#নিশীভাতি
#১৫তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)
হুমায়রার বাসায় হলুদের অনুষ্ঠানের ঝাকজমক আয়োজন। কাগজ দিয়ে গেট বানানো হয়েছে। কাঁচা হলুদ বাটা হয়েছে। বরের বাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছে। সকলের চোখ যেনো ছানাবড়া হয়ে আছে। এতো গহনা, এতো শাড়ি, এতো আড়ম্বড়তা! আনন্দের সন্ধ্যাটায় ফাঁটল ধরালো এক অদ্ভুত খবর। বড় মাঠের শেষ প্রান্তের অশ্বথ গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে শফির লা/শ। প্রথম দেখেছে গ্রামের প্রবীণ নাসির। খবরটা আগুনের গতিতে ছড়ালো। এমনকি কনের কান অবধিও পৌছালো। খবরটি শুনতেই হাত পা জমে গেলো কিশোরীর। মুখখানা শুষ্ক হয়ে গেলো। শফি ভালো মানুষ নয়, কিন্তু তার মৃত্যুর খবরটাও কাম্য নয়। অনুষ্ঠানের মাঝে এই খবরটা বললো, নাসিরের স্ত্রী মাফুজা। হুমায়রায় গায়ে হলুদ লাগাতে লাগাতে মিনমিনিয়ে বললো,
“জানোস না, চোখ দুখান বাইর হইয়ে আছিলো। জিব্বাও। কি ভয়ানক, কি ভয়ানক। ভাবোন যায়, শফি ভাই কি না আত্মহ/ত্যা করলো। অবশ্য হবে নাই বা কেন, জেবন তো আর জেবন ছেলো না। বউ, মাইয়া নাই। ভবঘুরের লাহান ঘুরতো। মনে হয় মদ গাঞ্জা খাইয়ে ঝুলছিলো”
হুমায়রার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু মাফুজা তার কথার ঝুলি থামাচ্ছিলোই না। মহিলার কথা চালাচালির বাতিক আছে ভীষণ। বলতে গেলে চলন্ত নিউজ চ্যানেল। হুমায়রার চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠলো। ইলহা পাশেই ছিলো। সে কিছুটা আঁচ করলো। তাই খুব নম্রভাবে বললো,
“চাচী, ছাড়ুন না। উনার মাগফিরাত কামনা করা ছাড়া তো আর কাজ নেই। আজ একটা আনন্দের মুহূর্ত। মাটি করার মানে নেই”
“তুমি কেডা?”
মাফুজার কথায় বাধ সাধায় সে প্রচন্ড অপ্রসন্ন হলো। চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়েই প্রশ্নটি শুধালো। ইলহা এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। মাফুজার কথায় সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হলো সে। পাশের মহিলারা বলে উঠলো,
“তোমারে তো আগে দেহি নাই, কে তুমি মা?”
“উনি আমার এক বান্ধবীর বড় বোন, ওরা শহরে গিয়েছে তাই উনি আমার সাথে থাকছে”
হুমায়রা সাথে সাথেই উত্তর দিলো। তার উপস্থিত বুদ্ধিতে বেশ চমকালো ইলহা, মেয়েটি খুব শান্ত। কিন্তু বেশ গুছানো স্বভাবের। সে জানে এখানে সত্যিটা বললে নানাবিধ কথার সম্মুখীন হতে হবে ইলহাকে। সেই সাথে রাশাদের নামটিও উঠে আসবে। সংকীর্ণমনা মানুষের তো অভাব নেই পৃথিবীতে, তাদের মস্তিষ্কে আকাশে রিক্সাও উড়ে। হুমায়রার উত্তরের প্রেক্ষিতে ইলহাকে নিয়ে প্রশ্নের তীরের দিক পরিবর্তন হলো। এখনের কথার মূল বিষয়বস্তু হলো হুমায়রার শ্বশুরবাড়ি।
*****
কাওছার নিজ ঘরে, খানিকটা লুকিয়েই আছে বলা যায়। সে ভীত। বারবার বাহিরে উঁকি দিচ্ছে। শফির মৃত্যুর খবরটা তার কাছে বজ্রপাতের মতো ঠেকলো। গতকাল-ই না বাজারে মা/রামা/রি করলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো। শুনেছে বাজারে নাকি পুলিশও এসেছিলো। ময়নাতদন্তে গিয়েছে শফির মরদেহ। পুলিশ বেশ জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। যদি পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়? যদিও সে কিছু করে নি, কিন্তু বলা তো যায় না। দেখা গেলো কেউ বলে দিলো “শফির শত্রু কাওছার” — পুলিশ বাছবিচার করবে পরে, আগে তাকে জেলে পুরবে। জেলে যেতে চায় না সে। রাশাদকে দু-তিনবার শুধালে সে খেঁকিয়ে উঠলো,
“আপনি খু/ন করছেন? তাইলে এতো ভয় পাচ্ছেন কেনো?”
