প্রমত্ত_অঙ্গনা #আরোহী_নুর ৬,৭

0
185

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#আরোহী_নুর
৬,৭

সাক্ষরের স্থানে গিয়ে আঁখির হাত যেন আটকে গেল,সেখানে সাক্ষর করার ক্ষমতা জুটিয়ে উঠতে পারছে না,যার জন্য জীবনের সুন্দর সম্পর্কগুলো ত্যাগ করল আজ তাকেই ত্যাগ করতে হবে ভেবেই বুকের ভিতরে শুন্যতার ছড়াছড়ি হল আঁখির,ভ**য়া**নক এক খাপছাড়া অনুভুতি যা প্রকাশ করার কোনো ভাষা আছে বলে আঁখির জানা নেই,সে অ*লক্ষু**ণে অনুভুতি যার সাথে হয় সেই তার প্রখ**ড়**তার আন্দাজ করতে পারে। আঁখি বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল কাগজখানা,এমনই তো ছিল আদ্রিশের সাথে তার বিয়ের কাবিননামা,সেদিন একটা সাক্ষরের বিনিময়ে সব ত্যা*গের মাধ্যমে আঁখি প্রবেশ করেছিল আদ্রিশের জীবনে।সেদিন বুকে জড়িয়ে আদ্রিশ বলেছিল তাকে।

″আজ নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী বলে মনে হচ্ছে আঁখি,অবশেষে আজ আমি তোমাকে পেয়ে গেলাম।কখনও ছেড়ে যাবে না তো আমায়?″

″তোমাকে পাওয়ার জন্য সবাইকে ছেড়েছি,তোমাকে কিভাবে ছাড়ি বলো!তুমি যে নিশ্বাসে নিহিত,জীবনভর তোমার হয়ে থাকতে চাই।কখনও তৃতীয় কেউ এনো না আমাদের ভালোবাসার কাঁটা হিসেবে, সহ্য করতে পারব না আমি।″

″এ জীবনে তোমার পরে কেউ কখনও আসে নি আর আসবেও না আঁখি,তোমাকে ছাড়া এ হৃদয় যে কিছুই বুঝে না,তুমি ছাড়া যে আমি বদ্ধ উ**ন্মা**দ,সারাজীবন পাশে থাকবে কথা দাও।″

″ভালোবাসা আমাদের দু’জনে সীমাবদ্ধ থাকলে কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না কথা দিলাম।″

″আমাদের ভালোবাসা আমাদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে আমিও কথা দিলাম।″

চোখ টপকে ডিভোর্স পেপারের গায়ে আ*ছ**ড়ে পরল আঁখির চোখের দুফোঁটা জল।আদ্রিশ যে তার কথা রাখে নি,তবে আঁখি তার কথার খেলাফ যাবে না,সে তার কথা রাখবেই,মানিয়ে নিবে সব বি**চ্ছে**দ যন্ত্রণা,হোক না তা পাহাড় পরিমাণ,হোক না তা মৃ**ত্যু যন্ত্রণার সমতুল্য। মুছলো আঁখি আঁখিজল,কলমটা এবার বসিয়ে দিল জায়গা মত করে দিল সাক্ষর।ছাড়ল সস্তির এক নিশ্বাস।

আদ্রিশ কক্ষ থেকে বের হচ্ছিল আঁখির উদ্দেশ্য, আবারও ওকে নিজের কথায় আনার এক প্রচেষ্ঠা করবে বলে ঠিক করল তখন একজন কাজের লোক একটা কাগজ এনে আদ্রিশের হাতে দিয়ে বলল।

স্যার আঁখি ম্যাডাম এটা দিয়েছেন আপনাকে দেওয়ার জন্য।

আদ্রিশ কাগজখানা হাতে নিয়ে যেন আকাশ থেকে পরল,চোখ ছা*না*বা*না হল মুহুর্তে, ডিভোর্স পেপার যেটাতে আঁখির সাইন আদ্রিশের অন্তর অল্পতে পো**ড়ি**য়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথার্থ হল।চোখে জল এসে বাসা বেঁধে গেল এক পলকেই।

