ফুলকৌড়ি (২৪)কপি করা নিষিদ্ধ। #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
250

#ফুলকৌড়ি
(২৪)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

অফিস বের হচ্ছিলো নিভান।হঠাৎ জাহিদ সাহেবের ডাক পড়ায় চলে গেলো উনার রুমে।দরজার নক করতেই ভিতরে ঢুকতে বললেন তিনি।অসুস্থ শরীর নিয়ে সবসময়ের নিয়মানুবর্তিতা অনুযায়ী বেডে হেলান দিয়ে বসে আছেন।হাতে একটা ইসলামিক বই।নিভানকে আসতে দেখেই বইটা বুকমার্ক করে রেখে দিয়ে নিভানকে উনার পাশে বসতে বললেন।বাধ্য ছেলের মতো বসলো নিভান।নিভান বসতেই রয়েসয়ে তিনি বললেন।

‘কালরাতে নওশাদ সাহেব ফোন দিয়েছিলেন?

‘উনার সাথে তো অফিসিয়াল সকল কথাবার্তা কমপ্লিট হয়ে গেছে।এরপর সমস্ত অফিসিয়ালি সুবিধা অসুবিধা তো আমার সাথেই মিটানোর কথা।আপনাকে কিজন্য ফোন দিলো?

‘অফিসিয়াল কোনো কথাবার্তা বলার জন্য উনি ফোন দেননি।ব্যাক্তিগত কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলেন।

ভিতরে ভিতরে একটু চমকালো নিভান।সেদিন নওশাদ সাহেবের ছেলে বিহানের বিহেভিয়ার সম্পর্কে স্মরণ হতেই মনটা আরও উচাটন করে উঠলো।কোনোভাবে কি কৌড়ির বিষয়ে বলেছেন উনারা।মন মস্তিষ্কে মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা চললে-ও নিজের বহিঃপ্রকাশ স্বভাবিক রাখলো।বললো– ব্যাক্তিগত!কি বলতে চাইছেন উনি?

‘উনার একমাত্র ছেলে বিহানের জন্য মান্যতার হাত মেনেছেন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিভান।ফের নিজের জায়গায় তৃনয়কে ভাবতেই বললো–আপনি কি বলেছেন?

‘আমি উনাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোানো সিদ্ধান্ত জানাইনি।তুমি তো ভালো করেই জানো,আমার সকল সিদ্ধান্ত তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।তুমি হ্যা বললে তবেই আমি সেটাতে মতামত প্রকাশ করি,না বললে নয়।উনারা প্রস্তাব রেখেছেন,আমি শুনেছি।আর আমার সিদ্ধান্ত সরূপ বলেছি,আমি আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত ছাড়া তাদেরকে হ্যা বা না কোনো মতামত দিতে পারবো-না।এমনকি আমার মেয়ের মতামতটা-ও জরুরি।আর তার থেকেও তোমার মতামতটা বিশেষ।আমার মনেহয় তুমি মান্যতার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিবে,মান্য তা কখনোই অমত পোষন করবে বলে মনে হয়না।এখন তুমি বলো আমার সিদ্ধান্ত কি নেওয়া উচিত।উনাদের ফ্যামিলি ব্যাকগাউন্ড বা ছেলে সবদিক দিয়েই তো বেশ ভালো।খোঁজখবরও না-হয় নেওয়া যাবে।তোমার কি মতামত?

‘আপনি না বলে দিন।

জাহিদ সাহেবের কথাগুলো শুনতে শুনতে মূহুর্তেই সেদিনের বিহানের নজরভঙ্গির দৃশ্যটা মনে পড়ে গেলো নিভানের।সেই দৃষ্টিতে লালসা বা কোনো কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিভাব ছিলোনা।তবে মুগ্ধতা ছিলো সীমাহীন।আর সেই মুগ্ধ হওয়া দৃষ্টির মালিকের মনে,সেই সৌন্দর্যমীয়কে নিয়ে ঠিক কি কি ভাবনা গড়াতে পারে, তা নিয়েই সেদিন অযথা ক্ষিপ্ত হয়েছিলো নিভান।আর সেই পুরুষটা হবে তার বোনের পুরো জীবনের জীবনসঙ্গী।কখনো না।আর তারথেকে মুল বিষয় হচ্ছে, তৃনয়।বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখার জন্য,বন্ধুর বোনকে পছন্দ করা সত্ত্বেও কখনো তা প্রকাশ করেনি।মান্যতার সাথে সম্পর্ক গড়ার থেকে,বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখাটা তারকাছে বিশেষ মনে হয়েছে।বিধায় সেই অনুযায়ী, নিজের অনুভূতি ভিতরে চাপা দিয়ে এতোটা বছর চলে এসেছে।অথচ মান্যতাকে পাওয়ার কতো আকুলতা কতো প্রয়াস ছেলেটার।যা ক্ষনে ক্ষনে টের পেয়েছে নিভান।মান্যতাকে দেখলেই তৃনয়ের হাসফাস।নজর এড়িয়ে ঘুরেফিরে সেই মান্যতার মুখটাতেই মুগ্ধ চাহুনীতে তাকানো।মান্যতার কোনো বিষয়ে কখনো কথা হলে খেয়ালী হয়ে তার কথা শোনা।নিজের ব্রাইড লাইফ ছেড়ে দেশে চলে আসা।যা সবকিছু বুঝেছে তৃনয়ের এলোমেলো কথাকাজে আর আচারনে। তখন সেসব বুঝলে-ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি নিভান।তবে এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।কারন,নিজেরও যে একই দশা।
পছন্দের নারীকে ক্ষনে ক্ষনে দেখার তীব্রতা,নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,সর্বাবস্থায় তাকে কাছে রাখার ইচ্ছেটুকু কিভাবে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে জ্বালায়।আর তাকে না পাওয়ার ভাবনা।উফফ…সেই ভাবনাটা আর ভাবতে চায়না নিভান।যদিও তৃনয় আর মান্যতার বিষয়টা আলাদাভাবে ভেবে রেখেছিলো সে।তৃনয় চাকরী পেলেই,জাহিদ সাহেবের কাছে মান্যতাকে নিয়ে তৃনয়ের বিষয়টা তুলে ধরবে।তবে তার আগেই যখন কথা উঠলো,তখন বিষয়টা নিয়ে কথা বলাই সমীচীন।

