নিশীভাতি #১৬তম_পর্ব

0
344

#নিশীভাতি
#১৬তম_পর্ব

কবুল বলে এক অদৃশ্য বাঁধনে জুড়লো ফাইজান এবং হুমায়রা। হুমায়রার সাথে যুক্ত হলো ফাইজান ইকবালের নাম। কিন্তু এর মাঝেই হট্টোগোল বাধলো। গুঞ্জন উঠলো,
“পুলিশ আইসে, পুলিশ আইসে”

পুলিশ আসার খবর কানে আসতেই রাশাদের কপালে প্রগাঢ় ভাজ পড়লো। দৃষ্টি সরু হলো। গুজব নয়, আসলেই ফরমাল পোশাকে পুলিশ এসেছে। কোলাপুর থানার বড় সাহেব। শামসু মিঞা বাড়ির প্রবীণ হিসেবে এগিয়ে গেলেন। বিনয়ী কণ্ঠে শুধালেন,
“স্যার, আপনেরা, মোর বাড়িতে?”
“এখানে কি অনুষ্ঠান হচ্ছে?”
“জে, আমার নাতীনের বিয়া আজকে”
“অহ”

কিছুক্ষণ চুপ রইলেন কোলাপুর থানার অসি সাহেব। কন্সটেবল তার কানে কানে কিছু বললো। সে চিন্তিত স্বরে বলল,
“বাট ডিউটি ইজ ডিউটি”

এদিকে পুলিশের নাম শুনতেই কাওছারের হাটু কাঁপা শুরু করেছিলো। এক মুহূর্ত নষ্ট না করেই সে ছুটে গেলো নিজ ঘরে। কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো পুলিশের মতিগতি। যে অনুমান করছে সে যদি সত্যি হয় তবে তাকে জেলে নিতেই এসেছে পুলিশ। অসি সাহেব কন্ঠে কাঠিন্য আনলেন, কাঠকাঠ স্বরে বললেন,
“আব্দুল রহমান ওরফে শফি, চিনতেন তাকে?”

শামসু মিঞার মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। আমতা আমতা করতে করতে উত্তর দিলেন,
“জে, চিনতাম”
“উনার গতকাল মৃত্যু হয়েছে জানেন?”
“জে, জানি”
“সেই বিষয়েই কথা বলতে এসেছি”
“কিন্তু কেনে?”
“ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী গলায় ফাঁশ দেবার জন্য মৃ’ত্যু হয়েছে। কিন্তু উনার স্ত্রীর মতামত, এটা খু’ন। উনার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই কাওছার সাহেবের সাথে উনার ঝগড়া হয়েছে, সেই বিষয়েই কিছু জিজ্ঞাসাবাদ ছিলো”

অসি সাহেবের কথা শেষ হবার পূর্বেই রাশাদ বাধ সাধলো। দাদার পাশে দাঁড়ালো সে, খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“দেখুন সাহেব, আজ আমার বোনের বিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষ হলে না হয় এই জিজ্ঞাসাবাদটা করবেন”

রাশাদের কথা হয়তো পছন্দ হলো না কন্সটেবলের। রীতিমতো খেঁকিয়ে উঠলো,
“এই আমরা তোর বাপের চাকর, তোর কথা মতো আমাদের সময় চলে নি?”

রাশাদ তবুও বেশ শান্ত গলায় অনুরোধ করে বললো,
“জানি, অন্যায় আবদার করছি। কিন্তু আজ আমার বোনের বিয়ে, এই সময় এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনুষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হবে। আমি আব্বাকে পরে সময় করে থানায় নিয়ে আসবো”
“এখানে একজনের জীবন গিয়েছে, আমাদের কাছে আমাদের কাজ ই জরুরি”
“কিন্তু তার সাথে আমাদের তো কোনো সম্পর্ক নেই”
“শুনেছি, এই বাড়িতে শফি সাহেবের একবার বেশ মার খেতে হয়েছে”
“রাত তিনটের সময় আমার বোনের ঘরে ঢোকার সাহস দেখালে তো মা/র খেতেই হবে। সে আমার বোনের ইজ্জতে হাত দিতে গিয়েছিল। বাজারে আব্বা তাকে মেরেছিলো এই কারণেই, সে আমার বোনের নামে অকথ্য রটনা রটাচ্ছিলো। কিন্তু মারা আর একেবারে মে/রে ফেলা দুটো আলাদা। তাই না?”

