ফুলকৌড়ি (২২)কপি করা নিষিদ্ধ #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
368

#ফুলকৌড়ি
(২২)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সেদিন ঝড়বর্ষনের রাত থেকে আজ ক’টা দিন ইভানকে বেশ ব্যস্ত দেখাচ্ছে।দিনরাতের অধিক সময়টা তাকে বাহিরের ব্যস্ততায় কাটাতে দেখে,নীহারিকা বেগম একটু চিন্তিত হলেন।সবসময় দুষ্টুমির ছলে মজে থাকা ছেলেটাকে হঠাৎ ক’দিন ধরে উদ্বিগ্ন দেখায়।ব্যাপারটা উনার চোখে লেগেছে।কি হয়েছে ছেলেটার?সবার সাথে ছেলেটা মনখোলা হলেও,নিজের বিষয়ে বেশ চাপা স্বভাবের।স্বভাবটা আগে ছিলো না, হঠাৎই পরিবর্তিত হয়েছে।সকালে খাবার টেবিলে ইভানকে পেতেই তিনি খাবার দিতেই, জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ কদিন ধরে তোকে চোখের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না।ব্যাপার কি বলতো?ঝড়বৃষ্টি বলেও কোনো বাঁধা বিঘ্নতা নেই,বাড়িতেই থাকছিস না।কোথায় ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছিস?সত্যি করে বলতো,ঠিক কি হয়েছে তোর?

একগাল হেসে দিলো ইভান,সেই হাসিটা কোনো কারনে যেনো উদাসীন দেখালো।যেটা নীহারিকা বেগমের মোটে-ও ভালো লাগলো না।সেই ভালো না লাগাতে আর-ও একটু ঘি ঢালার মতো কাজ করলো ইভানের কথাগুলো—আমাকে সন্দেহ করছো?যে আমি অলস মস্তিষ্কে থেকে থেকে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে সঙ্গ দোষী হয়ে যাচ্ছি কি-না?আমি তোমার বড় ছেলের মতো খুব ভালো নাহলে-ও একবারে মন্দ নই।আমাকে ওরকম সন্দেহ না করতে পারো।পুরোটা নাহলে-ও তোমার ছেলেতো একটু বিশ্বাস রাখতে পারো।

তরকারির বাটিতে চামচটা একটু জোরে শব্দ করে রাখলেন নীহারিকা বেগম।ফের রাগান্বিত স্বরে বললেন- ‘এই আমি কখন তোকে ওরকম ছেলেদের সাথে মেশার ইঙ্গিত দিলাম।আজ কয়দিন সেভাবে বাড়িতে দেখছিনা তাই জিজ্ঞেস করলাম কোথায়’কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস! আর তুই কেনো ও-কে নিয়ে সবসময় সকল কথার মধ্যে ঢুকিয়ে এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলিস?তোর এটা কেনো মনেহয়,আমি শুধু নিভানকে বিশ্বাস করি ভরসা করি,ভালোবাসী,আদর করি, তোকে নয়।কেনো মনেহয় বল?এই তোদের মা আমি।একই পেটে লালিত-পালিত করে জন্ম দিয়েছি।আমি কিকরে তোদেরকে আলাদা আলাদা ভাবতে পারি! তোদের সবাইকে যে সমান ভালোবাসী,এটা কেনো বুঝিস না তোরা!কেনো মনে হয়না তোদের।কেনো মনে হয়না বল?কিজন্য মনেহয় ও-কে আমি বেশি ভালোবাসী,আর তোদেরকে কম।তবে কি এবাড়িতে পা রাখার আগে,সত্যিই কি ও-কে আমার ওবাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিলো?