আঁখি শাশুড়ি মায়ের পায়ে ধরে সালাম করে নিল,শাশুড়ি মা কান্নারত অবস্থায় তার মাথায় হাত রেখে দোয়া দিলেন তাকে।

″আল্লাহ তোকে তোর প্রাপ্য সুখ যেন দান করেন মা,দোয়া করি,ভালো থাকিস,এই বুড়িকে ভুলিস না।″

″প্রাণ থাকতে তোমাদের ভুলব না মা,দূরে চলে যাচ্ছি বলে ভেবো না সম্পর্কে দূরত্ব চলে আসবে,আমি দূর থেকেও তোমাদের পাশে সর্বক্ষণ থাকব।″

শুভ্রতা আঁখিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলল।

″আমাকে ক্ষমা দাও আঁখি,চেয়েও তোমার জন্য কিছু করতে পারি নি আমি।″

″ধূর, পাগলি বোন আমার,আমি কোনো অবলা না কি যে আমার জন্য কিছু করতে হবে তোমায়,তুমি নিজের,মায়ের আর আমার ভাই, ভাইপো এর খেয়াল রেখো আমার আর কিছু চাই না,কেমন।″

বুকের ব্যা*থা সযতনে বুকে চেঁপে জো*র করে আলতো হাসি মুখে টেনে এনে বলে গেল আঁখি কথাগুলো,বুক ফেঁ*টে কান্না আসছে তার তবে নিজেকে আজ দূর্বল পরতে দিবে না ভেবে নিয়েছে।ছোট্ট রিহানকে কতগুলো চকলেট দিয়ে তার গালে চুমু খেলো,নিজের সন্তানের মতই যে এতদিন ওকে ভালোবেসেছিল আঁখি।রিহানও আঁখিকে অনেক মানে,আঁখির নামে পা**গল বললেই হয়,তার সেই প্রিয় ছোটো মা যে আজ তার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে সে তা এখনও বুঝে উঠতে সক্ষম হয় নি নইলে কেঁদে নেয়ে একাকার করে দিত সব।চকলেটগুলো পেয়ে খুশিতে আত্ন*হা*রা হয়ে লাভ ইউ ছোটো মা বলে ছুটে চলে গেল,আঁখি এগিয়ে গিয়ে আদিলের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে নিল।

″চলি ভাইয়া,ভালো থাকবেন,কোনো প্রয়োজন মনে করলে এ বোনকে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।″

″আমার একটা ছোট বোন নেই,তোমাকে আমি সে বোনের আসনে বসিয়েছিলাম,ভাবিনি আদ্রিশ আমার সে বোনকে এভাবে কেড়ে নিবে,তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়,দেখো তোমার ভালো হবে,তুমি খুব সুখী থাকো দোয়া করি।″

রিদিকা একপাশে মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে,আঁখি নির্দিদায় হেঁটে গেল তার পাশে,অতঃপর বলল।

চলে যাচ্ছি, তোকে তোর স্বামী দিয়ে গেলাম,আমি তো ধরে রাখতে পারি নি,তবে দোয়া করব তোর আঁচলের বাঁধন যাতে শক্ত হয়,স্বামী হাতছাড়া না হয়ে যায়।
কথাটা যে তী**রের মত বি*ধল রিদিকার বুকে তাও স্বাভাবিক থাকল,কিছু বলল না,তবে মুঠো টা বরাবরের মত শক্ত করে নিল।আঁখি আবার বলল।

আমার অনেক সোনা,গহনা,কাপড় দামী জিনিস সবকিছু রেখে যাচ্ছি, যেখানের বেশিরভাগই আদ্রিশের দেওয়া,কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না আমি,রেখে গেলাম তোর জন্য,যেখানে স্বামী তোর সেখানে মনে নিরাশতা তো আসতেই পারে তোর স্বামীর দেওয়া জিনিস আমি আবার কেন নিলাম।তাই দিয়ে গেলাম,স্বামী নাহলে কেরে নিয়েছিস ওর সংসার সবকিছু না হয় তোকে আমি ভিক্ষে দিয়ে গেলাম।চলি…..।

