#ফুলকৌড়ি
(১৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সেই আতঙ্কিত জলদগম্ভীর গলার আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই, সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।নিজের কোমল শরীরের অবস্থানটা ঠিক কোথায় ঠেকে রয়েছে, বুঝে উঠতেই ভূমিকম্প বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।মূহুর্তেই বিদ্যুৎ গতিতে ছিটকে সরে গেল সে।বিস্মিত নজর,নিভানের দৃঢ় মুখের পানে ফেললো।মানুষটা তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলো আর সে বুঝে উঠতেই পারিনি,এমন বেখেয়ালিতে ছিলো সে!আশ্চর্য! এটাও হওয়ার ছিলো!আর ওসব কি বললো মানুষটা?সে তার মায়ায় যাদু করেছে!তাও আবার কাকে কাকে।মানেটা কি?নিভানের স্থির,শান্ত নজরে নজর পড়তেই ইভানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।মূহুর্তেই অস্বস্তিতে নজর এলোমেলো হয়ে পড়লো।নজর নামিয়ে নিলো।কার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটার ধুকপুকানি দ্বিগুণ হারে লাফাতে থাকলো তার।নিঃশ্বাস ঘনো হলো।পা ছটফটিয়ে উঠলো,জায়গা ত্যাগ করার জন্য।হঠাৎ মন পড়লো,ড্রয়িংরুমে বসা খুব চেনা মুখদুটো।চোখের ভ্রম নয়তো,নাকি দিনে দুপুরে চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখছে সে?না-হলে তারা আসবে কোথা থেকে?ভাবতেই সামনের মানুষটাকে ভুলে ড্রয়িংরুমের দিকে ফের তাকালো।নাহ,তার চোখের ভ্রম নয়।আর না দিবালকে দাড়িয়ে সে সপ্ন দেখছে।সত্যিই তারা এসেছে। কেনো এসেছে?তাঁকে নিয়ে যেতে।
ড্রয়িংরুমে বসা সুঠামদেহের ছেলেটার এলোমেলো নজর উপরে দিকে পড়তেই,মূহর্তেই কয়েক কদম পিছে সরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো কৌড়ি।আগে পিছে না তাকিয়ে এলোমেলো কদমে দ্রুত এগোলো মান্যতার রুমের পানে।ওই ড্রয়িংরুমে বসা লোকটা সম্পর্কে তার আপন চাচাতো ভাই।বাপের এক ছেলে হওয়ার সুবাধে ছোটোবেলা থেকে অতিরিক্ত রাগী,জেদী আর একগুঁয়ে স্বভাবের।যেটা বলবে সেটাই হতে হবে।নাহলে কে মা কে বোন কে আপনজন সব ভুলে,ব্যবহার হয়ে যায় হিংস্র পশুর ন্যায়।স্বভাবে লোকটার চরিত্র খারাপ না-থাকলেও,ব্যবহারে সে অমানুষ।বাজে ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে সেই ব্যবহারের সাথে সাথে চরিত্রটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বাপের এক ছেলে হওয়ায়,যখন যেটা চেয়েছে।সেটাই পেয়ে পেয়ে বিগড়ে গেছে এমন।তেমন বাপও, কখনো শাসনবারন করেন নি।বংশের প্রদীপ,তাতে আবার পুত্র সন্তান।আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এখন পরিনতি,ভরাডুবি নৌকা।আগে রাগ জেদ ব্যবহার খারাপ থাকলে-ও।চারিত্রিক বিষয়টা খারাপ ছিল না।এখন তো মদ গাঁজা আসক্ত হয়ে চারিত্রটাও নষ্ট করে ফেলেছে।আর সেই বাজে চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছে তারসাথে।
কবে থেকে ওই উগ্র মস্তিষ্কের নাহিদ ভাই নামক ছেলেটা তাকে পছন্দ করে,এটা কৌড়ির জানা নেই।জন্মসূত্রে চাচাতো ভাই বোন হিসাবে জানা-বোঝা তাদের।সেই ভাইবোনের সম্পর্কের উর্ধ্বে গিয়ে কখনো কিছু ভাবতে হবে এটা কখনো আশা করেনি বাা ভাবিনি কৌড়ি।তবে জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে সেই ভাবনা তাদের ভাই বোনের সম্পর্কে দেয়াল উঠিয়ে, সেখানে জন্ম দিয়েছে একরাশ ঘৃনিত অনুভূতি।পাশাপাশি বাড়ি তাদের।কৌড়ি বুদ্ধি হওয়ার পর দেখেছে।সব চাচাদের সীমানা ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ি করা।সব বাড়িতে কমবেশি যাতায়াত থাকলেও,মেজো চাচাদের বাড়িতে যাওয়ার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো কৌড়ির।নিষেধাজ্ঞা বাবা এবং দাদির দু’জনের পক্ষ থেকে ছিলো।মেজোমা ও পছন্দ করতোনা,ওবাড়িতে যাওয়া।বিধায় কৌড়ি-ও যেতো না।তবে যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো,নাহিদের উগ্র আচারন সম্পর্কে জানতে বুঝতে থাকলো তখন কৌড়ি বুঝলো কেনো ওবাড়িতে তাকে যেতে দেওয়া হতো না। হয়না।
