিচ্ছু বলবেনা।তবে ওই মেয়েটা বাদে।ভুলেও দ্বিতীয়বার আর ওর পিছু নিতে যাস না।আনাফ-তো খুব ভালো ছেলে তাই-না!আর একপলকে যে খেয়ালী নজরে ওকে দেখে ফেলেছিস,সবটুকু ভুলে যা।মনে-কর ওকে দেখিসনি তুই।কেমন?

অবাক হলো ছেলেটা।ভাইয়া সবসময় গম্ভীর গলায় এটাওটা আদেশ করে চললেও এমন শিথিল আর কঠিন গলায় কখনো কথা বলেনা।তবে?বিস্ময়ে গলায় ছেলেটা বললো–কেনো ভাইয়া?মেয়েটা কি স্পেশাল কেউ?

‘হুমম।খুব স্পেশাল।

অদ্ভুত নজরে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা।সামনের মানুষটার তুলনায় বয়স কম হলে-ও, মেয়েটাকে নিয়ে সামনের মানুষটার কঠিন গলার সতর্কতামূলক বানীগুলো তাকে বুঝিয়ে দিলো অনেক কিছু।ভিতরে ভিতরে ভিষন মন খারাপ হলো তার।তবে মুখের আদলে সেটা উহ্য করতে পারলো-না।মনের কৌতুহল মেটাতে দূর্বল গলায় ফের বললো।

‘মেয়েটা কি তোমার স্পেশাল কেউ?

ছোটো ভাইয়ের এবারের প্রশ্নে ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রতবোধ করলো নিভান।তবে বিষয়টা যখন কৌড়িকে নিয়ে উত্তর দিতে দ্বিধা মোটেও করলোনা।বললো।

‘তুই জেনে কি করবি সে ভাইয়ার স্পেশাল কেউ কি-না।তবে ভাইয়া যখন নিষেধ করেছে,মেয়েটার আশেপাশে ভুলেও না,তবে না। কেমন?

হঠাৎই স্বপ্নবোনা মনটা ভেঙে গেলো আনাফের।যেমন তাড়াতাড়ি স্বপ্ন বুনেছিলো,তারচেয়ে শত তাড়াতাড়িতে স্বপ্নগড়া মনটা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো তার।আর মেয়েটা এমন একজনের স্পেশাল কেউ।যেখানে ভুলেও আর এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। উচিত-ও হবে-না।
নিভানের কথার উত্তর সরূপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।নিভানও মিষ্টি হেসে, একটু আগে ছেলেটার এলোমেলো গুছিয়ে দেওয়া চুলগুলো ফের মাথায় আঙুল চালিয়েছে এলোমেলো করে দিলো।মুখে বললো–এইতো গুড বয়।

গুড বয় ট্যাগটা মোটেই পেতে ইচ্ছে করলোনা ছেলেটার,মন খারাপ করে ফের সিঁড়ির পথ ধরতেই নিভান পিছু ডাকলো।—আনাফ।

পিছু ফিরলো ছেলেটা।ছোটো ভাইয়ের বেজার মুখ দেখেও মনের কঠিন চাওয়াটা চেপে রাখলোনা।বললো- কৌড়িকে যখনই নজরে পড়বে,বড়ো ভাইয়ের বউয়ের ন্যায় সম্মানের নজরে দেখবি।পারলে মাথা নিচু করে রাখবি।তবুও সম্মান শ্রদ্ধা ছাড়া দ্বিতীয় তৃতীয় কোনো ভালোমন্দ নজর নয়।ঠিক আছে?

কথাটা মোটেও পছন্দ না হলেও ফের ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়ালো আনাফ।কেননা,আজ্ঞাটা যে দিচ্ছে তাকে প্রচন্ড মানে এবং সমীহ করে তার মা বাবা।এমনকি সেও।বিপরীতে আদর স্নেহ কম পায় না।তবে আনাফের মুখাবয়ব দেখে তার ভিতরের মনটা বুঝতে সময় লাগলো না নিভানের।গম্ভীর কন্ঠ ছেড়ে উচ্ছল কন্ঠে বললো–ওর থেকে-ও সুন্দর দেখতে মেয়ে তোরজন্য বউ করে আনবে ভাইয়া।ওকে?