“যদি ধইরা লয়?”
“জেলে যাবেন, দেখে আসেন ওখানের আবহাওয়া কেমন!”
উদ্বেগহীন স্বরে কথাখানা বললো রাশাদ। রাশাদের কথায় আরোও ভয় তীব্র হলো। ছেলে তাকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। সেও যে তাকে ধরিয়ে দিতে মদক দিবে না সেই বিশ্বাস নেই। এরচেয়ে ঘাপটি মেরে অন্য গ্রামে ছিলো সেটাই ভালো ছিলো। শুনেছে হুমায়রার শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক কিছু পাঠিয়েছে অথচ চোখের দেখাও দেখতে পারছে না। শুধু উঁকিঝুকি মেরে দেখছে পুলিশ নেই তো আশেপাশে_____
**********
“লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে”—– ভাড়া করা স্পিকারে ভীষণ শব্দ করেই গান ছাড়া হয়েছে। হুমায়রার শুভ্র গালজোড়া কাঁচা হলুদের রঙ্গে রাঙ্গা। হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে ইলহা। পরণে হলুদে শাড়ি। মাথায় অপরাজিতা ফুলের গহনা। অপরাজিতা ফুল হুমায়রার খুব পছন্দ। ভাইজান জানেন—তাই তো খুজে খুজে অপরাজিতা ফুলের গহনাই নিয়ে এসেছেন। উপস্থিত একজন বলে উঠলো,
“একটু নাঁচা গানা হবে না না কি! আইয়েন চাচী”
বলেই টেনে নিয়ে গেলো দু একজনকে। উঠোনে গোল করে তারা হাত পা ছুড়ে মন খুলে নাচতে শুরু করলো। কিছুক্ষন পর আতিয়া খাতুনকেও টেনে নিয়ে গেলো। বৃদ্ধা প্রথমে রাজী হলেন না। কিন্তু পরে সেও যোগ দিলেন বাকিদের সাথে। সবাই গোল করে তালি মেরে নাচছে। ইলহা মুগ্ধ নয়নে তা দেখলো। কি সাধারণ তারা, ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে প্রাণোচ্ছ্বল করতেই যেনো তারা পটু। একটু পর একটা ছোট মেয়ে তাকেও জোর করলো,
“আইয়েন না আফা, আপনে খালি বইয়ে আছেন”
“না না, আমি নাচতে পারি না”
“আমরাও পারি না”
ইলহা বারণ করতে নিলে হুমায়রা মিহি স্বরে বলল,
“যান না আপু”
ইলহা হাসলো স্মিত। সেও যোগ দিলো তাদের নাচের মাঝে। ঠিক কতদিন পর মন আনন্দ করছে নিজেও জানে না। শুধু জানে এখানে কেউ তাকে শাসাবে না, কেউ চোখ গরম করবে না। ছোট বেলায় ইলহা নাচ শিখতো। কারণ তার মায়ের খুব নাচ শেখার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু একদিন বাবার ক্রোধের শিকার হয়েছিলো শখের ঘুঙুরগুলো। এরপর থেকে কখনো নেচেছে কি না মনে নেই ইলহার। সে বেঁচে তো ছিলো, কিন্তু কুয়োর সেই শৈবালের মতো যার কাছে আকাশের পরিধিটা কুয়ো অবধি ই। আজ সবার সাথে অনেকদিন