ফুলকৌড়ি (১০) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
339

#ফুলকৌড়ি
(১০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কাঁচের দেয়াল বেষ্টিত সৌন্দর্যবর্ধনে সজ্জিত- গচ্ছিত নিজ অফিসকক্ষের চেয়ারে বসে আছে নিভান।রুমটা শুধুই তারজন্য স্পেশাল।জাহিদ সাহেব এবং শাহেদ সাহেব অফিসে আসলে তাদের জন্য-ও স্পেশাল নিজ নিজ অফিসকক্ষ রয়েছে।যে যারমতো করে নিজেদের অফিসকক্ষটা সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে।শীততাপনিয়ন্ত্রণ রুমটার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে।ইদানীং চোখ বন্ধ করলে সেই ক্রন্দনরত চোখজাড়ার সাথে সাথে আর-ও একটি দৃশ্য বদ্ধ নজরে ভেসে বেড়ায় তার।সেদিন বিকালের সেই ফিকে পড়া সূর্যের আলোতে কালোপোশাকে আবৃত এক মায়াহরিনীর গোলগাল কোমল লাবন্যময়ী মুখশ্রী ।কি অদ্ভুত!যে কারনে বিহানকে সে ঠান্ডা গলায় শাসালো,সেই একই নজরে সে-ও তাে দেখেছে মেয়েটাকে।তবে তাকে শাসাবে কে?আর মেয়েটা তো তার-ও কেউ নয় তবে কোনোই বা বিহানকে শাসালো সে?বিহানের মতো সেই মায়াহরিনীকে মুগ্ধ চোখে দেখার জন্য,তারও কি শাসন প্রাপ্য নয়?হবেনা কেনো?একই অপরাধে অপরাধী দুজন,তবে কেনো একজন শাসিত হবে।কিন্তু ভিতরটা কেনো বলছে ভিন্ন কথা!বিহানতো খারাপ নজরে মেয়েটাকে দেখেনি,তবে কেনো সেই মুগ্ধ নজরে তাকানোটা ঠিকঠাক লাগেনি তার?শান্ত থাকতে চেয়ে-ও মানতে পারিনি সে।হঠাৎ কি শুরু হলো এগুলো তার সাথে?কি?

‘আসবো?

কোনো সাড়া এলোনা ভিতর থেকে।কপাল কুঞ্চিত হলো তৃনয়ের।এতো কি ভাবনাতে ডুবে আছে ছেলেটা,যে তার ডাকটা অব্দি কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।নিভান এত মনোযোগী হয়ে কি ভাবনায় ডুবে আছে।আশ্চর্য!

‘এই নিভান আসবো?

সচকিত হলো নিভান।চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে।—তোকে বারবার কেনো উহ্য করে বলতে হয়, আমার কেবিনে আসার জন্য তোর অনুমতি প্রয়োজন নেই।

‘অফিসিয়াল রুলস বলে কথা।সেটাতো আর অগ্রাহ্যতা করা যায়না।রুলস্ তো সবার জন্য সমান।তাই না?

‘সেই অফিসের কোনো স্টাফ নোস তুই।আর না কোনো কোম্পানির কন্ট্রাক্ট ডিলার।আমার কাছের মানুষগুলোর আমার কাছে আসার জন্য কখনো তাদের অনুমতির প্রয়োজন নেই।

‘তা এমন কোন কাছের মানুষের কথা ভাবছিলি,যে আমার ডাকটা পর্যন্ত নিভান আওসাফ আহমেদ এর সেই ভাবনা ভেদ করে তার কর্নদ্বয় অব্দি পৌছালো না?

দুষ্ট হেঁসে কৌতুক গলায় কথাটা বলে চেয়ারে গা এলিয়ে
দিয়ে নিভানের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো তৃনয়।যদিও অপরপক্ষের ছেলেটার থেকে উত্তর পাবে এই আশাটা রাখে-না সে।তৃনয়ের ভাবানমতো সত্যিই উত্তর দিলো না নিভান।বরং অফিসের পিয়নকে ডেকে কফির অর্ডার করলো।পিয়ন চলে যেতেই তৃনয়কে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘হঠাৎ আমার অফিসে?সহজে তো পা পড়ে-না এখানে?কিজন্য এসেছিস?

