মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৩৮. #ফাবিয়াহ্_মমো .

0
66

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

নিরবে-নিভৃতে সতেরটা শাড়ির নিঃশেষ করার ঘটনা বাড়ির মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে চাহর হয়ে গেলো রুমটার ভেতর অজ্ঞাত কেউ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর মারজার অবস্থা বাকশূন্য। তিনি ডাক্তারের কাছ থেকে চেকআপ সেরে সদ্য বাড়িতে পা ফেলেছেন, পা ফেলতেই তিনি জঘন্য ঘটনার বিবরণ শুনে হতবাক। তিনি রীতিমতো ভেবেই পাচ্ছেন না, মেহনূরের ব্যক্তিগত জিনিসের প্রতি এতো ক্ষোভ কিসের? মেহনূর পুরো ব্যাপারটা বিশদ ভাবে জানালেও মারজা অদ্ভুতকাণ্ডের মতো নিরব রইলেন। কোনোপ্রকার বাক্য খরচ না করে ছাদের রুমটা দেখে এলেন, উপস্থিত সকলের পানে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শেষে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললেন,
– তুই আমার রুমে আয়। এক্ষুনি আসবি। রান্নাঘরের দিকে যাবি না, মাহতিমের রুমেও ঢুকবিনা। সোজা আমার রুমে এসে দেখা করবি।

কথার ধাঁচ দেখে চোখ ছোট করে তাকালো রজনী ইবনাত। মুখে কিছু না বললেও মনে-মনে ঠিকই মূখ্য ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে। সবাই যেখানে উপস্থিত ছিলো, অনামিকা সেখানে উপস্থিত ছিলো না। এটা নিয়ে কারোর মনে সন্দেহ না জাগলেও আসল ব্যক্তির মনে ঠিকই সন্দেহটা পাকাপাকি হয়েছে। মারজার প্রস্থানের পর রজনীও সেখানে মূহুর্তক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায়। নিজের রুমের দিকে আসার আগে চলন্ত পাদুটো অনামিকার রুমের কাছে থেমে যায়। দু’কানে এয়ারপড গুঁজে বিছানার হেডসাইডে পিঠ হেলিয়ে বসে আছে অনামিকা। চোখদুটো শান্তভঙ্গিতে বন্ধ করা, ঠোঁটদুটো যেনো গানের তালে-তালে নড়ছে, নিঃশব্দে আলোড়িত হচ্ছে কম্বলের ভেতরে থাকা পাদুটো। রজনী এ দৃশ্য দেখে দরজায় নক করলো না, কঠিন মেজাজে রুমে ঢুকে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো। তীব্র শব্দে বিছানা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো অনামিকা, হড়কে গিয়ে কান থেকে এয়ারপড দুটো খুলে এলো, হাতের ফোনটাও কোলে পরে গেলে চোখ-মুখ ক্রুদ্ধ করে দরজার দিকে তাকালো। নিমিষেই সমস্ত রাগ যেনো তরলে পরিণত হলো অনামিকার, ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ব্যর্থতা চারিদিক থেকে আগলে ধরলে নিরুত্তেজ দৃষ্টিতে তাকালো সে। রজনীর দিকে আমতা-আমতা করে গলা ভিজাতেই সঙ্কোচ সুরে বললো,

– ফু-ফু-পি তুমি এসেছো? দরজাটা খুব জোরে লাগালে কেনো?

রজনী বিছানার কাছে এসে চট করে অনামিকার দিকে এগিয়ে এলেন। বিছানার হেডসাইডে একহাত রেখে অনামিকার মুখ বরাবর ঝুঁকলেন। রজনীর কঠিন দৃষ্টি দেখে অনামিকৃ ভীতপূর্ণ উদভ্রান্ত চাহনিতে গুটিয়ে গেলো, রজনী তার অন্যহাতটা এগিয়ে খপ করে অনামিকার চোয়াল চেপে ধরলেন। অনামিকাকে বিন্দুমাত্র গোঙানোর সুযোগ না দিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

– রাতের বেলা পাকনামো করতে কে বলেছিলো? ওখানে গিয়েছো কোন্ সাহসে? আমি হাজার বার বলেছি আমি কোনো ভুল চাই না। মারজা ভাবী ঠিকই তোমাকে সন্দেহ করে ফেলেছে। একমাত্র তুমিযে এমন বিকৃত মস্তিষ্কের মতো কর্মকাণ্ড করতে পারো, সেটা উনার অজানা নয়।