‘মা।

চেচিয়ে উঠলো ইভান।মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়ের মুখের দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো কিয়ৎদক্ষন।আজ হঠাৎ মায়ের কি হলো?যে তার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো।আশ্চর্য!মা তো কখনো এরকম সিরিয়াসলি নেয়না।তবে?তবে কি ফুপুমনি আবার উল্টাে পাল্টা কোনো কথা শুনিয়েছে?নিশ্চয় তাই হবে।তা নাহলে মা এতোটা সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার কথা না।হয়ে যেতোও না।মায়ের আরও কাছাকাছি হলো ইভান।মমতভরা ছলছল চোখদুটো দিকে নজর দিতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো ইভানের।মা কষ্ট পেয়েছে!কিন্তু সে তো মা’কে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেনি।
দ্বিধাহীন হাতদুটো মায়ের কোমল মুখের দু-চোয়ালে রেখে আজলে নিলো ইভান।সহসা কেঁপে উঠলেন নীহারিকা বেগম।ইভানের এতো কোমল আচরনের সাথে তিনি পরিচিত নন।যদিও ছেলেটা সহসা উনার সাথে কখনো খারাপ আচারন করেনা। তিনি মনেমনে একটু বিচলিত হলেন।তবে মুখায়বে প্রকাশ করলেন না।মায়ের রাগান্বিত মুখ মিইয়ে মায়ামায়া করে চাওয়া নজরের দিকে তাকিয়ে বললো।

‘এতোটা রেগে যাচ্ছো কেনো,মা?আমি তো সিরিয়াসলি কথাগুলো বলিনি।তুমিতো খুবভালো করে জানো,আমি দাদাভাইকে ঠিক কি পরিমাণ ভালোবাসি।এটা নিশ্চয় বলে,চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তোমাকে বোঝাতে হবেনা।তবে কেনো এসব আবোলতাবোল কথা বলে চলেছো মা!তুমি জানো না,পৃথিবীর সবাই এসব বিষয়ে উল্টোপাল্টা কথা বললে আমি সহ্য করতে পারলেও, তুমি বললে আমি সহ্য করতে পারি-না।আমার ভিষন কষ্ট হয়।খারাপ লাগে.. মা।তুমি যেমন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করো,ভাবো।তোমার পেটেধরা সব সন্তানেরা তোমার কাছে সমান,কেউ উঁচুনিচু না।তেমন আমি-ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি,ভাবি।আমার মায়ের পেটে লালিতপালিত হয়ে জন্ম নেওয়া,আমরা ভাইবোনেরা।কেউ আলাদা নই।প্রতিজন মায়েরই একেকটা অংশবিশেষ।মায়ের সন্তান।সেখানে তফাৎ বলে কিচ্ছু নেই।তবে তুমি আমাকে জেনেশুনে কিকরে একথা গুলো মুখে আনতে পারলে?সত্যি তুমি আমাকে দাদাভাইয়ের মতো ভালোবাসো না কমই ভালোবাসাে।না হলে দাদাভাইয়ের সামনে এই কথাগুলো বলার ক্ষমতা ছিলো তোমার?

ইভানের অভিমানী কথায় মমতাময়ী মন আর-ও গলে পড়লো।রাগান্বিত খোলসটা ছেড়ে এবার তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন।

‘তবে কেনো উল্টো পাল্টা বলে আমাকে রাগিয়ে দিস?কোথায় যাস,কেনো যাস।আমাকে কেনো বলে যাস-না।
আমি মা না তোদের?তবে কেনো নিজের ভালোমন্দ তোরা মাকে একটু জানাতে পারিস না।কেনো এই বয়সে এসেও অন্যের কাছে আমাকে শুনতে হয়,আমি আমার নিজের পেটের ছেলেমেয়েদের একই নজরে দেখিনা।কে কখন বিপদ আপদ মাথায় নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।খেয়াল রাখিনা।শুধু স্বার্থপরের মতো পরের বাড়ী থেকে নিয়ে আসা ছেলেটার প্রতি ভালোমন্দ নজর দেই,খবর রাখি।এসব কেনো শুনতে হয় আমাকে বল?