তৃনয় জানতো উত্তর পাবেনা। তাই সেদিকে সে-ও আর এগোলা না।তবে নিভানের বলা কথাগুলো কানে যেতেই চেয়ারের হেডে মাথা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো— তন্ময়ীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।সেটাই বলতে আসলাম তোকে?

‘হঠাৎ?অনার্সটা তো কমপ্লিট করতে দে।তারপর না-হয় ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিস।

‘জানিসইতো,আম্মা আমাদের দুভাইবোনের অভিভাবক সম্বল।সবকিছু।হয়তো প্রতিটি সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের অবদান অতুলনীয়।তবে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই মা,বাবা মায়ের দুজনেরই অবদান রেখেছেন বর্ননাহীন।নিজে চোখে দেখে এসেছি তো,বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দুই-ভাইবোন-কে আঁকড়ে কিভাবে বেঁচে আছেন আম্মা।আমাদের সবদিকের যথাযথ খেয়াল রেখে প্রয়োজন অপ্রয়োজন সকল আশা আকাঙ্খা মিটিয়ে কি-করে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।সেই মায়ের সিদ্ধান্ত কখনো অমান্য করার চেষ্টা করেনি।তন্ময়ী-ও কখনো করিনি।হঠাৎ বিয়ের এই সিদ্ধান্তে ওর একটু মন খারাপ হলে-ও,মায়ের সিদ্ধান্তে অমত পোষন করেনি।তন্ময়ীকে আমি ঠিক কিরূপ ভালোবাসী।সেটা তো তুইও জানিস।আমিও তোর মতো চেয়েছিলাম,আর ভেবেছিলামও,এতো তাড়াতাড়ি ও-কে পর কর দেবো না।তবে মা যখন চাইছেন আমি-ও না করবো কিকরে বল?যদি-ও আমি না করেছিলাম।আম্মাকে বললাম– এতো তাড়াহুড়োর কি দরকার?পড়াশোনাটা আপতত কমপ্লিট করে নিক।তারপর না হয় ওর বিয়ের কথা ভেবে দেখা যাবে।মা আমার কথাতে রাজী হতে চাইছে না।বলছে,ভালো পাত্র,হাতছাড়া করা ঠিক হবে-না।আর এখনকার যুগে খুঁজে খুঁজে যোগ্য পাত্র মেলাও ভার।তা বাদেও মেয়েদের বয়স হয়ে গেলে,সঠিক পাত্র পাওয়াও মুশকিল হয়ে যায়।সঠিক বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত।এই কতশত কথা।মায়েদের ভাবনা বুঝিসই তো।
আর ছেলের ডিটেইলস সম্পর্কে খোঁজ খবর তো নিলাম।সবদিকে থেকে ভালোই তো মনেহলো।

‘আন্টি যখন ভালো ভেবেছেন,তবে নিশ্চয় চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আর তন্ময়ী অ্যাডাল্ট, ও যখন মতামত দিয়েছে।তবে আর না করার কি আছে!যদি-ও খোঁজখবর নিয়েছিস,তবু-ও আর-ও একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিয়ের মতো সিদ্ধান্তে যাবার চিন্তাভাবনা করিস।এটা কিন্তু শুধু একটা মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তা নয়।তোর আমার একেকটা জান কলিজার ভবিষ্যত।সেখানে ওরা ভালো থাকলেই তবে আমাদের শান্তি।

তৃনয় কথা বললো-না।শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।ফের চেয়ারে এলানো মাথাটা আরও শক্তকরে চেয়ারে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো।ওই শান্তশিষ্ট মায়াবী মিষ্টি চেহারার আদরের বোনটাকে তার পর করে দিতে হবে?ভাবতেই ক্ষনে ক্ষনে বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠছে তার।বাবা ছিলো না বিধায় ছোটো থেকে ওই বোনটাকে যে খুব যত্নে আগলে মানুষ করেছে সে।

‘এই তৃন?