রজনীর বড় বড় নখগুলো গালের চামড়ায় দাগ বসে যাচ্ছিলো, নখের তীব্র জ্বালা-যন্ত্রনায় আকুতি দৃষ্টিতে তাকালো ফুপুর দিকে। আপন ফুপুর আচরণ যে কতটা কঠিন, কতটা পাশবিক হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই তার জন্য গোপন বিষয় নয়। রজনী সত্যিই মেহনূরের আশ-পাশ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলো, সঙ্গে এটাও বলেছিলো সে যেনো কূটকৌশল না খাটাতে যায়। অনামিকা বুঝতেই পারছেনা, এবার মাহতিম নেই জেনেও কেনো তার ফুপি চেপে-চেপে চলছে। এমন পিছিয়ে-পিছিয়ে নিরব থাকার মানে কি? এসবের মূল সারাংশ আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকছে? অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রজনী ইবনাত। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, দরজার নব্ ঘুরিয়ে ফাঁক করে ফেললে একপলকের জন্য পিছু ফিরে তাকালেন। অনামিকা তখন বিপদমুক্ত হওয়ার আভাসে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ছিলো, স্বাভাবিক কায়দায় স্থির হতেই হঠাৎ একজোড়া ক্রুদ্ধদৃষ্টি দেখে আবার ভয়ে শুকিয়ে গেলো। নিজের শঙ্কিত অবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টায় জোরপূর্বক হাসি দিলো অনামিকা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না, অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকা অগ্নিদৃষ্টিটা ততক্ষণে পা চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।

.

নতশীর্ণ মুখে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো মেহনূর। শ্বাশুড়ির তলব-ধ্বনি শুনে মনটা ভয়ে আক্রান্ত। মাথায় ঘোমটা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেটা আপাতত শ্বাশুড়ির নির্দেশে পালিত হয়না। মেহনূর আচঁলখানা পিঠের উপর টেনে নিয়ে শ্বাশুড়ির মস্ত বিছানার দিকে এগুতে লাগলো। দৃষ্টিদুটো চকচকে টাইলসের উপর স্থির থাকলেও আড়চোখে মারজার কঠিনমূর্তিটা দেখে নিলো। বিছানায় আসন করে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছে মারজা, পিঠ দিয়ে আছে মেহনূরের দিকে। মেহনূর পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে খাটটা অতিক্রম করে মারজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। মারজা একপলক চাহনিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন, মেহনূরের সংকুচিত হৃদয়ের উদ্বেগ অবস্থা দেখে পাশে বসার নির্দেশ দিলেন। শ্বাশুড়ির আদেশে শির ঝুঁকানো অবস্থায় বিছানায় বসলো মেহনূর, ওমনেই তার মুখোমুখি হয়ে সুতীক্ষ্ম চাহনিতে আঁটসাঁট হয়ে বসলেন মারজা। অন্যসময় মেহনূরের হাতদুটো মাতৃতুল্য কোলের উপর দৃঢ়ভাবে টেনে নিতেন, সুকোমল হাতদুটো ধরে স্নেহের চুমু দিতেও দেরি করতেন না। আজ ব্যতিক্রম কাণ্ড ঘটানোর পাশাপাশি তিনি কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বললেন,

– রুম থেকে আর কিছু খুইয়েছে? হারিয়েছে কিছু?

মেহনূর একটু সময় নিয়ে ভেবে নিলো, এরপর নতমুখেই মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে জবাব বুঝিয়ে দিলো। মারজা উত্তর পেয়েও স্বস্তিসূচকে ফিরলেন না। জেরার প্রসঙ্গটা বজায় রেখে মেহনূরকে আবার প্রশ্ন করে বললেন,
– তোর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে? মন ঝেড়ে উত্তর দিবি। আমার কাছে কিচ্ছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।

মেহনূর এবার মাথা তুলে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। শান্ত-নিবিড়ভাবে বললো,
– না মা, আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। আমি মিথ্যা বলছি না।

মারজা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর মেহনূরের পেছনে থাকা দেয়ালঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে এবার মেহনূরের পায়ের দিকে তাকালেন। ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়তেই রুমটার ভেতর নিশ্বাসের শব্দ ছড়িয়ে পরলো। তিনি মেহনূরকে আড় ভেঙ্গে কিছুই বললেন না, পায়ের অবস্থা দেখে নির্দেশ দিলেন বিছানা না উঠতে। কথাটুকু শেষ হওয়া মাত্র নিজেই বিছানা ত্যাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এমন অত্যাশ্চর্য আচরণ দেখে আস্ফালন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় ঠাহর করতে পারলো না মেহনূর। মারজা মন শক্ত করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে পা বাড়িয়ে গেলেন, ওড়নাটা মাথার উপর ভালোমতো টেনে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমটার ভেতরে ঢুকলেন। কোনোপ্রকার সৌজন্যতা না দেখিয়ে একেবারে রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। রজনী ফোনে ব্যস্তভঙ্গিতে কথা বলছিলো, দরজা দিয়ে মারজাকে ঢুকতে দেখে সে আর কথা বলতে চালাতে পারলো না, ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চট করে কলটা কেটে দিলো। মারজার মুখের অবস্থা দেখে সন্দেহাতীত ঘটনা নিয়ে বিচলিত হলো রজনী, তবুও যতদূর সম্ভব সেটা আড়াল করে কৌতুহল গলায় বললো,