‘কেউ তোমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে উস্কানোর চেষ্টা করলো আর তুমিও বাচ্চা মেয়েদের মতো অভিমানী হয়ে আবোলতাবোল বলতে শুরু করলে।তবে তুমি-তো দেখি নাফিমের চেয়ে বাচ্চা হয়ে গেলে।তুমি অল্পস্বল্প নয়,উপযুক্ত বিবাহিত বয়স্ক তিন ছেলেমেয়ের মা।এখনকার যুগের ছেলেরা যেসব বয়সে বিয়ে করছে,
তোমার বড় ছেলেকে সেই বয়সে বিয়ে দিলে,এতোদিনে নাতী নানতীর বিয়েটাও তুমি খেতে পারতে।সেই তুমি বাচ্চা মেয়েদের মতো কান্ডকারখানা করছো?

কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের সম্মুখ থেকে সরে গিয়ে ফের চেয়ারে বসলো ইভান।নীহারিকা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।এই ছেলের জীবনে সিরিয়াস বিষয় বলে হয়তো কিছুই নেই।কখনো কোনো কিছু যেন
সিরিয়াসলি নিতেই পারেনা।পারেনা কি!নিতে চায়ই-না!নাহলে সিরিয়াস জিনিসটাকে মূহুর্তেই কচুরিপানার মতো ভাসিয়ে দিয়ে বিষয়টা কোনো ব্যাপার না টাইপ গাছাড়া ভাবটা নেয় কিকরে!এই দেখো আবার শুরু করে দিয়েছে।আর নড়েচড়ে সেই নিভানের পিছু লাগা।যদি-ও তিনিও বাচ্চামো করে ফেলেছেন।তবে ধৈর্য্য তো আর মানুষের সবসময় এক রকম থাকেনা।শুনতে শুনতে তিনিও অধৈর্য্য হয়ে পড়েছেন।আর গতকাল তো ইভানের এই বিষয়টা নিয়ে কতোকিছু শোনালেন উনাকে।এটাও শোনাতে বাদ রাখলেন না।-পরের বাড়ির ছেলে সব দখল করে নিয়ে বসে আছে অথচ নিজেদের বাড়ির ছেলের খোঁজ নেই।থাকবে কিকরে!যে মা নিজ সন্তানদের মধ্যে দুইদুই নজরে দেখে,তার কি আর খোঁজ রেখে লাভ আছে।

কালও ধৈর্য্য নিয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন।কিছু বলেন নি।আজও ইভানকে এসব কথাগুলো বলতেন-না।তবে কেনো জানেননা ধৈর্যচ্যুত হয়ে গেলেন।আর সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যবান থেকে কথাগুলো বেরই হয়ে গেলো।

‘কি হলো।খেতে দেবে-না নাকি?নাকি আবার-ও বড়ো ছেলের ভবিষ্যৎ ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবতে বসলে।

ইভানের পিঠে জোরে একখান চাপড় মারলেন তিনি।ফের মিছেমিছে রাগ দেখিয়ে বললেন-*আবারও শুরু করে দিয়েছিস?নড়েচড়ে তোর ওর পিছু লাগতে এতো ভালো লাগে কেনো?বলতো একটু?

‘কারনটা হলো,তোমার বড়ো ছেলে প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া তাই।আর পিছু লেগেও কি,তাতে তার কোনো হেলদোল আছে!কাজ হয়!কার-ও কথা যেনো তার কানে ঢোকেই না!তাই তাকে তো বলতে পারিনা,তোমাকে বলে নিজের সাধ পূর্ণ করি।বুঝেছো,নিভান ইভানের মা।এবার খেতে দাও।কাজ আছে,যেতে হবে।

ইভানের বলার ভঙ্গিমা দেখে নীহারিকা বেগম সন্দিহান গলায় শুধালেন।–কি কাজ আছে?

‘তোমার বউমাকে উদ্ধার করা।

‘মানেটা কি?বউমা?

