ফুলকৌড়ি (২৯) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
492

#ফুলকৌড়ি
(২৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কৌড়ি এবাড়িতে এসেছে,আজ পাক্কা দু’মাস ছয়দিন।এই দুমাস ছয়দিনে,সামনের বসা মানুষটা সম্পর্কে সে যেটুকু জেনেছে শুনেছে এবং দেখেছে।আর যেটা বুঝেছে।তাতে এই মানুষটার সিদ্ধান্ত বিহীন একটা কাজ-ও এবাড়িতে হয় না।যেকোনো কাজে আগে তার মতামত গ্রহণযোগ্যতা পায়।আর সেই মতামতকে সবাই বিশেষ ভাবে গুরুত্বও দেয়,বিশেষ করে জাহিদ আঙ্কেল।
ভাইবোনেরা এই মানুষটাকে ভয় পেলেও,সম্মান শ্রদ্ধার নজরে দেখে।সেটা তাদের কথাকর্মে বোঝা যায়।
সবকিছুতে বাবার পরে দাদাভাইয়ের আদেশ নিষেধ বিনাবাক্যবয়ে মেনে চলে তারা।বড়মা,ছেলে বলতে অজ্ঞান।ইভান ভাইয়া,দাদাভাই বলতে পাগল।আঙ্কেলের এতোবড় ব্যবসা বড়ছেলে হিসাবে যে মানুষটা নিষ্ঠার সহিত সামলে চলেছে।বড়ছেলে হিসাবে যাকে এতোবড় ব্যবসার কর্ণধার বানিয়ে রেখেছে।সেই মানুষটা বলছে, সে নাকি এবাড়ির কেউ নয়!কি-করে এই মানুষটা এবাড়ির কেউ না হতে পারে!এমন অযুক্তিযুক্ত কথা কেউ বলে!নাকি এমন অযুক্তি কথা বিশ্বাসযোগ্য।
মানুষটার ছোটো বেলার গল্প।সল্প পরিসরে হলেও,সে বড়মার মুখে কথার ছলে গল্প শুনেছে।তিনি নিজ ইচ্ছেতে কৌড়ির সাথে টুকটাক গল্প করেছেন।সেখান থেকে জেনেছে প্রথম সন্তান হিসাবে মানুষটার প্রতি কতোটা দূর্বল বড়মা,সব সন্তানদের থেকে আলাদা স্নেহ আবেগ মানুষটার প্রতি।সেই মানুষটা বলছে,সে এবাড়ির কেউ নয়।কেনো এমন কথা বলছেন তিনি?
সংকোচ ভুলে নিভানের নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।ওই দৃঢ় নজরও যে মিথ্যা বলছে,এটাও তো মনে বলছেনা কৌড়ির।তবে?পরাণটা কেমন ছটফটিয়ে উঠলো,উত্তরটা পাওয়ার জন্য।তবে মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারলো না সে।সামনের মানুষটাকে আশকারা দেওয়ার ভয়ে,চাইলো না সে প্রশ্ন করতে।তবে মনস্তাত্ত্বিকের টানাপোড়েনে ভিতরে ভিতরে অস্থির তোলপাড় অনুভব করলো।মনেমনে বিচলিত হলো কিছু কথা জানার জন্য।তবে তা জিহ্বার ডগায় এনেও সামনের মানুষটাকে প্রশ্ন করা হয়ে উঠলো না তার।

‘কি ভাবছো,তোমার ইচ্ছে অনুমতি ছাড়া তোমাকে চেয়ে বসা,এই বর্ণহীন,নিঃশ্ব মানুষটাকে আপনজন করা যায় কি-না।

কথাটা অদ্ভুতভাবে বুক ভারী করে তুললো কৌড়ির।না চাইতেও কৈফিয়তের স্বরে তড়িৎ বললো সে–মোটেই আমি তেমনটা ভাবছি-না।

কৌড়ির নখ কাটা হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।নখগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে নেলকাটারের পিছু ঘষার অংশে পালিশ করছে নিভান।নিজের কোমল হাতখানা যে কারও শক্ত হাতের মুঠোয়, সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল ধ্যান নেই কৌড়ির।সে আছে সামনের মানুষটার সম্মুখে কিকরে নিজেকে কঠিন রাখা যায়। কৌড়ির উত্তর শুনে ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটলো নিভানের।মজার ছলে বললো–তবে কি ভাবছো,আপন করা যায়?

লজ্জা পেলো কৌড়ি।কথার প্যাচে পড়ে যাবে ভাবিনি।এলোমেলো নজর এদিকে ওদিক পানে ঘুরিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললো।—মোটেই তাও ভাবছি-না আমি।আপনি খুব বেশি বেশি ভাবছেন।

‘তবে কি ভাবছো,এই বর্ণহীন নিঃশ্ব মানুষটা আবার তোমাকে পাওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছে কি করে?