ছেলেটার মুখে যেনো একটা টুকরো হাসি ফুটলো।মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললো।—ওকে ভাইয়া।

ছেলেটা চলে যেতেই ঠোঁটের হাসি মিলে গেলো নিভানের।তপ্ত শ্বাস ফেলে সেদিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছাঁদের সিঁড়িপথের দিকে তাকালো।বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ঢল।সময়টা বিকাল হবোহবো।দুপুরে খাবারের পর সবাই হয়তো বিশ্রামে। বিধায় ড্রয়িংরুমের দিকে মানুষের আনাগোনা সেভাবে নেই।আশেপাশে খেয়ালী নজরে তাকিয়ে ছাঁদের সিঁড়িপথ ধরলো নিভান।ছাঁদের দরজার সামনে গিয়ে দেখলো।সকালে মামাদের বসার জন্য ছাদে আলাদাভাবে টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।সেটা নামানো হয়নি।ছাদের দরজার দিকে পিঠ ফিরে সেই চেয়ারে বসে আছে দীঘল চুলের এলোকেশী কন্যা।খোলা চুলগুলো ছাঁদের ফ্লোর ছুঁইছুঁই।গভীর মনোযোগে দিয়ে ম্যাডাম কিছু করে চলেছে।

বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির প্রতিটি রুমে যেনো ঠেসেঠুসে মানুষ ভরে আছে।এমনকি কৌড়িকে থাকতে দেওয়া তার নিজের রুমটাও বাদ যায়নি।মৌনতা আর মান্যতা আপু কেউ বাড়িতেই নেই।শপিংয়ে গিয়েছে।সাথে দীবা আপুসহ তার মামাতো কিছু ভাইবোনও গিয়েছে। তাকে-ও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো এমনকি যাওয়ার জন্য জোরাজোরিও করেছিলো।সে যায়নি।মূলত অত অপরিচিত মানুষের মধ্যে নিজেকে কেমন কেমন লাগছিলো।তন্মধ্যে সবার পরিপাটি রূপ,সাজ পোশাক চালচলনের কোয়ালিটিই আলাদা।সেখানে নিজেকে কেমন অদ্ভুত অনুভব হচ্ছিলো।বিধায় বিভিন্ন বাহানায় তাদের সাথে যেতে না করে দিয়েছে।এখন বাড়িতে কিছু মুরুব্বি মানুষ বাদে সবই অপরিচিত মুখ।কোথাও নিজেকে মানিয়ে নিতে স্বস্তি পাচ্ছেনা কৌড়ি।মনেমনে একটু ফাঁকা জায়গা খুজছিলো।হঠাৎ ছাঁদের কথা মনে হতেই চলে এসেছে সে।হাতে পায়ে নখ বেড়েছে বলে সাথে নেল-কাটার এনেছে।নিরিবিলি বসেবসে নখকাটা যাবে।তবে আসতে গিয়ে পথে ঘটলো বিপত্তি।বিপত্তি পাশ কাটিয়ে ছাঁদে এসে চারপাশের সবুজ মনোরম পরিবেশ দেখে মন ভালো হয়ে গেলো তার।ভুলে গেলো সবকিছু।কিছুক্ষণ বাগানের মধ্যে হাটাহাটি করে,চেয়ারে বসে নখকাটায় মনোযোগ দিলো সে।হঠাৎই ছাঁদের দরজা শব্দ হওয়ায় মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো তার। পিছু ফিরলো সে।নিভানকে ছাঁদের দরজা আঁটকে দিতে দেখেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে,বুকে কম্পন ধরে গেলো তার।আতঙ্কিত হয়ে সহসা উঠে দাড়ালো সে।এমনিতে ওই মানুষটা আশেপাশে থাকলে কাঠের পুতুল মনেহয়। নিজেকে নিজের মধ্যে অনুভব হয়না।যারকারনে বোবা মানুষের মতো আচারন করতে হয় তার।ভুলেও মানুষটার সাথে কথা বলেনা সে।আর ইদানীং ওই মানুষটার কথাবার্তা,আচারনতো তাকে ভিতরে ভিতরে ছটফটিয়ে মারছে।অথচ না পারছে সে গিলতে আর না পারছে কোনো একটা কারনে ফেলতে।আর সেই মানুষটা আবারও তার দুয়ারে!

‘বসো।

গলার স্বরটা শুনতেই স্বাভাবিকভাবে চলা নিঃশ্বাস বুকে বিঁধে গেলো কৌড়ির।সামনে তাকাতেই দেখলো,তার সামনাসামনি চেয়ারে বসে পড়েছে মানুষটা।কখন?টের পেলোনা সে।তড়িৎ বললো।

‘আমি নিচে যাবো।

মুখ তুলে কৌড়ির পানো চাইলো নিভান।শান্ত অথচ দৃঢ় নজর।নজরে নজর মিলতেই সহসা বসে পড়লো কৌড়ি।বুকের ভিতরের কম্পন দ্বিগুণহারে বাড়লো।সেই কম্পন আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিভান বাম হাতটা পাতলো তারপানে।শক্তপোক্ত হাতের তালুটা নজরে পড়তেই নজর তুলে নিভানের দিকে তাকালো।কৌড়ি তাকাতেই নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করলো হাত রাখতে। সহসা ইশারা বুঝলোনা কৌড়ি।সেটা বুঝতে পেরে নিভান বললো।