কারনে অকারণে মা বোনদের সাথে তুই তুকারি করে বাজে আচারন করা।এমনকি গায়ে হাত তোলা।মুখে অশালীন বাজে ভাষা ব্যবহার করা।বড়ছোটো কাওকে মান্য করে কথা না বলা।বখাটে ছেলেপুলেদের সঙ্গে মেলামেশা।পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাত নেই বিরাত নেই,সারাক্ষণ এই মোড়ে সেই মোড়ে আড্ডাবাজি করা।তা নিয়ে কেউ কথা বললে,তারসাথে উগ্র আচারন করা।ছোটো বেলা থেকে এগুলো করে এসেছে ছেলেটা।কখনো মুরুব্বি মানিনি।বাড়িতে অবাধ নালিশ এসেছে।রাস্তা ঘাটে বাবা,চাচাদের দেখলে চেনা পরিচিত বিভিন্ন ময়মুরুব্বিরা বলতো, ভালো বংশের ছেলে হয়ে এতো উগ্র মস্তিষ্কের কেনো ছেলেটা?কাওকে মান্য করে কথা বলেনা।আর যে ছেলে মুরব্বি মানেনা, সে ছেলে মানুষ হওয়ায় নয়।আর কতো কথা।আর সেই ছেলেকে কেই বা পছন্দ করবে?কৌড়ির বাবাতো নাহিদ বলতে ভিষণ অপছন্দ ছিলো!বিধায় ওবাড়িতে যাওয়াও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়,কখন আবার নিজের মেয়ের প্রতি নজর চলে যায়।আর সর্বনাশী কি কান্ড ঘটে বসে!এই আশঙ্কায় ওবাড়িতে যাওয়াটা আরও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।যেটা দাদীআপাও সরাসরি দিনে দু’বেলা মুখে আওড়াতেন।
আর তাই-ই ঘটেছিলো।কৌড়ি যখন ক্লাস এইটে পড়ে,তখন কৌড়ির বাবার কাছে হঠাৎই একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে নাহিদ।প্রস্তাব তো নয়,সে চড়াও গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো।কৌড়িকে সে বিয়ে করতে চায়,তাকে জেনো অন্যত্রে বিয়ে দেওয়া না-হয়?কারন সে জানতো,তার সাধারন কথায় কখনো কৌড়ির বাবা মানবেন না।এমনিতেই মানতোনা এটাও জানতো।বিধায় হুমকিধামকি দিয়েছিল।আর এই হুমকিধামকির প্রস্তাবে কৌড়ির বাবা ভিষণ রেগে গিয়ে বাজে ব্যবহার করেছিলো নাহিদের সাথে।এমনকি গায়ে হাতও তুলেছিলো পর্যন্ত।ভাইকে ডেকেও,ছেলের হয়ে নানাবিধ কথা শুনিয়েছিলেেন।ছেলেকে উনার মেয়ের থেকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন।নিজের বংশের ছেলে হলে কি হবে,যে ছেলের আচার ব্যবহার,ওঠবস ভালো নয়।সেই ছেলে,উনার মেয়েকে বিয়ে করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।আবার উনাকেই হুমকিধামকি দিচ্ছে।এটা কখনোই মানবেনা তিনি।দরকার হলে মেয়েকে ফকির ভিখারির হাতে তুলে দেবেন,তা নাহলে মেয়ের পাত্র হিসাবে যদি কাওকে না পান নদীতে ভাসিয়ে দেবেন।তবুও ভাইয়ের ওই উগ্র মস্তিস্কের ছেলের হাতে কখনোই তুলে দেবেন না।একটা সময় গিয়ে এবিষয় নিয়ে দুই-পরিবারের মধ্যে ভিষণ মনোমিলন্য হয়।দুই পরিবার বলতে কৌড়ি বাবা ও চাচার মধ্যে।তারপর থেকে শুরু হয়,কৌড়ির জীবনে স্বাধীনভাবে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা।
সেই ঝামেলা শেষ হওয়ার পর,কিছুদিন চুপচাপ ছিলো নাহিদ।তবে কৌড়ির ক্লাস নাইনে উঠার পর আবারও শুরু হয়ে যায়।তাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে।কনভিন্স তো নয়,সেই উগ্র মেজাজের হুমকি-ধামকি! কোনো মেয়ে কি আর সেই হুমকি-ধামকিতে কনভিন্স হয়?হওয়ার কথা নয়।কৌড়ির-ও সেসব হুমকি ধামকির আচারনে নাহিদের প্রতি কনভিন্স হওয়া তো দূর, আরও তীব্র ঘৃণা জন্মাতে থাকে।বাড়িতেতো বাবা আর দাদিআপার কারনে ঢুকতে পারতোনা ওই অমানুষটা।তাই স্কুল-কলেজে যাতায়াতের রাস্তায় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে হুমকিধামকি দিতো।বখাটে ছেলেদের মতো আচারন করতো।উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করার হুমকি ধামকি-ও দিয়েছে।সেসব দাদিআপাকে বাড়ি এসে বলতো কৌড়ি।তা নিয়ে আবার অশান্তি, ঝামেলা শুরু হয়।আর সেই ঝামেলার নতুন উৎপত্তি শুরু হয়, কৌড়ির বাবার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি ধামকিতে।কৌড়ির বাবা সেবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে ভাইকে ডেকে বলে বসলেন,ছেলেকে সোজা করতে না-হলে এরপর যদি নাহিদ আর একবার-ও কৌড়িকে নিয়ে উগ্রতা দেখায় তবে তিনি আইনে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।
কৌড়ির বাবা একজন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন।ভালো
