#ফুলকৌড়ি
(৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সকাল থেকেই মায়ের পিছনে ঘ্যান-ঘ্যান করে চলেছে মান্যতা।শরৎকাল শুরু হতে না হতেই তার সব বান্ধবীগুলো,কি সুন্দর লাল পাড়ের সাদা শাড়ী পরে সেজেগুজে কাশফুলের রাজ্য থেকে ঘুরে এসেছে।ফেসবুকে কতো সুন্দর সুন্দর পিক আপলোড করেছে।আর দুটো ’মাস নিয়ে এক একটা ঋতু, অথচ শরৎ এর একমাস পার হয়ে গেলো।সে এখনো যেতে পারলো-না।পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র কাশফুলের নরম পাপড়িগুলো কে ছুঁয়ে দেখতে পারলো-না।ভাল্লাগে না।নীহারিকা বেগম দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন।মেয়ের এমন ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন।এতোবড় মেয়ে এরকম কানের পাশে অযথা প্যানপ্যানানি করলে কার ভালো লাগে।ভার্সিটিতে যাওয়া বাদ দিয়ে,এখন তিনি কাশফুলের রাজ্য হারিয়ে যাওয়ার বাহানা জুড়েছেন।
‘এই তোদের ভার্সিটির পশ্চিম এরিয়াজুড়ে না কাশফুলের আগান-বাগান।তবে সেই জিনিসটা আবার আলাদা করে অন্যত্র দেখতে যাওয়ার মানেটা কি?
‘মা,আমাদের বাড়িটাতো জমিদার বাড়ি থেকে কোনো অংশে কম নয়,তবে আলাদা করে দিয়াবাড়ি,রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি এগুলো দেখতে যাওয়ার দরকারটা কি? ব্যাপার তেমনই।জানো না, গোয়ালের দোরগোড়ায় ঘাষ গরুর মুখে রোচে না।
‘তা যা বলেছিস!খুব ভালো জিনিসের সাথে নিজের তুলনা করেছিস।নাহলে তোকে বোঝাতে এতো কাঠখড় পোড়ানো লাগে।
সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বললেও,কথার মধ্যে যে তাকে নিয়ে কঠিন অবজ্ঞা করা হলো।বেশ বুঝলো মান্যতা।নাকে কেঁদে জোরেশোরে মা’কে ডেকে উঠলো সে।
‘আম্মু।
নীহারিকা বেগম সে ডাকে গুরুত্ব দিলেন না। মান্যতা ফের বললো।
‘আমি কিন্তু আমার বান্ধবীদের সাথে যেতে পারতাম কিন্তু সেটা আব্বু শুনলে মনোক্ষুণ্ণ হতো।আর বড়ো- দাদাভাই জানলে রাগারাগি করতো।যা আমিও চাইনা।তাই বলে এসব বলবে তুমি?
‘বড় হয়েছো বলে এখনো এতোবড় হয়ে যাওনি,যে বাবা মায়ে’র অনুমতি ছাড়া বাঁধনহারা পাখির মতো উড়ে বেড়াবে।আর এবাড়ির মেয়েদের যে সেভাবে চলতে দেওয়া হয়নি,এটা তুমি-ও খুব ভালোভাবে জানো।
হঠাৎ মায়ের কন্ঠ গম্ভীর হয়ে যাওয়ার, নিজের বলাকে সংযাত করলো মান্যতা। ফের মিনমিনে গলায় বললো।
‘এজন্যতো তোমার অনুমতি চাইছি।তুমি, বাবাকে আর দাদাভাইকে বুঝিয়ে বলবে।অবশ্যই শুধু দাদাভাইকে বুঝিয়ে বললে হবে,দাদাভাই যেটাতে সম্মতি দেয়।সেই সিদ্ধান্তে তো বাবা আর কখনো অমত পোষন করেননা।
ও আম্মু?
এবার মান্যতার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন নীহারিকা বেগম।বিরক্তি স্বরে বললেন।
‘যাবি ভালো কথা।তবে বাড়ির গাড়িতে করে।আর ভুলেও সাথে রানীকে না নিয়ে যাওয়ার বাহানা একটুও করবিনা।তবেই যেতে পারবি।
‘আমি তো একা যাবোনা সাথে দীবা আপুও যাবে। তবে রানীসাহেবাকে আবার কি দরকার?