‘আচ্ছা ঠিক আছে,আমি তাদের না বলে দেবো।তবে না বলার কারনটা কি আমি জানতে পারি নিভান?

‘আপনার তৃনয়কে কেমন লাগে?

হঠাৎ তৃনয়ের বিষয় উঠায় বিশেষভাবে বুঝতে পারলেন না জাহিদ সাহেব,নিভান ঠিক কি বলতে চাইছে।তবুও তিনি বললেন–ছেলেটাকে তো সেই কবে থেকেই দেখে আসছি।সবদিক থেকে তো বেশ ভালোই।পড়াশোনায়ও তো বেশ ভালো ছিলো।বাহিরের দেশ থেকে এমবিএ ও করে এসেছে।যদি-ও বাহিরের দেশে তার ব্রাইড লাইফ ছিলো,তবে দেশে এসে ব্যবসায় নেমেছে।এটাও তো বেশ ভালো।তা হঠাৎ তাঁকে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো যে?

‘মান্যর জন্য কোনোভাবে তৃনয়কে কি আপনার অযোগ্য বলে মনেহয়?

একটু আশ্চর্য হলেন জাহিদ সাহেব।নিভানের কথার হাবভাব দেখেই যেনো কিছুটা আচ্ করতে পারছিলেন তিনি।মনের মধ্যে তৃনয়কে নিয়ে দোনোমোনো করছিল।আর সেটাই বললো নিভান।তবে সবদিক ভেবে বললো কি নিভান?নাকি বিষয়টা অন্যকিছু?মান্যতা বা তৃনয়ের মধ্যে কোনোপ্রকার সম্পর্ক তৈরী হয়নি তো?না তেমন আচার ব্যবহার তো মেয়েটার মধ্যে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয়না উনার আর না ছেলেটার আচারনে।আর সেরকম আচারবিধি যদি বাড়ির মেয়ের মধ্যে লক্ষ্য করলে,বাড়ির আর কেউ গলা চড়িয়ে না বললেও,উনার বোন মুখে কুলুপ এঁটে থাকার মতো মেয়ে নন।তবে কি কারনে নিভান কেনো এমন প্রস্তাব রাখলো?নাকি নিজে থেকেই তৃনয়কে মান্যতার জন্য চয়েজ করছে তাই বলছে?তিনি বললেন—অযোগ্য বলে মনে হবে কেনো!
অপছন্দ হওয়ার মতো ছেলেতো সে নয়।তবে তুমি যখন তার হয়ে প্রস্তাব রাখছো,তখন নিশ্চয় তোমার বোনের ভবিষ্যৎ ভেবেচিন্তে।কিন্তু তৃনয়ের তো একটা পছন্দ অপছন্দতা আছে।তুমি-যে তাকে তোমার বোনের জন্য পছন্দ করে রেখেছো, এটা কি সে জানে?আমরা মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ান হয়ে তো আর নিজের মেয়েকে তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখতে পারিনা।আগ্রহটা তো তাদের দেখাতে হবে।

জাহিদ সাহেব খোলাখুলি প্রশ্ন না করলেও উনার কথা দ্বারা মুলত কি বোঝাতে চাইছেন সেটা বেশ বুঝলো নিভান।উনি মুলত তৃনয়ের মনোভাবটা বুঝতে জানতে চাইছেন।তৃনয় উনার মেয়ের প্রতি আগ্রহী কি-না?বা উনার কথায় এটাও স্পষ্ট, তৃনয় যদি মান্যতাতে আগ্রহী হয়ে না থাকে তবে নিভান কেনো আগ্রহী হয়ে তার হয়ে প্রস্তাব রাখছে?আর বিহান বা তৃনয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মনেমনে তিনি হয়তো যোগ্য পাত্র হিসাবে বিহানকেই এগিয়ে দেখছেন।ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে গেলে হয়তোবা বাবা মায়ের নজরভঙ্গি অন্য রকম হয়ে যায়।যেখানে উনাদের ছেলেমেয়ে খুব ভালো থাকবে,খুব সুখে থাকবে।সেই জায়গাটাকেই যোগ্য মনে করেন।হয়তো জাহিদ সাহেবের কাছে সেটাই মনেহচ্ছে,সবদিক থেকে বিহান যোগ্য পাত্র।তবে কেনো তাকে রিজেক্ট করে তৃনয়কে পছন্দ করতে চাইছে নিভান।যেখানে তৃনয়ের মধ্যে সেরকম হাবভাব তিনি টের পাননি।বস্তুত,সেই ছেলে কখনো উনার মেয়ের হয়ে প্রস্তাব রাখেনি।নিভানও সময় নিয়ে বললো।