টিচার হিসাবে সবাই উনাকে বেশ সম্মান করতেন,মান্য করেও কথা বলতেন।বংশ পরিচয়েও সমাজে উনার একটা উঁচুস্তরের সম্মান ছিলো।গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের সাথেও স্বাভাবিক ওঠবস ছিলো।বিধায় কৌড়ির বাবা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাওয়ায়,উগ্র মেজাজের ছেলে হুমকিতে না দুললে-ও ছেলের বাবা হয়তো সেই হুমকিতে কিছুটা দুলেছিলেন।কিভাবে কি-করে জেনো ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন।তবে নাহিদের বাজে নজর যে তখনও কৌড়ির পানে ছিলো,এটা কৌড়িও বেশ জানতো।সবসময় দাদিআপার আদেশ নিষেধ অনুযায়ী সাবধানে চলাফেরা করতো।তবুও কি কাজ হয়েছিলো?হয়নি!সেদিন যদি দাদিআপা সময় মতো না আসতো তবে আজ কি আর এখানে থাকা হতো।ওই অমানুষের বাজে স্পর্শের জন্য হয়তো ধর্ষিতা তকমা গায়ে লাগিয়ে ওই অমানুষটাকেই বাধ্য হয় বিয়ে করা লাগতো।যেমনটা ওই অমানুষটা প্লান করেছিলো,আর খালি বাড়িতে তাকে একা পেয়ে তার ঘরে ঢুকে মাতলামি করে কথাগুলো বলেছিলো তাকে।-তোর বাপের তোকে নিয়ে খুব দেমাগ তাইনা!হবেনা কেনো,বুড়ো বয়সের ফূর্তির সন্তান বলে কথা।দরদ তো উথলে উথলে থাকবেই।তবে আমি কি বলেছিলাম,তার ওই ফূর্তির সন্তানকে আমি আদর দেবো না!শয়তান বদমাশ হতে পারি,তাই বলে বউকে আদর করবোনা!এাটা হয়?আর এটা তোর বাপে বুঝলোনা কেনো,তাইআজ বুঝিয়ে দিতে আসছি আমি। তোকে আজ ভরপুর আদর সোহাগ দিয়ে তোর আর তোর ওই দেমাগধারী বাবাকে বুঝিয়ে দেবো যে,তোকে বিয়ে করার পর ঠিক কতোটা আদর ভালোবাসায় রাখতাম আমি।আর এমনিতেই আজ যদি তোকে একটু আদর সোহাগ দেই,কাল নির্দ্বিধায় তোর দেমাগিওয়ালা বাপ নিজ থেকে আমার হাতে তোকে তুলে দিতে বাধ্য হবেন।
সময়টা ছিলো ডুবডুব সন্ধ্যা।দাদিআপা পাশের বাড়িতে কোথায় একটা গিয়েছিলেন।আর বাবা আসরের নামাজ পড়তে গিয়ে বাড়িতে তখনও ফেরেননি। ফেরার কথাও ছিলোনা,কেননা তিনি আসরের নামাজ পড়ে বাহিরে উনার সমবয়সী মানুষদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা বলে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরেন।পাশাপাশি চাচাচাচিদের বাড়ি থাকতেও,সেদিন নাহিদের ড্রাগ নিয়ে চোখমুখ লাল-লাল করা মাতাল অবস্থা দেখে,আর ওসব নোংরামো আবোলতাবোল কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।চিৎকার চেচামেচি করবে,গলা দিয়ে জেনো আওয়াজ বের করতেও সেদিন ভুলে গিয়েছিলো।মন হয়েছিলো,সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিত্যদিনের ন্যায় ওই অমানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নাহ!নিজের গায়ের ওড়নায় যেই টান পড়েছিলো,গলা ছেড়ে চেচিয়ে উঠেছিলো সে।তারপর তার গলা ছেড়ে চিল্লাপাল্লা কান্নাকাটিতে,পাশের বাড়ি থেকে দাদিআপা সহ চাচীরা ছুটে এসেছিলেন।তখন ওই অমানুষটা তাঁকে হুমকিধামকি করে বাঘের থাবার ন্যায় গাল চেপে ধরে তার কান্না চেঁচামেচি বন্ধ করাতে ব্যস্ত!কি বিভৎস সন্ধ্যাটা ছিলো সেদিন!মনে উঠতেই গা শিহরে উঠে।
নিজের সাথে করা ওই অমানুষটার আচার ব্যবহারগুলো মনের দুয়ারে ভেসে উঠতেই তিক্ততায় ভরে উঠলো মন।রাগে ঘৃনায় রিরি করে উঠলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরিত রক্ত।ওই অমানুষটার জন্য বাড়ি ছাড়া হতে হলো,চলে এসেছে নিজের চেনা- পরিচিত সবকিছু ছেড়ে তারপরও পিছু ছাড়লোনা জানোয়ারটা।এলোমেলো পদচারণে মান্যতার রুমে ঢুকেই শব্দ করেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে।সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ নজরে শুধু কৌড়িকে অবলোকন করে গেলো নিভান।মেয়েটাকে আজ অসম্ভব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।লজ্জা, ভয়,জড়তামুলক আচারন প্রয়াসই কৌড়ির মধ্যে খেয়াল করেছ নিভান।তাই বলে এরকম অস্বাভাবিক আচরন তো করতে কখনো দেখিনি মেয়েটাকে।তবে আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার?সামনে তাকালো নিভান।ড্রয়িংরুমে বসা ভদ্রসভ্য হয়ে বসা ছেলেটার পানে গিয়েই বিধলো নজর।তবে কি,কৌড়িকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়ার কারন,ড্রয়িংরুমে বসা ওই ভদ্রসভ্য ছেলেটা!