বাদে আনন্দের অংশ হয়ে মনে হলো বিশাল নীলাম্বর দেখার অনেক বাকী। হঠাৎ ইলহার মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। খুব সংযত, সুবিন্যস্ত অথচ গাঢ় দৃষ্টি। ইলহা চোখ ফেরালো। মানুষটি কি চলে গিয়েছে? হয়তো। এখানে শুধু গ্রামের মেয়ে বউরা। তাহলে কি মনের ভুল! হতে পারে। সে বিনাদ্বিধায় আবার যোগদান করলো অবর্ণনীয় আনন্দে____
*******
আকাশে আজ অর্ধচন্দ্রমা। হাতের মেহেদী প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শাড়ি বদলেছে ইলহা। হুমায়রা এখনো হলুদের শাড়িই পরিহিত। চোখ জোড়া আকাশের অর্ধবৃত্ত চাঁদে নিবদ্ধ, শীতল সমীরের আনাগোনায় উড়ছে উন্মুক্ত চুল। আগামীকাল তার বিয়ে। “বিয়ে” —- শব্দটির সাথে আগেও একবার পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু সকালের প্রথম কিরণে সব কিছু বদলে গেলো। হুট করেই জুবাইদার মুখখানা মানসপটে ফুটে উঠলো। এমন একটি হলুদের হাতে জুবাইদা এসেছিলো তার ঘরে। বসেছিলো কিশোরীর পাশে। বলেছিলো,
“আয় তোরে চুলে তেল মাইখ্যা দেই, রাতে ভালো ঘুম হইবো”
কিশোরীর আনন্দ দেখে কে। মা তার সাথে কখনোই খুব একটা আন্তরিক ছিলেন না। মাতৃমমতা শব্দটির সাথে খুব একটা পরিচিত ছিলো না হুমায়রা। তাই মায়ের এমন মাতৃসুলভ আচরণে যেনো চাঁদ হাতে পেয়েছিলো। সেদিন জুবাইদা তার সাথে অনেক সময় কথা বলেছিলো। মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলেছিলো,
“কালকেরা তোমার জেবনের নতুন শুরু হইবো। এক নতুন ঘরে যাইবা। নতুন মানুষ থাকবো সেইহানে। অনেক কিছুই বদলাইয়া যাবে। আমরা মাইয়া মানুষ, বদলানোর সাথেই আমগোরে মানায় লইতে হয়। তোমারেও মানায়ে লবে। তোমার বর খান ভালা, শিক্ষিত। তারা মানুষ পেটাইবো না। কিন্তু তোমার সবার মন জোগায়ে চলতে হবে। সংসার একটা শেকলের লাহান, মরন না হইলে মুক্তি নাই। তুমি কি ভয় পাইতাছো?”
“হ্যা”
“ভয় পাইও না। কি আর হবে। আমার চেয়ে খারাপ জেবন তো পাইবা না”
জুবাইদার হাত তখন ঘুরছিলো হুমায়রার কৃষ্ণকেশে। সে চুলগুলো খোপায় বাঁধলো। তার মৃদু স্বরে বলল,
“ঘুমাও, সহালে অনেক ধকল”
আসলেই সেই দিনটি খুব ধকলের ছিলো। হুমায়রা খেয়াল করলো তার চোখ ভিজে এসেছে। মায়ের কথা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। বাহিরে গলার খাকারি শোনা গেলো, হালকা করাঘাত করে পুরুষটি শুধালো,
“হুমায়রা আসবো?”