– কিছু হয়েছে মারজা আপা? আপনার মুখ এমন মলিন দেখাচ্ছে কেনো? আপনি কি মেহনূরের —

কথার মাঝপথে ছিদ্র বসিয়ে কঠোর আভাসে বললেন মারজা,
– অবশ্যই কিছু হয়েছে। আমার পিঠ-পেছনে এরকম ঘটনা আশা করা যায়নি ভাবী। আমি যখন বাড়ির বাইরে থাকি, তখন পুরো বাড়ির দায়ভার আপনার উপর দিয়ে যাই। আপনি আমার অনুপস্থিতিতে কেমন খেয়াল রেখেছেন? আমি নিতান্তই অসুস্থ মানুষ। ঔষুধের জোরে টিকে আছি। তাই বলে এমন দিন দেখতে হলো? আমারই বউয়ের রুমে ওসব তছনছ অবস্থা? আমিতো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।

মারজার উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে কিছুটা স্বাভাবিক হয় রজনী। পুরো বিষয়টাকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সামাল দেওয়ার জন্য মিথ্যা চিন্তার অভিনয় করে বিচলিত সুরে বললো,

– আমার ভুল হয়েছে আপা। অনামিকার জন্য লজ্জায় এখন মুখ দেখাতে পারছিনা। ও রাগের ঝোঁকে কাজটা করে ফেলে আপা। ওর বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। এদিকে ভাইজানেরও শেষমূর্হতে কাজের খবর এসে যায়, আপনিতো জানেন ভাইজান পলিটিক্সের মানুষ। দিনে কতলোকের সাথে উঠাবসা করা লাগে তার হিসেব নেই। তাই জন্য ভাইজান অনামিকাকে বাধ্য হয়ে না করে দেন। ও বুঝতে পারেনি, রাগের মাথায় কাজটা করার পর হুঁশ ফেরে। ততক্ষণে যা হওয়ার সব হয়ে গেছে। আমার কাছে রাতে এসেই কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। আপা আপনার হাতদুটো ধরি, আপনি মেয়েটাকে মাফ করে দিন। মেহনূরের শাড়ির ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি, বিকেলের মধ্যেই হোম ডেলিভারী করিয়ে দিবো।

রজনী এখানেই ক্ষান্ত হলো না, যতপ্রচার বশীভুত কথাবার্তা আছে সব একে-একে ফলানো করে মারজার মন সিক্ত করলো। মারজা ক্রুরহৃদয়ে এসেছিলেন ইচ্ছামতো কথা শোনাবেন বলে। পরক্ষণে ব্যাপারটা এমনভাবে উলটে যায়, মারজা তখন সমস্ত রাগ ঝেড়ে বিগলিত হৃদয়ে চলে যান। মারজাকে আজকের মতো জব্দ করতে পেরে বুকের উপর থেকে দশ টনের পাথর সরে গেলো রজনীর, ভারমুক্ত হয়ে হাঁফ ছাড়তে-ছাড়তে ধপ করে ডিভানে বসলো সে। মারজা যেমন সরল-সহজ মন নিয়ে চলাফেরা করে, তেমনি আকস্মিক রাগ নিয়ে আগমন হলে সেটা সামলা নেওয়া তেমন কঠিন কিছু না। সমস্যা হলো, অনামিকা যদি আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারগুলো ঘটায় তাহলে সোজা মাহতিমের কান অবধি পৌঁছে যাবে। বাড়ির প্রতিটি কাজে মূখ্য কর্তা হিসেবে এখন মাহতিমই গণমান্য, তার একটা কথার উপর দ্বিতীয় কথার প্রলেপ পরার সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই সে স্বাভাবিক চিন্তাধারার ব্যক্তি, হাসিখুশী থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু রাগ যখন তুঙ্গস্পর্শী হয় তখন সেটা নিচে নামানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাকে থামানো, বুঝানো, শান্ত করার জন্য নিজেরই ধৈর্য্য যেনো অসহায় হয়ে যায়, অধৈর্য হয়ে বিগড়ে যায় মেজাজ। যার মুখটা হাসিতে ভরপুর, তার রাগটা ততই ভয়ংকর।
.