★
বিশাল বড় ড্রয়িংরুমটা নামীদামী জিনিস দিয়ে বেশ আভিজাত্যপূর্ণ সাজে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো।যে কারও নজর বলে দেবে রুচিশীল হাতের কারুকায।অবশ্যই টাকা থাকলে কি-না করা যায়,যেখানে বাঘের চোখ মেলে।বড়ো ভাই আহসান হাবীবের কয়েকজন শহরে বন্ধু আছেন।তন্মধ্যে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেনএটা আরশাদ হাসান জানতেন আর জাহিদ সাহেবকে দেখেছেনও।লোকটার অর্থ সম্পদ আছে,শহরে বাড়িগাড়িও আছে,এটাও জানতেন।তবে লোকটা এতো বিত্তশালী,এটা জানা ছিলো না উনার।ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন আরশাদ হাসান।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছেন তিনি।কি দিয়ে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।ছেলের জেদ মেনে একপ্রকার বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে উনার।যেটা মোটেও উচিত হয়নি,সেটা এখন বেশ বুঝতে পারছেন।কিন্তু কি করবেন?ছেলের একটাই জেদ।কৌড়িকে তার চাই!যে কোনো মূল্যেই চাই।হাতের নাগালে থাকলে নাহয় ছেলের বাসনা পূরণ করতে অসুবিধা হতোনা,রাজ্যসহ রাজকন্যা যেকোনো মূল্যে উশুল করা যেতো। কোনো ব্যাপার ছিলোনা।কিন্তু উনার মা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে মেয়েটার বাপ মরতে না মরতেই উনাদের নাগাল থেকে বের করে দিয়েছেন।এখন এই ক্ষমতাধারী বৃত্তশীল পরিবার থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজ হবেনা।বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।তবুও মেয়ে যখন তাদের চেষ্টা করে দেখা যাক।আখেরি লাভ তো উনারই।রাজকন্যা পাবে ছেলে।আর রাজকন্যার বাপের রেখে যাওয়া রাজ্য হবে উনার।তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়!
‘আসলে আমরা এখানে এসেছি,আমাদের মেয়েটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।নিজের সবকিছু থাকতে,পরের বাড়িতে এভাবে আর কতোদিন পড়ে থাকবে মেয়েটা?আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি সবাই জানতে ইচ্ছুক,বিয়ে নেই সাদী নেই হঠাৎ মেয়েটা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো?না জেনে না বুঝে আমাদের প্রতি মেয়েটার প্রতি সবার একটা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি!যার কোনো উত্তর দেওয়া যায়-না।আমরা চাচা চাচি থাকতে আম্মা কি বুঝে কৌড়িকে এখানে পাঠালেন,বুঝলাম না।
ড্রয়িংরুমের চার আসনের বসার সোফাটার মধ্যেবর্তী আসনে বসে আছেন জাহিদ সাহেব।খবর পেয়েছেন, সকাল সকাল উনার সাথে দেখা করতে কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছেন।কারা আসতে পারেন বুঝতে সমস্যা হয়নি উনার।তবে সেদিন ফোনে কথাবার্তা বলার পরও যখন এবাড়িতে আসার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তখন তাে কথা বলাই দরকার।কথার প্রেক্ষিতে কথা বলতে যাবেন তিনি। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো ইভান।বাবার বাঁপাশের খালি জায়গাটায় বসতে বসতে বললো।
‘তা আপনার আম্ম কৌড়িকে এখানে কেনো পাঠিয়েছেন,বুঝতে যখন পারছেনই না।তখন কিন্তু আপনাকে আপনার আম্মার কাছ থেকে সুন্দর করে শুনে বুঝে তারপর এখানে আসা উচিত ছিলো।আর তার থেকেও ভালো হতো,যখন আপনার ভাই মারা গিয়ে কবরে শুতে পারলেন না,তার আগেই তড়িঘড়ি করে উনার মেয়েটাকে কেনো একটা অচেনা অজানা জায়গায় পাঠানো হচ্ছে?সেটা জানাটা।তখন আপনি এতো আদরের চাচা সাহেব কোথায় ছিলেন?
জাহিদ সাহেব সোজাসাপ্টা কথাবার্তা বলতে চেয়েছিলেন।কৌড়িকে নিতে এসেছে তার চাচা,আর তিনি জেনেশুনে মেয়েটটাকে নরকে ঠেলে দেবেন না।কিন্তু ইভান যেভাবে কথা শুরু করলো,উনার চিন্তা ভাবনার থেকে আরও একধাপ উপরে।নীরবে হাসলেন। ইভানকে শাসন বারন না করে আরশাদ হাসানের মুখের দিকে তাকালেন।নজর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আরশাদ হাসানের।কে এই ছেলে না জানলেও,ছেলেটা যে মহা সেয়ানা সেটা বেশ বুঝতে পারলেন।কেমন উড়ে এসেই কথার মুখ মেরে দিলো।এখন তিনি উত্তর সরূপ কি বলবেন?ইভানের বা পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় নাহিদ বসেছে।অল্পতে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে যায় ছেলেটার।কারও ভালো কথা তার সহ্য হয়না।বরাবরই উগ্র মেজাজে আখ্যা পাওয়া ছেলেটা,ইভানের ইনিয়েবিনিয়ে বলা কথাগুলো শুনতেই মাথা গরম হয়ে গেলো।রাগে চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো।হাতও মুষ্টিবদ্ধ হলো।দরদের লোকের দেখি অভাব নেই।এখানে এসেও রূপের জালে ফাঁসিয়ে দরদী লোকজন বানিয়ে নিয়েছে।এখানে আসার আগে বারবার বাবার দেওয়া সাবধানতা বানী মনে করে,নিজেকে আর নিজের তিরিক্ষি মেজাজ কে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো।নাহিদকে লক্ষ্য করে ইভান একটু তারদিকে হেলে গিয়ে ফের বললো।
‘ফুলকৌড়ির বড়োভাই হিসাবে বোনকে নিতে এসেছেন?নাকি ব্যাপার অন্য কিছু ব্রো?আমার নজর তো বলছে,আপনি ঠিক সুবিধার মানুষ-নন।আর এই অসুবিধার মানুষজনদের কাছ থেকে ফুলকৌড়িকে ঠিকঠাক রাখার জন্য, তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে! আমার নজরের ধারণা ট্রু নাকি ফলস্?