ছেলেটার মন খারাপ হলেই নিভানের সঙ্গ খোঁজে।আজ হয়তো সেই সঙ্গটাও মন খারাপটাকে বিতাড়িত করতে পারছে-না।সেটা বুঝে তৃনয়কে ডাকতেই চোখ মেলালো সে।তন্ময়ীর জন্য যে ছেলে দেখা হয়েছে তার সম্পর্কে এবং তার ফ্যামিলি সম্পর্কে ডিটেইলসে জানতে কথা বাড়ালো নিভান।কথার মধ্যে থাকলে হয়তো ছেলেটার মন খারাপটা দীর্ঘ হবে-না।সেটা ভেবেই মুলত কথা বাড়ানো নিভানপর।একপর্যায়ে কফি নিয়ে এলো পিয়ন।কফিটা পান করতেকরতে দুই-বন্ধুর কথা আরও জমে উঠলো।

বেডে হেলান দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে বই পড়ছেন জাহিদ সাহেব।বই পড়ার অভ্যাসটা উনার আগে খুব বেশি একটা ছিলো না।বলতে গেলে,ব্যবসায়ী কাজের জন্য পড়ার সময়ই পেতেন না।অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এই পড়ার অভ্যাসটা হয়েছে উনার।এখন সারাদিন নামাজ কালাম তসবিহ তাহলীল ছাড়া সারাদিনের সঙ্গী হলো বই।আসরের নামাজটা পড়ে বিকালের চা নাস্তা নিয়ে স্বামীর খেদমতে হাজির হলেন নীহারিকা বেগম।নীহারিকা বেগমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইটা হাত থেকে বেডের একপাশে রাখলেন জাহিদ সাহেব।যতো প্রয়োজনীয় কাজ আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক এই নারাীটাকে তিনি কেনো জানি উপেক্ষা করতে পারেন না।কতো বছরের সংসার উনাদের।অথচ যতোবার স্ত্রী নামক নারীটার পদচারণ এই রুমে পড়ে তিনি সব উপেক্ষা করে নারীটাতেই মন দেন।

‘নিন,আপনার চা।

চায়ের কাপটা হাতে নিলেন জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ এক কাপ চা?তোমারটা কোথায়?

‘দুপুরের খাবারটা আজ অসময়ে খাওয়া হয়েছে।তাই চা টা আর এসময়ে খেতে ইচ্ছে করলোনা।

কথা বাড়ালেন না জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে ছোটো ছোটো চুমুর দিতে থাকলেন।সাথে একটুকরো বিস্কিট ও নিলেন।সেদিকে কিছুসময় নীরবে তাকিয়ে থেকে কথা পাড়লেন। বললেন–মেয়েটার দু’মাস বাদে ফাইনাল পরিক্ষা।কলেজ যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা উচিত নয় কি?

‘কার কথা বলছো?কৌড়ির?

‘হুমম।

জাহিদ সাহেব ভাবান্বিত হলেন।সময় নিয়ে কিছুসময় ভাবলেনও।ফের বললেন—ব্যবস্থা তো করা উচিত।তবে এই পরীক্ষার দু’মাস আগে কলেজ কতৃপক্ষ কোনো বহিরাগত স্টুডেন্ট এলাও করবে কি-না।এটাও চিন্তার বিষয়।

ফের জাহিদ সাহেব কিছু ভাবলেন।বললেন–তবে আমি দেখছি।রাতে শাহেদ বাড়িতে আসলে আমার সাথে একবার জরুরীভাবে দেখা করতে বোলো তাকে।

‘ঠিক আছে।

সম্মতি জানিয়ে ফের নীহারিকা বেগম বললেন।-আমিও তাই ভাবছিলাম।মৌনতার স্কুল এন্ড কলেজের যে প্রিন্সিপাল,উনার সাথে শাহেদের তো বেশ সখ্যতা আছে।সম্পর্কে মৌনতার নানুবাড়ির দিক থেকে আত্নীয় ও হয়।আপতত পরিক্ষার আগ অব্দি মেয়েটাকে একটু ক্লাস করার ব্যবস্থা করে দিলেই হচ্ছে।মেয়েটা মনেহয় আবার সাইন্সের স্টুডেন্ট।