‘রানীসাহেবাকে কি দরকার মানে?ও গেলে সমস্যা কোথায়?ওর বুঝি ঘুরতে মন চায়না।আর ওকে তোদের সাথে কোথাও পাঠালে আমি একটু স্বস্তিতে থাকতে পারি।যদি-ও সব আল্লাহ ভরসা।সন্তানদের নিয়ে বাবা মায়ের কতো দুশ্চিন্তা, জ্বালা ও তোরা কি বুঝবি।বিয়ে হোক,সন্তান জন্ম দে তারপর বুঝবি।মা কোনো অযথা অকারণে সন্তানের নিয়ে চিন্তা করে,বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের নিয়ে।একই পেটে লালিত হওয়া কোন সন্তানকে ছোটোবড় কেমন চোখে দেখে,আর কাকে কম-বেশি কতোটা ভালোবাসে।আর তাদের নিয়ে ভালোমন্দ কতো চিন্তা ভাবনা মায়ের।সময় হলে ঠিকই বুঝবি।
মান্যতা জানে,শেষের এমন কথাগুলো মা এতোটা আক্রোশ নিয়ে কিসের জন্য তাকে শোনালো।ছোটো দাদাভাই যে সবসময় বাবা মায়ের মুখের উপর বলে দেয়,বড়দাদা ভাইকে বাবা মা বরাবরই বেশি প্রায়োরিটি দেয়,বেশি ভালোবাসে।সেজন্য আম্মু মাঝেমধ্যে এরকম কথা তাকে উদ্দেশ্য করে শুনিয়ে থাকেন।মান্যতা মায়ের মন খারাপটা বুঝে নরম গলায় বললো।
‘আচ্ছা রানিসাহেবাকে নিয়ে যাবো।তবুও এরকম দুঃখী দুঃখী কথা বলবেনা তো।ও আম্মু, তুমি আর ছোটমা-ও যাবে নাকি আমাদের সাথে ঘুরতে?
অদ্ভুত নজরে মেয়ের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।
ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে, তা দেখে জোর করে মুখে হাসি টেনে কেটে পড়লো মান্যতা।তাকে রান্নাঘর ত্যাগ করতে দেখে নীহারিকা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন।–তোদের সাথে কৌড়িকেও নিয়ে যাস।মেয়েটা সারাদিন মন খারাপ করে রুমে বসে থাকে।কারও ডাকে ছাড়া সহজে রুম থেকে বের হয়না।ও-কে ও সাথে করে নিয়ে যাস।বাহিরে একটু ঘোরাঘুরি করলে মেয়েটার মনটা একটু ভালো হবে।
কৌড়িকে এমনিতেই নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার প্লান ছিলো মান্যতার।মা বলতেই সেটা শিরোধার্য হয়ে গেল।
.
শরৎ ঋতুর পরিপূর্ণ সৌন্দর্যতার বিবরণ মনেহয় এক কাশফুলেই বহন করে।পৃথিবীতে নানাধরণের নজরকাঁড়া অপরূপ সৌন্দর্যময় ফুল আছে।তবে যে কারও মন কেড়ে নিতে মনেহয় শরৎ ঋতুতে ফোটানো কাশফুলের জুড়ি নেই।কাশফুল মানে অবাধ অপরূপ সৌন্দর্য।স্নিগ্ধ ভরপুর সাজানো একটা বিকেল।সেই স্নিগ্ধতায় ভরপুর বিকালটা কাশফুলের দুলে দুলে বয়ে যাওয়া অবাধ সৌন্দর্যে মন আরও সতেজতায় ভরিয়ে তুলছে।বিস্তৃত নীল আকাশটা যদিও মৃদুতর ছড়াছড়া কালো মেঘমন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বৃষ্টি আসবে কি-না কারও জানা নেই।তবুও চারপাশের পরিবেশটা নজর মন আবেশিত করে দেওয়ার মতোই স্নিগ্ধকর।নতুন নববধূবেশে থাকা বউয়ের রূপের মতো নজরকাঁড়া,মনোমুগ্ধকর।
উত্তরার দিয়াবাড়ির কাশফুল বাগানের পিচঢালা পথের প্রান্তরে ,পকেটে হাত গুঁজে হেঁটে চলেছে নিভান।পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তৃনয়।দায়িত্ব আর কাজ পাগল ছেলেটার কাজ থাকা সত্ত্বেও, এখানে একপ্রকার জোর করে নিয়ে এসেছে সে।প্রথম একটু রাগারাগি করলেও, শরতের এই মনোমুগ্ধকর বিকাল দেখে তার বন্ধু রূপে ছেলেটার রাগ পড়েছে মনেহয়।শ্যামবর্ণ মুখের শান্ত অবয়বটা দেখেতো অন্তত তাই মনেহচ্ছে।এতো সময় চুপচাপ দু’জনে হাটলেও এবার মুখ খুললো তৃনয়।
‘স্কলারশিপ পেয়েও নিজের স্বপ্নপূরণে পিছু হাটলি,বি সি এসটা তো অন্তত দিতে পারতিস?এখানে কিন্তু আঙ্কেলের দোষ দেওয়া যায় না।স্কলারশিপ পেয়ে তখন পরিস্থিতির খাতিরে আঙ্কেলকে সাপোর্ট দিতে বাহিরে যেতে পারিসনি, ঠিক আছে।কিন্ত যখন পরিস্থিতি ঠিকঠাক হলো তখনতো আঙ্কেল সাপোর্ট দিয়েছিলো তোকে।পিছুপা হলি কেনো?