‘মা খেতে দাওনা।প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। ওসব মানে-টানে পরে উদ্ধার করো।আগে তোমার ক্ষুধার্ত ছেলের পেট উদ্ধার করো।

নীহারিকা বেগম আর দাড়ালেন না।রান্নাঘরে দিকে এগোলেন ছেলের জন্য খাবার আনতে।টেবিলের খাবার আপতত শেষ।সবাই খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেছে।ইভান এসেছে দেরীতে।নীহারিকা বেগম চলে যেতেই সেখানে হাজির হলো কৌড়ি।কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই বেরিয়েছে সে। নীহারিকা বেগমকে বলেই বের হবে বলে ডাইনিংয়ের দিকে আসতেই দেখলো ইভান বসা।কিন্তু চুপচাপ।মনেহয় গভীর কিছু নিয়ে চিন্তিত ভাবান্নিত।না হলে তাকে দেখে চুপ থাকার বান্দা তো নয় সে।তাই আজ নিজে থেকে খুঁচিয়ে কথা বললো।

‘কি ব্যাপার বলুন তো?কার বউ ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন বসেবসে?

মনের কথা যেনো পড়ে নিলো কৌড়ি।ভিতরে ভিতরে একটু চমকালো ইভান।ফের বললো—-নিজের বউকে, কিকরে অন্যের হাত থেকে ভাগিয়ে নিজের কাছে আনা যায় সেই প্লানিং করছি।

‘আপনার মতো ইতুড় মানুষেরও গার্লফ্রেন্ড আছে?

‘না-তো।আমার মতো ইতুড় মানুষের গার্লফ্রেন্ড টেকে, তুমি বলো?তবে তিন কবুল না বলা একটা বউ আছে।সেই না কবুল বলা বউটাকে অন্যের থেকে উদ্ধার করে কিকরে কবুল বলিয়ে নিজের করবো,সেটাই আপতত ভাবছি।

ইভানের প্যাচ লাগানো কথাগুলো সব কৌড়ির মাথার উপর দিয়ে গেলো।কি বলবে কথা পেলো না।তবে মনে মনে ভাবলো,ইভান মনেহয় ফাজলামো করছে।সে-ও আর দাড়লোনা,রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যোক্ত হতেই ইভান দুষ্ট হেসে বললো—তা তোমাদের প্রেম-সেম কতোদূর এগোলো ফুলকৌড়ি।যদিও ব্যাপারটা প্রেমময় টাইপ নয়,তবে তুমি বললেই কবুল।

মূহুর্তেই সেদিনের হুমকিমুলক কথাগুলো মনে পড়ে গেলো কৌড়ির।হাসফাস করে উঠলো বুকের ভিতরটা।কিছু না বলে ফের চলে যেতে উদ্যোক্ত হতেই মজার ছলে ইভান ফের বললো।—সামথিং সামথিং মনেহচ্ছে?

সহসা উত্তর দিলো কৌড়ি।–সামথিং সামথিং না কচুর মাথা!আপনিতো দারুন খারাপ,সাথে আপনার ওই দাদাভাইটাও সাংঘাতিক খারাপ।

‘কেনো,ওর দাদাভাই তোমাকে কি করলো?

গম্ভীর কন্ঠটা কানে আসতেই বক্ষস্থল ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো।কলিজাটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।ইন্নালিল্লাহ,এই মানুষটা এখনও বাড়িতে।জানলে জীবনেও সে এই মানুষটার বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করতো না।এটাই বলে মহা-দূর্ভাগ্য।ভাগ্য কখনো তার ভালো কথা-কাজে সায় দেয়না কেনো?মূহুর্তেই নজর পাংশুটে ধারন করলো তার।মুখাবয়ব হলো ফ্যাকাশে।সেই নজরে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখলো,সে মিটিমিটি হাসছে।অসভ্য ছেলেটা সবসময় এভাবেই তাকে ফাঁসানোর ধান্দায় ব্যস্ত থাকে।নিশ্চয় জানতো মানুষটার তার পিছনে।জেনে-বুঝেই তাকে ফাঁসিয়েছে!এখন কি বলবে সে?

‘তুই আবার বাড়িতে।কোনো সমস্যা?