গ্রামের চিরপরিচিত পরিবেশ নিয়ে যদ্দূর বর্ণনা খাটে, তাতে হয়তো সরল-সহজ জীবনযাত্রার দৃশ্যপট ফুটে উঠে। চিত্রিত হয় সবুজে ঘেরা মেঠোপথের রাস্তা, মানসপটে ভেসে উঠে সরলভাবে রোজগার করা পুরুষ কর্তার শ্রম। দিনের শুরুটা সূর্যাদয়ের সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিলো, জাগতিক কর্মকাণ্ডগুলো শুরু হয়েছিলো স্বাভাবিক নিয়মে। খাঁ খাঁ করা খরাক্রান্ত জমি, মাথার উপর জলন্ত সূর্যপিণ্ড দাপুটে রাঙা ছড়াচ্ছে। জমির একদিকে টিনের বাংলাবাড়ি বানানো, বাড়িটাও পুরোনো হয়ে টিনের উপর জংয়ের আস্তরণ পরেছে। আশেপাশে কোনো জনবর নেই, দূর-দূরান্ত শুধু ফসলি জমির জায়গা। যারা ফসলী জমিতে এতোক্ষণ কাজ করছিলো, তারাও দুপুরের আহার সারার জন্যে বাড়িমুখী হয়েছে। নির্জন ধূ ধূ করা মাঠের সেই বাংলাবাড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে এক লোক। যার বয়সটা চল্লিশ পেরিয়ে পয়তাল্লিশের কাছাকাছি এসেছে। পড়নে ময়লা লুঙ্গি, গায়ে পাতলা ধরনের গোল ছলার গেন্ঞ্জি। সাদা গেন্ঞ্জিটা এখন আর সাদা নেই, সাদা রঙকে ভিজিয়ে-ভিজিয়ে রক্তিম রঙে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখের ডানকোণা ফেটে র’ক্ত ঝরছে অনবরত, মুখ দিয়ে ঝরছে বিন্দু-বিন্দু র’ক্ত, হাতদুটো পিছমোড়া করে বাধঁলেও পাদুটো শক্ত শিকলে পেঁচিয়ে রেখেছে। নিশ্বাসের গতি এতোটাই ধীর ভাবে চলছে, লোকটা নিশ্বাস নিতেও যেনো ম’রণ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। বুকের ছাতি যেনো ফেটে যেতে চাইছে তার, গলা শুকিয়ে খরার মতোই রুক্ষ হয়ে গেছে, চক্ষুর লোলুপদৃষ্টি যেনো ঝাপসা-ঝাপসা। হঠাৎ মাথার উপর কঠিন ব্যথা অনুভব করলে চিৎকার করতে গেলো লোকটা, কিন্তু আফসোস, গলা ভেদ করে শেষ শব্দগুলো যেনো কুন্ডলী পাকিয়ে আঁটকে যাচ্ছে। চিৎকার করতে যেয়ে ব্যর্থ হলে জোরে-জোরে কাশতে থাকে লোকটা, তখুনি ঝাপসা দৃষ্টির সামনে টিনের বদ্ধ দরজাটা দু’ধার বরাবর খুলে গেলো। উন্মুখ দুয়ার দিয়ে ঢুকলো কয়েক জোড়া পদযুগল। ঝাপসা দৃষ্টিতে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা লোকটা, গোঙানির মতো চেঁচাতে গেলে ঠোঁটের কিনারা দিয়ে তরল রক্ত পরতে লাগলো তার। মাথাটা নিচে নোয়ানো থাকলেও আকস্মিকভাবে আবারও চুলে টান খেয়ে মাথা তুলে তাকালো, বুজে আসা চোখ দিয়ে পিটপিট করে তাকাতেই অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো সামনে এখন কে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা হলফমাত্র দেরি করলো না, ভয়ে-আতঙ্কে উপস্থিত সবার সামনেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। টিনের ঘরটার ভেতর লোকটার ক্রদনধ্বনি দফায়-দফায় বেজে উঠছিলো, পদযুগল এসে একদম কাছাকাছি থামলো। কেবল একজোড়া বৃদ্ধ পা এসে দু’কদম বেশি এগিয়ে এলো। লোকটা কান্না স্ফীত না করে হাউমাউ করেই বলতে লাগলো,