রাশাদের কাঠকাঠ উত্তরে বড় সাহেবের দাম্ভিকতায় আঁচ লাগলো ভীষণভাবে। সে ক্ষিপ্র স্বরে বললো,
“পুলিশের কাজে আপনি কিন্তু বাঁধা দিচ্ছেন। আমি চাইলে আপনাকে এরেস্ট করতে পারি”
“আমি তো অনুরোধ করছি”
“এই কাদের, সরাও এটাকে”

রাশাদ প্রতিবাদ করার আগেই উগ্র কন্সটেবল তার কলার টেনে ধরলো পেছন থেকে। আরেকজন রীতিমত ঘরের ভেতর থেকে ভীত, সন্তস্ত্র কাওছারকে ঘাড় ধরে বের করে আনলো। উঠানে টেনে আনতে আনতে বলল,
“স্যার, পালঙ্কের তলে লুকায় আছিল”

কাওছার রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আকুতিময় কন্ঠে বললো,
“স্যার আমি কিছু করি নাই, আমি ওরে মারি নাই”
“সেটা তো তুই থানায় চল তারপর ই বোঝা যাবে”

অসি সাহেব হুকুম দিলেন কাওছারকে গাড়ি তোলার জন্য। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেই উঠে পড়ে লাগলো কন্সটেবললা। একেবারে টেনে হিচড়ে গাড়িতে উঠানোর প্রচেষ্টা করলো কাওছারকে। হাতে পড়ালো লৌহ হ্যান্ডকাফ। রাশাদের বিরক্তিতে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। সে নড়তেই চাইলে কন্সটেবল তাকেও দু ঘা দিতে বাকি রাখলো না। উৎফুল্ল স্বরে বললো,
“এইডারেও তুলি স্যার?”
“তোলো”

বিয়ে বাড়ির আমেজখানা মূর্ছিত হলো নিমেষেই। ভাইজানকে পুলিশ ধরেছে খবরটা অন্দরমহলেও গেলো। সাথে সাথেই নববধু সব লাজসরম ছেড়ে ছুটে উঠানে এলো। শামসু মিঞা তখন ছেলে নাতীর জন্য আকুতি মিনতি করছে। কিশোরীর মাথায় সোনালী পাড়ের লাল ওড়নাটা খসে গেলো। সে ছুটে গেলো অসির কাছে। কাঁপা স্বরে বললো,
“ভাইজানকে কেনো নিচ্ছেন? আমার ভাইজানকে নিবেন না। আমার ভাইজান তো কিছু করে নি”
“এই মেয়ে সরো এখান থেকে”

বলেই হাত ঝাড়া দিলো অসি সাহেব। বলে হুমায়রা কদম খেই হারালো। ভারসাম্য না রাখতে পেরে উঠানে ছিটকে পড়তে নিলো। সাথে সাথেই দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে ধরলো। ভীত, সন্তস্ত্র হুমায়রা চোখ তুলে চাইতেই শ্যাম কঠিন চোখের দর্শন পেলো। কিন্তু এই কঠিন দৃষ্টি তার জন্য নয়। হুমায়রাকে সোজা করলো ফাইজান। কিন্তু তাকে কাঁধছাড়া করলো না সে। এর মাঝেই ফরিদ এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরলো অসির দিকে। অসি প্রথমে অবাক হলো। ক্রোধিত স্বরে বলল,
“কি এটা?”
“কথা বলুন”

ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে ধরলো সে। “হ্যালো” বলার পর পর ই মুখোভাব পালটে গেলো। কঠিন অসি নমনীয় হয়ে গেলো। গদগদ স্বরে বলল,
“স্যার, চিন্তা করবেন না। আমি ছেড়ে দিচ্ছি। ছোট কেস তো। আমি মিটিয়ে নিবো”

সাথে সাথেই কাওছার এবং রাশাদকে ছেড়ে দেওয়া হলো। অসি সাহেব ফাইজানের সামনে এগিয়ে যেয়ে বলল,
“উনি আপনার কে হন স্যার?”
“আমার শ্বশুর এবং আমার সম্বন্ধী হয়”
“এটা আপনার বিয়ে”
“জ্বী”
“সরি স্যার, আমি জানতাম না”
“স্বাভাবিক, আমি তো থানায় থানায় বিয়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে আসি নি। এখন তো জানেন। আশাকরি, এই ভুল আর হবে না”

অসি সাহেবের মুখে মেদুর জমলো। ফাইজান তার ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত করে বললো,
“আমি আর আপনি দুজন ই জনগণের সেবক। সেবক যদি শোষক হয়ে যায় তাহলে শোষণের বিচার কে করবে?”