সব জায়গায় নিজের আবেগ অনুভূতি দৃঢ়চিত্তে চেপে রাখার চেষ্টা করলেও,দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন একজায়গায় হয়।দু’জনে মন খুলে কথা বলার চেষ্টা করে।যদি-ও নিভান কমই বলে।বিকেলের হিমেল হাওয়ায় সাদা কাশফুলের ভেলাগুলো দুলেদুলে চলছে।সেদিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে নজর দিলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তরসরূপ কিছু সময় তাকে অপেক্ষা করালো।ফের বললো।
‘উনাকে ওই অবস্থায় রেখে,আমি নিজের স্বপ্নপূরণের কথা ভাবিনি।কারন আমার বিবেক ঋনি ছিলো উনার কাছে।সেটা শোধ করবার পালা এসেছিলো তখন।আর পরিস্থিতি ঠিক হলে পরবর্তীতে যাওয়ার কথা বলছিস, আমি,জে এস জে ইন্ডাস্ট্রির কর্নধরের চেয়ারে বসে সমস্ত কিছু পরিচালনা করলেও,সেখানের কোনো কিছুর দাবিদার,হকদার বলে নিজেকে মানিনা।আমি যা হতে চেয়েছিলাম,সেটা শুধুমাত্র নিজের মেধা আর চেষ্টাতে।সেখানে যখন বাঁধা পড়েছে, ইনাফ।আর বি সি এস।প্রিপেইড হয়েছিলাম,চেয়েছিলাম পরিক্ষা দেবো।কিন্তু সেভাবে সময়টা আর পেলাম কোথায়।উনি আর মা-ও নিষেধ করলেন।
নিভানের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে মোটামুটি জানা তৃনয়ের,তাই আর ঘাটালো না সে।তবে ছেলেটার এই সারাদিনের ব্যস্ত লাইফ,দায়িত্ব, কাজ।সবকিছু ভালো লাগলেও,নিভানের এই অতি নিস্পৃহতা ভালো লাগেনা তৃনয়ের।কলেজ লাইফ থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড তারা,তৃনয়ের আগে নিভানের কোনো বেস্টফ্রেন্ড ছিলো বলে জানা নেই।শান্ত গম্ভীর ছেলেটার ভার্সিটি লাইফে এসে কিছু সংখ্যক বন্ধু হলেও,কলেজ লাইফ থেকে একমাত্র বন্ধু ছিলো তৃনয়।গম্ভীর ছেলেটার সাথে ফ্যামিলি, আর্থিক, সবদিক থেকে বেশ তফাৎ থাকলেও,কিভাবে কিকরে জেনো খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তারা।মায়া আর অদ্ভুত এক টানের সম্পর্ক তৈরী হলো।সেখান থেকেই নির্দ্বিধায় একে অপরের ভালো মন্দটা জানা,বোঝা।
‘তুই ভুল ধারনা পোষন করে আছিস।আঙ্কেলের নজরে তুই তার বড় সন্তান।মান্যতা, ইভান,সবার মতো সবকিছু পাওয়ার,সব অধিকারের যোগ্য সন্তান হিসাবে তোকে তিনি সেই সম্মাননাটা দিয়ে আসছেন তুই।তারপর উনার সবকিছু তোর কিছুই নয়,এটা কেনো ভাবিস। যে প্রায়োরিটিটা উনি তোকে দেয়,সেখান থেকে তোর মুখে উনি শব্দটা আমার তাই ভালো লাগে-না।সেখানে উনার কেমন লাগার কথা তোর আমার সবার জানা কথা।তবুও তিনি কিন্তু উনার সবকিছুর যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করে উনার ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত পরিচালনার ভার তোর হাতে তুলে দিয়েছেন।তোর ভালোমন্দ যেকোনো সিদ্ধান্তঃ বিনাবাক্যবয়ে মেনে নেন।তারপর ও তোর মনে হয়ে তুই উনার কিছুই না?