‘হুম।আহসান বলেছিলো মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে।সেই হিসাবেই এগিয়েছে।আর সেদিন ওর কাগজপত্রগুলো তো দেখলাম।ক্লাস ফাইভ, এইট,এস এস সি।হাই কোয়ালিটি রেজাল্ট।সবগুলোতে গোল্ডেন এ প্লাস।

‘হুমম।

দু’জনে মিলে কৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ বেশ টুকিটাকি আলোচনা করতে থাকলেন।কীভাবে বাাবা মা মরা মেয়েটাকে নিজের সন্তানদের মতো, তার স্বপ্নের পথের দিকে এগিয়ে দেওয়া যায়।

রাতে শাহেদ সাহেব বাড়িতে এলে কৌড়ির বিষয়ে উনার সাথে আলোচনা করলেন জাহিদ সাহেব।আলোচনার একপর্যায়ে শাহেদ সাহেব বললেন।তিনি মৌনতার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে কৌড়িকে কলেজে ক্লাস করার জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন।নিশ্চিত হলেন জাহিদ সাহেব।সেখান থেকে দু’দিন বাদেই কৌড়িকে নিয়ে কলেজে গিয়ে,ওর বিষয়ে কথা বলে আপতত ক্লাস করার ব্যবস্থাটা করে দিয়ে আসলেন শাহেদ সাহেব।তবে পরিক্ষাটা মেয়েটা এখানে দিতে পারবে-না।
পরিক্ষাটা, তার নিজ কলেজের রেজিষ্ট্রেশন অনুযায়ী সেখানেই দিতে হবে।


নিজের অফিস কক্ষের কাঁচের বেষ্টনীতে ঘেরা ওয়ালের সম্মুখে,দু-পকেটে হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।নজরটা তার ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে স্থির। সাততলা ভবনের উপর থেকে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত যানযট আর তারচেয়ে ব্যস্ত মানুষের চলাচলের আনাগোনা দেখে চলেছে সে।বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন পোশাকের মানুষের আনাগোনা চলছে,বাকী নেই স্কুল, কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ত চলাচল সেখানে।এমনকি বিভিন্ন পোশাকে ভিন্ন ভিন্ন নারীর পদচারণাও। হঠাৎ নিভানের মনেহলো বাড়ির গাড়িটাও সেই ব্যস্ত চলাচলের রাস্তায় ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।গাড়িতে কে বা কারা?আর এই অসময়ে কোথায় চলেছে?হঠাৎই আবার মনেহলো গাড়ীটা তার অফিসের পার্কিং এরিয়ার দিকে টার্ন নিচ্ছে।ব্যাপার কি?চাচ্চু আর সেতো সেই কখন অফিস চলে এসেছে।তবে অফিসে আবার কে আসলো।ইভান নাকি অন্যকেউ?ইভান তো সহজেই অফিসে পা মাড়ায় না।আর অন্য কেউ।কে?হয়তোবা প্রয়োজনে কেউ এসেছে।তবে অনেক্ক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পরও যখন মনেহলো,অফিসে কেউ আসেনি।ব্যাপার অন্যকিছু। নাহলে এতো সময় বাড়ি থেকে কেউ এসেছে,এটা তার কাছে ইনফর্ম হয়ে যেতো।