অসি চুপ করে থাকে। ফাইজান তখন খুব শীতল স্বরে বলে,
“আপনি এখানে আপনার কাজে এসেছেন, কিন্তু যেহেতু আমার শ্বশুর আব্বা কিছুই করেন নি তাই ব্যাপারটা পোলাইটলিও হ্যান্ডেল করা যেত। যাক গে, এসেছেন যখন খেয়ে, জিজ্ঞাসাবাদ করেই তারপর যাবেন”

ফাইজান কাওছারকে নিজের শ্বশুর বলায় তার বুক চওড়া হয়ে গেলো যেন। ভয়, সন্ত্রাশ যেনো উবে গেলো। যে কাওছার চোরের মত লুকিয়ে থাকতো সে এখন বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। শামসু মিঞাও বেশ উৎফুল্ল হলেন। কিন্তু রাশাদ রইলো মৌন। কোনো কথা বললো না। ফাইজান সকলের সামনে হুমায়রার মাথার ওড়না ঠিক করে দিলো। খুব মোলায়েম স্বরে বলল,
“ভেতরে চলুন হুমায়রা”

*******

পৌষের আকাশে মেঘ করেছে। ভারী, কৃষ্ণ মেঘ। সেই সাথে ভার হয়ে আছে উঠানের প্রতিটি মানুষের হৃদয়। মিয়ে এসেছে অনুভূতিগুলো। চোখে অশ্রুরুপে জমেছে বিচ্ছেদের বিষাদ। হুমায়রা এখন আর এই বাড়ির একনিষ্ঠ সদস্য থাকবে না। তার গন্তব্য এক অজানা বাড়ি যা এখনো সে দেখেও নি। কেমন হবে সেই যাত্রা, কেমন হবে এই দালানকোঠা জানা নেই। আতিয়া খাতুন তার বুবুকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখলেন। হুমায়রা নিঃশব্দে কাঁদলো। চোখখানা ফুলে গেলো অশ্রুবিসর্জনে। ইলহা তাকে ছোট্ট একটা কোরআন শরীফ সুন্দর করে উপহার দিলো। বললো,
“যখন ই নিজেকে দূর্বল পাবে, মনে রাখবে আল্লাহ আছেন। সে তোমাকে সাহস দিবেন”

হুমায়রা মুচকি হেসে বললো,
“তুমি আমাদের বাড়িতে থেকে যাও ইলহা আপু”
“সে কি করে হয় পাগলী। আমি ক্ষণিকের মুসাফির, আমার গন্তব্য যে এখানে নয়”

হুমায়রা আর কিছু বললো না। অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া নিজের ভাইজানকে খুজলো। কিন্তু রাশাদ সেখানে থাকলো না। হয়তো কোথাও নিজের বেদনাগুলো গুছাচ্ছে। বোনের বিদায়ক্ষণ সহ্য করার মতো সাহসটি হয়তো নেই তার। ভাইজানকে কাঁদতে দেখার ইচ্ছে হলো না হুমায়রারও। তাই যাবার ক্ষণে দাদীকে বললো,
“ভাইজানকে বলো যেনো অনিয়ম না করে। অনেক খাটে সে। অনিয়ম করলেই অসুস্থ হয়ে যাবে”

****

গাড়িতে পাশাপাশি বসে রয়েছে ফাইজান এবং হুমায়রা। তাদের মাঝের দূরত্ব বেশি নয়, কিন্তু মনের ফারাক অনেক। ধরনীতে তখন বৃষ্টি। বৃষ্টির ধার নেই, বাহিরে তাকালে বোঝার উপায় নেই। অথচ গাড়ির কাঁচ ভিজে গিয়েছে। বাতাবরণ তখন শীতল। হুমায়রার চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত। নাক, ঠোঁটে রক্তিম আভা। তবুও তার চোয়াল শক্ত। স্থিরভাবে বসে আছে সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ফুপানো দমিয়ে রাখছে। রক্তিম চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির দিকে। হঠাৎ ই তাকে অবাক করে তার সামনে নিজের রুমালখানা ধরলো ফাইজান। খুব মোলায়েম স্বরে বললো,
“আমার সামনে আপনি কাঁদতে পারেন হুমায়রা, আমি বিরক্ত হবো না আবার মিছে সমাবেদনাও দিবো না। তাই নিজেকে গুমড়ে রাখবেন না”

