মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৩৯. #ফাবিয়াহ্_মমো

0
70

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

– মেহনূর আফরিন, আনসারী হেয়ার!

চিৎকারের কল্লোলধ্বনি চর্তুদিকে জানান দিলো সে এসেছে। বাতাসের সাথে বেজে উঠলো পরিচিত কন্ঠের তেজীভাব। আজ বহুদিন, বহুকাল পর নীড়ের মাঝে ফিরেছে। ফিরেছে হাতে গোণা চারটি মাসের ব্যস্তময় কর্মজীবন কাটিয়ে। বাতাসের উত্থাল-পাত্থাল বৈরি অবস্থা প্রকৃতিকে অশান্ত করে দিচ্ছে, আশেপাশের ধূলো উড়িয়ে অন্ধকারকে ডেকে আনছে, আকাশের সূর্যহীন নিষ্ক্রিয় অবস্থা বারিধারার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। দিনের অবশিষ্ট আলোটুকু এক লহমায় চোখের পলকে নিভে গেলো, অন্ধকারকে ডেকে এনে বৃষ্টির সোল্লাসকে বরণ করলো। বড় বড় ফোঁটায় ঝপ করে বৃষ্টি নামলো তখন। মেদিনী ভিজিয়ে সিক্ত করলো ধূলোর কারসাজিকে। ওয়াশরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে আকস্মিক বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আছে মেহনূর। হাতদুটো বেসিনের ট্যাপের নিচে সাবানমুক্ত করার জন্য ধীরেসুস্থে ধুচ্ছে, হাতের মুঠোদুটো কচলে-কচলে ধুতেই মনের ভেতর আওড়াতে লাগলো, ‘ তুমি আজ কেনো এলে বৃষ্টি? তোমাকে দেখলে বারবার ওই মানুষটার কথা মনে পরে। জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে যখন তোমাকে ছুঁতে যাই, তখন প্রথম ছোঁয়ায় যে শিরশির অনুভূতিটা হয়, যেই আনন্দাপ্লুত সুখটা মনের উঠোনে দোল লাগিয়ে দেয়, যেই একটুকরো হাসিটা ঠোঁটের উপর চনমনিয়ে ফুটে উঠে, তাঁর স্পর্শ পেলে, হাসি দেখলে, কন্ঠ শুনলে আমার কেমন অনুভব হয় তাতো বোঝানো অসম্ভব। আমিতো তাঁকে কিছুই বলতে পারিনা। আমার এই না-বলা ভাবটা কবে শেষ হবে জানি না। আমার না-বলা কঠিন অনুভূতির কথাগুলো যদি প্রকাশ হয়ে যেতো, যদি কখনো উনি জানতে পারতেন আমি উনার প্রতিটি স্পর্শ-গন্ধ-কথা মনের কোণে সযতনে রেখে দিয়েছি, তখন কি
উনি আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাতেন? উনার ওই শূন্য বুকটার উপর একটুখানি টেনে নিতেন না? আমার এই অর্ন্তমুখী স্বভাবটা আমার অন্তরটাকে বিরোধী বানিয়ে দিয়েছে, পদেপদে বিমুখ বানিয়ে আজ কতখানি ক্ষতি করে দিয়েছে তাতো লোকের কাছে দেমাকী, অহংকারী উপাধি হিসেবে খোটা পেয়েছি। আর কি চাইবার আছে কিছু? ‘

নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করে জানালা থেকে দৃষ্টি সরালো মেহনূর। জোরে এক লম্বা নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের কালিগুলো হালকা হয়েছে বটে, তবে পুরোপুরি মিটে যায়নি দেখে বিরক্তিতে হ্যান্ডওয়াশে আবার চাপ দিলো। ফোস করে একটুখানি লিকুইড হাতের তেলোয় আসতেই পুনরায় ফেনা তুলে কালির জায়গাটা ধুতে লাগলো। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে বাঁহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ডানহাতের তালুটা সমানতালে ঘষতে থাকলো মেহনূর, ওমনেই দরজায় টুকটুক করে শব্দ করে উঠলো। সহসা হাতদুটো থমকে বেসিনের আয়নার দিকে দৃষ্টি তুললো মেহনূর, আয়নার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পেছনে থাকা বদ্ধ দরজার উদ্দেশ্যে একপলক ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তখনই বাইরে থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
– দরজা খোলো মেহনূর।