নিভান যে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেপাশ থেকে গাড়িটার কিছু অংশ দেখা গেলেও,গাড়ির সামনের অংশ আর গাড়িতে কারা?এটা দেখা যাচ্ছিলো না।দ্রুত পা চালিয়ে নিজের অফিস রুমের সাথে নিজস্ব কেবিনটায় চলে গেলো নিভান।সেখানে মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থাকার সুব্যবস্থা করা আছে।সুব্যবস্থা করে রেখেছে নিভান।মাঝেমধ্যে এর প্রয়োজনীতা সুফল দেয় খুব।কেবিনের বিশাল বড় কাচের জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নিচের পার্কিং-এরিয়ার দৃশ্যবলী নজরবন্ধিতে স্পষ্ট হতেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।গাড়ির দরজা খোলা,সেখান স্পষ্ট একটা মেয়েকে মাথা এলিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।মেয়টা কে বুঝতে অসুবিধা হলোনা
নিভানের।প্রায় মাসের কাছাকাছি হতে চলেছে,মেয়েটা তাদের বাড়িতে এসেছে।সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ কম হলেও,মেয়েটা শত দূর থেকে তার নজরে পড়লেও সে চিহ্নিত করতে পারবে মেয়েটা কে?তবে মেয়েটার কি হলো,ওভাবে বসে আছে কেনো?আর এরা এই অসময়ে এখানেই বা কি করছে?মান্যতা আর দীবা গাড়ির বাহিরে দাড়ানো।মান্যতা চিন্তিত মুখে কিছু ভেবে চলেছে আর দীবা তাকে কিছু বলে চলেছে। হাফিজ ভাই তাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্ড দেখছে।কোনো কারনে মন একটু বিচলিত হলো নিভানের।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা এনে পুনরায় জানালার পাশে দাঁড়ালো।কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন দিতেই ওপাশের মানুষটা তথাস্তু হয়ে কিছুটা ভয়েভয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। সে নিশ্চিত স্যার নিশ্চয় উনাদের দেখেছেন বলেই তাকেই ফোন দিচ্ছেন।
মান্যতাদের কাছ থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালো হাফিজ।ফের ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো।সালামের উত্তর দিয়েই নিভান স্বভাবমত গম্ভীর গলায় শুধালো।

‘এ্যনি প্রবলেম,হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে কেনো আপনারা?

কি বলবে হাফিজ খুঁজে পেলোনা।এই মহিলাদের কান্ড-কারখানা তার বুঁজে আসেনা।কি যে করবে এরাই ভেবে পাচ্ছেনা তো সে কি বলবে!

‘হাফিজ ভাই।

গম্ভীর গলার ডাকটা শুনতেই মান্যতাদের দিকে একপলক তাকিয়ে তড়তড়িয়ে উত্তর দিলো।–আসলে হয়েছে কি স্যার।ওই যে নতুন মেয়েটা এসেছে না,উনার জন্য কিছু বই আর কিসব শপিংয়ের জন্য বড়ো ম্যাডাম পাঠিয়েছেন।মান্যতা ম্যাডাম আর মেয়েটা আসছিলেন। দীবা ম্যাডাম বললেন তিনিও শপিংয়ে যাবেন তাই তিনিও তাদের সাথে এসেছেন।আর..

‘আমি সবার ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চাইনি হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে এতো সময় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো সমস্যাটা কি সেটাই বলুন।

নিভানের থমথমে গলায় আওয়াজ কানে আসতেই থতমত খেয়ে সংক্ষেপে কথা ধরলো হাফিজ।বললো–

‘মেয়েটা মনেহয় আগে থেকে কোনো-কারনে অসুস্থ ছিলো।গাড়িতে উঠার পর,মাঝ রাস্তায় এসে হড়বড়িয়ে কয়েকবার বমি করে দিলো।এখন আবার এখান থেকে বাড়ি ফিরতে তো সময় লাগবে,আমারাও শপিংমলের কাছাকাছি চলে এসেছি।তাই মান্যতা ম্যাডাম চাইছিলেন,সেই কাছাকাছি এসে গেছি যখন মেয়েটাকে আপনার অফিসের শীলা ম্যাডামের কাছে আপতত রেস্টে রেখে,জিনিসগুলো কেনাকাটা করে নিতে।মেয়েটার এই অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে শপিংয়ে তো আর ঘোরাঘোরি করা ঠিক হবেনা।আর গাড়িতে একা রেখে যাওয়াতো রিস্ক হবে, তাই।কিন্তু…

‘কিন্তু কি?