হুমায়রা অশ্রু বাধ ভাঙ্গলো। গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। ডানহাতে রুমালটি নিলো সে। ফাইজান নিঃশব্দে হাসলো কেবল। কিছুই বললো না। বরং দৃষ্টি ফেরালো বাহিরের দিকে। দৃষ্টি স্থির রেখে ফরিদকে বললো,
“এসি কমিয়ে দাও, হুমায়রার ঠান্ডা লাগছে”

******

বর্তমানে শ্বশুরবাড়ি বললে চেয়ারম্যান বাড়ি ই। পুরানো দোতালার প্রকান্ড লৌহগেট পার হয়ে যখন দাঁড়ালো সদরে, তখন দই মিষ্টি দিয়ে তাদের বরণ করলো সালমা। শরীফা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখখানা উজ্জ্বল। নিজের পুত্রবধুকে পারলে মাথায় করে রাখে সে। বরণের কিছু সময় বাদেই ফাইজান একটি ফোন আসায় বেড়িয়ে পড়লো। হুমায়রা থেকে গেলো গ্রামের মহিলাদের মাঝে। চেয়ারম্যানকন্যা পিহু তাকে নিয়ে গেলো ফাইজানের ঘর। আশ্চর্যব্যাপার। ঘরটি একেবারে সাজানো হয় নি। এমন কি পর্দাও বদলানো হয় নি। পিহু তাকে খাটে বসাতে বসাতে বললো,
“ফাইজান ভাইছা ফুল সহ্য করতে পারেন না। তার ফুলে নাকি হাচি পায়। কিছু মনে কইরো না ভাবী”

হুমায়রা মাথা দুপাশে দোলালো। সে কিছু মনে করে নি। তবে বরের ঘরটা নিপুনভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সে। নেতা সাহেব বইপোকা সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। কারণ তার ঘরের ছোট টেবিলে কম করে হলেও বিশটা বই পর পর রাখা। কেউ ঘুরতে আসলেও যদি বই নিয়ে আসে তবে বুঝতে হবে মানুষটি বইখেকো প্রাণী। পিহু মেয়েটি সর্বদাই বেশ বাচাল। সে গেলো না, পাশে বসেই তার ভাইছার গুনগান করতে লাগলো। গফগদ স্বরে বলল,
“ভাবী, ফাইজান ভাইছা তোমারে খুব পছন্দ করে। যেমনে হিরোর মতো ধরলো, আমি তো ভাবলাম সিনেলা দেখতেছি। তোমাদের একসাথে মানাইছেও কিন্তু। ভালোই হইছে তোমা্র সাথে বিয়ে হইছে। তুমি বলেই আমি কথা বলতে পারতেছি। আমি আবার বেশি কথা বলতে পারি না জানোই তো। তোমারে ভাবী বলতে হবে প্রথম প্রথম যেনো কেমন লাগতেছিলো। কারণ তুমি আমার ছোট।“
“তুমি আমাকে হুমায়রাই বলো। আমি কিছু মনে করবো না”
“কিন্তু ফুপু কান ছিড়ে ফেলবে। ফুপুরে চেনো না। মহিলা এক নাম্বারের হিটলার। হিটলার ও তারে সালাম দিবে। এই মহিলারে শুধু থামাইতে পারে ফাইজান ভাইছা। কিন্তু আমি হা, তুমিও তারে চুপ করাতে পারো”