‘আমার জানা চেনামতে তৃনয় বিশ্বাস এবং ভরসাযোগ্য ছেলে।যেটা আমি-ও জানি,আপনি-ও হয়তো জানেন।নওশাদ চৌধুরীর বা এতোদিন যারা মান্যতার বিয়ের জন্য প্রপোজাল দিয়ে এসেছে,তাদের মতো হয়তো বিত্তশালী পরিবার বা নাম-ডাক তার নেই।তবে যেটুকু আছে আমার বোনকে যথেষ্ঠ সুখে এবং ভালো রাখার যোগ্যতা।আমার বিশ্বাস রাখতে পারবে সে।আর আমার এটাও বিশ্বাস,মান্যতাকে সেভাবে গুছিয়ে রাখার প্রয়াসও সে করবে।একটা দুটো বছর নয়,বিগত আট নয়টা বছর মতো তারসাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক আমার।তার সবদিক বিবেচনা করেই তারপর আপনার কাছে তার হয়ে প্রস্তাব রেখেছি আমি।আর নিজে-ও সিদ্ধান্ত নিয়েছি,মান্যতার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তৃনয়কে।দ্বিতীয়ত আপনি যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন,সেটা বলতে আমার দ্বিধা নেই।তৃনয় মান্যতাকে পছন্দ করে।সেটা আমাদের বন্ধুত্বের কারনে হোক বা নিজের সীমার গন্ডি বজায় রাখার জন্য,কখনো তা প্রকাশ করিনি।তবে আমি তার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করে এটুকু বুঝেছি।
মান্যতা তৃনয়ের কাছে ভালো থাকবে।ভালো রাখবে সে আমার বোনকে।সেখানে চারিত্রিক বিষয় বা অন্যন্য সবদিক থেকেই তাকে মান্যতার যোগ্য বলে মনে হয়েছে আমার।তবে এখানে আপনার বা মান্যতার মতামত-ও গুরুত্বপূর্ণ।আপনি আমার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন আমি খোলামেলা জানিয়ে দিয়েছি।এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন,আপনি মেয়ের বাবা হিসাবে ঠিক কি সিদ্ধান্তে এগোবেন।আমার মনেহয় তৃনয় এতোদিন নিজের ভালোলাগাটা মনের মধ্যে চেপে চুপচাপ থাকলে-ও তন্ময়ীর বিয়ের পর,সে একবার হলে-ও নিজের পছন্দের কথা ভেবে আমাদের কাছে প্রস্তাব রাখবে।আপতত ততোসময় পর্যন্ত আমি চুপ থাকছি বা থাকতে চাইছি।আমি নিজেও চাইছি সে নিজ থেকে প্রস্তাব রাখুক আমাদের কাছে।এখন আপনি সবদিকে ভেবে দেখুন তাকে মেয়ে দেওয়া যায় কি-না।

‘এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই।যেখানে তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।সেখানে আমার না করার প্রশ্নই আসে না।আমি বরাবরই তোমার সিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখি,ভরসা করি।সেখানে তোমার সিদ্ধান্ত দ্বারা মান্যতার ভবিষ্যত খারাপ হতে পারে,এটা কখনোই আমি ভাবতে পারি-না।তবে একটাই আশা রাখছি,তৃনয় নিজে প্রস্তাব রাখবে।না হলে আমি এটাও আশা রাখছি তোমার সিদ্ধান্তও না হবে।

‘হুমম।আমি-ও সেটার অপেক্ষায় আছি।

আরও কিছুসময় কথা বলে উঠে দাঁড়ালো নিভান।জাহিদ সাহেব-ও নিজের কাজে মনোবেশিত করলেন।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে নিভান।চোখ বন্ধ রেখে গভীরভাবে কিছু ভেবে চলেছে সে।ভাবনার বিষয়বস্তু কৌড়ি।মেয়েটাকে যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলো,মেয়েটা ততোটা সহজ নয়।হ্যাঁ,শান্তশিষ্টতা ঠিক আছে।তবে একেবারেই নরম মনের নয়।ওই কাজলকালো চোখে চোখ রেখে সেটা বুঝতে পেরেছে নিভান।মেয়েটা তার চালচলনেও কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছে তা।শান্তশিষ্ট, নম্রতা তার বাহিরের রূপ, ভিতরে সে শক্তপোক্ত এক কঠিন মনের মানবী।যাকে নিজের প্রতি দূর্বল হওয়াটা সহজ হবে বলে মনে করছেনা সে। আর ওই মানবীকে নিজের প্রতি দূর্বল করা যতোটা সহজ ভেবেছিলো ততোটাও সহজ হবে-না।আত্নকেন্দ্রীক ওই মানবী,বাধ্য হয়ে এ-বাড়িতে থাকলেও,নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে চলছে।এটা সে অল্পস্বল্প মায়ের মুখ থেকে শুনেছে,জেনেছে।চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,চলনবলনে,সবকিছুতেই নাকি মেপে মেপে চলা তার।ছোট্টো একটা মেয়ে অথচ নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে মেপে মেপে তার প্রিয় ব্যক্তিদের দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী চলেছে, মানা যায়!এতোটা বাধ্য হয়ে এখানকার যুগের মেয়েরা চলে!নাকি চলতে চায়?মৃদু হাসলো নিভান।মনেমনে আওড়ালো-তোমার শান্তশিষ্টতার পরপরই বাধ্যতা আর নিজকে সংবরণ করে রাখা,আমাকে তোমার প্রতি আরও আকৃষ্ট করেছে,আমার মায়াহরিণী যাদুময়ী।আর সেই আকৃষ্টতার অনুভূতি জানান দেয়,তুমি শুধু আমারই হবে কাশফিয়া আহসান কৌড়ি।শুধুই নিভানের।যেখানে নিভানের হৃদয়ে চাপা দেওয়া কঠিন পথরটা তুমি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে নিজে ঘাঁটি পেতে শক্তপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়ে বসেছো,সেখানে তো তুমি বাধ্য নিভানের হতে।এখন সে তুমি যতোই কঠিন মনের হওয়া কেনো,আর নিজেকে যতোই পরপর ভেবে সংবরণ করে নিজের সীমাবদ্ধের মধ্যে আঁটকে রাখো না কেনো!তুমি তো নিভানেরই।