দ্বিতীয়বার একই কথাটা নিভান আওড়াতেই,লজ্জা ভুলে খেয়ালী নজরে নিভানের শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।একমনে মাথা নিচু করে মনোযোগী হয়ে তার নখের পরিচর্যা করে চলেছে মানুষটা।বিকালের নরম হয়ে আসা আলোতে শক্তচোয়ালের শ্যামবর্ণ মুখাবয়বের মানুষটাকে শুধুমাত্র রঙের জন্য কি কোনো কারনে সুদর্শন কম দেখাচ্ছে?কৈ কৌড়ির নজর তো সেটা বলছেনা।তবে মানুষটা কি-করে বলছে তিনি বর্নহীন!শ্যামবর্ণ মানুষ আবার বর্নহীন হয় কিকরে!আচ্ছা রঙে সাদা,কালো,শ্যাম, উজ্জ্বল কোনো মানুষই কি আসলে বর্নহীন হয়!এগুলো তো শুধু,জাস্ট রঙ।আর শুধু রঙ দিয়ে কি মানুষকে বিচার করা যায়!মানুষ বলতেই তো আল্লাহর দান শ্রেষ্ঠ জীব।তবে সেই শ্রেষ্ঠ জীব সম্পর্কে মানুষের ধারণা এতো উঁচুনিচু হয় কি-করে!মানুষের আচার ব্যবহার চালচলন কথাবার্তা যদি ভালো হয়, শ্রেষ্ঠ হয়। তবেই না সে সুন্দর,সুশৃঙ্খল,সুদর্শন।আর সামনে বসা মানুষটাতো সেসব গুনে একেবারে পরিপূর্ণ গুনোন্বিত।তবে?দৈহিক পেটানো শরীরের উচু লম্বা মানুষটার মায়ামায়া কাটকাট আদলের শ্যামবর্ণ মুখটাকে দেখলে,কে বলবে এই মানুষটা বর্ণহীন।আর তার ধারালো ব্যক্তিত্ব।যেকোনো মেয়ে তাকে পাওয়ার ইচ্ছে পোষন করবে।কৌড়ি কি করেনি!মুখে স্বীকারোক্তি পোষন না করলেও,মনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা।সেই চেষ্টায় ভিতর বাহিরে কতোটা সফল অসফল হচ্ছে সেটা শুধু সেই জানে।নিজের ভাবনা মতোই গলায় কিছুটা অবাকতা নিয়ে বললো।

‘আপনি বর্ণহীন, নিঃশ্ব?

নিভান প্রহসন গলায় বললো-কেনো,মনেহচ্ছে না সেটা?

ভাবনার ঘোর মূহুর্তেই কেটে গেলো কৌড়ির।অপ্রস্তুত গলায় বললো–জানিনা।

এবার মুখ উঁচু করে তাকালো নিভান।সুডৌল অদ্ভুত মায়াময় মুক্তোদানার মতো গোলগাল একটা মুখ।দেখলে নজর,হৃদয় পরিতৃপ্ত হয়ে যায়।অথচ সেখানে নিষ্পলক তাকিয়ে মন নজর পরিতৃপ্ত করার দলিলনামা তার নেই।ভালোবেসে একটু ছোঁয়ার অধিকারও নেই।নিভান তাকাতেই নজর এলোমেলো করে এদিক ওদিক পানে চেয়ে,নিজের দ্বিধা কাটাতে চাইলো কৌড়ি।হাত টেনে নিয়ে সরাতে চেয়েও,সেই মানুষটার শক্তপোক্ত হাতের বাঁধন থেকে কিছুতেই হাত ছাড়াতে পারলো-না।শক্ত হাতের বিস্তৃত তালুতে কৌড়ির কোমল হাতের তালুটা, নিজের বৃদ্ধাআঙুলের দৃঢ়চাপনে ধরে রাখলো নিভান।শীতল চাহুনিতে কৌড়ির মুখের দিকে নজর ফেলে আবেগমিশ্রিত গলায় বললো।

‘এই কৌড়ি,আমার জন্য একটু লোভী হও-না।তুমি লোভী হলে আমার নিজের চাওয়া পাওয়া ইচ্ছেগুলো একেবারে নিঃশ্ব হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাবে।আমার জন্য একটু লোভী নাহয় হলে তুমি।খুব কি ক্ষতি হবে?

কথার উত্তর দিলোনা কৌড়ি।তবে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো।কেননা সামনের মানুষটার আকুল আবদনে বুকের মধ্যে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে তার।কৌড়ির জবাবোর আশা না রেখে নিভান ওর হাত ছেড়ে দিলো।জানতো,সামনের মেয়েটা থেকে সহজে জবাব পাবে না সে।আশাও রাখেনি,তবে মেয়েটার বহিরাগত এক্সপ্রেশন জানতে চাইছিলো।মৃদু হাসলো নিভান।হাত ছাড়া পেতেই তড়িৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো কৌড়ি।ঘুরে সামনে এগোতে গেলেই নিভানের ডাকে,না চাইতে-ও পা থেমে গেলো তার।সেটা দেখে শিথিল গলায় সর্তকতাবানী সরূপ নিভান বললো।

‘বেখায়লিতে চলাফেরা করো-না কৌড়ি।আমার সব ইচ্ছে, চাওয়া পাওয়া আমি আমার আপনজনদের কথা ভেবে একটু একটু করে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি।তবে আফসোস হয়েও,মনে রাখেনি।তুমি আমার এমন চাওয়া।সেখানে আফসোস নামক শব্দটা প্রয়োগ করা তো দূর শস্য পরিমাণ স্যাক্রিফাইস করার দুঃসাহসিকতাও দেখাতে চাইনা আমি।যে কোনো মূল্যে রাজি নই আমি।আর আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে বিসর্জন দেওয়া মানে,আমাকেই বিসর্জিত করা।আমার সবকিছু শেষ হওয়া।