নীহারিকা বেগমের গলা পেতেই হাফ ছেড়ে বাচলো কৌড়ি।বুকে হাত চেপে ঘনোঘনো শ্বাস ফেললো।যাক তবে তাকে আর উত্তর দিতে হবেনা।বাচলো সে।নিভান উত্তর দিলো—প্রয়োজন ছিলো একটু,তাই ব্যাক করতে হলো।

‘ওহ।

মায়ের ওহ শব্দটা শুনে নিভান আর দাঁড়ালো না।নিজের রুমে চলে গেলো।নীহারিকা বেগমও ইভানকে খাবার দিতে ব্যস্ত হলেন।তার ফাঁকে কৌড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–তুই রেডি হয়ে বেরিয়েছিস?আচ্ছা একটু দেরি কর,নিভান আসুক।আপতত আজ ওর সাথে যা,ও-ই পৌঁছে দেবে তোকে।

কৌড়ি তড়িঘড়ি করে বললো–না না বড়মা।উনাকে আমায় নিয়ে যেতে হবেনা।উনার কতো কাজ,উনাকে আর আামকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ফালতু ঝামেলায় জড়িওনা।আমি একা যাই-তো,আজ-ও
যেতে পারবো।কোনো সমস্যা হবেনা।

‘আমি জানি তুই পারবি।তবুও,ও যখন এসময়ে বের হচ্ছে।তখন আর অযথা রাস্তাঘাটের ঝামেলা পোহানোর দরকার কি?ওর সাথে চলে যা।ও পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে যাবে,এটাতে ফালতু ঝামেলা কোথায় মনে হলো তোর?

‘ঠিকই তো বলেছে মা।অযথা রিকশা সিএনজির ঝামেলা না পোহায়ে,চলে যাও দাদাভাইয়ের সাথে।আর
তুমি নিজেকে দাদাভাইয়ের ফালতু ঝামেলা মনে করলেও, দাদাভাই কিন্তু একেবারেই সেটা মনে করেনা।

বলেই দুষ্ট হাসলো ইভান।সেটা দেখে মনেমনে কৌড়ির ভিষন রাগ হলো।মনেমনে ইভানকে ইচ্ছেমতো বকলোও সে।ওই লোকটা আশেপাশে থাকলে তার এমনিতেই অকারণে দম বন্ধ হয়ে যায়,আর সেখানে সে যাবে ওই লোকটার গাড়িতে।কখনো না।যদিও বড়মায়ের মুখের উপর কথা বলা অসভ্যতামী মনে করলো।তবুও নিচু গলায় উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো-বড়মা,আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।আমি যেতে পারবো,আসছি।

‘চলো আমি এগিয়ে দিচ্ছি।

পিছে ফিরার আগেই ফের গম্ভীর গলার কথাটা শুনতেই
ফের বুকের ভিতর উথাল-পাতাল শুরু হলো।নজর ব্যথাতুরের ন্যায় অসহায় হলো মূহুর্তেই।সেই অসহায় নজরে ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ছেলেটা এমন ভাবে খাচ্ছে,যেনো কতো বৎসরের অভুক্ত সে।আশেপাশে কোথায় কি ভেসে যাচ্ছে ডুবে যাচ্ছে কোনো দিকে খেয়াল ধ্যান নেই তার।

‘তুই এসেছিস।আমি আর-ও তোরসাথে যাওয়ার কথা বলছিলাম।তুইও যখন বলছিস,নিয়ে যা তো সাথে করে ও-কে।কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাস।