দরজায় কড়া পড়তেই,চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।সামনে তাকিয়ে দেখলো তৃনয় এসেছে।ফের গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।ভিতরে ঢুকলো তৃনয়।মৃদু হেসে গান ধরলো।

‘পৃথিবীতে সুখে বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার নাম ভালোবাসা,তারই নাম প্রেম।

চেয়ারে শরীর এলোনো ভঙ্গিতেই কপাল কুঁচকে তৃনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিভান বললো।–তোর আবার ইভানের রোগে পেলো কবে থেকে?

চমৎকার হাসলো তৃনয়।চেয়ারে বসতে বসতে মজার গলায় বললো—যেদিন থেকে ইভানের ভাইয়ের মতো আমার বন্ধুটাও প্রেমে পড়েছে সেদিন থেকেই আমার বন্ধুটাকে দেখলেই সময় অসময়ে বসন্ত ঋতুটা ভর করছে আমার কন্ঠে।তা আমার বন্ধুটার প্রাণপাখিটার খবর কি?

শান্ত চোখে তৃনয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনবোধ করলো-না।সময় নিয়ে বললো—সন্ধ্যায় তন্ময়ীর গায়ে হলুদ তুই এখন এখানে কি করছিস?

‘ওদিকে আপতত আজকের অনুষ্ঠানের সবকিছু কমপ্লিট।আর কিছু কাজে শপিংয়ে এসেছিলাম,সেটাও আপতত শেষ।বাড়িতে যা মানুষের মেলা,মাইন্ড ঠান্ডা রাখার জন্য মনে করলাম তোর এখান থেকে একটু ঘুরে যাই।তাই চলে এলাম।কেনো,ডিস্টার্ব করলাম নাকি?

‘তোর মনেহচ্ছে আমি ডিস্টার্ব হয়েছি?

‘তুই ডিস্টার্ব হোস-নি।তবে তোর মন মস্তিকের অলিগলিতে যে চলছিলো তাকে তো ডিস্টার্ব করে দিলাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।তৃনয়ের মজার ছলে বলা কথাটার ফিরতি উত্তর দিলো না।দেওয়াটা সে মোটেই প্রয়োজন অনুভব করলো না।যেদিন থেকে কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা টের পেয়েছে তৃনয়।সেদিন থেকেই ইভানের মতো সে-ও কৌড়িকে নিয়ে পিছু লেগে আছে।
পাত্তা দিলে অসভ্যগুলো আরও পিছু লেগে থাকবে। তাই আপতত পাত্তা দিতে চাইছেনা সে।নিভানকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফের মজা করে তৃনয় বললো।

‘বল,সে অলটাইম তোর মাথার মধ্যে ঘুরছে কি-না?

‘মাথার মধ্যে ঘুরুক আর নাই ঘুরুক।সে এমনিতেই আমার।আর যে আমার,সে তো আমার মনমস্তিকের সর্বক্ষণের সঙ্গী।তাকে আবার আলাদাভাবে ভাবার বা মাথার মধ্যে ঘোরার কি আছে!

দুষ্ট হাসলো তৃনয়।বললো-ক্যা বাত হে,আমাদের নিভান সাহেব তো পুরোদস্তুর প্রেমে পিছিল গায়া।দেরী করছিস কেনো? বিয়ে করে নে।

চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নিলো নিভান।ফের নির্বিকার কন্ঠে বললো–দুনিয়াটা দেখা’র একটু সুযোগ করে দেই।দেখুক দুনিয়া,চারপাশটা নজর খুলে দেখুক,বুঝুক।বুঝুক আমাকেও।তার কখনো যেনো না মনে হয়,সে আমার থেকে-ও বেটার কাওকে পেতো।যদিও পাওয়ার মতো মেয়ে সে,তবুও যেনো মনে নাহয় ।অন্তত আমাকে বোঝার জন্য তাকে অবাধ চলাফেরার সুযোগটা তাকে আমি দিতে চাই।

‘তুই কি তাকে দীবার মতো ভাবছিস নিভান?কৌড়িকে কিন্তু আমার তেমনটা কখনোই মনে হয়-নি বা হয়ও না।

চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় নির্বিকার গলায় ফের বললো নিভান।