এই প্রথম নয় এর আগেও এমন বিভিন্ন কথা বুঝদার কথা দ্বারা ছেলেটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তৃনয়।কিন্তু যে বুঝদার তাকে কি অন্য কেউ শত বুঝিয়েও বুঝদারের কিনারার সন্ধান দিতে পারে।তৃনয়ের ভাবনার মাঝে নিভান দৃঢ় গলায় বললো।
‘আমি জানিনা, আমার সবসময় কেনো মনেহয় আমি ওবাড়ির কেউ না।শুধু মা আছে বলে তাই মনেহয় ওবাড়িতে থাকা।
‘এসব কেমন কথা নিভান।ইভান মান্যতা তোর ভাইবোন।ছোট থাকতে ইভান যা করেছে করেছে,এখন কিন্তু তোকে মানেও।যদি-ও সেটা ওর হাবভাবে বুঝতে দেয়না।আর মান্যতা,আঙ্কেলের মতো সে-ও তার দাদাভাইয়ের সমস্ত সিদ্ধান্ত চোখ বুঁজে মেনে নেয়।তবুও তুই এরকমটা কি করে বলতে পারিস?শুধু গুটিকয়েক মানুষের জন্য,তোর কাছের মানুষের অনুভূতি গুলো এভাবে ইগ্নোর করতে পারিস না।
নিভান উত্তর দিলোনা।দৃঢ় চোয়ালে সামনের দিকে এগিয়ে চললো সে।হয়তো তৃনয়ের কথাই ঠিক,সম্পর্কে এতো কঠোরতা ঠিক নয়।নিজেকেও বা এতো ছোটো করে দেখা ঠিক নয়,যেখানে সবাই তাকে মাথায় তুলে রেখেছে।ভাবনা সেদিকে আর এগোলোনা।না চাইতেও গম্ভীর মুখাবয়বের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল।প্রসঙ্গ এড়াতে বললো।
‘আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের নামটা কিন্তু তোর হাতের দুধ চিংড়ীর রেসিপি,কলাপাতায় মোড়ানো ইলিশে ভাপা,আর সাধারণ ঘি পোলাওটা কিন্তু বেশ নাম-ডাক করিয়ে দিয়েছে।সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে এই দিনটায় কি পরিমান লোকের সমাগম হয় এই রেসিপি গুলোর জন্য আমাদের রেস্টুরেন্টে।দেখেছিস? যদি-ও আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের সব খাবারের মোটামুটি নামডাক আছে।তবে সিক্রেট শেফের হাতের এই রান্নাগুলো কিন্তু বেশ মজা করেই খায় খাদ্যপ্রিয় মানুষগুলো।
নিভান প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে।বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃনয়।নিভান ফের বললো–যদিও রেসিপিগুলো কমন,তবুও তোর হাতের আলাদা স্পেশালিটি থাকায় রান্নার স্বাদগুলো আলাদা হয়।চেষ্টা তো আমিও করি।তবুও তোর রান্নার মতো স্বাদ আনতে পারিনা কেনো?কার হাতের স্পেশাল রেসিপি এই রান্নাগুলো,আজ আমাকে বলতো?যে হুবুহু তার হাতের গুনটা রপ্ত করেছিস?আন্টির হাতের?