আঁখি চলে যেতে নিলে রিদিকা মৃদ্যু স্বরেই বলল।

আমি ওকে কেরে নেই নি,ও নিজে থেকেই তোকে ছেড়ে আমার পিছু নিয়েছে।

কথাটা কর্ণপাত হতেই রা**গে শরীর জ্ব**লে উঠল আঁখির,ফিরে গিয়ে সজোরে একটা কঢ়া থা**প্পড় বসালো রিদিকার গালে,থা**প্পড়ে**র তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে আ**ছ*ড়ে পরল রিদিকা।আঁখি তেঁড়ে গিয়ে ওর চুল মুঠো করে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে কটমট করে বলতে লাগল।

তোর মতো বা**জে নারীদের জন্যই আজ সমাজটা এত বিকৃতি পেয়েছে।হ্যাঁ ওসব সকল পুরুষ খা**রাপ এবং নি**কৃ**ষ্ট যারা বউ রেখে অন্য নারীর মোহে পরে,তবে সেই নারীগুলো কী দুধের ধুয়া তুলসীপাতা যারা একজন পুরুষের বউ আছে জেনেও তার দিকে ধাবিত হয়,তার প্রস্তাবে রাজি হয়,সেই নারীগুলো যদি সেসব পুরুষদের ফিরিয়ে দিত,চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত তাদের নিজেদের নিকৃষ্ট অবস্থান, তাদের কাছে নিজেকে বি**লি**য়ে না দিত তবে আজ সমাজে পর**কী**য়া আর ডিভোর্সের হার বাড়ত না,তাই একতরফা আদ্রিশের গলায় দোষ চাপাতে যাস না,নইলে এত মা**র*ব যে পায়ে পরে মাফ চেয়েও প্রা**ণ ভি**ক্ষা পাবি না।

তখনি আদ্রিশ এসে আঁখিকে টান দিয়ে সরালো রিদিকার কাছ থেকে,বেশ তেজি স্বরে বলল।

″এসব কি করছ আঁখি!পা**গল হয়ে গেছ তুমি!তোমার সমস্যা আমাকে নিয়ে তবে আমার সাথে কথা বলো ওকে কেন টানছো?″

″বড্ড দরদ হচ্ছে দেখি উকিল সাহেবের নতুন বউয়ের জন্য..।″

″আঁখি তুমি কিন্তু বড্ড বেশি রিয়াক্ট করছ।রিদিকা এতদিন যখন তোমার বান্ধবী ছিল তখন তো ওর জন্য দরদ তোমার উতলে পরছিল,আর এখন আমি ওকে বিয়ে কী করে নিয়েছি ও তোমার দু**শ**মনে পরিণত হল,ওকে মেনে নিলে কী এমন পরা যাবে তোমার,শুনি?″

″দেখো আদ্রিশ তোমার মত বু**দ্ধিহী**ন, চরি**ত্রহী**ন ল*ম্প*টের সাথে কথা বলার রুচি এই আঁখির নেই।ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি,নিজে সাইন করে দিও,আমি লোক পাঠিয়ে নিয়ে নিব।″

″তোমাকে আমি ডিভোর্স দিব না,দেখি তুমি কি করতে পার।কি ভেবেছ তুমি? আমাকে ছেড়ে যাবে আর আমি যেতে দিব তোমায়! নো ওয়ে,আমিও দেখব তুমি ডিভোর্স কি করে পাও।″

কথাটা বলে আদ্রিশ ডিভোর্স পেপারটা একটানে দু’টুকরো করে ফেলল,সাথে সাথে আঁখি আদ্রিশের গাল বরাবরও একটা ছাপ্পড় বসিয়ে দিল সবার সামনেই,আদ্রিশ রেগে গিয়ে আঁখি বলে গর্জে উঠলে।