ইভান শেষের কথাটার উত্তর চাইলো চোখের ইশারায়।
রাগে মাথা দপদপ করতে লাগলো নাহিদের।দাতে দাঁত চেপে যতোসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।তবে ইভানের কথার উত্তর সরূপ ইভানের দিকে লাল লাল নজরে একবার তাকাতে ভুললো-না।সেটা দেখে কৃত্রিম অমায়িক হেসে ইভান ফিসফিসিয়ে বললো।
‘আরেহ কুল ব্রো।তবে ভুল জায়গায় চলে এসেছেন!যাকে পাওয়ার চিন্তা করে এখানে এসেছেন।ভুলে-ও আর তাকে পাওয়া তো দূর,চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে তো আমার অন্তত মনেহচ্ছে না।কোনোরূপ আশা দেখছিনা আমি।আপনি-ও আল্লাহর ওয়াস্তে আশা ছেড়ে দিন।তাতে আমার মনেহয় আপনারই ভালো হবে।
ঠান্ডার মাথার ঠান্ডা গলার হুমকি!তাতে অপর পক্ষের মানুষটা ভয় পেলো কি-না বোঝা গেলোনা।ঠাই যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে আছে।উপর থেকে ইভানের আর নাহিদের আলাপন কপাল কুঁচকে দেখলো নিভান।
ইভান হাজির হতেই মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।সামনে নজর রেখেই একে একে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ পার করে ড্রয়িংরুমে এসে জাহিদ সাহেবের অন্যত্র পাশে বসলো।
তবে মনোযোগ বা আগ্রহ সামনের দু’জনের পানে মোটেও রাখলোনা।সামনের টেবিল থেকে পেপার হাতে নিয়ে সেটাতে মনোযোগ দিলো।মনেহলো,সে বিশেষ ভাবে এখানে পেপার পড়তে এসেছে এবং বসেছে।কিন্তু বিষয়টা মোটেই তা নয়,নজর পেপারে থাকলেও কান সজাগ পাশের মানুষগুলোকে ঘীরে।সেটা বুঝে হাসলো ইভান।তার কোলাহলমুক্ত শান্তি প্রিয় দাদাভাই,নিজের শান্ত পরিবেশের রুম রেখে,স্টাডি রুম রেখে এখানে মানুষের কথাবার্তার মধ্যে এসেছেন পেপার পড়তে!মহা আশ্চর্যের বিষয়!আর এই মহা আশ্চর্যের বিষয়টা ঠিক কি সেটা ইভানের ভালো রকম জনা আছে।আরশাদ হাসান এবং নাহিদ দুজনে দেখেই চিনতে পারলো,এই সেই ছেলেটা সেই ছেলে।সেদিন কৌড়িকে এখানে নিয়ে এসেছিলো।নাহিদের সুক্ষ নজর নিভানকে পর্যবেক্ষণ করলো।কারনটা সেদিনেরই,সে যখন কৌড়িকে এখানে আসতে দেবেনা বলে হুমকিধামকি মাতলামো শুরু করেছিলো,লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের ছেলেটা তীক্ষ্ণ নজরে তারদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিলো–
‘কোথায় আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিতে হয়,মাতলামো করতে হয়।এরপর জেনে-বুঝে করবেন।মৃতবাড়ি না হলে আপনি কে আর আমি কে আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিয়ে কথা বলে চলেছেন, ঠিকঠাক জানিয়ে বুঝিয়ে দিতাম।বাবা যখন মেয়েটাকে নিয়ে যেতে বলেছেন,দ্বিতীয়বার জেনা আমার সামনে আর আপনার ফালতু চিল্লাপাল্লা না শুনি।তবে মৃতবাড়ি বলেও কিন্তু ধৈর্য্য সহ্যশক্তি সহবৎ বলে কিছু আছে,মনে রাখবো না।
নিভানের দিকে সূচালো তীক্ষ্ণ নজরে নাহিদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছু একটা বুঝে,তাকে উদ্দেশ্য করে ফের ফিসফিসিয়ে ইভান বললো।
‘আপনি ফুলকৌড়ির যেই হোন-না কেনো,আমি ইন্টারস্টেড নই।তবুও বলছি,তাকে নিয়ে ভালো-মন্দ যে ভাবনাটা মনের মধ্যে চলছে বা আছে অথবা ভাবছেন,সেই ভাবনাটা এখানেই বন্ধ করে দিন।ওই সদ্য এসে বসা পেপার হাতে নেওয়া মানুষটাকে দেখছেন না।সম্পর্কে উনি আমার দাদাভাই।ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ ভাবনার জন্য আপতত উনিই যথেষ্ঠ।আমার মনে হয়-না,এখন আর তাকে টপকিয়ে যে কেউ ফুলকৌড়ির ধরাছোঁয়ার কাছে ঘেঁষতে পারবে বা ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভাবতে পারবে।আপনি যেই হোন না কেনো,মনেহয় আপনিও পারবেন না,ব্রো।সো ফুলকৌড়ি বলে আপনার লাইফে বোন অথবা বোনের বাহিরে কেউ ছিলো,এই ভাবনাটা মাইন্ড আউট করে ফেলুন।বুঝছেন কিছু?