– আমারে ছাইড়া দেন হুজুর। ও হুজুর, আমি ভুল করছি আমারে মাই’রেন না। আমি আপনারে কিডনী বেইচা হইলেও টেকা পরিশোধ কইরা দিমু। আমারে এইবারের লিগা ছাইড়া দেন হুজুর, আমি কারুর কাছে কিচ্চু কইবার যাইতাম না। এই দেহেন কিরা কাইটা কইতাছি, আমি কালকাই আপনের টেকা দিয়া যামু। আমারে মাই’রেন নাগো হুজুর। আমার বউ পোলাপাইন ক্যামনে চলবো? আমি ছাড়া ওগোরে কেউ দেখতো না হুজুর।

বৃদ্ধ পদজোড়ার ব্যক্তিটা কথাগুলো নিরবে শুনলেন, শোনার কয়েক মূহুর্ত স্থির থেকে মাটিতে নতজানু হয়ে বসলেন। মাটিতে বসার দৃশ্য দেখে চেলারা সবাই হৈহৈ করে মাদুর-পাটি বিছিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু বৃদ্ধ লোকটার আঙ্গুলী নির্দেশ দেখে সবক’টা সেখানেই থেমে গেলো। ক্ষতবীক্ষত লোকটা অশ্রু টলটল চোখে বৃদ্ধর সহানুভূতির আভাস পেয়ে শান্ত হতে লাগলো, কান্নার হিড়িকে কাঁপতে-কাঁপতে বললো,

– হুজুর…

চোখের পলকে সবকিছু বীভৎস অন্ধকারে ছেয়ে গেলো, কানের ভেতর মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করতে-করতে মাথাটা ঝিমিয়ে এলো। ঝাপসা দৃষ্টিটা আরো সংকুচিত হতে-হতে ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে নরলো। চোখের সামনে প্রহেলিকার অন্ধকারে ছেয়ে গেলো লোকটার, ফে’নকি দিয়ে তরতর র’ক্ত-বন্যা জায়গাটা সিক্ত করতে লাগলো। নতজানু অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ, মাটিগুলো ঝাড়া দিতে-দিতে চেলাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,

– ওর বাড়ির কেউ জানে?

উক্ত চেলাটা ব্যস্তভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
– না, মোল্লা হুজুর। ওর বাড়িতে কেউ জানে না। জানে ওয় আবার গান্ঞ্জা টানতে উধাও হইয়া গেছে। কেউ ওর খবর মালুম করতে পারবো না মোল্লা হুজুর। আমি আপনারে নিচ্চিন্ত দিতাছি। ওর আষ্টগুষ্ঠিও ওর খবর উদ্ধার করতে পারবো না। আপনে ঠান্ডা মাথায় বাড়িত যান। বাকিডা আমরাই দেখতাছি।

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে হাতদুটো কোমরের কাছে বেঁধে নিলেন হান্নান শেখ। যেই ভঙ্গিতে তিনি এখানে এসেছিলেন, একই ভঙ্গিমা বজায় রেখে চুপচাপ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনজন চেলা আগে থেকেই পথঘাটের অবস্থা দেখে এসেছে, রাস্তায় মোসাদ্দেক চাষা ছাড়া আর কেউ ক্ষেতে ফিরেনি। তারা হান্নান শেখকে অন্য রাস্তার খবর দিয়ে সেদিক বরার বাড়ি ফিরতে বলে দিলেন, হান্নান শেখ আবারও ধূর্ততার সাথে সকল গ্রামবাসীর চক্ষু আড়ালে কাজ সেরে এলেন। নিজের বাড়িতে ফিরে কলপাড়ে গিয়ে সাদামাটা ভাবেই হাতমুখ ধুলেন, সুজলাকে একগ্লাস পানির চাহিদা প্রকাশ করে নিজের ঘরের দ্বার ঠেলে ঢুকলেন। ঘরের এককোণে থাকা আলনা থেকে শুকনো গামছা নিয়ে মুখ মুছতেই সুজলা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ‘ আব্বা, আপনার পানি ‘ বলতেই হান্নান শেখ প্রসন্ন হাসিতে বললেন,
– বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই বড় বউ। ভেতরে এসে গ্লাসটা রাখো।

সুজলা ঘরে ঢুকে ছোট্ট কাঠের টেবিলে গ্লাস রাখতেই হান্নান শেখ কনুই পযর্ন্ত হাত মুছতেই বললেন,
– আমার নাতনীটার কোনো খবর আনছো বড় বউ? শানাজের সাথে যোগাযোগ হয়?