″আঁখি….″

″ওই উকিল ভলিওম ডাউন,উকিল হবি তুই কোর্টে আমার সামনে ক্ষমতা ঝাড়তে আসিস না,ভুলে যাস নে আমি আঁখি সবকিছু জ্বা**লি**য়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।স্বামী হিসেবে সম্মান দিয়েছিলাম বলে আমার আসল রুপ ভুলে গেলি!হি*ট**লার আঁখিকে জাগাতে আসিস না বলে দিলাম,যেভাবে এটা ছিঁড়েছিস নতুন করে বানিয়ে সাইন করে নিয়ে আসিস নইলে উকিল এর উ পর্যন্ত রাখব না আমি এই বলে গেলাম,তোদের স্বামী স্ত্রীর সব রোমান্টিকতা মুহুর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিব,কথাটা মনে রাখিস।″

কথাগুলো বলে আঁখি হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল,হাতে শুধু তার ব্যবহার্য ফোন,এই বাড়ি থেকে যতই বেড়িয়ে আসছে বুকটা ততই কাঁ*প*ছে আঁখির,কত স্মৃতি জমে আছে আঁখির এই বাড়িতে,কত সপ্ন কত আশা নিয়ে আদ্রিশের স্ত্রী রূপে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল আঁখি,সবকিছু আজ ধুলোয় মিশে গেল,কাঙাল হয়ে বেড়িয়ে এলো আজ আঁখি,চোখের জলও যেন আজ পর হল,ভিতরটা ধু*ম*ড়ে মু*চ*ড়ে গেলেও চোখ দিয়ে আজ আর নামছে না জল,আচমকা এক আকর্ষণ এই বাড়ির প্রতি টানছে আঁখিকে,যেন শুনতে পাচ্ছে কিছু পিছুডাক,কতগুলো অশ্রুশিক্ত চোখের না বলা বাণী,নির্জীব সেই ইট পাথর সেই অজীব বস্তুদের অজানা ভালোবাসা টানছে বড্ড আজ আঁখিকে,হয়ত স্বামী সংসারের মায়া এমনই হয়, এক একটা বস্তুকেও ছেড়ে যেতে মন চায় না,তবে মন বানিয়ে নিয়েছে যে আঁখি,আজ সে আর পিছু ডাকে সারা দিবে না,খুঁজে নিবে নিজের এক নতুন গন্তব্য।

দূর আমেরিকার বিশাল এক অট্টালিকার আলিশান কক্ষ ঘেষে এক বারান্দা, বারান্দার প্রাচীর এর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বলিষ্ঠ দেহি এক সুদর্শন পুরুষ,বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে,মনে সুখে নাচ করছে যেন তারা,হাতে তার একখানা চিঠি।অপলকে তাকিয়ে আছে সেই চিঠিটার পানে,মনের প্রতি প্রান্তে আ**ঘা*ত করছে চিঠিতে ফুটে উঠা সেই অপ্রিয় সত্য বাণীগুলো।

একদিন তোমার আকাশেও বৃষ্টি নামবে,খুব করে চাইবে তখন পাশে আমায়….
দেখে নিও, তুমিও কাদবে,বিষন্নতায় ভুগবে,খুব করে আমাকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্খা জাগবে,কিন্তুু আফসোস প্রকৃতি আপনার বিপক্ষে চলে যাবে।প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার সাধ্য থাকবে না আর।
আপন মানুষ হা*রা*র শোকে পো*ড়*বে আপনার উতলা হৃদয়, কিন্তু আফসোস ফিরে পাবে না আর সেই বোকা ফুলকে,অতলেই হারিয়ে যাবে সে।

চোখ টপকে আজকেও জল গড়ালো তার, প্রতিনিয়ত আঁখির প্রে**ম*দহ**ণে পো*ড়া*র সাজাটা যে হয়ে গেছে তার কপালের লিখন।আজ নিজেই দো**ষী নিজের এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার জন্য।

চলবে……

প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৭)