‘হাতটা দাও।

হাতটা দিলেনা কৌড়ি বরং হাতটা টেবিলের উপর থেকে সরিয়ে নিলো নিজের কাছে।টেবিলের উপরে নেলকাটারটা রেখে তখন যে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেটা এখন সামনের মানুষটার হাতে।আর তার হাতটা চাইছে কেনো সেটাও বুঝতে বাকি রইলো-না কৌড়ির।সেটা বুঝে দৃঢ় কন্ঠে কৌড়ি বললো।

‘আমার কাজটা আমি করে নিতে পারবো।

‘তুমি পারবে কি পারবেনা সেটা আমি জিজ্ঞেস করিনি।আমি হাতটা দিতে বলেছি,তুমি দেবে।

নিভানের জেদালো পূর্ণ কথা শুনে কন্ঠ আরও দৃঢ় হলো কৌড়ির। গলায় দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল–‘আপনি বললেই তো হবেনা।

‘তবে কাকে বলতে হবে? কে বললে হবে?তুমি যে এই বেখেয়ালিতে চলাফেরা করে অন্যের আমানত খেয়ানত করছো,হক নষ্ট করছো।তাতে কিচ্ছু হচ্ছে না?

নিভানের রাগমিশ্রিত দৃঢ়কণ্ঠের কথাগুলো কানে আসতেই সহসা প্রশ্ন করলো কৌড়ি।–মানে কি?আমি আবার কার হক নষ্ট করলাম?

আবারও দৃঢ়কণ্ঠের জবাব নিভানের–‘আমার!

ভয়,সংকোচ কথার ফেরে অনেক আগেই কেটে গিয়েছে কৌড়ির।সহসা আবারও প্রশ্ন করলো-কিভাবে?

মৃদু হাসলো নিভান।হয়তো এই প্রথম নিভানকে হাসতে দেখেছে কৈৌড়ি।শ্যামবর্ণ মুখের, পুরো ঠোঁটের হাসিটা মন কাড়লো কৌড়ির।মুগ্ধ নজরে দেখলো সে।সেই ফাঁকে কৌড়ির হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো নিভান।সমস্ত শরীর মৃদুতর কেঁপে উঠলো মেয়েটার।হাত টেনে,পুরুষালি হাতটা থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।তবে সামনের মানুষটার শক্ত হাতের চাপে পারলো না।কৌড়ির হাতের পানে চাইলো।চকচকে ফর্সা হাতটা নিজের শ্যামবর্ণ হাতের মধ্যে বেশ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।
গোটালো আঙুলগুলোর মধ্যে তিনটে আঙুলের বাড়তি নখ কাটা শেষ, আপতত দুই আঙুলের নখ আছে।অনামিকা আঙুলটা বেশ নরমস্পর্শে ধরে নখ কাটতে গেলেই হাত আবারও ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কৌড়ি।সেটা দেখে নিভান স্বাভাবিক গলায় বললো।– -হাত নাড়িয়েও না,ব্যাথা পাবে।

‘আমি বলেছি তো কেটে নিতে পারবো।

‘আমি বলেছি কি তুমি কাটতে পারবে-না।

কৌড়ি বেশ বুঝতে পারলো, সামনের মানুষটার জেদের সাথে সে পেরে উঠবেনা।প্রশ্ন মনে রয়ে যাওয়ায় আগের কথায় ফিরে গেলো সে।–আমি আপনার কি হক নষ্ট করেছি?

‘একটু আগে যে নিজের বেখেয়ালিতে একটা ছেলের গায়ের উপর পড়লে,ওটা কি কারও হক নষ্ট নয়।

আশ্চর্য হলো কৌড়ি।সে কি ইচ্ছেকৃত পড়েছে নাকি।কিছুটা কৈফিয়তের স্বরে বললো-ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো মাত্র।ইচ্ছাকৃত কোনোমতেও ছিলো-না।

‘জানি সেটা আমি।তবুও তোমার বেখেয়ালিতে চলা উচিত হয়নি।তোমার বেখেয়ালীর জন্য অন্যের হক নষ্ট, সে কিন্তু কিছুতেই মেনে নেবেনা কৌড়ি।

‘আমি মানুষ আমার দ্বারা ভুল বা অন্যায় হতেই পারে।
সে কেউ মানলো কি না মানলো তা আমার বোঝার বা দেখার প্রয়োজন নেই।আর আমি আমার অন্য কারও নই।