নিঃশ্বাস আঁটকে রইলো কৌড়ির।বিগত দুমাস ধরে দেখে এসেছে, মানুষটা গম্ভীরর্য স্বভাবের।বাড়ির সবার সাথে খুব কমই কথা হয় মানুষটার।আর যেটুকু বলে খুবই শান্ত আর গম্ভীর স্বরে।ছোটো বড়ো সমবয়সী কারও সাথে সেভাবে মেলামেশা খোলামেলা নয় তার।অথচ তার বেলায় কথাবার্তা আচারন কতো সহজ সেই গম্ভীর্য মানুষটার।সেই মানুষটা তাকে পছন্দ করে ভাবলেই কৌড়ির পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করে উঠে।কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতি হয়।যেখানে সে কখনো যেটা স্বপ্নেও ভাবেনি।সেখানে সেটা বাস্তবিকরূপে নিজের সাথে ঘটলে,নিজেকে কিভাবে ভালোমন্দের বেড়াজালে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়!তবু-ও রাখতে যে তাকে হবেই।বাবা মা মরা এবাড়ির আশ্রিতা সে।আর আশ্রিতা কি কখনো কার-ও সুখের নীড় হতে পারে!কিজানি,হয়তো পারে নয়তো না।আর ভাবতে চাইলোনা কৌড়ি,পা বাড়ালো পিছনের মানুষটা থেকে পালাতে।সেটা পিছনের মানুষটা নিস্প্রভ শান্ত নজরে দেখলো।কৌড়ি দৃষ্টিসীমা গোচর হতেই চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে নিলো সে।শ্বাস ছাড়লো সংগোপনে।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো—তুমি কঠিন হতে চাইছো,হও।যতো কঠিন হতে চাইবে,তোমাকে চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,তীব্রতা নিভানের ততোই বাড়বে।
তারপর নিজের আকুল অনুভূতি ছেড়ে কোথায় পালাবে তুমি!যেখানেই পালাতে চাওনা কেনো,লুকোনোর জায়গা হিসাবে তোমাকে খুঁজতে হবে নিভানের এই শক্তপোক্ত বুক।যা নিভান তোমাকে দেখার পর তোমার নামেই করে দিয়েছে।শুধু তোমারই নামে,কৌড়ি।

নিজের রুমে প্রবেশ করতেই ইভানকে নিজের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে থমকে পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো নিভান।স্থির নজরে,বেডে পা ঝুলিয়ে দু’দিকে দুহাত ছড়িয়ে শুয়ে থাকা ইভানকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল।তারপর নিজের কাজে,ওয়াশরুমে চলে গেলো।নিভানের উপস্থিতি ইভানও টের পেয়েছে তবে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি সে।কতোদিন পর নিজের ইগো ছেড়ে, প্রিয় জায়গাটায় শুয়েছে সে।একটা সময় এই জায়গাটা তার নিত্যকার ছিলো।তারপর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।কেনো হয়ে গেলো!নাহলে আর যাই হতো,তার জীবনের অন্তত এইদিনটা হয়তো দেখতে হতোনা তাকে।এরকম একটা দিনের সম্মুখে পড়ার আগে,তার দাদাভাই কাছে সে তন্ময়ী সম্পর্কে সবকিছু বলতো।আর দাদাভাই বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো তাঁকে সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিতো।নিভান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বললো।

‘হঠাৎ আমার রুমে?এ্যানি প্রবলেম?

চকচকে সাদা রঙ করা ছাঁদের পানে নজর স্থির ইভানের।নির্লিপ্ত গলায় বললো সে।-এই বেডটায় শুয়ে তুমি কি নির্দ্বিধায় কতো কঠিন কঠিন কাজ সহজভাবে সল্ভ করে ফেলো।তাই আমিও ভাবলাম,দেখি সেখানে শুয়ে আমার জীবনের এলেমেলো সবকিছু সল্ভ করা যায় কি-না। সবকিছুর ঠিক করার সল্যুশন খুজছি।কিন্তু আমি তোমার মতো করে পারছি-না সবকিছুর সহজ সমাধান মিলাতে।কেনো বলতো পারছিনা দাদাভাই?দেখেছো,কোনো বাবা সবসময় বলেন।সব জায়গায় শুধু দখলদারী নিলে হয়না।যোগ্য,বিচক্ষণ বুদ্ধিবিবেচক,জ্ঞানী ব্যক্তির দরকার হয়!নাহলে সব ধ্বস নেমে যায়।আমার জীবনের সবকিছু যেনো না চাইতেও একটু একটু করে ধ্বস নেমে যাচ্ছে।

‘কিসব আবোলতাবোল বকে চলেছিস ইভান।কি হয়েছে কি?

ইভানের মুখে ধ্বস নামা শব্দটা শুনতেই কিছুটা ধমকের স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে তারদিকে এগোলো নিভান।সেটা দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে ইভান বললো।

‘আমি কখনো চাইনি,আমার জন্য কেউ মিনিমাম সামন্যটুকুও কষ্ট পাক।অথচ সেই আমার দ্বারাই সবাই ব্যথিত।নিজের পছন্দের চাওয়া পাওয়ার স্থায়িত্ব রূপ দিতে তন্ময়ীকে না চাইতেও অসম্মানিত,লজ্জিত করলাম।যেটা আমি কখনো চায়নি।বিশ্বাস করো দাদাভাই আমি একটুও চায়নি ওই মেয়েটাকে অসম্মানিত লজ্জিত করতে। সবার কথা ভেবে বিয়েতে ও রাজী হলেও, আমার প্রতি অসন্তুষ্ট।আমার দ্বারা ব্যথিত।কষ্ট পেয়েছে ও খুব।ও কখনো ক্ষমা করবে-না আমায়।আমি কিভাবে ওর সাথে সংসার গুছাবো। ওকে আমার করে রাখবো কিভাবে দাদাভাই?কিভাবে ঘৃনার বদৌলে ওর ফিরতি ভালোবাসাটা পাবো?আমি ওকে ছাড়তেও পারবো না।আবার ওর ঘৃনা নিয়ে একসাথে পথ চলবো কিভাবে দাদাভাই? সমাধান পাচ্ছি না!সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার!সব!