সুজলা উদাস মুখে চোখ নামিয়ে বললো,
– আব্বা, শানাজের ফোনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা নাকি কাজ করেনা। সুরাইয়া রাগ দেখিয়ে ফোনটা যে আছাড় মারলো, ওটা আর ঠিক হয়না।

হান্নান শেখ ভাবুক ভঙ্গিতে গামছাটা সুজলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সুজলা শ্বশুড়ের ভেজা গামছাটা নেড়ে দেওয়ার জন্য চলে গেলে হান্নান শেখ তার ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলেন। চোখদুটো শ্রান্তিতে ঢুলে আসছে, ইজিচেয়ারে দোল খেতে-খেতে তিনি জীবনের মস্ত বড় ভুলটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মারজাকে যখন বিয়ে দেওয়া হলো, তখন হয়তো জানাই ছিলো সে সেনাসদস্যের স্ত্রী হয়েছে। মারজার সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্নতার বিশেষ কারণ হয়তো এটাই ছিলো, মারজার স্বামীর পেশাগত জীবন। হান্নান শেখ স্বেচ্ছায় মারজার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, কিন্তু মারজার সেই স্বামীই যখন দুনিয়ায় নেই, তখন এসব নিয়ে আর চিন্তায় পড়তে হয়নি। মারজা বহু বছর পর তার ভিটেবাড়িতে ঘুরতে এসেছিলো, স্বপরিবারে না এলেও যাদের নিয়ে এসেছিলো, বেশ ভালো করেই খাতির করেছে হান্নান শেখ। এখানেই তিনি বিশাল বড় ভুলটা করে ফেলেন। যেই ছেলেকে তিনি সহজচিত্তের সুপুরুষ ভেবেছিলেন, ওই ছেলে সহজের কাতারে কোনোদিন পরতোনা। মারজার ছেলেকে নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করার ইচ্ছা তার ছিলো না, ওরকম মনোবৃত্তিই তার উদয় হয়নি। মারজা যখন নিজ থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন, তখন আশেপাশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে মেহনূরকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেন। আচ্ছা, মেহনূর কি আদৌ এ বিয়েতে মন থেকে রাজী ছিলো?

.
দেশের সর্বত্র নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। ভারি-ভারি মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে সূর্যটা। খুব যে একটা ঠান্ডানুভব হচ্ছে তাও অবশ্য না। মেঘগুলো যেনো বিষণ্ণতায় উত্তীর্ণ হয়ে সূর্যকে আড়াল করে দিয়েছে। তার উপর পৃথিবীর এ প্রান্তে আজ কড়া আলো পরেনি। সময়ের আবহকাল ছুটতে-ছুটতে দিনপন্ঞ্জিকার মাসগুলো পালটে দিচ্ছিলো। জাদুদণ্ডের কারসাজির মতোই পেরিয়ে যাচ্ছিলো ঋতুময় চক্রটা। মারজা দিনকে-দিন অসুস্থ হয়ে পরছিলেন, মাথার যন্ত্রণার জন্য নানাপদের ঔষুধ গিলতে হত। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি শয্যাশায়ী থাকতেন, প্রচণ্ড যন্ত্রনায় কাতরাতে-কাতরাতে একপর্যায়ে ঘুমে ডোজে ঘুমিয়ে পরতেন। মেহনূর চারটা মাসের ভেতর পুরো আনসারী নিবাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। চুপচাপ-নিরবে কাজ সেরে যাওয়াই মেহনূরের আসল কর্ম ছিলো, নিজেকে সংসারের হালে মিলিয়ে নিলে আস্তে-আস্তে অনেক কিছুই বুঝতে শিখলো। জীবনের গম্ভীরতা আজও তাকে কঠিনভাবে ভুগাচ্ছে, সে এখনো কারোর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি। মারজার সাথে যতটুকু হৃদতাপূর্ণ মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কেবল মাহদির সাথে একটু-আধটু। রজনী যে কিসের জন্য নিরব থাকতো, সেটা আস্তেধীরে বুঝতে লাগলো অনামিকা। চার-চারট মাস কচ্ছপের খোলসের মধ্যে মাথা গোঁজ করে আছে রজনী, কাঙ্ক্ষিত সময়টার জন্য যেনো বাঁকা হাসিতে অপেক্ষা করছে সে। পন্ঞ্চম মাসটার শুরুর দিকে ভিডিও বার্তায় যুক্ত হলো আটজন, আজ তাদের সম্মেলনে মাহদি যুক্ত নেই। সময়টা বাংলাদেশ টাইম রাত দুটোর দিকে চলছে, অন্যদিকে আমেরিকায় চলছে সকাল বারোটার মতো। দু’দেশের দু’প্রান্ত থেকে মোবাইল-পিসি-ল্যাপটপে একত্র হলো সবাই, প্রথমে হাসি-ঠাট্টায় কুশল চললো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে চিন্তিত বিষয়ধারা চলে এলে ফারিন প্রথম প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো,