আগুনে ঝলছে যাওয়ার মতো সমস্ত শরীর জ্বলে গেলো নাহিদের।ইভানের কথার অর্থ বুঝতে তার সময় লাগলো না।মাথার মধ্যের শিরা উপশিরা গুলো দপদপ করে উঠলো,কৌড়ির প্রতি রাগে।কাছে পেলে হয়তো মেয়েটাকে এতো সময় নিজের রূপ দেখিয়ে দিতো।আছড়ে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করতোনা।ভীতু,লাজুক, ঘরকুনো মেয়েটার বড়লোক ছেলে দেখেই মাথা ঘুরে গেলো।নিজের সৌন্দর্য দিয়ে পটিয়ে ফেললো তাকে।অথচ সে কতোকিছু করলো তাকে নিজের করার জন্য। কিন্তু তাকে শুধু ঘৃনার নজরেই দেখলো।আর সেই ঘৃনা নিয়ে তারসাথে সারাজীবন রেখে দেওয়ার জেদ চেপেছিলো একসময় নাহিদের।আর সেই জেদ বজায় রেখেই এখনো পিছে লেগে থাকা।মেয়ের দেমাগ ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস।তবে এখানে বসে হুমকিধামকি দিলে নিজের পিঠ বাঁচনো যাবে না,এটা এবাড়ির ঐশ্বর্য আর ছেলেদের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে।কৌড়িকে এখানে নিয়ে আসার দিনও বুঝেছিলো,ছেলেটার ওই শান্ত তীক্ষ্ণ চাহুনির কথাগুলো তার পষান্ড হৃদয় আর শরীরকেও কাঁপিয়ে তুলেছিলো।তবে এতো সহজে তো সে-ও ছাড়বেনা!
ছেলেটাকে শাসাতে পেরে মনেমনে বেশ মজা পেলো ইভান।সেদিন মা আর বাবাকে কৌড়ির বিষয়ে কথা বলতে শুনেছিলো।মেয়েটাকে এখানে কেনো পাঠানো হয়েছে।আর কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছে শুনতেই এখানে এসে ছেলেটাকে দেখে বেশ বুঝেছে,এই খবিশ নেশাখোর ব্যাটার জন্য মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।তবে খবিশ ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।ব্যাটার জন্য কৌড়ি যদি বাড়ি ছেড়ে এখানে না আসতো।তবে সে দাদাভাইয়ের জন্য ওমন সুন্দর একটা শান্তশিষ্ট ফুলকৌড়ি নামক বউমনি পেতো কোথায়।দাদাভাই আর ফুলকৌড়ির বিয়ে হয়ে যাক।তারপর না-হয় একদিন যেচে গিয়ে মিষ্টি মিঠাই নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে আসবে খবিশটাকে।এখন ধন্যবাদ জানালে ব্যাটার দেমাগ বেড়ে যেতে পারে।
★
‘আপনি মেয়েটাকে নিতে এসেছেন,তবে আমি দিতে চাইছি না তাকে।আপনার পাড়াপ্রতিবেশি আশেপাশের লোক, আত্মীয় স্বজনরা কে কি বলছে আমার জানার দরকার নেই।তবে এই আত্নীয় স্বজনের কথা নিয়ে যদি আপনি চিন্তিত থাকেন,মেয়েটার ভবিষ্যতের চিন্তা করে থাকেন। বিয়ে দেবেন কিকরে?তবুও বলছি কৌড়ির চিন্তা আপনাদের কারও করা লাগবেনা,ওর সবকিছুর দায়িত্ব আমার।এমনকি বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও।তবুও আমি আপনাদের সাথে ওকে পাঠাতে চাইনা।এটাই ফাইনাল।
এতোসময় পর জাহিদ সাহেবের স্ট্রেইট কথায় নিজের গ্রাম দাপিয়ে কথা বলা আরশাদ হাসান আরও মিইয়ে গেলেন। উনার দু’পাশে বসা সামর্থ্য দুই ছেলেকে দেখে আর কোনো কথা বলার স্কোপ খুঁজে পেলেননা।মেয়ে উনাদের অথচ কথা বলার জোর পেলেননা।বরং উনার ছেলের সম্পর্কে জেনেশুনেও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছেন এটাতে জেনো কথার প্রতিত্তোর করতে আরও দ্বিধা করলেন উনি।তবে আরশাদ হাসানকে প্রতিত্তোর করতে না দেখে মনেমনে বাবার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হলো নাহিদ।নিজেই এবার মুখ খুললো।গমগমে গলায় বললো।
‘কৌড়ি আমাদের সাথে যেতে চায় কি-না, সেটা একবার ওর থেকেই জানতে চাই আমি।আপনি না বললে তো হবে না,ওর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয়েছে।আমি ওর নিজের মুখ থেকে সিদ্ধান্ত জানতে চাই।
নাহিদের বিশ্বাস কৌড়ি তার চোখের দিকে তাকালে কখনো হ্যা না কথা বলতে পারবে-না।বাধ্য হবে তাদের সাথে যেতে।সেই মনস্কামনাতে কথাটা বললো।কপাল কুঁচকে ফেললো ইভান।ঘাড় কাত করে বাবার ওপাশে বসা ভাইয়ের দিকে তাকালো।একটু আগের সাবলীলভাবে ধরা পেপারটা এখন খামচে ধরার মতো করে ধরে আছে।নিশ্চয় মনেমনে নাহিদের কলিজাটা খামচে ধরেছে।হাসলো ইভান।ঠোঁটে প্রকাশ পেলো-না হাসিটা।তবে মনেমনে নাহিদকে উস্কিয়ে দিলো,আরও দুটো একটা বেফাস কথা বলার জন্য।জাহিদ সাহবকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ ফের বললো।
‘ওকে ডাকুন,আমি ওর থেকে জানতে চাই।ও যেতে চায় কি না,ওর মুখ থেকে শুনতে চাই….