নিভানের উদ্দেশ্য কথা শেষ করে।ফের কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘আরেহ দাঁড়িয়ে রইলি কেনো?ওর সাথে চলে যা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।উপায় না পেয়ে নিভানের পিছু পিছু এগোতে হলো তাকে।আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলো!যে এমন একটা মানুষের সঙ্গ পেতে হলো তাকে।যাকে সর্বক্ষণ সর্ব অবস্থায় এড়িয়ে যায়,আজ তারই সঙ্গ।ভেবেই নিঃশ্বাসের চলার গতি ধীমে আসছে তার।ভাবনা সমেত লন এরিয়ায় পা রাখতেই দেখলো,কালো রঙের টয়োটা গাড়িটার ফ্রন্ট সিটের দরজাটা খোলো।অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে এলেও পা বাড়িয়ে,আশেপাশে না তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো সে।সঙ্গে সঙে পরিচিত সেই মিষ্টি ঘ্রাণটা যেনো গাড়ীর ভিতরময় সর্বত্র ছড়িয়ে তীক্ষ্ণভাবে নাকে এসে ঠেকলো তার।বেশ কিছুদিন গাড়ীতে উঠার দরূন সিটবেল বাঁধাটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার।ত্রস্ত হাতে সেটা বেঁধে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।বাড়ি ছেড়ে গাড়ী চললো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে।শহুরে রাস্তা ধরতেই ভিতরে ভিতরে করা হাসফাস অবস্থাটা কিছুটা কম হলো কৌড়ির।ব্যস্ত রাস্তা।ঘনোঘনো চলা বিভিন্ন যানবাহন।বহু মানুষের চলাচল।বিচিত্রময় দোকানপাট।রঙ বেরঙের বহুতল ভবন।সবকিছু হাসফাস করা মনকে কেমন স্বস্তি দিলো।সেদিকে তাকিয়ে পাশে কে আছে ভুলে যেতে চাইলো কৌড়ি।কিন্তু পাশের জন হয়তো সেই ভুলে যাওয়াটাকে মোটেই মেনে নিতে চাইলোনা।পাশের বসা রমনীটাকে একটু খোঁচাতে ইচ্ছে করলো তার।গম্ভীর নয় বরং স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘বললে না-তো,ইভানের দাদাভাই খারাপ কেনো?তা-ও আবার একটু আধটু নয়, সাংঘাতিক খারাপ!কেনো?সে তোমাকে কি করলো,যে এতো অভিযোগ?

বাহিরের পানে চেয়ে থাকা কৌড়ির,কথাগুলো কানে যেতেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সে।কেনো,কথা না বললে চলছিলোনা তার।কথা না বলে ভালোই ভালো কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে তো পারতো।
তা না!উফফ,কথা বলাটা কি খুব প্রয়োজন ছিলো!আর বললো যখন,এই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে হলো!তবে পাশে বসা মানুষটার কথার উত্তর না দেওয়াটা বেয়াদবি মনেহলো, তাই তড়িৎ করে উত্তর দিলো সে।

‘আমি কোনো অভিযোগ করিনি।

মৃদু হাসি ফুটলো নিভানের ঠোঁটে।শ্যামবর্ণ আদলে চমৎকার দৃশ্যমান হওয়া সেই হাসিটা নজরে পড়লো-না কৌড়ির।তবে কৌড়িকে ভৎসনা করতে ছাড়লো না নিভান।বললো।-তুমি হয়তো সত্যি বলছো।আমি হয়তো শুনতে ভুল করেছি।

ফের হাসফাস করে উঠলো কৌড়ির ভিতরের সর্বত্রটা।নড়নচড়ন যেনো ভুলে গেলো সে।খিঁচে বন্ধ রাখা চোখজোড়া খুলে,দুহাত কচলাতে থাকলো সে।গাড়ী চালানোর ফাঁকেও সেটা লক্ষ্য করলো নিভান।কৌড়ির অস্বস্তি আরও একটু বাড়িয়ে দিতে বললো।–তবে ইভানের দাদাভাইয়ের প্রতি অভিযোগ জানালে ইভানের দাদাভাই কিন্তু তোমার প্রতি একটু-ও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতো না।বরং সে জানতো,নিশ্চয় সেই অভিযোগে অভিযোগী সে।না-হলে ইভানের শান্তশিষ্ট বউম….

‘সেদিন ছেলেগুলো ওভাবে আপনি মেরেছিলেন তাই না?