– আচ্ছা তোমরা একটা কথার জবাব দিবে? আমি জাস্ট ফ্যাড আপ হয়ে গেছি, তবুও কোনো আন্সার বের করতে পারলাম না। রজনী মামীকে কেনো আমরা ভয় পাচ্ছি? কেনো আমরা ওই মহিলাকে ভয় পাচ্ছি? আমি নীতি আপুকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, বাট নো আন্সার। তৌফ ভাইয়াকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, সে এ্যাজ-অলয়েজ আমাকে ঝারি মারলো। আমার প্রশ্নের উত্তর কেউ দিবে? প্লিজ আমি কোনোভাবেই তোমাদের ভীতু হওয়ার রিজ্যান ধরতে পারছিনা। তোমরা কেনো আমাকে ছোট-ছোট করে আন্সারটা দিচ্ছো না? আমিতো মুখচোরা না, পেট-পাতলাও না।

ভিডিও কলের আওতায় সবাই যেনো চুপ রইলো। চুপটি থাকার পর নীতির কাছেই বিষয়টা উদ্ভট ঠেকতে লাগলো। আসলেই তো, কেনো ফারিনকে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে না? আর কতো চুপিচুপি? নীতি সব চিন্তা উপেক্ষা করে গলা পরিষ্কার করে নিলো, কানের এয়ারপডটা ঠিকঠাক করে শান্ত গলায় বললো,
– ফারিন শোন, রাগ করিস না। তোকে না বলার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, কিন্তু টেনশনে ছিলাম যদিনা আবার প্রবলেম ক্রিয়েট করে দিস। শোন তাহলে, রজনী মামীর ভা —–

কথাটা ভয়ংকর ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে চট করে বলে উঠলো সিয়াম,
– তুই চুপ কর্। তোর ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে কান দিয়ে র’ক্ত বের হইবো। আমি বলি, রজনী বেডির ভাই একটা তুখোড় মাল। রাজনীতি করে, একনামে সবাই চিনে। তুইও দামী মালটারে চিনোস। নাম আর ভাঙ্গায়া বললাম না। আগুন-আগুন যুদ্ধ লাগলে কেমন অবস্থা হইবো চিন্তা করছোস? চিন্তা করোস নাই। মাহতিম যদি শান্ত থাকতো ওরে নিয়া টেনশন কাজ করতো না, ওর মেজাজের উপর বিশ্বাস নাই ফারিন। যদি একবার খারাপ হয় জানো’য়ারের মতো সবগুলারে ছিঁ’ড়া ধরবো। ওই বেডিরে আমরা ভয় পাই না ফারিন। ভয় পাই ওই লোকটারে। ওই লোক খুবই পাওয়ারফুল। আমার নিজের বাবা পযর্ন্ত ওই লোকটার কাছে যাওয়ার আগে দশবার ভাবে। নাহলে অনামিকারে আমরা ছাড়তাম? ওরে না চুলের মু’ঠি ধইরা কাদার মধ্যে ডুবাতাম! সাহস আছে ঠিকই, কিন্তু ভয়টা কোনদিকে করতেছে এইটা একটু বুঝিস ফারিন। সবাই আমাদের বাইরের অবস্থা দেইখা ভাববো, আমরা এমন দাপট দেখাই, অথচ সামান্য দুইটা ডাই’নীর কাছে কুঁজো হয়ে আছি ক্যান। ভাই, আমরা যতোই তোপ দেখাইতে যাইনা ক্যান, এইসব মানুষ ক্যামনে যে বুকের উপর কলি’জা টাইনা ধরবো আন্দাজও করতে পারবিনা।

ফারিন কোনো কথাই বলতে পারলো না। আস্তে করে কলটা কেটে গিয়ে অফলাইন চলে গেলো।
.