জাহিদ সাহেব নিজের সামনে বসা ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না।যারজন্য মেয়েটাকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো,তারমধ্যে ভয় লাজলজ্জা, অনুতাপ কোনো কিছুই নেই।বরং লেজ উঠিয়ে মেয়েটাকে নিতে এসেছে।আবার উনার সামনে বসে গলা চড়িয়ে কথা বলার স্পর্ধাও দেখাচ্ছে।সবকিছু জেনেশুনেও ভদ্রভাবে কথা বলছেন বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।তাই যদি হয় তবে সামনে বসা দুজনের ধারণা খুবই ভুল।তিনি ভালোরও ভালো। খারাপের আবার খুব খারাপ!কিছু বলতে যাবেন তারআগে চোখের ইশারায় নিভান থামিয়ে দিলো উনাকে।হাতে রাখা পেপারটা খুব সাধারণ ভঙ্গিতে টেবিলে উপর রাখলো ।সবার নজরে সাধারণ মনে হলে-ও ইভানের নজরে কিছুতেই সেটা সাধারণ মনে হলো-না।দাদাভাই সহজে রাগে-না।আর রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়।মনেমনে একটু আতঙ্কিত হলো ইভান।তন্মধ্যে
ইভানকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় নিভান বললো—ইভান,বাবকে উনার রুমে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।উনি অসুস্থ, এতোসময় বসে থাকতে পারেন না।সেটা বাহিরের লোকজন না জানলেও,আমাদের মনে রাখা উচিত।ভিতরে নিয়ে যাও বাবাকে।
ফের জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো–আপনি নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন।আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিচ্ছি।বিষয়টা আমি দেখছি।
নিভান মানেই যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য জাহিদ সাহেব।তাই আর না করলেন না।
প্রশ্নই উঠলো না,না করার।এখানে বসে থাকতেও উনার কষ্ট হচ্ছে।ছেলের কথা শুনে হুট করে উঠে যাওয়াটা কেমন দেখায়,তাই নিজের অসুস্থতার বিষয়টা জানিয়ে, ইভানের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসে চলে গেলেন।যাওয়ার আগে বলে গেলেন মেহমানদের নাস্তাপানির ব্যবস্থা করতে।জাহিদ সাহেব চলে যেতেই রাজকীয় ভঙ্গিতে গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসলো নিভান।ফের ঠান্ডা গলায় শুধালো।
‘তো কি বলছিলেন যেনো,এবার বলুন।
নিভানের এই দায়সারা ভাবসাব মোটেই পছন্দ হলোনা নাহিদের।আরশাদ হাসান তো সেই থেকে চুপ।পাঙ্গা এমন মানুষের সাথে নেওয়া দরকার, যার সাথে পেরে উঠা যায়।হয়তো সমানে সমানে নয়তো নিজের ক্ষমতা অর্থসম্পদের থেকে নিচুস্তরের লোকের সাথে।নিজের ক্ষমতা আর দৌলতের উর্ধ্বে গিয়ে উঁচু স্তরের লোকের সঙ্গে পাঙ্গা নিলে তা হয়তো কখনো জেতা যায়না।আশা করাও বোকামি।তিনি বুদ্ধিমান অতি চতুর ব্যক্তি সেই বোকামীটা করলেন না।সাথে সামনে বসা ছেলেটার বাজপদখির ন্যায় তীক্ষ্ণ নজর!গমগমে গম্ভীর দৃঢ় গলার স্বর!রাজকীয় বসার ভাবভঙ্গিমা।এমনিতেই রুদ্ধ করে দিয়েছে উনার শ্বাসনালী।নিভান প্রশ্ন করলেও উত্তরের আশা করেনি।তবুও কিছুসময় চুপ থেকে দেখতে চেয়েছিলো,তার সামনে বসা মানুষের দুজনের ঠিক সাহস কতটুকু। তারপর মুখ খুললো সে।গমগমে গলায় বললো।
‘ওর মুখ থেকে উত্তর চাই, তাই তো?মনে করুন আমি নই ওই-ই বলছে,ও আসবে না এখানে।আর যাবেও-না আপনাদের সাথে।যদি বলেন ওর হয়ে উত্তর দেওয়ার আমি কে?আমি কেউ না!তবুও ওর হয়ে আমি যে সিদ্ধান্তটা নেবো সেটাই ওর জীবনের লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিভিশন হবে।শেষ কথা যাকে বলে।প্রশ্ন যদি হয় কেনো এবং কিসের জন্য!তবে তার উত্তর আমি আপনাদেরকে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করছি না।আর কোনো প্রশ্ন বা উত্তর চাই?
আরশাদ হাসান তো কোনো কথাই বলতে পারলেন না।
তবে এটা বুঝতে পারলেন,কৌড়ি তাদের নাগালের বহুত দুরে চলে গেছে। সাথে এই ছেলের নজরেও পড়ে গেছে মেয়েটা।তার সেখান থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজলভ্য হবে না।ছেলের পানে চাইলেন।কাঠ হয়ে চুপচাপ বসে আছে সে।হয়তো সেও বুঝে গেছে,মেয়েটার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।তবে ছেলের অহামিকায় আঘাত লেগেছে।এর যের ঠিক কিভাবে পোহাতে,প্রভুই জানেন।হঠাৎ টেবিলের উপর কিছু রাখার শব্দে খেয়াল ভঙ্গ হলো উনার।দেখলেন এক ভদ্রমহিলা চা কফির ট্রে-টা টেবিলে রাখায় মৃদু শব্দ হয়েছে।
‘রানীসাহেবা,উনাদেরকে ডায়নিংয়ে নিয়ে যান।খাবারের ব্যবস্থা করুন।কৌড়ির আপনজন বলে কথা,সে যেমনই হোক আপ্যায়ন তো এমনিতেও হোক আর ওমনিতে-ও।করতেই হবে।
কি উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয়েছে বিশেষ না বুঝলেও নড়েচড়ে বসলেন আরশাদ হাসান।ছেলেকে গাঁট হয়ে বসে থাকতে দেখে,উঠতে চেয়েও উঠতে পারলেন না।
তন্মধ্যে রানী বললো।
‘আসুন,এমনিতেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা টেবিলে গোছানো হয়েছে। তবে এখানে কথা চলছিলো বলে,ভাবী সাহেবা চা নাস্তা পাঠালেন।
উঠলেন আরশাদ হাসান।এমনিতেই সামনে বসা ছেলেটার সামনে বসে থাকতে কেমন অদ্ভুত লাগছে উনার।উঠলেই বাঁচেন এমন একটা অবস্থা। সেই হেতুই উঠে দাঁড়ানো।ছেলেকে ডাকলেন।তবে সাড়া না পেয়ে রানীসাহেবাকে অনুসরণ করলেন।তিনি আলে যেতেই কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।চুমুক দিলো খুবই আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে।ফের সামনে বসা একগুঁয়ে তেজস্বী ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে শীতল গলায় বললো
‘আমাকে দেখলে সবাই খুবই চুপচাপ আর শান্ত মাইন্ডের ছেলে বলে মনে করে।তেমনটাই নাকি আমার ব্যবহারে আর চেহারায় প্রকাশ পায়।আপনারও কি আমাকে তাই বলে মনেহয় যে,আমি খুবই ভদ্রসভ্য আর শান্ত স্বভাবের ছেলে?