মনেমনে বিস্তর হাসলো নিভান।কৌড়ির জেদালো কথাগুলো শোনার জন্য কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে তার।যদিও এবিষয়ে কথা উঠাতে চাইনি সে।তবে দু’জনের মধ্যে ভয় সংকোচ, দ্বিধার দেয়াল ঘুচানোর জন্য সুযোগটা লুফে নিয়ে ছাঁদে এসেছে সে।আর একের পর এক কথা বাড়িয়ে চলেছে।তাই কথা বাড়তে বললো।

‘প্রয়োজন তোমার না থাকলেও তার আছে।আর তুমি তার না ননে করলেও, সে তোমাকে অবশ্যই তার মনে করে।আর তোমার ইচ্ছে তোমার চাওয়া,আমার নয়।আমার ইচ্ছে,চাওয়াটা তোমার ভিন্ন।

বামহাতটা ছেড়ে দিয়ে কৌড়ির ডানহাতটা ধরলো নিভান।এবারও হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কৌড়ি তবে পারলোনা।কৌড়ির ডান হাতটা হাতে নিতেই,ফর্সা হাতের উপর কুচকুচে কালো জটটা নজরে পড়লো নিভানের।মূহর্তেই ভেসে উঠলো সেদিনের দৃশ্যটা যেদিন তার ফোনটা দেওয়ার জন্য পর্দার ফাঁক ঘেঁষে হাতটা বাড়িয়ে ছিলো মেয়েটা।চকচকে ফর্সা হাতের উপর জটটা দেখে নিভানের মনে হয়েছিলো, ফর্সা হাতের উপরে কেউ যেনো নজরটিকা দিতে একটা কালো দাগ একে দিয়েছে।আর সেটা নজর কাঁটার বদৌলে নজরের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।সেদিন জটটা মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলো নিভান।আজ সেই জটটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো খুব।তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে ফেললো নিভান।সেদিক থেকে নজর সরিয়ে নখ কাটায় মনোযোগ দিলো।একেএকে নিঃশব্দে নখের বাড়তি অংশ কেটে চললো সে।কৌড়ি দ্বিধান্বিত নজর কাটিয়ে সেটা দেখলো।শ্যাম গায়ে নেভিব্লু কালারের একটা টিশার্ট পরা।মাথার ঘনোকালো চুলগুলো এলোমেলো।গায়ের রঙ শ্যামবর্ন হলেও,সুদর্শন একটা আদল।দুপুরের সূর্যের তেজস্বী আলো কমে গিয়ে বিকালের নরম আলোতে মানুষটাকে বেশ দেখাচ্ছে। মুগ্ধ হলো কৌড়ির নজর।ভিতরে ভিতরে কিছু একটা হয়ে গেলো।তবে সে দূর্বল হতে চায়না আর না চায় লোভী হতে।মনের কথাটা হঠাৎই মুখে বহিঃপ্রকাশ করলো সে।

‘আমি লোভী হতে চাইনা।

একমনে কৌড়ির হাতের নখগুলো কাটছিলো নিভান।দারুণ একটা মূহুর্ত উপভোগ করছিলো সে।হঠাৎই কৌড়ির কথায় হাত থেমে গেলো তার।কৌড়ির কথাটা বুঝে উঠতেই,পুনরায় হাত চালালো সে।নখগুলো কাটা শেষ করে বললো—ডানহাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে নখ কাটা শুরু করবে,তারপর ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল পর্যন্ত কেটে বামহাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে শুরু করে ডানহাতের বৃদ্ধা আঙুলে এসে নখ কাটা শেষ করবে।এটাই হচ্ছে নখ কাটার উত্তম পন্থা।কখনো এভাবে এলোমেলো নখ কাটবেনা।

প্রতিত্তোর এলোনা।হয়তো তার কথার উত্তর আগে চাই তার।সেটা বুঝে নিঃশব্দে মুখ নিচু করে হাসলো নিভান।কৌড়ির মুখের পানে চেয়ে সেই হাসি বিস্তৃত হলো।অথচ হাসিটা মোটেও সুখকর হাসি বলে মনেহলো না কৌড়ির।অযাচিত কারনে ধ্বক করে উঠলো বুক।সেই ধ্বক করে উঠার ধাক্কাটা আরও তিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়ে নিভান স্বাভাবিক গলায় বললো।

‘তোমাকে যে লোভী শব্দটা প্রয়োগ করেছে,সেতো জানে আমি এবাড়ির কেউ নই।এখন আমিই যখন এবাড়ির কেউ নই,তখন তুমি লোভী হবে কিকরে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here