হুমায়রার খুব ক্লান্ত লাগছে। কাঁদার কারণে চোখ ফুলে গেছে। মাথা ভার লাগছে। একটু ঘুমানো গেলে মন্দ লাগতো না। কিন্তু পিহু যাবার নাম ই নিচ্ছে না। সে যে কত কথা বলতে পারে সেই পরিচয় এই এক ঘন্টায় ই দিয়ে দিয়েছে। এর মাঝেই সালমার ডাক পড়লো। তাই হুমায়রাকে একা রেখে বাধ্য হয়ে যেতে হলো পিহুকে। হুমায়রা হাফ ছাড়লো। দরজা ভিজিয়ে দিলো। ওড়না খুলে রাখলো। নিজের ব্যাগ থেকে একটা ত্রিপিছ বের করে পড়লো। বড় জানালা দিয়ে উত্তরীয়া বাতাসের থাবায় উড়ছে পর্দা। ভেজা চুলগুলো মেলে গা এলিয়ে দিলো হুমায়রা। ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু গায়ে দেবার মতো কিছু পেলো না সে। ঘরের নির্জন শীতলতায় কখন যে চোখ বুজে এলো নিদ্রায় জানা নেই। যখন চোখ খুললো তখন ভোরের শীতল কিরণ ঘরে দাপাদাপী করছে। পাশের মানুষটি রাতে ফিরে নি? কিন্তু অবাককর ব্যাপার তার গলা অবধি কম্বল টানা। কিন্তু পাশের অংশটি শীতল। হুমায়রা বিছানা ছাড়লো লম্বা ঘন কৃষ্ণ কেশ খোঁপায় বাঁধলো। নামায পড়ে নিজে যেতেই জানতে পারলো তার বর তার কাজে ঢাকা গেছে। শরীফা তো ক্ষেপে ফুলে আছেন ছেলের এমন নির্বুদ্ধিতায়। হুমায়রাও কোথাও না কোথাও মনক্ষুন্ন হলো। এই মানুষটির সাথে কি করে কাটাবে সে সংসার জীবন?

******

রাশাদ সকাল সকাল তৈরি হয়ে গেলো। ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে খুব। হুমায়রার ঘরের দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। মনে হলো এই বুঝি বোন বেড়িয়ে আসবে ছাতি নিয়ে। বলবে,
“ছাতিখান নিয়ে যাও ভাইজান, বৃষ্টি বাদলার দিন”

কথাটা ভাবছিলোই তখন ই সেই ঘর থেকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে আসলো ইলহা। পরনে খুব সাধারণ একটা জামা। তবুও ভোরের স্নিগ্ধতা যেনো তাকে অনন্য করেছে। ছাতাটা রাশাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“বৃষ্টি হতে পারে, নিন্মচাপ চলছে। এই ছাতাটি নিয়ে যান”

রাশাদের দৃষ্টি তখন ইলহাতে আবদ্ধ। স্থির, মুগ্ধকর দৃষ্টি। কিছু বলতে যেয়েও বলা হলো না। নির্বাক ছাতাটি নিলো। তখন ই ইলহা বললো,
“একটু বিরক্ত করবো? অনুমতি আছে?”
“আপনার কবে থেকে অনুমতির প্রয়োজন?”
“শুরু থেকেই”
“আমি কি কখনো বলেছি সেটা?”
“আচারণে বুঝা যায়”
“ভুল বুঝেছেন”
“তাহলে বিরক্ত করবো বলছেন?”

রাশাদ উত্তর দিলো না। ইলহা মৃদু হেসে বলল,
“আমাকে একটু বাজারে নিয়ে যাবেন। আমার কিছু মেল চেক করার ছিলো। এখানে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না”
“এতো সকালে তো কোনো নেটের দোকান খোলা থাকবে না”
“অহ!”

ইলহার কন্ঠ মিয়ে গেলো। রাশাদ তখন বললো,
“বিকেলে তৈরি থেকেন। নিয়ে যাবো”
“ঘুরতে?”
“যা মনে করেন”

রাশাদ দাঁড়ালো না। হনহন করে বেরিয়ে গেলো। ইলহা হাসলো। কেনো যেনো নাতীসাহেবকে তার ভালো লাগছে। এই ভালো লাগাটা ঠিক কেমন তা শব্দ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। শুধু এটুকু জানে, মানুষটির কাঠিন্যের মাঝেও অমায়িকতা লুকিয়ে থাকে যেনো। যা তাকে মুগ্ধ করে।