একটু থামলো ইভান।পরপর বললো– এই দেখো,না চাইতেও আম্মুকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেললাম।আমার সিদ্ধান্ত দ্বারা আম্মু অসন্তুষ্ট হয়েছেন,এটা বুঝে আম্মুকে বোঝাতে মানাতে গেলাম।অথচ পুনরায় আমার ব্যবহার কথাদ্বারা উনাকে কষ্ট দিয়ে এলাম।আমি চায়নি দাদাই আম্মুকে ওটা বলতে।কিন্তু কেনো জানি আম্মুর উপর অভিমান হলো,তিনিও তন্ময়ীর মতো কিছুতেই আমাকে বুঝতে চাইছেন না।অথচ আমর জীবনের প্রিয়,বিশেষ দু’জন নারীকে আনি বিশেষভাবে আগলে রাখতে চেয়েছিলাম।আমার দ্বারা ভুলেও কষ্ট পেতে দিতে চায়নি।অথচ তারাই আমার আচারন দ্বারা খুব বেশি ব্যথিত।অসন্তুষ্ট।আমি কেনো তোমার মতো নই দাদাভাই? আমার প্রিয় মানুষদের কেনো আমি ভালো রাখতে পারিনা?

স্থির দাঁড়িয়ে ইভানের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।গলায় কাতরস্বর!সুদর্শন ছেলেটার চোখমুখ কেমন ছন্নছাড়া ভাব।হাতগুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।অথচ ওই হাতদুটো একটা সময় তাকে ভরসা হিসাবে কতো বিশ্বাসে তার গলা জড়িয়ে ধরতো।সে না-ধরলেই কখনোই ইভান বলতোনা,দাদাভাই আমাকে ধরো আমি পড়ে যাবো।ছেলেটা যেনো মন থেকে ভরসা করতো,দাদাভাই যাই হয়ে যাক কখনো তাকে পড়ে যেতে দেবেনা।ব্যাথা পেতে দেবেনা।অথচ সম্পর্কের টানাপড়োনে আজ হাতদুটো অসহায় পড়ে আছে।ভরসা বিশ্বাস করেও,তার গলা জড়িয়ে ধরে বলতে পারছেনা,দাদাই আমার জীবনের এলোমেলো সবকিছু ঠিক করে দাও।গুছিয়ে দাও।সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলো নিভান।আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ইভানের পানে।হাতের তোয়ালেটা বেডের একপাশে রেখে ইভানের মাথায় হাত রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা চোখ বন্ধ করে নিলো।মায়ের পরে এই একজনের স্পর্শ তার ভূবন দুলিয়ে দেয়।পৃথিবীতে কখনো কোনো ভাইয়ের স্পর্শে কেউ মমতা খুজে পেয়েছে কি-না ইভানের জানা নেই।তবে এই স্পর্শে সে মমতা খুঁজে পায়।আদর,ভালোবাসা, আহ্লাদ খুঁজে পায়।এই মানুষটা তাকে ছুলে মনেহয়,মায়ের মমতাময়ী দ্বিতীয় কোল। কোমল আশ্রয়স্থল ।অথচ এই স্পর্শ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলো কতোগুলো দিন।উফ,সে যন্ত্রণা কি সে অনুভব করেনি!করেছে তো।

‘মন খারাপ কেনো করছিস?এটা নিয়ে কেউ মন খারাপ করে?তুই পুরুষ মানুষ।পুরুষ মানুষের এতো তাড়াতাড়ি দূর্বল হয়ে পড়লে চলে!তন্ময়ী ভুল বুঝেছে,সেটা তাকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিতে হবে।যদিও হলুদের অনুষ্ঠানে মতো একটা বিশেষ দিনে অতোগুলা মানুষের সামনে নিজের বিয়ে ভেঙে যাওয়া।কতোটা লজ্জার, অসম্মানের,সেটা ওর জায়গায় না থাকলে হয়তো আমরা কেউ বুঝবিনা।আমরা আমাদের মতো চাইবো,বলে যাবে।সেখানে দাঁড়িয়ে ওইতো বুঝবে ওর কি হারিয়েছে আর কি গেছে।আর যেখানে ও অসম্মানিত হয়েছে লজ্জিত হয়েছে।কারনটাও তুই।আবার সেই মানুষটাকেই আবার গ্রহণ করা কি সহজ কথা?তবুও যে কারনেই হোক সে তোকে গ্রহন করতে চেয়েছে।সেখানে সেই অসম্মানিত হওয়া,লজ্জিত হওয়াটাকে তোকে মুছে ফেলতে হবে।জানিনা বিষয়টা মুখে বলার মতো সহজ হবে কি-না।তবে দ্বায়ী যখন তুই।তাকে পেতে হলে,প্রাপ্য শাস্তিটা তো পেতেই হবে ইভান।সেভাবে হোক চেষ্টা করতে হবে তাকে নিজের করে রাখার।তাকে করা অসম্মান মুছে দেওয়ার।আর তন্ময়ী খুবই ভালো এবং বুদ্ধিমতি মেয়ে।ওর সামনে নিজেকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করলে,ও নিশ্চয় তোকে বুঝবে।

নিজের পাক্তপোক্ত হাতের ভারী পাঞ্জাটা ইভানের চুলে থামিয়ে দিলো নিভান।ছেলেটার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হলো ভিষন।চঞ্চল ছেলেটা কিভাবে মূর্ছা পড়েছে।দুষ্টমী করা,মজা করা,সবার পিছে লাগা থাকা ছেলেটাকে এভাবে দেখা যায়।এবার নিভান বেশ সাবলীল গলায় বলো।আর মাকে আবার কি বলেছিস?নিশ্চয় বলেছিস মা আমাকে বেশি ভালোবাসে।তাইতো?