‘যদিও মা রান্নাগুলো জানেন।এবং খুবই সুন্দর রান্না করেন। তবে আমি দাদিমা যেভাবে রান্না করতেন,সেটাই রান্নার সময় বেশি ফলো করি।উনার রান্নার হাতটা দারুন ছিলো।বাবা চাচারা,আমরা ভাইবোনেরা সবাই উনার হাতের রান্না খুবই তুষ্টতার সহিত ভোগ করতাম।
গম্ভীর মুখে এক টুকরো হাসি ফুটলো,সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার মিলিয়ে গেলো।তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ ঘাড় বাকিয়ে শুধু একবার তারদিকে তাকালো নিভান।শীতল গলায় বললো।
‘আমাদের রেস্টুরেন্টেটা যেমন আমরা সাধারণভাবে উপস্থাপন করে,সেখানে নামীদামী নয় অতিসাধারণ সব বাঙালিয়ানা খাবারেরই জোগান দিতে চেয়েছিলাম।সেরকম সাধারণ ভাবে রান্নার মধ্যে অসাধারণ হয় তোর বানানো রেসিপিগুলো।যেটা আমাদের রেস্টুরেন্টেটাকে আরও উন্নতি সাধন করতে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘হয়তো।তবে সু-গৃহিনী হওয়ার কথা ছিলো আমার বউয়ের হয়ে গেলাম আমি।
হেসে দিলো তৃনয়।সেটা দেখে নিজের মুখের হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করলো নিভান।বললো–সুগৃহিনী হওয়া কি শুধু স্ত্রীলোকের দায়িত্ব,নাকি এটা শুধু তাদেরই কর্ম?দেশ বিদেশের ছোটো বড় নামাদামী সব হোটেল রেস্তোরাঁ গুলোতে গিয়ে দেখ,সেখানে বড়বড় ডিগ্রীধারী শেফ-রা,অধিকাংশ পুরুষই।
‘হুম এজন্য তো স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জন করে-ও,নিজের ইচ্ছেপূরনে নেমেছি।যদি-ও চাকরীর জন্য বিভিন্ন ভার্সিটিতে-ও এপ্লাই করছি।একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকেও অফার এসেছে।দেখি করা যায়।
দেশে চাকরীর বড় অভাব।চাইলে তৃনয় বাহিরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যেতো পারতো।তবে আরও একটা কারনে সে ওই সূদুর বিদেশভুইয়ে থাকতে পারিনি।তবে সেটা নিভানের সামনে উহ্য করে বলতে সাহস পায়না,আর না সেই সাহস দেখাতে চায় সে।যদি না এতো বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে যায়?আর যে প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার সাধনায় তার মন আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে,যোগ্যতায় সেই মানুষটাকে মুখ ফুটে চাওয়া যে বড়োই অপরাধ।হঠাৎ নিভানকে থামতে দেখে ভাবনা কাটলো তৃনয়ের।নিভানের কুঞ্চিত নজরের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকাতেই নিজের হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো তার।সেই প্রিয় মুখটা।ফর্সা শরীরে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি জড়ানো, কি স্নিগ্ধ কি সুন্দর দেখাচ্ছে।শরতের কাশফুলে সাজানো বিকালটাও জেনো সেই সৌন্দর্যের কাছে ফিকে মনে হলো।নজর সরিয়ে নিলো তৃনয়।অবাক কন্ঠে শুধালো।
‘মান্যতারা এখানে আসবে তুই জানতিস না?দীবা আর মৌনতাও এসেছে দেখছি।
তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার আগে,প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে উদ্যোক্ত হলো নিভান,মা-কে ফোন দেবে তাই।তার আগে রানীসাহেবাকে গাড়ী থেকে বের হতে দেখে হাত থেমে গেলো,বুঝলো মায়ের অনুমতি নিয়েই বেরিয়েছে তারা।মান্যতারা আসবে সে জানতো না।উত্তরটা দিয়েই পিছে মুড়ে,গাড়ি যেখানে রাখা সেদিকে যাওয়ার জন্য এগোলো। তবে তৃনয়ের কথায় থেমে গেলো,তবে পিছে মুড়লো না।
‘এই নিভান, মান্যতাদের সাথে ওই নতুন মেয়েটা কে-রে?এতো অনিন্দ্য সুন্দরী?
চোখ বন্ধ করতেই,হঠাৎই সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আবারও ভেসে উঠলো নিভানের বদ্ধ অক্ষিপটে।সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেললো সে।ভুলে-ও পিছে মুড়লো-না।তবে নতুন মেয়েটা বলতে কে বুঝতে পারলো। তীক্ষ্ণ গলায় কথার বান ছুড়ে দিলো তৃনয়ের দিকে।
‘অনিন্দ্য সুন্দরীকে নজরে লেগেছে নাকি?