কথার উত্তর দিলো-না নাহিদ।তবে অনুধাবন করতে পারল,তার সামনে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ধূর্ত একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যাকে নিজের সহজ হোক বা দূর্লভ কথায় বশ করানো বা ভয় দেখনো সহজ হবে না।তাই কথা বলার প্রয়োজন মনে করলোনা।আর এটাও অনুধাবন করতে পারলো,তার সামনে বসা মানুষটা তাকে উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেও উত্তর নেওয়ার অপেক্ষায় নেই।নিশ্চুপ থাকা প্রতিপক্ষ ছেলেটা নিজের থেকে কম বুদ্ধিমান, এটা ভুলেও ভাবলো না নিভান।মনেমনে হাসলো।ফের বলতে শুরু করলো।
‘তবে আমি ছেলেটা মোটেও তেমনটা নই।শান্তশিষ্টতা আমার বাহিরের রূপ,যা দেখে সবাই সেভাবেই বিবেচিত করে আমাকে।আমার ভিতরের রূপটা বাহিরের রূপের প্রকাশভঙ্গির পুরো বিপরীত।অতিরিক্ত বাজে,খুবই ভয়ঙ্কর,নিন্মমানেরও বলা চলে।তবে সেটার বহিঃপ্রকাশের পরিচিতি আমি আবার সবার সাথে পরিচয় করাই-না।পরিচয় করাই শুধু তাদের সাথে,যারা আমার অতি অপছন্দের মানুষ।সেটাও মাত্রারূপ ছাড়িয়ে গেলে।বিশেষ করে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে কেউ আঘাত করার চেষ্টা করলে।বলতে পারেন,তাদের কোনোরূপ ক্ষতি আমার ওই অতিরিক্ত বাজে নিন্মমানের ভয়ঙ্কর হিংস্র আত্মাটাকে জাগিয়ে দেয়।সেখানে কাকে আপনার প্রশ্নের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে চাইছেন,আপনার ধারনাও নেই।সুতারাং কোথায় বসে আছেন আর কার সামনে বসে আছেন, ভেবেচিন্তে একটু বুঝেশুনে কথা বলার চেষ্টা করবেন।
নাহিদের অপমানে রক্তিম হয়ে উঠা ক্রোধিত মুখাবয়বের দিকে আরও একপলক তাকিয়ে,কফির মগটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো নিভান।সামনে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎই ।ফের গম্ভীর কন্ঠে বললো।
‘আর দ্বিতীয়বার এবাড়িতে ও-কে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে পা রাখবেনও একটু সাবধানে!গভীর ভেবেচিন্তে!
মনে রাখবেন আমি মানুষটা যেমনটা সবাই দেখে ভাবে ঠিক তেমনটা নই।
★
মান্যতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কৌড়ি।আর ওই নাহিদ নামক অমানুষটার আচারনগুলো বিবরণ করে চলেছে।মান্যতারও মন খারাপ হলো খুব,ছোট্টো মেয়েটা, তার এতটুকু বয়সে কি-না কি দেখে চলেছে।এতটুকু বয়সে মা চলে গেলো তারপর বাবা নামক ছায়াটা।তারপরও কতোকিছু সয়ে গেছে এইটুকু জীবনে। কান্না থামানোর জন্য এটাওটা বলে স্বান্তনা দিতে থাকলো কৌড়িকে।
ফের বললো –মন খারাপ করোনা,দেখবে বাবা কিছুতেই উনাদের সাথে তোমাকে যেতে দেবেন না।
‘আমার যেতে মানা নেই আপু।বরং আমার বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করে।ওখানে থাকতে খুব মন চায়।তবে ওই অমানুষটার জন্য উপায়হীন আমি।
ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললো কৌড়ি।দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।কি বলে আর স্বান্তনা দেবে মেয়েটাকে বুঝে আসলোনা।হঠাৎ প্রানউচ্ছল কন্ঠটা কানে আসতেই সেদিকে ফিরলো মান্যতা।কান্না থেমে গেলো কৌড়িরও।
‘আরেহ.. শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চাওনা।সেটা বললেই হয়।এরকম ভ্যা ভ্যা করে কান্নার কি দরকার!আর যে কেউ তোমাকে নিতে চলে আসলে তোমার বর,সহজেই হোক বা যুদ্ধ বিদ্রোহ করে,তাকে তোমাকে দিয়ে দেবে ভাবছো কিকরে,?
চলবে…
আমার অল্পসংখ্যক কমেন্ট বাসীরা।গল্প পড়ে নিজেদের অনুভূতি জানবেন ।