চোখ খুললো ইভান।মূহুর্তেই দুচোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল গড়ালো।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললো।–সত্যি বলবে,মা বাবা তোমাকে বেশি ভালোবাসে কি-না?

‘আর তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কে?তোর অযথা অন্যায় আবদার মেটায় কে?

নিভান কথাটার উত্তর দিয়ে ইভানের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে গেলেই ইভান,এতোদিনের ইগো ছেড়ে,দু-ভাইয়ের মধ্যে সকল দুরত্ব ঘুচিয়ে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো।নিভানের কথার উত্তর না দিয়ে আকুল গলায় বললো।–স্যরি দাদাভাই।তোমার থেকে আমি আমাকে একটু একটু দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য, খুব বেশি স্যরি।স্যরি দাদাভাই।

ইভানের আকুলতায় নিজেকে আর দূরে রাখতে পারলোনা নিভান।না কঠিন রাখতে পারলো।নিজের সাথে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্নেহের ভাইকে।যেমনটা ছোটো বেলায় পরম স্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরতো ইভানকে।ইভানের তার থেকে সরে যাওয়ার অনুতপ্ততা,নিভানকে আরও বিগলিত করলো।তবে সেসব আর না ঘেঁটে প্রসঙ্গ এড়াতে বললো–এতো বেশি মন খারাপ করার মতো কিচ্ছু হয়নি, বাচ্চা।দাদাভাই আছে তো,দাদাভাই সব ঠিক করে দেবে,ইনশাআল্লাহ।আর আম্মু,আরেহ মায়েরা-তো ওরকম ইমোশনাল হয়।
আমরা দোষ করবো,অন্যায় করবো,তাদের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে অপছন্দনীয় কাজ করবো।আর তাদের কাজ ইমোশনাল হওয়া।তাই বলে তাদের আঘাত দিয়ে কথা বলা উচিত?কোনোমতও উচিত নয়।তবুও মানুষ আমরা ভুল,অন্যায় আমাদের দ্বারা হবেই।তোরও হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।আজ তোর উপর মন খারাপ করেছে, কাল ঠিক হয়ে যাবে।সন্তান যতোই ব্যথা দিক,মা তারপ্রতি যতোই অসন্তুষ্ট হোক।দেখেছিস কখনো সেই সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখতে?আমাদের উপর যতোই রাগ, অভিমান হোক রেখেছে কখনো তার মমতাস্থল থেকে দূরে?দিনশেষে সন্তানের দোষ, অপরাধ কখনো মনে রাখেনা তারা।সেই সব ভুলে গিয়ে ঠিকই তাদের মমতাস্থলের ছায়াতলে মুড়িয়ে নেয়।তোর উপর রেগে গিয়েছে,তবে তন্ময়ীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অখুশি হয়নি।আমি মায়ের সাথে কথা বলেছি। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।উনি আমাদের মা।কারনে হোক বা অকারণে আমাদের উপর রাগ দেখাতে পারেন। অভিমান করতে পারেন,অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
তাই বলে আমাদের উচিত নয় তাদেরকে কষ্ট দিয়ে,ব্যথা দিয়ে কথা বলা।আর কখনো নয় ঠিক আছে?

নিভান যেনো ছোটো কোথায় বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে।যদিও ছোটো ভাইবোনগুলোকে সে বাচ্চায় মনে করে।ইভানও হ্যা বোধক সম্মতিতে মাথা নাড়লো। তবে মুখে সেই একই কথা আওড়ালো।–তবে আম্মু আব্বু সত্যিই তোমাকে বেশি ভালোবাসে।

নিভান হাসলো।ইভানের জ্ঞানবুদ্ধি হওয়া থেকে এই একটাই অভিযোগ–‘আম্মু আব্বু কোনো তোমাকে বেশি ভালোবাসে।আচ্ছা উনারা ভালোবাসলে সে কি করবে!
কিছুটা মজার ছলে নিভান বললো।

‘আচ্ছা আম্মু আব্বুকে বলে দেবো আমি।আজ থেকে তোর বিয়ের কবুল বলার সময়টা পর্যন্ত,যেনো আমার মতো করে একটু বেশি বেশি ভালোবেসে দেয় তোকে।
তাদের নাবালক ছেলে বলে কথা।নাবালক ছেলের বউ হয়ে গেলে নাহয় তাদের ভালোবাসাটা একটু কম হলেও চলবে।ও-কে?

‘ইট’স নট ফেয়ার।তুমি আমাকে এমনটা ভাবো দাদাভাই?

ইভানকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।এই বিষয়ে কথা বাড়ালে আজ আর শেষ হবেনা।আয়নার সামনে দাঁড়ালো নিভান।এখন তাঁকে একটু বের হতে হবে।তাই নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হলো।হাতে কাজ চললেও মুখ বললো–তন্ময়ীর জন্য শপিং করতে গেলো সবাই।তুই গেলিনা কেনো?