মেহনূর বিরক্তিতে সেদিকে আর বিশেষ ভাবে পাত্তাই দিলো না। উলটো আকস্মিকভাবে রাগ দেখিয়ে কাজে লিপ্ত হলে হাত ধুতে-ধুতে বললো,

– আমাকে বিরক্ত করবেন না। দরজায় শব্দ করা বন্ধ করুন, এখান থেকে চলে যান।

মেহনূর ভ্রুঁ কুঁচকে কঠিন ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে কাজ করতে থাকলে আবারও বাইরে থেকে বাক্যসুর ভেসে এলো,

– আমি তোমাকে বিরক্তি করছি? রুমটা তো আমার। তুমি কাকে চলে যেতে বলছো?

প্রচণ্ড বেখেয়ালি ছিলো মেহনূর। এমনেই কালির উটকো যন্ত্রনার জন্য রাগ লাগছে, তার উপর বাইরে থেকে এরকম উদ্ভট কথা শুনে বিরক্ত হয়েই জবাব দিলো,

– হ্যাঁ, আপনাকেই চলে যেতে —-

ট্যাপের নিচে কচলাতে থাকা হাতদুটো থেমে গেলো এবার। বুকটায় ধড়াস করে কড়াঘাত বাজতেই গলা শুকিয়ে এলো মেহনূরের। অত্যাশ্চর্য চাহনি নিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো, শান্ত-স্থির-স্বাভাবিক নিশ্বাসগুলো ক্রমশ অশান্ত-অস্থির-অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে যেনো ঠোঁটের বাষ্পটুকুও শুষে ফেলেছে, খরার মতো শুষ্ক ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে জিভ দিয়ে সিক্ত করলো মেহনূর। ছলছল করে ট্যাপের পানিটাও বন্ধ করার মতো হেলদোল নেই তার , থেমে-থেমে জোরে নিশ্বাস টানতেই বুকটা ক্রমাগত উঠা-নামা করছে। মেহনূর কাঁপা-কাঁপা গলনালিতে বহুকষ্টে ঢোক গিলে মাথা পিছনে ঘুরালো। ট্যাপটা ওভাবেই ছেড়ে মূঢ় ভঙ্গিতে নির্বাক দৃষ্টিতে দরজার দিকে পা বাড়াতে লাগলো। হাঁটতে গিয়ে যেনো ওয়াশরুমের ফ্লোর থেকে ভুলবশত শাড়ি না ভিজে না, সেজন্য বাঁহাতে কুচিগুলো ধরে ধীরগতিতে শাড়িটা উপরে তুললো। দরজার মুখোমুখি এসে ডানহাত এগিয়ে খট করে ছিটকিনি খুললে দরজাটা তখন সরু মতোন ফাঁক হলো। মেহনূর আরেকবার নিজেকে আশ্বস্তরূপে স্বাভাবিক করার উছিলায় চোখ বুজে ঢোক গিললো, দরজার রূপালি হ্যান্ডেলটা ধরে হালকাভাবে টান দিয়ে নিচুদৃষ্টিতে রুমের ভেতরে পা ফেললো। মুঠোয় ধরা কুচিগুলো ছেড়ে দিয়ে নত দৃষ্টিটা উপরে তুলতে লাগলো মেহনূর, উপরে তুলতেই তৎক্ষণাৎ শূণ্য বিছানার দিকে নজর আঁটকে গেলো। দৃষ্টিজোড়া আর উপরে তুলতে পারলো না। শরীরের উপর তখনই বয়ে গেলো ঠান্ডাশীতল হাওয়া, ফুলানো বুকের নিশ্বাসটা ওই ছোট্ট বুকের মধ্যেই আঁটকে গেলো, হাতদুটো সাথে-সাথে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেলো মেহনূরের। যেই বিছানায় একটু আগে ডায়েরী-কলম-বই ছাড়া অন্য কোনো বস্তু ছিলো না, এখন সেখানে নেভি ব্লু শার্টটা খুলে রাখা আছে কোমরের কালো কুচকুচে বেল্টটা শার্টের একপাশে জায়গা নিয়েছে। ব্রাউন