দেখতে দেখতে রাত গড়ালো, আঁখি যাওয়ার পর আদ্রিশ প্রচন্ড রা*গে তার কক্ষের জিনিস ভাং*চুর করেছে তারপর বাইরে কোথাও চলে গিয়েছিল,কাজের লোক দিয়ে কক্ষ পরিষ্কার করিয়েছে রিদিকা,এবার আদ্রিশ ঘরে ফিরল,রিদিকা আদ্রিশের জন্য অপেক্ষা করছিল তার কক্ষেই আদ্রিশ আসতেই হাসিমুখে তার পাশে গেল এগিয়ে।

″তুমি এসেছ,কোথায় গিয়েছিলে?সেই সকালে বের হয়েছিলে আর এখন আসছ,এত কল দিলাম একটাও ধরলে না,আমার চিন্তা হয় না বুঝি তোমার জন্য?ফ্রেস হয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি,খাবে।″

″খাব না খিদে নেই,তুমি একটু একা ছেড়ে দাও আমায়,প্লিজ।″

কথাটা বলে আদ্রিশ রিদিকাকে পাশ কাটিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরল চিৎ হয়ে,রিদিকা এবার ওর মাথার পাশে এসে বসল,আদ্রিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বলল।

″আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি দেখবে খুব জলদি ঘুম চলে আসবে।″

″প্লিজ তুমি যাও,আমি ঠিক আছি।″

″আমি কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে,তাছাড়া আঁখি তো চলেই গেছে,এখন তো আর ফিরবে না,তাই এখন এখানে আমি থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই।″

″আঁখি ফিরবে,ওকে ফিরতেই হবে।আর ও আসুক না আসুক,ওর অবস্থান ওরই থাকবে আমার জীবনে।″

″ওর জন্য এত ভাবো আর আমার জন্য কোনো ভাবনা নেই তোমার মধ্যে, ওকে তো আমি বা তুমি যেতে বলি নি,ও নিজে থেকেই গেছে,আমি তো বলছি না ওকে ফিরিয়ে এনো না,ওর জায়গাও আমাকে দিতে বলছি না,তবে আমার জায়গা তো আমাকে দেওয়া যায়,না কি এক রাতেই মন ভরে গেল।″

″রিদিকা তোমাকে চলে যেতে বলেছি চলে যাবে,এত প্যাচাল করছ কেন?″

রিদিকা বেশ অভিমান নিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললে তার কথার প্রতিক্রিয়ায় গর্জে উঠে আদ্রিশ উক্ত কথা বলে উঠল।রিদিকা আর কিছু না বলে বেশ শব্দ করে কেঁদে ছুটে কক্ষ ত্যাগ করল।

বেশ বিরক্তিকর একটা অনুভুতি খেলিয়ে গেল মুহুর্তেই আদ্রিশের মনের ভিতর,তবে সেই বিরক্তিটা আসলো নিজের উপর,তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মনে সে এভাবে পী*ড়াদা*ন করতে চায় নি,অল্পসময় কথাটা নিয়ে অনেক গভীর ভাবনায় তলালো সে অতঃপর উঠে এগিয়ে গেল রিদিকার কক্ষের পানে।