‘আল্লাহুম মাগফিরুলি।এগুলো কি বলিস!আমি-তো, তাকে দেখে এমনিতেই কথাটা বলে ফেললাম।যতো অনিন্দ্য সুন্দরি আমার সামনে দিয়ে যতোই ঘুরে বেড়াক না কেনো,আমার নজর সেখান থেকে কুঞ্চিতও নাড়াতে পারবেনা।
ঘাড় বাঁকিয়ে তৃনয়নের দিকে তাকাতেই,বোকা হেসে দিলো তৃনয়।বললো-ওরা হয়তো আমাদের দেখিনি।তাই বলে আমাদের যাওয়া উচিত নয়,ওদের দিকে?হঠাৎই দেখা যখন হয়ে গিয়েছে, চল কথা বলে আসি।
শীতল চোখে তৃনয়ের দিকে তাকাতেই সে ফের বললো-তুই এরকম হইছিস ক্যান ভাই।এতো অনুভূতি শূন্য।এরকম থাকলে বউ টিকবেনা তোর।
‘নিজেরটা টিকিয়ে দেখাস তারপর আমার কথা ভাবিস।আমারটা টিকবে কি টিকবেনা,সেটা আমি বুঝে নেবো।এখন চল আমার অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে।যেতে হবে।
সামনে এগোলো নিভান।কিন্তু তৃনয়ের পা কিছুতেই সামনে এগোতে চাইলো-না।প্রিয় নারীটাকে শাড়ী পরা অবস্থায় কাছ থেকে একটু দেখতে পেলো-না।কি আফসোস।পিছে ফিরলো আরও একবার।আফসোস জেনো আরও জোরালো হলো।ফের সামনে ফিরে, বিড়বিড় করে নিভানকে বকতে বকতে এগোলো সে।
‘নিজের অনুভূতি তো সব বিসর্জন দিয়েছে, এখন তাকে জুটি বানিয়ে তার গুলোও বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে।
★
বিকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন বাড়িতে বোনদের কাওকে দেখলোনা নাফিম।এমনকি কৌড়িকে-ও না। তখন কেঁদে কেটে স্বান্তনা রহমানকে অস্থির করে তুললো।কেনো বোনেরা তাকে নিয়ে গেলো-না, সন্ধ্যার পরে তারা বাড়িতে ফিরলেই নানা অভিযোগ জুড়লো নাফিম।মৌনতা সেই অভিযোগে একদম গুরুত্ব না দিলেও।দীবা বুঝালো তাকে।কাজ হলো-না।কৌড়ি বুঝালো তবু-ও মুখ ভার করে রইলো,কথা বললো-না তার সাথে।কৌড়ি যেতে চাইনি।মান্যতা একপ্রকার তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো।তাতে আবার শাড়ী পরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো,শেষে কৌড়ি যেতে চাইলেও।শাড়ী আর পরেনি।দীবা আপু আর মান্যতা আপু শাড়ি পরে গেলেও।সে আর মৌনতা সাধারনভাবেই গিয়েছিলো।
চেষ্টা করেও যখন নাফিমের গোমরা মুখের আদল কেউ পাল্টাতে পারলোনা।তখন মান্যতা,নাফিমের কাছে এসে তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো।
‘আচ্ছা ভুল হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি,কিন্তু এখনতো কিছু করার নেই।তবে ভুলের মাশুল হিসাবে আমি সুন্দর একটা অফার দিচ্ছি। কাল তোকে অনেকগুলাে চকলেট কিনে দেবো,আর আজ রাতে তুই ঘুমোনো অব্দি আমার ফোনটা তোরকাছে থাকবে।তুই যতো ইচ্ছে কার্টুন দেখ।
রাগ ভেঙে নাফিম উৎফুল্ল হয়ে বললো।—সত্যি বলছো বড়আপু।
‘তিন সত্যি।
নাফিমকে মানাতে পেরে খুশি হলো মান্যতা। নাফিম- ও খুশিমনে ফোন নিলো।কাল স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি,আর সপ্তাহের এই দু’দিন প্রাইভেট টিচার আসে না তার।এখন সে ইচ্ছেমতো কার্টুন দেখবে,গেইম খেলবে।ড্রয়িংরুমে বসেই ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।স্বান্তনা রহমান খানিক বিড়বিড় করে বকে নিজের রুমে চলে গেলেন।সারা বিকাল থেকে সন্ধ্যা ছেলের বকবকানিতে মাথা ধরেছে উনার।এখন একটু না শুয়ে পড়লে নয়।এরকম যে যার কাজে চলে গেলো।