চোখ মুছতে মুছতে স্বাভাবিক গলায় হুমায়রা বলল,
“আসো ভাইজান”
রাশাদ ঘরে প্রবেশ করলো। ইলহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হুমায়রার সাথে একটু কথা ছিল”
“হ্যা হ্যা, শিওর। ক্যারি অন। আমি বাহিরে যাচ্ছি”
“বেশি দূর যাবেন না, রাত হয়েছে”
ইলহা স্মিত হেসে বেড়িয়ে গেলো। রাশাদ বসলো ঠিক বোনের মুখোমুখি। বিয়েতে হুট করে মতামত দেওয়াটা খুব অবাককর ছিলো হুমায়রার জন্য। কিন্তু রাশাদ একটিবার ও তার কাছ থেকে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে আসলো না, যা সর্বাধিক অবাক করলো কিশোরীকে। হুমায়রাও তার সাথে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলো না। বিনা প্রশ্নে, প্রতিবাদে মেনে নিলো নিজ নিয়তি। রাশাদ স্বর নরম করলো,
“হুট করে ভাইজান এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলো প্রশ্ন করলি না যে”
“তুমি ভেবে চিন্তেই নিয়েছো”
হুমায়রার মুখখানার বিষন্নতা বুকে তীরে মতো বাঁধলো রাশাদের। ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। নিজেকে সামলালো। স্বর আরোও নরম করে বলল,
“আমার উপর অভিমান করেছিস?”
রাশাদের প্রশ্নে চিবুকখানা আরোও নেমে এলো হুমায়রার। চুপটি করে মেহেদি আঁকা হাতের পানে চেয়ে রইলো। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলো। ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হলো, “ভাইজান আমাকে কেনো বের করে দিচ্ছো”— কিন্তু বলতে পারলো না। রাশাদ এবার বললো,
“একটা কথা মাথায় রাখবি, তোর ভাইজানের কাছে তোর গুরুত্ব সর্বাধিক। বিয়ে হয়ে গেলেও তুই আমার বোন থাকবি। যা হয়ে যাক, মনে রাখবি তোর ভাইজান জীবিত আছে”
হুমায়রা চোখ তুলে চাইলো, তার চোখ অশ্রুসিক্ত। রাশাদ আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ঘুমা, কাল অনেক ধকল যাবে”
*******
উঠানে বড় হাড়িতে রান্না হচ্ছে বিরিয়ানি। বিরিয়ানির কেওড়া জলের গন্ধে মম করছে বাড়ি। জুম্মা বাদে মানুষের আগমন হলো। সাদা পাঞ্জাবীতে বর বেশে এলো ফাইজান। শ্যাম গালে আজ অমায়িকতা। মিষ্টি দিয়ে তাকে বরণ করলেন আতিয়া খাতুন। বরের সৌন্দর্য্যতা নিয়ে বেশ কানাগোসা হলো। হুমায়রার বান্ধবীরা তো তাকে বেশ খুচালো,
“কেমনে এমন সুন্দর বর পাইলি বোন, আমাদের ও উপায় বল”
হুমায়রা শুধু হাসলো। ইলহা নিজ হাতে সাজিয়েছে তাকে। কেনো যেনো ইলহার খুব খারাপ লাগছে। আজকের পর থেকে মেয়েটি থাকবে না তার সাথে। এই কয়দিনে বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো। কাজী সাহেব এলো। কবুল বলে এক অদৃশ্য বাঁধনে জুড়লো ফাইজান এবং হুমায়রা। হুমায়রার সাথে যুক্ত হলো ফাইজান ইকবালের নাম। কিন্তু এর মাঝেই হট্টোগোল বাধলো। গুঞ্জন উঠলো,
“পুলিশ আইসে, পুলিশ আইসে”……………
চলবে
[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?
ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)
পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]
মুশফিকা রহমান মৈথি