‘কখনো না।দীবা আর সে,দু’জনেই সবদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।আমি কখনোই তাকে দীবার সাথে তুলনা করে ছোটো করে দেখতে চাইনা।আর ও সেরকমও নয়।যদি ও সেরকম হতো,তবে কখনোই নিভান তারপ্রতি দূর্বল হয়ে পড়তো না।ও আমাকে তারপ্রতি দূর্বল করেছে!তুই ভাবতে পারছিস?নিভানকে ওর প্রতি দূর্বল করে ফেলেছে।আর তাকে দীবার সাথে তুলনা করলে নিজেকেই যে ছোটো করা হয়ে যায়!তুচ্ছ দেখানো হয়!সেই নিজেকে এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখি কি করে!যাই হোক,ওর সম্পর্কে ধারণা আমার নিজের মতো,অন্যরকম।আর সবচেয়ে বড়কথা দীবা ম্যাচুউর ছিলো।তবুও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে।সেই তুলনায় বয়সটা ওর নিতান্তই কম।এরকম বয়সে ছেলেমেয়েরা আবেগে ভাসে-ডোবে।সেই আবেগের সিদ্ধান্তটা যেনো আমি না হই ওর।আমাকে চাইতে হবে ওর মনেপ্রাণে।আর কিচ্ছু চাইনা,শুধু এটুকু চাই ওর থেকে আমি।শুধু ওটুকুই চাই, ও আমাকে মনেপ্রাণে চাক।আমার মতো করে আমাকে ছাড়া ও আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে না বুঝুক, না ভাবুক আর না চাক।

‘তবে কি তুই ওর সিদ্ধান্তকে নিজের অনুভূতির থেকেও প্রায়োরিটি দিতে চাইছিস?

‘দেওয়াটা উচিত নয় কি?নিভানের জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি দূর্বল অনুভব করেছে সে।তার প্রতি কি একটু ভরসা বিশ্বাস রেখে দেখা উচিত নয়কি?সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করলাম।অমূল্য কিছু পেতে গেলে তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।সেই জিনিসটার প্রতি অটুট বিশ্বাস ভরসা রাখতে হবে।আর ওর প্রতি কেনো জানি না,সেই ভরসা বিশ্বাসটা আমার আপন ইচ্ছেতেই জন্মে গেছে।কেনো জানি মনেহয়,ও আমার ভরসা বিশ্বাস কখনোই ভঙ্গ করবেনা।ও আমারই হবে।আর যদি না হয় তবে,সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করেই ওকে আগলে রাখলাম।তবে কেনো জানি মন বলে,ও আমারই হবে।শুধু নিভানের।

তৃনয় অবাক হয়ে দেখলো, চেয়ারে গা এলিয়ে রাখা শ্যামবরণ পুরুষটাকে।গায়ের রঙটা শ্যামবরন হলে কি হবে তাকে সুদর্শন সুপুরুষই বলা যায়।লম্বা চওড়া গড়নের গম্ভীর ব্যাক্তিত্বপূর্ন ছেলেটা,কলেজ ভার্সিটি লেবেলে কখনো কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক তো দূর, কথা অব্ধি সেভাবে মেয়েদের সাথে বলতোনা।অথচ এই পুরুষটাতেই মেয়েরা ফিদা ছিলো।তবে সে বিষয়ে কখনো গুরুত্ব দেয় নি নিভান।যাকে রিজেক্ট করে দীবা-ও এখন পস্তাচ্ছে।সেই কাটাকাট আদলের ব্যক্তিত্বপূর্ন পুরুষটা ফেঁসে গিয়েছে এক বাচ্চা মেয়েতে।তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে,সে কোন লেভেলের দূর্বলতা অনুভব করে মেয়েটাতে।নিজে চোখে দেখেছে-ও তৃনয়।সেদিন ছেলেগুলোকে যেভাবে মারলো।উফফ, জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।ছেলেগুলো হয়তো এখনো হাসপাতালে।অথচ এতো বাড়াবাড়ি করতে কখনো দেখিনি নিভানকে। না নিজের অনুভূতিগুলো এতো খোলামেলা ভাবে ব্যক্ত করতে শুনেছে।সেই ছেলে ওই মেয়েটাতে এতোটা দূর্বল অনুভাবিত হয়েছে,যে নিজের অনুরক্তিগুলো মনের মধ্যে আর চাপিয়ে রাখতে পারলোনা।কাওকে মন থেকে নিজের করে চাওয়ার অনুভূতির তীব্রতা হয়তো এমনই।তবে সে কেনো পারছে না ব্যক্ত করতে।তবে কি তার চাওয়ায় খামতি আছে?হয়তোবা!তৃনয়ের ভাবনার মাঝে,চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।তৃনয়কে গভীর ভাবতে দেখে সময় নিয়ে বললো

‘ নওশাদ চৌধুরী,মান্যতাকে উনার ছেলের বউ করার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।এতোদিন অনেক প্রস্তাব এসেছে,নাকচ করে দিয়েছেন।এবারেরটা আর ফিরিয়ে দিতে চাইছেন-না।আমার কাছে মতামত চেয়েছেন উনি।কি করা যায় বলতো?

ছলাৎ করে উঠলো তৃনয়ের ভিতরটা।তোলপাড় শুরু হলো হৃদপিণ্ডে।এই চুপিচুপি ভালোবাসার যন্ত্রণা এতো দিন তাকে কষ্ট দিলেও, এতোটা ব্যথা অনুভব করায়নি।কি বলছে নিভান!মান্যতার বিয়ে!মেয়েটা অন্য কারও হয়ে যাবে?তা কি-করে সম্ভব!সহ্য করবে কি-করে সে?বুকে ব্যথা নিয়ে ধীরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।

‘এতো তাড়াতাড়ি কেনো?