‘কিচ্ছু ভালো লাগছিলোনা।আর ও-বাড়ি থেকে ওকেও নিয়ে শপিংয়ে যাবে ওরা।আমি গেলে ওর রাগ বাড়বে।হয়তো নিজের পছন্দ অপছন্দ বলবেও না।তাই যেতে ইচ্ছে হয়নি।

‘এটা কোনো কথা হলো ইভান।বিয়ে একবারই হবে, সেখানে দু’জনের পছন্দ অপছন্দতা থাকবে।আর তোদের মধ্যে যে ঝামেলা তৈরী করেছিস।সেটা দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা নাহলে মিটবে কিকরে?যাই হয়ে যাক তোর যাওয়া উচিত ছিলো।

তড়িৎ ইভান উঠে দাড়ালো।বললো–তাহলে চলো,যাই।

‘চলো যাই মানে?আমি কোথায় যাবো?আমাকে অফিস যেতো হবে এখন।

নিভান কিছুটা অসন্তুষ্ট গলায় বললো–দাদাভাই!বিয়ের দু’দিন তো আপতত অফিস যাওয়া বন্ধ রাখো!

ফর্মাল ড্রেস ছাড়া নিভান অফিসে খুব কমই যায়।তবে একটুখানির জন্য এবেলায় আর ড্রেস চেঞ্জ করে ফর্মাল পোশাকে জড়ালোনা নিজেকে।ব্লু জিন্স আর নেভিব্লু টিশার্ট পরা ড্রেসটায় বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।চুল ঠিক করে গায়ে পারফিউম পুশড করতে করতে বললো–কাল থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত আপতত অফিসে পা দেবোনা।বিধায় এখন আমাকে যেতেই হবে।

‘ওসব জানিনা আমি।কৌড়ি ওদের সাথে শপিংয়ে যায়নি।আমি কৌড়িকে নিয়ে নিচে আসছি।তুমি গিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হও।অপেক্ষা করো।

ইভান দাঁড়ালো না।ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো।নিভান সেদিকে স্থির নজরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে আওড়ালো।-তার ম্যাডাম যখন যাবে,তবে তো সে যেতে বাধ্য।


গাড়িতে অপেক্ষা করছে নিভান।ইভান যখন বলেছে কৌড়িকে সে নিয়ে আসবেই।তারমানে নিয়ে আসবেই।
সে যেই-ই বাঁধা দিক-না কেনো।কৌড়ি নিজে বাঁধা দিয়েও কাজ হবে-না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলো,সত্যিই কৌড়িকে নিয়ে ইভান আসছে।সাথে আনাফও আছে।ছেলেটা ইভানের সাথে মাথা নিচু করে কথা বলতে বলতে আসছে।মৃদু হাসলো নিভান।ওরা কাছাকাছি আসতেই মুখটা আগের ন্যায় স্বাভাবিক করে ফেললো।গাড়ীর কাছাকাছি আসতেই আশ্চর্য হয়ে ইভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।ইভান ভাইয়া,বড়মাকে বলে তাকে নিয়ে এসেছে।সে আসতেই চায়নি।কিন্তু সবাই শপিংয়ে গিয়েছে আর সে বাড়িতে একা থাকবে,অনেক ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বড়মাকে দিয়ে তাকে কনভিন্স করিয়ে নিয়ে এসেছে।বলেছে মান্যতা আপুদের কাছেই শপিংয়ে যাচ্ছে।অথচ যাচ্ছে সেই মানুষটার গাড়িতে!ইভানের প্রতি মনেমনে অসন্তুষ্ট হলো কৌড়ি।মনেমনে ভিষন বকলোও।মানুষটা থেকে যতো দূরে থাকার চেষ্টা করছে ততোই কাছাকাছি হতে হচ্ছে।
ভাবলো সে যাবেই না।কথাটা মুখে বলার আগে নিভান বললো।

‘ উঠে বসো।

ড্রাইভিং সিটের পাশের ফ্রন্ট সিটের দরজার দিকে তাকাতেই নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করলো উঠতে।নিভানের স্বর কানে যেতেই ইভানও তাল মিলিয়ে বললো–এই ফুলকৌড়ি,তুমি সামনে বসো।আমি আর আনাফ পিছনে বসছি।

কথাটা বলেই দু’জনে গিয়ে পিছনের সিটে বসে দরজা আঁটকে দিলো।সেটা দেখে কৌড়ি কি বলবে কি করবে, বুঝে উঠতে পারলোনা।এখন এখান থেকে চলে যাওয়া মানেই বেয়াদবি।আর বেয়াদবিটা করতে চেয়েও, হয়ে উঠলো না কৌড়ির।বাধ্য হয়ে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লো সে।মূহুর্তেই মাথা ঘুরিয়ে নজর দিলো জানালার বাহিরে।সেটা দেখে মৃদু হেসেই,ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে নিলো নিভান।কৌড়ির পাশের দরজা আঁটকে দিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।পিছন থেকে দুজনকে সুক্ষ নজরে একবার খেয়াল করলো ইভান।ফের আনাফকে উদ্দেশ্য করে বললো–সামনে আমাদের বড় ভাই আর ভাবী বসে আছে।ভুলেও তাদের দিকে নজর দিবি-না।আর তাদের কথাবার্তা-তো কানেই তুলবিনা, কেমন?

জানাসত্ত্বে-ও আনাফ বললো–সামনের মেয়েটাকে ভাইয়া পছন্দ করে?

‘সামনের মেয়েটা মানে কি?বলছিনা বড়ভাবী হয়।বউমনি বলবি।

‘ওকে।বউমনি বলবো।বলোনা ছোটো ভাইয়া,বড়ভাইয়া তাকে পছন্দ করে?