মুখটা ছোটো হয়ে এলো হাফিজের।আমতাআমতা করে বললো–দীবা ম্যাডাম চাইছেন না আপনার অফিসে মেয়েটাকে রেখে যেতে।বলছেন আপনি এসব উল্টো পাল্টা কাজের জন্য রেগে যেতে পারেন।আমাকে বলছেন উনাদের শপিংমলে রেখে মেয়েটাকে বাড়িতে দিয়ে আবার আসতে।সেটাতে তো প্রচুর দেরী হবে।আর বড় ম্যাডাম আবার বারবার করে বলে দিয়েছেন, তাদেরকে একা না ছাড়তে।মেয়েটারও যা অবস্থা!তার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।খুবই ক্লান্ত মনেহচ্ছে তাকে।

দীবার বিষয়টা আমলে নিলোনা নিভান।সে যে কি কারনে মেয়েটাকে অফিসে রাখতে দিতে চাইছেনা।এটা নিভানের থেকে ভালো কে জানে।তবে মেয়েটার যা পরিস্থিতি শুনছে,মেয়েটার তো আপতত রেস্টের প্রয়োজন।তবে শিলাও তো অফিসে নেই।

‘কিন্তু শীলা তো আজ আসেনি।সে ছুটিতে আছে।

হাফিজের সাথে কথা বললেও নিভানের দৃঢ় নজর স্থির গাড়ির সিটে নির্জীব ভঙ্গিতে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার পানে।সেদিকে লক্ষ্য রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘আমি নিচে আসছি।

নিচে যেতে সময় নিলোনা নিভান।হাফিজের নজরে পড়তেই সে তথাস্তু হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।স্যার নিচে আসতে চেয়েছে এ খবর সে কাওকে দেয়নি।তাই নিভানকে নজরে পড়তেই মান্যতার মুখ শুকিয়ে গেলো।
উল্টো পাল্টা কাজকর্ম দাদাভাইয়ের সহ্য হয়না,এখন কি না কি বলে বসে?যদিও দাদাভাই পরিস্থিতি বুঝে রাগারাগি করে।তবুও দাদাভাইয়ের এই দৃঢ় চোয়ালের কঠিন মুখাবয়ব নজরে পড়লেই অযথা কারনে বুক কাপে তাঁর।

নিভানকে নিচে দেখে দীবাও অবাক হলো।কিছু বলতে নেবে তার আগেই শক্ত গলায় মান্যতাকে প্রশ্ন করলো।

‘সমস্যা কি?

দৃঢ়চিত্তে এসে সটদন সামনে দাঁড়ালো শক্ত চোয়ালের মানুষটাকে একবার দেখে নিয়ে নমনীয় স্বরে মান্যতা বললো।

‘ওর হালকা মাথা ব্যথা ছিলো।মনে করেছিলাম বাহিরে আসলে ঠিক হয়ে যাবে।তাই ও না আসতে চাওয়া সত্ত্বেও,ও-কে নিয়ে এসেছি।ওর সামনে ফাইনাল পরিক্ষা তাই বইসহ ওর কিছু পোশাকও কেনা লাগতো।ও সাথে থাকলে বই পোশাক,দুটোই কিনতে সুবিধা হতো তাই মুলত নিয়ে আসা।কিন্তু ও এতো অসুস্থ হয়ে পড়বে আমি বুঝতে পারিনি।

‘ও অসুস্থ জেনেও ওকে নিয়ে আসা তোমার ঠিক হয়নি মান্য।

বিস্ময় চোখে নিভানের দিকে তাকিয়ে আছে দীবা।এ- কোন নিভানকে দেখছে সে! কৌড়ির হয়ে কথা বলছে নিভান!সম্ভব!এটা নিভানইতো?সে ভুল কাওকে দেখছে না তো?দীবার বিস্ময় আরও কঠিন রূপে বাড়িয়ে দিয়ে নিভান গমগমে গলায় মান্যতাকে আদেশ দিলো।

‘ও-কে বাহিরে আসতে বলো?

এবার মান্যতাও চোখ বড়বড় করে নিভানের দিকে তাকালো।পরপর চোখ নামিয়ে নিয়ে কৌড়ির কাছেই এগোলো।বিভিন্ন প্রশ্ন জাগলো মনে,তবে ভুলেও করলো না।গাড়ীর সিটে চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার ক্লান্ত মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভিষন মায়া হলো।খুব করে মনেহলো,মেয়েটাকে জোর করে আনা তার একদম ঠিক হয়নি।কৌড়িকে ডাক দিতেই চোখ খুললো।একটু আগের কথোপকথোন কথন শুনেছে সে।এমনিতেই মানুষটাতে তার ভয় এবার ভয়ের সাথে সংকোচও কাজ করলো।বাহিরে গিয়ে সে ওই মানুষটার সামনে দাঁড়াবে কি করে?তাই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বললো।