তৃনয়ের মুখের দিকে দৃঢ় নজর ফেলে নিভান বললো–
‘এতো তাড়াতাড়ি কোথায়?তন্ময়ী আর মান্যতাতো সেম ইয়ার।তন্ময়ীর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেতে পারলে, মান্যতার কেনো হতে পারবে-না।

‘হুম।তা তো ঠিক।তবুও ওর পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়ার পর তো বিয়ের ভাবনাটা ভাবতে পারতিস?

‘এখন তো আর সেই যুগ নেই।যে পড়াশোনা অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে দিলে,ওখানেই সেই মেয়ের পড়াশোনাটা শেষ হয়ে যাবে।শ্বশুর-বাড়ী থেকে আর পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে-না।সুতারাং ভালো প্রস্তাব হাতছাড়া করে লাভ আছে কি!

কথার বাহানা দেওয়ার জন্য আর কোনো শব্দ খুঁজে পেলো-না তৃনয়।ভিতরে ভিতরে হাস-ফাস করে উঠলো বক্ষস্থল।বলবে কি নিভানকে যে,তোর বোনটা আমাকে দিয়ে দে।আমি তাকে,তোর বাবা আর তোদের চেয়ে-ও খুব যত্নে আমার কাছে গুচ্ছিত রাখবো।খুব ভালোবেসে আগলে রেখে দেবো আমার কাছে।পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা কুড়িয়ে এনে হাজির করবো তার পায়ের কাছে।তাকে দিয়ে দে না নিভান আমাকে।আমার বুকটা খালি হতে দিসনা নিভান।বুকের বা পাশটায় তোর বোনটা না থাকলে যে আমি আর আমি থাকবো না নিভান।আমি তৃনয় অর্থহীন হয়ে যাবো।

তৃনয়ের ভিতরের ছটফটানিটা জেনো মুখাবয়বে হালকা হলেও অনুভব করতে পারলো নিভান।নিজেও যে সেই একই জ্বালায় ভুক্তভোগী।তবে কেনো বুঝবেনা অন্যের ভিতরের জ্বালা।বেদনা!আর তৃনয়কে যে সাহস নিয়ে বলতেই হবে। না হলে তাকে যে হারাতে নিজের একান্ত চাওয়া পাওয়াটা।হারাতেই হবে।

ধরণীতে সন্ধ্যা নামনাম ভাব।সূর্যটা কমলা রঙের আভা ধারন করে প্রায় ডুবুডুবু অঙ্গসাজ।সেই সময়টাতে নিভানের গাড়ীটা বাড়ির পার্কিং এরিয়ায় এসে থামলো। এই সময়টাতে কখনো বাড়িতে আসেনা নিভান।আজ আসার কারন,তন্ময়ীর গায়ে হলুদ।সেখানে যেতে হবে তাই।যদিও অফিস থেকেই যতো পারতো সে।তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে সে জানতে পেরেছে,তাহার যাদুময়ী মায়াহরিনীটা সেখানে যায়নি।ম্যাডামের নাকি কোনো কারনে প্রচন্ড শরীর খারাপ।বিধায় বাড়ির সবাই তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও,তিনি যাননি।কি কারনে শরীর খারাপ তথ্যটা ঠিকঠাক পায়নি নিভান।তবে এটুকু তথ্য পেয়েছে,মেয়েটার প্রচন্ড পেটব্যথা এবং হাতপায়ের যন্ত্রণায় কাতর সে।তাই যেতে চায়নি নিজেই।কিন্তু মেয়েটা ছাড়া ওখানে নিজে কি-করে কাটাবে।আর দ্বিতীয়ত অসুস্থ মেয়েটাকে দেখার তীব্র বাসনা জেগেছে মনে।তাই সরাসরি অনুষ্ঠানে না গিয়ে বাড়িতে এসেছে সে।গাড়ী থেকে নেমে ডোরবেল বাজাতেই রানী দরজা খুলে দিলো।ভিতরে প্রবেশ করতেই স্বাভাবিক গলায় নিভান শুধালো।

”কৌড়ি কোথায়,রানিসাহেবা?

কৌড়ির খোঁজ নেওয়াতে একটু আশ্চর্য হলো রানী।তবে সেটা প্রকাশ না করে,সে-ও স্বাভাবিক গলায় বললো–নিজের রুমে শুয়ে আছে।

“ও-কে বলুন রেডি হয়ে নিতে।আর আপনিও রেডি হয়ে নিন।আমারা এখন তন্ময়ীর হলুদ অনুষ্ঠানে যাবো।

‘মেয়েটার তো শরীর খারাপ বাবা!ও যাবে কি-করে?

‘শরীর কি বেশী খারাপ লাগছে?তাহলে তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।হয়েছে কি ওর?আর মা জেনেশুনে ওভাবে ও-কে একা রেখে গেলেন কেনো?