*****

প্রকান্ড দোতালার ছাদটা একেবারেই খোলামেলা। মাটিতে শেওলার চাঁদর। কেউ আসে না বলে পরিষ্কারও করা হয় না। দুপুরের অবসরে চুপি চুপি হুমায়রা আজ উপরে উঠেছে। এবাড়িতে আজ তার তিনদিন। শ্বাশুড়ি মা মোটেই পিহুর বচন অনুসারে জল্লাদ নয়। বরং বাঁচাল প্রকৃতির মজার মানুষ। হ্যা, তার রাগ নাকের ঢগায় থাকে। তাই তো নিজে ছেলে কথায় গা/ধা বলতেও বাধে না। সালমা মামী খুব মিশুক। মনেই হচ্ছে না সেটা তার মামা শ্বশুর বাড়ি। কারণ বউমা বউমা করে সকলেই তাকে মাথায় করে রেখেছে। এই কৃতীত্ব অবশ্য শরীফার একার। ফাইজান আসলে বৌভাত হবে, তারপর তারা ফিরবে নিজ গৃহে। হুমায়রার মন্দ লাগছে না। তবে কোথাও যেনো সে দ্বিধাগ্রস্থ। বাড়ির চাকররা যখন রসিয়ে রসিয়ে প্রেমপ্রীতি বিশেষ করে স্বামীর সোহাগের কথা বলে তখন সেই দ্বিধা গলায় কাটার মতো লাগে হুমায়রার। অষ্টাদশীর মাথায় তখন প্রশ্ন উঠে হাজার।
“তুমি কেন বিয়া করলা ফাইজানকে?”

হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠে চিন্তার মেঘে ছেদ পড়লো। খানিকটা চমকালো হুমায়রা। পেছনে ফিরতেই আমানের মুখোমুখি হলো। সাথে সাথেই যাবার জন্য তৎপর হলো সে। ঠিক তখন ই হাতখানা টেনে ধরলো আমান। ক্ষুদ্ধ স্বরে বললো,
“আমি আর ফাইজান কি খুব আলাদা?”
“হাত ছাড়েন আমানভাই”
“ও তোমারে ভালোবাসে না হুমায়রা। দেখো তাই তো তোমারে ফেলায়ে চলে গেছে”
“হাত ছাড়েন আমান ভাই”

আমানের গা থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে। সে যে নেশা করে এসেছে এটা বুঝতে বাকি থাকলো না হুমায়রার। আমানের হাত ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হলো সে। কঠিন স্বরে বলল,
“আমানভাই, ভুইলে যায়েন না আমি আপনার ভাবী হই। হাত ছাড়েন আমার। আমি অন্য কারোর বউ, আমারে ছোঁইয়ার অধিকার নাই আপনার”
“কিন্তু তুমি তো আমার বউ হইতে পারতা হুমায়রা”

আমানের কাতর স্বর শুনেও না শোনা করলো হুমায়রা। নিজের সমস্ত জোর দিয়ে হাত ছাড়ালো। রোষপূর্ণ স্বরে বললো,
“আর কখনো এই কাজ করবেন না আমান ভাই, নয়তো আমি সবাইরে ডাকবো”

বলেই তড়িৎ গতিতে ছাদ ছাড়লো। হাতের কবজি লাল হয়ে গেছে হুমায়রার। সে বুঝে না এই মানুষটি এখনো কেনো মিথ্যে প্রেমের দোহাই দেয়, সে কখনোই হুমায়রাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসে তার সৌন্দর্যকে। মানুষটাকে ভালোবাসা মানে তাকে সম্মান করা, কিন্তু এই মর্মার্থ হয়তো আমান কখনোই বুঝবে না

******

নিগূঢ় রাত, খোলা জানলা দিয়ে সুরসুর করে প্রবেশ করছে হিমশীতল বাতাস। কিশোরী তখন বেপরোয়া ভাবে ঘুমে লিপ্ত। শরীরের কাপড় এলোমেলো হয়ে আছে। দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো ফাইজান। নিজের কোটটা খুলে চেয়ারে রাখল। পাঞ্জাবীর গলার বোতাম খুলতেই চোখ পড়লো ঘুমন্ত হুমায়রার পানে। নির্নিমেষ নয়ন দেখলো তাকে কিছুসময়। নিজের কাজ থামিয়ে পাশে গিয়ে বসলো সে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো শুভ্র মুখখানার দিকে। স্থির সেই চাহনী। বাতাসের ঝাপসায় এলোমেলো চুলগুলো খুব সন্তর্পনে কানের পেছনে গুজলো। ঠিক সেই সময়েই চোখ মেললো হুমায়রা। বিস্মিত নয়নজোড়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে ফাইজানের দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করার পূর্বেই পুরু পুরুষালী আঙ্গুল বিচরণ শুরু করলো তার ঠোঁট। ফাইজানের পুরুষালী কন্ঠ ধ্বনিত হলো ঘরে,
“যেহেতু সেদিন রাতে আমি ছিলাম না, তাই নিয়মমাফিক আজ আমাদের বাসর রাত”………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here