আঁখি নিজের গাড়িতে করে নিজের করা বাড়িতে চলে আসলো,আঁখির সপ্ন মহল নাম রাখা বাড়িটার।বাড়িটা আঁখির নিজের টাকায় গড়া,স্বামী সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন থেকে আলাদা হওয়ার চিন্তা আঁখির কখনো ছিল না,কিন্তু আঁখির সেই ছোটবেলা থেকেই সপ্ন ছিল নিজের টাকায় একটা বাড়ি করবে,সেই সপ্নটা এই তো একমাস আগেই পূরণ হল,আঁখি ভেবেছিল বাড়িটা করলে কখনও কখনও বেড়াতে আসবে এখানে সবাইকে নিয়ে কিন্তু এটাই টার স্থায়ী আশ্রয় হবে ভাবনাটা কল্পনাতেও টোকা দেয় নি আঁখির কবুও,বাড়ির একটা কক্ষ বানিয়েছিল ওর আর আদ্রিশের জন্য,যেখানে তাদের সব রকমের ছবি টাঙানো ছিল,তাছাড়া আদ্রিশের পছন্দ অনুযায়ী বাড়িটা ডেকোরেট করেছিল আঁখি,ভেবেছিল ভালো একটা ছুটির দিন দেখে আদ্রিশকে এখানে নিয়ে এসে স্যারপ্রাইজ দিবে,সাথে সবাইকে নিয়ে এসে হৈ-হুল্লোড় করবে সারাদিন,কিন্তু কই হল তার আশা পূরণ,সুন্দর স্বপ্নগুলো সপ্ন রয়ে যাবে জানা থাকলে হয়ত তা কখনও ওভাবে সাজাত না আঁখি,ভা*ঙা এই অনুভুতির সাথে মানিয়ে নেওয়া যে কত দূরুহ হচ্ছে তা শুধু আঁখিই জানে,বাড়িতে এসেই কাজে লেগে গেল আঁখি,মন ভেঙে চু*র্ণবিচু*র্ণ তবে মনের সক্ষমতা এক চুলও কম হয় নি তার,শক্ত মানবীরুপে সরিয়ে নিল সব ছবি তার আর আদ্রিশের,সেগুলো ঠাই পেল স্টোররুমে এক কোণে,বাড়ির গার্ড আর কাজের লোক দিয়ে দিনে দিনে সব কিছুর সাজগোজ পাল্টে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাজাল সব আসবাবপত্র।এই বাড়ির দেখাশোনার জন্য সে কয়েকজন গার্ড আর কাজের দুজন লোক আগেই রেখেছিল।যাক সবকিছুই তার কাজে দিল,আজকে নিজে থেকেই আঁখি কাজে যায় নি,নিজের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাইল আজ সে।

হাতে আঁখির ছবি নিয়ে আজও বসে আছে আদৃত নামক সেই গম্ভীর পুরুষ,সবার কাছে তার গম্ভীর এই রুপখানা অটল থাকলেও আঁখির জন্য তার মন যে সবসময় এক পা*গ*ল উতলা প্রেমিক,কখনও তার সেই অ*কৃ*ত্রিম অসীম এই ভালোবাসা উপলব্ধি করানোর ক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি সেই কাঙ্ক্ষিত রমণীকে,আদৃত যে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল আর তার মাসুল প্রতিক্ষণে তাকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে আঁখির ছবি নিয়ে প্রায় দিনের মতই গল্পতে মশগুল আদৃত।

কি দেখছ এংরি বার্ড?দেখছ আমাকে?ঘৃ*ণা হচ্ছে না আমাকে দেখে বড্ড?হওয়ারই তো কথা, কখনও তোমার ভালোবাসার মর্ম দিতে পারি নি আর যখন দিতে চাইলাম তখন তুমি অন্য কারও হয়ে গেলে,জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুখটা তুমি অন্যতে পেয়ে গেলে,আমাকে নিজের প্রেমে আবদ্ধ করে দূরে চলে গেলে তুমি অনেক,অনেক সুখি আছো তাই না?হয়ত বিয়ে করে নিয়েছ,স্বামী সন্তান আছে তোমার।খুশি আছো তুমি আদ্রিশকে নিয়ে,তবে আমি যে সুখি নেই প্রিয়তমা,তোমার শোকে রোজ যে পোঁড়ে ম*র*তে হয় এই পা*ষা*ণ হৃদয়কে।

রিদিকা নিজের কক্ষের এক কর্ণে এসে দাঁড়িয়ে গেল,অতি আবেগ আর অভিমানে আবৃত হয়ে দুইহাতে মুখ চেঁপে বেশ শব্দ করেই কাঁদতে লাগল,আদ্রিশ পিছনে এল তার,নতুন বউকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ বিচলিত হল তার মনখানা,বুকের ভিতর আফসোসের এক সুর জাগ্রত হলো,তাই এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল রিদিকাকে,তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলত করে বলল।

ক্ষমা করা যায় না আমায়?ভালোবাসি বলেই তো ধমক দিলাম,আমার কি একটু রা*গারও অধিকার নেই?