নিভানের উদ্বিগ্নতা নজরে পড়তেই দ্বিধায় পড়ে গেলো রানী।কি বলবে সে?মেয়েটার পিরিয়ডের ব্যথা চলছে।আর সেকারণেই অসুস্থ সে।যারকারনে এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে কোনোনতে সে তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হয়নি।মান্যতা মৌনতা তাকে কত জোর করলো, তবুও মেয়েটা রাজী হয়নি।এমনকি তারা নিজেরাও যেতে চাইছিলোনা।শেষমেশ তার অসুবিধার কথা জানিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে।আর নীহারিকা বেগম,তিনিও তো মেয়েটাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে চাননি।তবে তিনি না গেলেই নন।তাই সবকিছু বিবেচনা করে,রানীকে-সহ কৌড়িকে রেখে যেতে রাজী হয়েছেন।আর এটাও বলে গিয়েছেন—মেয়েটা একটু সুস্থতাবোধ করলে তাকে জেনো জানানো হয়।হাফিজকে পাঠিয়ে দেবেন,হাফিজ এসে নিয়ে যাবে তাদেরকে।মেয়েটা এখন কিছুটা সুস্থতাবোধ করছে তবে কিছুতেই সেখানে যেতে রাজি নয়।

‘রানীসাহেবা।

সহসা নিভানের ডাকে চমকে গেলেন তিনি।বললেন–সকাল থেকেই মেয়েটার শরীর খারাপ লাগছিলো।তবে এখন ভালো আছে।আর তার তেমন কিছু হয়নি,এই এমনিতেই একটু পেটব্যথা করছে।

‘ব্যথার কোনো ঔষধ খায়নি?

নিভানের এতো খুঁজিনামা দেখে ভিতরে ভিতরে আশ্চর্য হলো রানী।তবে সহসা উত্তর দিলেন–খেয়েছে তো।এখন আপতত ঠিক আছে।

রানীর সংকোচময় উত্তর দেওয়া দেখে মনেমনে কেমন একটা অনুভব হলো নিভানের।সাধারনত কোনো অসুস্থতা হলে তাকে তো খোলামেলা বলার কথা যে, মেয়েটার এই কারনে এই অসুস্থতা বোধ করছে বা অসুবিধা হচ্ছে।তবে কৌড়িকে নিয়ে রানীর কথাগুলো কেমন এড়ানো এড়ানো ভাব।সেটা বুঝতে পেরে সেই বিষয়ে আর ঘাটাঘাটি না করে তাকে আর-ও সংকোচে ফেলতে চাইলোনা নিভান। বললো—যদি শরীর বেশি খারাপ না লাগে তবে ওকে রেডি হয়ে নিতে বলুন।আমরা বের হবো।আর বাহিরে বের হলে শরীর মন দুটোই ভালো লাগবে।

নিভানের তাড়ায় রানীও একপ্রকার হার মেনে কৌড়ির রুমে চলে গেলো।না-হলে আবারও যদি মেয়েটার অসুস্থতা নিয়ে এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করে নিভান,তবে সে কি উত্তর দেবে।বিধায় বাধ্য হয়ে কৌড়িকে গিয়ে নিভানের কথাগুলো বলতেই,সে নাকচ করে দিলো।সে যাবে-না।আর ওই মানুষটার সাথে তো কখনোই নয়।কথাগুলো নরমস্বরে বললেও বাহিরে দাড়ানো নিভানর কানে এসে ঠিকই বিঁধলো।হয়তো ওই কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় ছিলো সে।তাই আর আলাদাভাবে কৌড়ির কথাগুলো এসে বলা লাগলো না তাকে।সহসা পা বাড়ালো সে।কৌড়ির রুমের দজার সামনে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দাঁড়াতেই ঘুরে দাঁড়ালো কৌড়ি।বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা মূহুর্তেই বেড়ে গিয়ে ঘনোঘনো উঠানামা শুরু হলো তার।সকাল বেলা কিসব কথাবার্তা বলে গেলো মানুষটা।তারপর কি আর অবিচল হয়ে তার সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকা যায়।এমনিতেই মানুষটাকে দেখলে পরাণ যায়যায় অবস্থা হয় তার।আর সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেই শরীরের তপ্ততা নেমে গিয়ে শীতলতা ভর করে সেখানে।আর ইদানীং মানুষটা তাকে নিয়ে যা বলা শুরু করেছে।কি করবে কি বলবে ভেবে পায়না সে।

‘রানীসাহেবা আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।

নিভানের দিকে পিছে ফিরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে একপলক দেখে নিয়ে রুমের বাহিরের দিকে পা বাড়ালো রানী।সহসা কৌড়ি বললো–উনাকে বলে দিন রানীসাহেবা,আমি যাবো-না।আমার ভালো লাগছে না।

‘আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।

কৌড়ি আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পেলোনা।রানীও আর দাঁড়ালো না।তবে দরজার সম্মুখীন গিয়ে পিছে ফিরে তাকালো সে।নিভানের কথা-কাজ যেনো উনার সুবিধার ঠেকলো না।এতোবছর ছেলেটাকে দেখে আসছে।কখনো কারও উপর জোর খাটাতে দেখেনি,সেই ছেলে কৌড়ির উপর জোর খাটাচ্ছে।আর কৌড়ির প্রতি নিভানের দৃষ্টি,গলার স্বর।একটুও ঠিক লাগলোনা।কোনোকারনে দুই মানব মানবীকে যে-যার জায়গায় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে চলে গেলেন তিনি।রানী চলে যেতেই নিভান মুখ খুললো।

‘কৌড়ি।

ছলকে উঠলো জেনো শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাহিত রক্তকণিকা।হৃদপিণ্ড আরও দ্বিগুণ মাত্রায় ছটফটিয়ে উঠলো।ডাকের উত্তর দেওয়ার সাহসটা আর হয়ে উঠলো না।নিজের পরিহিত জামাটা দু-পাশের আস্তিন দু’হাতের মুঠোয় শক্ত করে খামচে ধরে পাথর কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।বিপরীত মানুষটা থেকে উত্তর পাওয়ার আশাটা করলোও না নিভান।বললো।

‘শরীর খারাপ লাগছে যেতে চাইছোনা,ঠিক আছে।তবে আমার সাথে কেনো যাবেনা বলছো?আমাতে তোমার সমস্যা কোথায়?