‘হুমম।ভিষন সিরিয়াস।

সেটা কি আর বুঝিনি সে।বড়ো ভাইয়ার কথাবার্তা আচারনে সে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে, মেয়েটাকে নিয়ে বড় ভাইয়া কতোটা সিরিয়াস।সামনে একপলক তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছেলেটা।ফের নিজের কাজে মন দিলো।ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করলো।

কিছুদূর যেতেই কৌড়ির দিকে ফিরলো নিভান।হঠাৎই বললো–কি চাই তোমার?

কানে এলো কথা।কি চাই মানে?বুঝলোনা কৌড়ি।তাই প্রতিত্তোরও করলোনা।সেটা দেখে নিভান বললো—বলছো না যে,কি চাই তোমার?

উফফ,তাকে ঘিরে এই মানুষটার মুখে যেকোনো সম্বোধন বুকে খিল ধরিয়ে দেয় তার।আবারও একই কথা বলতেই, না বুঝেই বাহিরের পানে তাকিয়ে উত্তর দিলো কৌড়ি।—কিচ্ছু চাইনা।

‘আমাকেও না।

চোখ বন্ধ করে নিলো কৌড়ি।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলেও, সেই নিঃশ্বাসের শব্দ পাশের মানুষটা পর্যন্ত আসতে দিলো না।আর না কথার উত্তর দিলো।চুপচাপ বসে রইলো সে।বরাবরের উত্তর পাওয়ার আশা করলোওনা নিভান।কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলো।ফের নিভান বললো।

‘তোমার এবাড়িতে থাকতে মাঝেমধ্যে দম আঁটকে আসে তাই না কৌড়ি?মনেহয় নিজের মতো করে কোথাও গিয়ে থাকতে পারতাম।সেখানের সবকিছু শুধু তোমার হবে। এমনকি তোমার মাঝেমধ্যে বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করে,তাই না?

চকিতে নিভানের দিকে তাকালো কৌড়ি।নির্লিপ্ত মুখাবয়ব।দক্ষ হাতে সামনের দিকে নজর ফেলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ মানুষটার।অথচ তার মনের খবর জেনে বসে আছে।কিভাবে?সে তো ভুলেও কখনো প্রকাশ করেনি মনের কথা।তবে,তার মনের কথা জানলো কি করে মানুষটা!বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হলো।কৌড়ির বুকের ধুকপুকানির তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়ে নিভান ফের বললো।

‘জানো,আমারও ইচ্ছে করে এমনটা।যেখানে আমার বলে সবটা থাকবে।আভিজাত্য বলে কিছু না থাকলেও, সেখানে আমার একটা তুমি থাকবে।আমার তোমার কিছু ইচ্ছে থাকবে।আমাদের ভালোবাসা থাকবে।যে ইচ্ছেগুলো বিসর্জন দিয়েছি,স্বপ্নগুলো হারিয়েছি সেটার আফসোস থাকবেনা।নিজের চারপাশের হাওয়া বাতাসগুলোয় আপন আপন গন্ধ থাকবে।যেখানে প্রান খুলে বাঁচা যায়।সবটা আমার বলে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বলতে পারো।

জ্যামে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো।গাড়ি থামিয়ে গা এলিয়ে দিলো সিটে নিভান।তখনো কৌড়ি থমকে নিভানের পানে তাকিয়ে।ভয় সংকোচ তো এই মানুষটার তারপ্রতি সাবলীল আচারনে কবেই দূরীভূত হয়ে গেছে।সেখানে এসে এখন ভীড় জমিয়েছে অন্য অনুভূতিরা।নিভান অদ্ভুত মায়ামায়া নজরপ তাকালো কৌড়ির পানে।সে চোখে নজর পড়তেই,বুকের ভিতর কেমন কেমন করে উঠলো কৌড়ির।তবে কেনো জানি নজর সরাতে পারল না।অদ্ভুত মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো।সেই মোহগ্রস্ত নজরের পানে তাকিয়ে নিভান ফের বললো।

‘এই কৌড়ি চলোনা আমাদের দু’জনের একটা সেরকম সংসার বানিয়ে ফেলি।যেখানে আমাদের ইচ্ছেগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক।আমি আর তুমি থেকে শুধুমাত্র আমরা হয়ে যাই।যেখানে আমরা একেঅপরের নিঃশ্বাস হই,ভরসা হই,বিশ্বাস হয়ে বেঁচে থাকি।দিনশেষে শুধুমাত্র আমরা আমাদের হয়ে থাকি।

গাড়ির হর্নে মোহ কাটলো কৌড়ির।জ্যাম ছেড়েছে।এবারও পাশে বসা নারীটি থেকে উত্তর নেওয়ার আশা করলোনা নিভান।গাড়ি ছাড়লো।দু’জনের আর কথা হলোনা।শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি পার্কিং করতেই পিচন থেকে ইভান আর আনাফ নেমে পড়লো।সেটা দেখে নিভান বললো।