নিভানকে কথা শেষ না করতে দিয়ে হঠাৎই কথাটা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে দিতে চাইলো কৌড়ি।যদিও কথা বলতে তার কঠিন অস্বস্তি হচ্ছিলো,তবুও কথা না এড়ালে নয়।এই মানুষটা যে ওই বেফাঁস মুখো ইতুড়ে ইভানের ভাইয়ার ভাই।এটা ভুলে গেলে তো চলবে না!তাই কখন কি বলে বসে,আর তার প্রতিনিয়ত চলা নিঃশ্বাসটা একেবারে বন্ধ করে দেয়।বলার উপায় আছে!মূহর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠলো নিভানের মুখাবয়ব।তীক্ষ্ণ নজরটা পিচঢালা রাস্তায় রেখেই দৃঢ়কণ্ঠে বললো।

‘কেনো?মারাটা ভুল ছিলো নাকি?নাকি তুমি বলতে চাইছো ওরা যে বেঁচে আছে এখনো সেটা ভুল?

আন্দাজে ঢিল মারার মতো কথাটা বলেছিলো কৌড়ি।কিন্তু কথাটা সত্য হবে,এটা যেনো অভাবনীয় না হয়েও অভাবনীয়।সুস্থ হওয়ার পর যখন কলেজে গেলো সে।সেদিনই জানতে পেরেছিলো,ওখানের পরিচিত কিছু লাফাঙ্গা গুন্ডাপান্ডা ছেলেদের কেউ মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।তারমধ্যে থেকে দু’জনের মরমর অবস্থা।আইসিইউতে লাইফ-সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাদের।ছেলেদের নাম আর চেহারার বিবরণ শুনে কৌড়ি বুঝতে পেরেছিলো,সেদিন ঝড়বৃষ্টির দিনে তার সাথে ঘৃনিত কর্মকাণ্ড করা ছেলেগুলো।মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলে মনেমনে সবার মতো সে-ও সেই মানুষটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলো,যে ওই মানুষরূপে পিশাচগুলোকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে আল্লাহ হায়াত দান করুক।পরমূহর্তে হঠাৎই ,এই মানুষটার কথাও মনে পড়েছিলো তার।তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।অথচ সেই ভাবনা থেকে মুখ ফসকে বলে ফেলা কথাটা সত্যি হবে,এটা সত্যিই তার ভাবনাতিত ছিলো।ঘাড় ফিরিয়ে অবাক নজরে,নিভানকে দেখলো সে।একমনে পিচঢালা রাস্তায় নজর নিবিষ্ট রেখে গাড়ি চালিয়ে চলেছে মানুষটা।কতোটা স্বাভাবিক তার মুখাবয়ব। যেনো ছেলেগুলোকে মেরে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েও কোনো আফসোস নেই!নেই কোনো অপরাধবোধ!আশ্চর্যতায় মুখ ফসকে কৌড়ি ফের বলে বসলো।

‘ওরকম নিষ্ঠুরভাবে কেউ মারে?কেনো মেরেছিলেন?

গাড়ি থেমে গেলো।রয়েসয়ে কৌড়ির দিকে ফিরলো নিভান।নিজের জায়গায় অবিচল থেকে শান্তকন্ঠে বললো।—কেনো মেরেছিলাম,জানো না তুমি?ওরা তোমার কোথায় ছুয়োছিলো বা ছুঁতে চেয়েছিলো জানা নেই আমার।জানতে চাইওনা আমি।শুধু একটু জেনেছি,ওরা তোমাকে ছুঁতে চেয়েছিলো।আর সেই ছুঁতে চাওয়াটাই ওদের পাপের পুকুরটা পূর্ন করে দিয়েছে।যার ফলসরূপ ভোগটা ওরা পাচ্ছে।আর সেটা তোমার কাছে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও,আমার কাছে ওদের মৃতুটাই শ্রেয়!তোমার হয়তো জানা নেই,ওরা নিভানের কোথায় ছুঁতে চেয়েছিলো?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here