আপনি মানেই তো ভয়ঙ্কর সমস্যা!কথাটা চেয়েও দিতে পারলোনা কৌড়ি।ওই গম্ভীর স্বরের মালিকের মুখে মুখে তর্ক করাটা কি এতোটাই সহজ বিষয়।কৌড়িরতো মোটেও সহজ বলে মনে হয়না।কেনো জানি পারেনা সে তর্ক করতে।কৌড়ি উত্তর দেবেনা বুঝে নিভান ফের বললো।

‘তোমার জন্য রানীসাহেবা-ও যেতো পারছে-না।নিজের আনন্দ অনুভূতি চেপে রেখে তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছে এটা কি তোমার ভালো লাগছে?

এবার খারাপ লাগলো কৌড়ির।সত্যিই তো।মুখ খুললো সে।আলতোস্বরে বললো—তবে আপনি উনাকে নিয়ে যান।আমার সমস্যা হবেনা,আমি থাকতে পারবো।

এতোটা জেদী এতো কঠিন হৃদয়,ওই মানবীর সচ্ছ মুখের আদলে তো সেটা বোঝা যায়না।মায়ামায়া মুখটার দিকে তাকালে মনেহয়,ভেতরটা তার মোম গলানো তরল।অথচ তার গলার স্বরটা বলে দিচ্ছে,তিনি কঠিন হৃদয়ের মানবী।তার মন গলানো সহজ কথা নয়।
তবে কি শুধু তার বেলায় কঠিন হতে চাইছে মেয়েটা?কিন্তু কেনো?এই মূহুর্তেই কৌড়ির মুখটা নিজের বাদামীবর্ন চোখজোড়া দিয়ে পরখ করতে ইচ্ছে করল নিভানের।ওই ডগরডগর চোখের ভাষা পড়তে ইচ্ছে করলো।ওই মায়ামায়া মুখাবয়বের এক্সপ্রেশন জানতে ইচ্ছে করলো।আর বলতে ইচ্ছে করলো,কেনো তুমি আমার বেলায় এতো কঠিন হতে চাইছো কৌড়ি?আর কেনোই বা চাইছোনা আমাকে।নিভান তার দূর্বলতা তোমার প্রতি প্রকাশ করে ফেলেছে তাই!মনেমনে নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি হাসলো নিভান।নিজের ব্যাক্তিত্বের বাহিরে গিয়ে কখনো নিজেকে মেলে ধরেনি সে।নিজেকে ছোটো করে দেখবে এমন দূর্বলতা দেখায়নি কাওকে।সবসময় নিজের চরিত্রের ভিতর বাহিরটা কঠিন রূপে রূপায়ণ রেখেছে। অথচ এই মানবীর কাছে,এতো বছরের শক্ত খোলসের সেই ভিতরে বাহিরের কঠিন নিভানটা কেমন মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তার খোলাসাটা আলগা করে দিলো!

ক্ষনিকের জন্য চোখ বুঁজে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে ফের চোখ মেলে নিলো নিভান।নজর স্থির করলো,নিজের হৃদ হরন করে নেওয়া সেই মানবীর পানে।হৃদয় এতোটা দূর্বল হয়ে পড়লো কিকরে এই নারীরপানে!যেখানে নিজেকে দূর্বল দেখাতে-ও মন দ্বিধা করছে-না।আর নিজেকে খোসালা রূপে জানাতে তো মোটেই নয়।কিছু সময় দু’দিকের দুই মানব-মানবী নীরবতায় ছেয়ে থাকলো।একজন তার ভাবনায়,অন্যজন মনের হাসফাসে।হাসফাস করা মানবীটি জানে তার পিছনের মানুষটা এখনো তার পিছে অটল দাড়ানো।যায়নি।ভাবনার অতল গভীর থেকে ডুব দিয়ে এসে মুখ খুললো নিভান।ধীরকন্ঠে গুছিয়ে গুছিয়ে খুব সুন্দর করে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘শরীর বেশি খারাপ না লাগলে রেডি হয়ে নাও।তোমাকে বাড়িতে একা রেখে ওখানে আমি আমাকে স্থির রাখতে পারবো না কৌড়ি।আর-ও তুমি অসুস্থ,এটা জেনে একটু না!যদি-ও আমাকে ভালো রাখার দ্বায় তোমার নয়,তবে নিজেকে ভালো রাখার দ্বায়টাতো আমার।তুমি ভাবতেই পারো আমি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি।যেখানে তুমি অসুস্থ জেনে-ও,আমি আমাকে ভালো রাখার জন্য তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জোরবাদী করছি।আজ আমাকে ভালো রাখার জন্য না-হয় দ্বায়টা একটু কষ্ট করে হলে-ও তুমি বহন করো।আমি না-হয় স্বার্থান্বেষী মানুষ, তুমিও একটু না-হয় দয়ামায়াময়ী হলে।

চলবে….

নিজের অসুস্থতা।সেই অবস্থায় নানুর অসুস্থতার কথা শুনে সাত আট ঘন্টা একটানা জার্নি করে বাড়িতে আসা।নানুর মৃত্যু।সব মিলিয়ে খারাপ একটা সিচুয়েশনে মধ্যে দিয়ে আজ একটা সপ্তাহ পার হয়ে গেলো।যদিও দেরী হয়,তবুও আরও দেরী করার জন্য ক্ষমা করবেন আমাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here