রাত সাড়ে নয়টা বাজে তখনও নাফিম ড্রয়িংরুমে বসে ফোন দেখছে।স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগম রাতের খাবার সাজাচ্ছেন ডাইনিং টেবিলে।সাথে রানিও এটাওটা এগিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে। এই চারটা মানুষ বাদে নিচে কেউ নেই।বাড়ির কলিং বেলটা বাজতেই রানি সাহেবা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।সেদিকেও হুঁশ নেই নাফিমের।সে এতো সময় ফোনে গেইম খেললেও,এখন মান্যতা গ্যালারি ভরা পিকগুলো দেখতে ব্যস্ত।
হঠাৎ মনেহলো তার পাশে এসে কেউ বসেছে।পাশ ফিরে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।উৎফুল্লতায় ডুবে থাকা মুখটা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেলো।দাদাভাই কখন এসে পাশে বসলো!মা এতো সময় বারবার সাবধান করে যাচ্ছিলো।বলছিলো,তোর দাদাভাই আসার ডময় হয়ে গেছে ফোনটা রাখ।এসে যদি দেখে পড়া বাদ দিয়ে ফোনে গেম খেলছিস,দেখিস!সেই তাই হলো? হঠাৎ বোকার মতো কাজ করে বসলো নাফিম।পরাস্ত সৈনিকের মতো ফোন নামক অস্ত্রটা সসম্মানে নিভানের দিকে বাড়িয়ে দিল।সেটা দেখে কপাল কুঞ্চিত হলো নিভানের।হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই নাফিম দৌড়ে চলে গেলো।আশ্চর্য হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে আনতেই,নাফিমের রেখে যাওয়া ফোনের গ্যালারিতেই নজর স্থির হয়ে গেলো।
হালকা কলাপাতা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটার।ফর্সা সাধাসিধা গোলগাল মুখটা আটকে আছে গাঢ় জলপাই রঙা একটা হিজাবে।সেভাব কিছুতে নজর আটকালো না নিভানের। নজর সোজা গিয়ে আটকালো মান্যতার পাশে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার ডগরডগর কাজল-কালো চোখে।শীতল,স্থির নজরে সেই চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন।নিঃসন্দেহে মায়াবীনি যাদুময়ী দু’টো চোখ।
ফোনটা রাখতে গিয়েও,রাখতে পারলোনা নিভান।মন টানলো।যে জিনিসটা কখনো করা হয়নি,সেটাই করতে বাধ্য করলো নিজের মন।মান্যতার ছবিটা একপাশে ফেলিয়ে কৌড়ির ছবিটা জুম করলো সে।সত্যিই তৃনয়ের ভাষ্যনুযায়ী অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটা।ছবিটা আরও জুম করতেই,কৌড়ির মোটামোটা চোখজোড়া স্কিনের উপরে আরও বড় হয়ে ধরা দিলো।কাছ থেকে সেই যাদুময়ী মায়াবিনী ডগরডগর চোখজোড়া,গভীর আর নিস্প্রভ নজরে দেখলো নিভান।হঠাৎই ফোনটা সোফার একপাশে রেখে দিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।আশেপাশে ভুলেও নজর না দিয়ে গটাগট সিঁড়ি পথ ধরলো।রুমের মধ্যে গিয়ে বাহিরের পোশাক ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করতেই,সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া ভেসে উঠলো বন্ধ অক্ষিপটে।চোখ খুলে ওয়াশরুমের আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে নজর দিলো নিভান।মনেমনে বিড়বিড়ালো।
‘নারী তুমি সত্যিই ছলনাময়ী।আর তোমার কঠিন ছলনা হলো,চোখের নোনাঅশ্রুদ্বারা পুরুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করা।
চলবে….
নেক্সট তো আমি দেরিতে হলেও এমনিতেই দেনো।তাই আপনারা নেক্সট নাইস না লিখে,গল্পটা সম্পর্কে একটু আধটু মন্তব্য করবে।