ঋতুচক্রের সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া যেনো বিচিত্র রূপে পালটে গেছে। নীলচে আকাশ যেনো ভারী-ভারী মেঘের বেশভূষায় গা ঢেকে নিয়েছে। আকাশটাকে ধূসরবর্ণে মূর্ছিত করে নিভিয়ে দিয়েছে দিনের আলো। ঠান্ডা শীতল হাওয়া যেনো জেঁকে বসেছে শহরের বুকে। শহরের নগরীতে যেনো হিমেল হাওয়ার তোড়জোড় চলছে। ঘড়ির সময়সীমা হিসেবে বেলা তিনটে বাজে, অথচ প্রকৃতির অবস্থা দেখলে মনেহয় সান্ধ্যাহ্নিক প্রহর। মেহনূর নির্মলচিত্তে সমস্ত কাজ সেরে আবারও প্রাণ-প্রনয়ের শূন্য শয্যায় বসে আছে। বসে-বসে উবু হয়ে মাহদির দেওয়া নতুন ডায়েরীতে নিজের শব্দ-সম্ভাষণ লিখছে। রুমের ভেতরকার অবস্থা আজও আবছা অন্ধকার, যদিও সবগুলো জানালা খুলে দেওয়া। উন্মুক্ত জানালার পর্দাগুলো উত্থাল হাওয়ায় উড়ছে, টালমাটাল প্রকৃতির রূপ যেনো সস্নিগ্ধ ধারায় প্রফুল্ল। গাঢ় রেগুনি রঙের জামদানীটা কি ভেবে যে বাঙালী কায়দায় পরেছে জানা নেই, তবে বেগুনী ব্লাউজটার হাতটা এবার যেনো খাটো। মাথায় আজ ভুলবশত ঘোমটা দিয়েছিলো মেহনূর, কিন্তু বাতাসের দাপটের কাছে হার মেনে একনিমিষেই মাথা থেকে সরে গেলো ঘোমটার কাপড়। এক ঝটকায় সরতে গিয়ে মেদহীন পিঠটার উপর থেকেও আচঁলখানা খসে পরলো, উন্মুক্ত হয়ে উঠলো ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী কোমরের অংশটা। লিখতে গিয়ে ভারী বিরক্ত হলো মেহনূর, কলমটা ডায়েরীর পাতায় ফেলে হাত উলটে আচঁলখানা টানতে গেলো, কিন্তু বৃথা হয়ে চেষ্টাটুকুতে হাল ছেড়ে দিলো মেহনূর। রাশি-রাশি চুলগুলো খোপায় মুড়ে কাধের কাছে জড়সড় করে বেঁধেছিলো, সেখান থেকে চুল ছুটতে-ছুটতে অনেক চুলই কানের দুইধার দিয়ে বেরিয়ে পরেছে। ডায়েরীর পাতায় আবার মনোযোগ দিলো মেহনূর, প্রতিটা শব্দ যেনো হৃদয়ের আদর মাখিয়ে লিখছে। অশান্ত হাওয়ায় মত্ত প্রকৃতিটা মেহনূরের সাথে যেনো লুকোচুরি করে খেলছে। হাওয়ার সেই চন্ঞ্চলতা-অস্থিরতা-উন্মত্ততা সশব্দ সমারোহে শোঁ শোঁ করতে থাকলে চারিদিক থেকে মুখর হতে লাগলো গাড়ির বিকট হর্ণের আওয়াজ। বাতাসের শোঁ শোঁ হাসিটার সঙ্গে নিরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দাপুটে হর্ণটা, সূদূর থেকেই যেনো বাজাতে-বাজাতে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে জানান দিয়ে আসছে। আগমনী সূত্রে সংকেত যেনো বাতাসের শব্দ চিড়ে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে। উৎকট আওয়াজের যন্ত্রণায় চিকন দুটো ভ্রুঁ তৎক্ষণাৎ কুঁচকে এলো, সুকোমল ওষ্ঠাধর কঠোরভঙ্গিতে শক্ত হয়ে উঠলো। কলমটা আবারও ছেড়ে দিয়ে খোলা জানালার থেকে তাকালো মেহনূর। বিরক্তিতে চূর্ণ হয়ে কঠিন কিছু কথা বলতে নিচ্ছিলো, ওই সময়ই খেয়াল করলো কলমের নিপটা অজান্তেই বেরিয়ে গেছে, এদিকে ভকভক করে কালি বেরিয়ে ডানহাতটা কালিঝুলিতে বিশ্রী অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে হর্ণের শব্দ একবিন্দু হ্রাস হয়নি। মেহনূর আবারও খোলা জানালা দিকে শব্দ উৎসের জন্য কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। ইচ্ছা করছিলো এখুনি জানালা দিয়ে দেখে আসতে, কিন্তু কালির দূর্দশা দেখে হাতটা ধোয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো মেহনূর। তখনই বাতাসের সোল্লাসে বাইরে থেকে চিল্লানো সুরে ছুটে এলো কন্ঠধ্বনি,

– মেহনূর আফরিন, আনসারী হেয়ার!

#চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা : যারা জানেন না তাদের জন্য নোটবার্তা সংযুক্ত করেছি, আমার ফোন নেই। কাজেই অন্যের ফোন দিয়ে বহু কাহিনী শেষে রাত বারোটায় পোস্ট করতে পারলাম। এটা আমার জন্য সুখের না দুঃখের জানা নেই। কেননা, প্রচুর যন্ত্রনা সহ্য করে শেষে পোস্ট করতে পারার আনন্দ কাজ করছে। আবার অনেক বেশি দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখও লাগছে। বেখাপ্পা কোনো অসংগত লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here