‘তোরা চল,আমরা আসছি।

আজ্ঞা পেতেই দু’জনে মলের ভিতরের দিকে চলে গেলো।কৌড়ি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো’না।কৌড়ির পাশের দরজা খুলে দিতেই নেমে পড়লো সে।নিভানও বামলো।গাড়ী লক করে,শপিংমলের ভিতরের দিকে এগোলো।কৌড়িও তাকে অনুসরন করলো।শপিংমলের দোতলায় উঠার জন্য চলন্ত সিড়ির কাছে যেতেই,অনুমতিবিহীন কৌড়ির হাত ধরলো সে।আশেপাশে তাকিয়ে কৌড়ি আর কিছু বলতে পারলো না।দোতালায় উঠতেই জামাকাপড়ের ভরিভরি দোকান।মান্যতাদের কাছে না গিয়ে,সেখানের একটা নির্দিষ্ট দোকানে ঢুকলো।আভিজাত্যপূর্ন দোকানটায় সম্পূর্ণ দোকনটা শীতের বস্ত্রে পরিপূর্ণ।এখানে এলো কেনো মানুষটা?মনেমনে প্রশ্নের মাঝেই নিভানের গলা শুনতে পেলো দোকানির সাথে।

‘ভাই,শাল দেখানতো।বেশি দেখানোর প্রয়োজন নেই।দুই একটা দেখাবেন,যেনো বেশি ঘাটাঘাটি না লাগে।নজরে লেগে যায়।

দোকানি মূহুর্তেই ওপরের দিক থেকে তিনটে শাল বের করলো।চাদরের কারুকার্য আর গায়ের সিলমোহর বলে দিচ্ছে।একনম্বর ইন্ডিয়ান কাশমেরী শাল।দামও চড়া।তিনটে শালের মধ্যে কালোর উপরে কোলো সুতোর মিশিলে কাজ করা একটা চাদর পছন্দ করলো নিভান।দাম দরাদরি করলোনা।দোকানী দম বলতেই পেমেন্ট করে দিলো।দোকানী শালটা প্যাকেটিং করে দিতেই নিভান বললো।

‘প্যাকাটিং করা লাগবেনা।আমার কাছে দিন।

শালটা হাতে পেতেই পাশে দাঁড়ানো কৌড়ির গায়ে জড়িয়ে দিলো নিভান।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।এটা তার জন্য কিনেছে মানুষটা!কিন্তু কেনো?হালকা শীতশীত ভাব পড়েছে।বাহিরে বের হতেই সেটা তীব্র অনুভব করলেও, প্রকাশ করেনি।অথচ পাশে থাকা মানুষটা ঠিকই বুঝে নিয়েছে।নিচু গলায় কৌড়ি বললো।

‘শালটা প্রয়োজন ছিলো-না।অযথা কিনলেন।

চলতি পথে উত্তর দিলো নিভান–তোমার কাছে অযথা মনে হতে পারে আমার কাছে নয়।আর ঠান্ডাভাব পড়েছে জেনে-ও কেনো কোনোকিছু গায়ে জড়িয়ে আসলে-না।তবে শালটা অপ্রয়োজনীয় মানুষটার থেকে জড়িয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়তো-না।

মুখ ছোটো হয়ে গেলো কৌড়ির।সময় দিয়েছিলো ইভান ভাইয়া তাকে।বাসায় পরা ড্রেস পরেই চলে এসেছে,শুধু আলাদাভাবে হিজাবটা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায়।আর কিছু নেওয়ার সময় পেয়েছে কোথায়?অথচ মানুষটা এমন করে বলছে যেনো,সে ইচ্ছে করে এভাবে এসেছে।ঠান্ডাভাব তারও লাগছে,তাই বলে কি চাদর কিনে দিতে বলেছে সে?আর কিনে দিয়ে কথাও শোনাচ্ছে!আর কখন বলেছে,তিনি অপ্রয়োজনীয় মানুষ।ধীর অথচ কাঠখোট্টা গলায় কৌড়ি বললো

‘আমার অনুমতি ছাড়া আর কোনোকিছু আমাকে কিনে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করবেন না।আমি চাই না সেটা।

চলবে…..
___আপনারা হয়তো জানেননা,আমি কতোটা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে ডিসেম্বর মাসটা পার করেছি।নানুর মৃতু সংবাদ শুনে ডিসেম্বরের তিন তারিখ আমি বাড়িতে এসেছি।সেই সপ্তাহ পার হতে পারলোনা, ভাইয়ের মারাত্মক এক্সিডেন্ট।সবমিলিয়ে যেই একটু স্বস্তি পেলাম,দাদু অসুস্থ হয়ে পড়লো।তিনদিন নিঃশ্বাস চলা ছাড়া,সবকিছু বন্ধ। দাদুর সাত ছেলে,চার মেয়ে।কর্মসুত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের বাসস্থান। দাদুর অসুস্থতার খবর শুনে মোটামুটি সবাই হাজির। সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে লেখাটা আমার হয়ে উঠেনি।সত্যি বলতে মানসিকভাবে পেরে উঠেনি আমি।দাদু এখন মোটামুটি সুস্থ।তবে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কখন আল্লাহ ডাক দেন কে জানে।তবে কর্মক্ষেত্র তো আর পরিস্থিতি মানবেনা।আরর মানলেও কতোদিন!তাই যার যার কর্মক্ষেত্রে সবাইকে ফিরতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাড়ি থেকে যাবার প্রস্তুতি নিবো,এমন সময় গত মঙ্গলবার বড়মামা নিজ বাইক এক্সিডেন্ট করলেন।কি এজটা অবস্থা, সবাইকে যে কিকরে বোঝাই।একমাস তিনদিন আমি বাড়িতে।নানুর মৃত্যুর পর একের পর এক দুর্ঘটনা।আমি কিভাবে যে লিখছি, আল্লাহ জানেন।যাই হোক গল্প দেরিতে দেওয়ার জন্য মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন।আর গল্প পড়ে মন খুলে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here