রিদিকা এবার মুখ থেকে হাত সরালো,পিছন ফিরে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশকে,তার বুকে মাথা রেখে আহ্লাদি কন্ঠে বলল।

″সত্যিই ভালোবাসো?″

″হুম,ভালোবাসি।″

″তাহলে দূরে ঠেলে কেন দাও?″

উত্তরে আদ্রিশ কিছু বলল না।রিদিকা আবার বলল।

″এর মানে আমাকে পাশে রাখতে চাও না,ঠিক আছে কালকেই আমি আমার মা বাবার কাছে চলে যাব।″

″একদম বাজে বকবে না,তুমি কোথাও যাচ্ছো না।″

″এভাবে দূরত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না আদ্রিশ,হয়ত নিজের কাছে রাখো নয়ত দূরে পাঠিয়ে দাও।″

″আমি তোমাকে কোথাও দূরে পাঠাচ্ছি না।″

″তাহলে আপন করে নাও,ভালোবাসো আমায় যাতে আমি চাইলেও দূরে যেতে না পারি তোমার থেকে।″

রিদিকার আদ্রিশের বুক থেকে মুখ তুলে আহ্লাদী স্বরের উক্ত আবদার যেন ভুলিয়ে দিল আদ্রিশের সকল দুশ্চিন্তা,মাথায় চড়ল এক অদ্ভুত মোহের খেলা,রিদিকার নে*শা*ক্ত ডাকে সারা না দিয়ে পারল না আদ্রিশ,মুছে দিল হাত তুলে রিদিকার চোখের জল,দু’হাতের মধ্যেখানে রিদিকার মুখখানা আগলে নিয়ে এগিয়ে গেল তার অধরের ছোঁয়া পেতে।

একদিকে আদ্রিশ সুখের রাত্রী যাপন করছে ওপরদিকে আঁখি যাপন করছে বিনিদ্র রজনী,একা এই জীবনে আজ যে কাঁদতেও নেই কোন বারণ,একা দূর্বল পরারও তো কোনো ভয় নেই,কেউ অবলা বলে তো তাচ্ছিল্য করার থাকবে না, তাই একা এই ঘরে আজ বেশ শব্দ করেই কাঁদতে মগ্ন হল আঁখি,মা বাবার আদরের মেয়ে যার কান্নার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না কখনও দূর দূর অব্দি, দুঃখ যাকে কখনও ছুঁতেও পারে নি,তার বাবা যে ঢাল ছিল তার,তার নামে তার বাবার ছিল পৃথিবীর সকল সুখ।আজ সেই বাবার মেয়ে চিৎকার করে করে হেঁচকি টেনে কাঁদছে আর বলছে।

মা বাবা,দেখ না আজ তোমাদের এই পা*গ*ল মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে, আজ নেই কেউ তার চোখের পানি মুছে দেওয়ার মত,যার মধ্যে সকল সুখের আশ রেখেছিলাম,যার জন্য তোমাদের ছাড়তেও পিছপা হইনি সেই আজ আমায় কাঙাল করে ছেড়ে দিল,আজ তোমাদের কথা বড্ড মনে পরছে বাবা মা,তোমাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ারও কোনো সামর্থ্য নেই আমার,কোন মুখে যাব তোমাদের কাছে,আমি যে আমার ভাগের সাজাটা আজ পেয়ে গেছি বাবা দেখ,তুমি আর মা হলে হয়ত আজ আমার এ হাল হত না,কখনই এতটা ভেঙে পরতাম না আমি,আগলে নিতে তোমরা,কি করব নিজের দোষে সব হারিয়েছি,হারিয়েছি তোমাদের,পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়,এই অভাগীকে আর অভিশাপ দিও না তোমরা সে যে আর সইতে পারবে না।

ফোনের রিংটনে বেশ বিরক্ত হল আদৃত,আঁখির ছবি থেকে চোখ হটিয়ে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির করল,মা লেখাটা চোখে ভেসে আসায় বিরক্তি দূর হল মুহুর্তেই,ফোনটা রিসিভ করে বলল।

আসসালামু আলাইকুম আম্মু, কেমন আছো।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছিস বাবা?

এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?আর বাবা?

আমি আর তোর বাবা দু’জনই ভালো আছি। বলছিলাম কি ইশিকার তো একটা মেয়ে হয়েছে,তুই তো ছবিতে দেখেছিস ওকে,সামনাসামনি দেখতে বুঝি মন চায় না ওকে তোর?তুই আবারও মামা হয়েছিস,এবার তো চলে আয় দেশে আর কতদিন পরিবার থেকে দূরে থাকবি,ইশিকা বড্ড করে চাইছে তোকে দেখবে।

আসলে মা এখানে কাজের অনেক চাপ,চাইলেও আসতে পারি না,তা এখন রাখি একটা সার্জারি আছে ফ্রি হয়ে কল করব তোমায়।

কথাটা বলেই কল কেটে দেয় আদৃত,মায়ের সাথে জোর দিয়ে কখনও মিথ্যে বলার ক্ষমতা বা অভ্যেস কিছুই তার নেই,সর্বদা সত্য বলা আদৃত আজ দেশে ফিরার নামে নিজের জননীর সাথেই মিথ্যে বলে,কী বা করার আছে এই কঠিন পুরুষের,দেশে ফিরার নামে যে তার বুকের ভিতরের মোচড়ের পরিমাণটা হাজারগুণ বেড়ে যায়।

সুখের অনেকক্ষণ কাটানোর পর শান্তির এক নিদ্রা যাপন করছে রিদিকা তবে পাশে শুয়ে থাকা শ্যামবর্ণের সেই মায়াবী চেহারার অধিকারী পুরুষের ঘুম নেই,হাতে নিয়েছে ফোন,সুখের ক্ষণ পেরিয়ে গেলে মাথায় আবারও ভর করল আঁখির দুঃ*চিন্তা, তাই তাকে হুটহাট কিছু ম্যাসেজ করবে ভাবল।তবে এ কী! কোনোভাবেই আঁখির সাথে যোগাযোগ
করতে সক্ষম হল না আদ্রিশ,সবকিছুতেই আঁখি ব্লক করেছে তাকে,বন্ধ করেছে তার আঁখির খোঁজ নেওয়ার সকল রাস্তা, যা ক্ষণিকে মনে অস্থিরতার যোগান দিল আদ্রিশের।

সাত সকালে আরিয়ান মির্জা সাহেবের কপালে চিন্তার বেশ কটা ভাজ পরল,উক্ত অবস্থা তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাতসকালে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে হল উনার,উনি জানেন তার স্ত্রীর কান্নার কারণ,এটা যে এখন প্রায় দিনেরই কান্ড মিসেস শায়লা মির্জার,বেশ নিরাশতা নিয়ে উনি শায়লা মির্জার কাছে এসে বসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন।

″কেন কাঁদো শায়লা?ছেলে কাজ করে ওখানে,ওর ওখানে কাজ করতে পছন্দ তাই, করতে দাও না তাকে তার কাজ,এমনি তো সারাদিন কথা বলো,কখনও কখনও মধ্যরাতে উঠে কল দাও কাল রাতে যেমনটা দিলে,এভাবে ওর সাথে কথা বল প্রায় সারাদিনই আর কি চাই তোমার?″

″আমার আর কিছু চাই না,আমার শুধু আমার ছেলেকে চাই।সেই ৬ বছর আগে হঠাৎ করে কেন চলে গেল!আর কেন আসে না ফিরে বাড়িতে! বাবা হয়ে কি কখনও জানার চেষ্টা করেছ?আমি কিছুই জানি না তুমি যে করে পার আমার ছেলেকে এনে দাও,নইলে আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।″

কথাটা বলে শায়লা মির্জা বেশ রাগ দেখিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।আরিয়ান মির্জা ব্যার্থতায় ভরা এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here