‘আমি আপতত ঠিক আছি আপু।উনার সামনে যেতে চাইনা,প্লিজ আপু।আমি উনাকে খারাপ ভেবে বলছি-না আপু।

কৌড়ির ভয় সংকোচের কারনটা জানে মান্যতা।সে আগেও খেয়াল করেছে দাদাভাই যেখানে থাকে কৌড়ি সহজে সেখানে যায়না।কারনটা,তাদের মতোই।ওই কঠিন মুখাবয়বের মানুষটার সামনে সহজে তারা ভয়ে কেউ পড়তে চায়না।জানে দাদাভাই ওরকম কঠিন মুখাবয়ব করে থাকলে-ও সহজে বকা রাগদ্বেষ করবে না।তবুও ওই মানুষটাকে দেখলে একটা ভয় কাজ করে।কেনো এটা তারা কেউ জানেনা!হয়তো তার কম বলা আর গম্ভীর স্বভাবের জন্য।কিন্তু এখন উপায় নেই।কথা না শুনলে দু’দিকেই বিপদ।

‘না বলো না।প্লিজ নেমে এসো কৌড়ি।তোমার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি একদম ঠিক হবেনা।আম্মু জানলেও বকবে।আর দাদাভাই জেনে গিয়েছে যখন,উপায়ও নেই।তাই প্লিজ লক্ষী বোন আমার,না বলো না।এবারের মতো বাচিয়ে দাও আমাকে।

তারজন্য কেনাকাটা করতে আসা।আবার তারজন্যই তারকাছে অনুনয়। একটুও ভালো লাগলোনা কৌড়ির।সবার জন্য কেমন একটা গলায় বিঁধে থাকা কাটার মতো হয়ে গেছে সে।অন্তত নিজেকে তাই মনেহচ্ছে ইদানীং তার।দূর্বল পায়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে।বের হতেই সামনে দাঁড়ানো উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ দেহের কঠিন মুখাবয়বের মানুষটাকে দেখেই মুখ নিচু করে নিলো সে।

‘হাফিজ ভাই গাড়িতে উঠুন।তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শেষ করে ওদের নিয়ে ফেরার চেষ্টা করবেন।

নিভানের গলার আদেশ পেতেই,দ্রুত পায়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো হাফিজ।সেটা লক্ষ্য করেই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিভান ফের বললো।

‘মান্য গাড়িতে উঠে বসো।শপিং শেষ হলে,যাবার সময় ওকে এখান থেকে নিয়ে যেও।যাও।

কৌড়ি তড়িৎ গতিতে মুখ উচু করে মান্যতার দিকে তাকালো।মান্যতা তারদিকেই অসহায় ভঙ্গিতে আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো।তার মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে, পড়েছি যমের হাতে,এখন যা বলবে তাই শুনতে হবে।দূর্বল শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রোমে রোমে কাটা দিয়ে উঠলো কৌড়ির।তাকে এই জলদগম্ভীর ভয়ংকর মানুষটার সাথে আপতত কিছু সময়ের জন্য থাকতে হবে!এরথেকে মান্যতা আপু তাকে, এই অজানা অচেনা শহরের অলিতে-গলিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতো বা নিজে হস্তে কোনো ক্ষুধার্ত বাঘের মুখের আহার বানিয়ে দিতো।তবুও ভালো ছিলো।আল্লাহ।

গাড়ি ছাড়তেই ভাবনা কাটলো কৌড়ির।গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করা মান্যতার মুখটা দেখে ভিষণ কান্না পেলো তার।সত্যিই রেখে যাচ্ছে তাঁকে?গাড়িটা কিছুদূর যেতেই নিভানের কন্ঠে চমকে তার দিকে তাকিয়ে ফের মুখ নিচু করে নিলো।

‘আমি কোনো ভয়ংকর জীব নই,যে আমার সামনে এলে তোমাকে গিলে ফেলবো।চলে এসো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here