রঙের ঘড়িটাও উলটো হয়ে নির্বিকারে ঠাঁই নিয়েছে যেনো। পুরো রুমের ভেতর কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে, নিশ্বাস টানলেই যেনো তিরতির করে মোহনীয় সুভাষটা ইন্দ্রীয়শক্তিকে পৌঁছে যাচ্ছে। মেহনূর অবলীলায় বিশ্বাস করতে বাধ্য, এই মূহুর্তে কি হতে যাচ্ছে। নিজের বেখেয়ালি ভুলের জন্য আবারও তার সাথে রুষ্ট আচরণ করেছে মেহনূর। দফায়-দফায় খারাপ ব্যবহার পেয়ে নিশ্চয়ই মানুষটা স্থির মেজাজে থাকবেনা। তাঁর রুক্ষ আচরণের কঠোরতা না দেখলেও চড়া মেজাজের শঠ ধ্বনি ঠিকই শুনেছে মেহনূর। বিছানায় যেভাবে শার্ট-বেল্ট-ঘড়ি ফেলে রেখেছে, তাতে মনেহচ্ছে রোষানলে দীপ্ত হয়েই ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছে সেগুলো। মেহনূরের অবচেতন সুপ্ত মনটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে, জানালার কাছেই হয়তো মানুষটা রক্তিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতরটা এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে, জানালা দিয়ে বৃষ্টির উন্মত্ত বারিধারার ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে, ফ্লোরস্পর্শী লম্বা-লম্বা পর্দাগুলো এখনো হালকা হাওয়ায় উড়ছে। মনের উপর বল প্রয়োগ করে ভয়ের রেশটা কিন্ঞ্চিৎ কাটালো মেহনূর। তাঁকে একটুখানি দেখার জন্য চোখের ভয়যুক্ত চাহনিটা ধীরে-ধীরে বাঁদিকে ঘুরাতে লাগলো, জানালার অভিমুখে ঘুরাতেই এতোক্ষণ যেই অবস্থাটা মনের উপর হালকাভাবে উত্থাল করছিলো, সেটা তীব্রভাবে মনের কুটিরে হামলে পড়লো। জানালার কাছে নির্বিঘ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। শোঁ শোঁ করে বৃষ্টির সঙ্গে আসা হিমেল হাওয়াটা তার উন্মুক্ত দেহটাকে প্রাণনাশক বানিয়ে দিয়েছে। সৌষ্ঠব্য দেহের পেশিগুলো শার্টহীনতার কারণে আরো তীব্রভাবে পরিদৃষ্ট। তাঁর হাতদুটো সে বুকের কাছটায় দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে, নয়তো ক্ষোভের রোষে ভাঁজ করে রেখেছে। জানালার দুদিকের পর্দাগুলো তাঁর উপস্থিতিতে কেমন চন্ঞ্চলীভূত হয়ে নাচছে। মেহনূর ওই লম্বামূর্তি দেখে দুঠোঁট চেপে ডুকরে কেদেঁ উঠলো। মাথাটা নত করে ভেজা চোখে তার দিকে এগুতে লাগলো। নিঃশব্দ কদমে মানুষটার এগুলেও সেই রোষাক্রান্ত মানুষটা ঠিকই কানের কর্ণধারে পদধ্বনি টের পাচ্ছে। গূঢ় অভিমানের চেয়ে মনের মধ্যে রাগের উত্তাপটাই আজ বেশি। বেহায়ার মতো গাড়ি থেকে না বেরিয়েই মেহনূরকে চিৎকার করে ডাকলো, অথচ মেহনূর একবারও জানালা দিয়ে চুপি দিলো না। আনসারীর নিবাসের প্রতিটা জানালা দিয়ে বাড়ির চাকর-বাকর, মা, মাহদি, বিশেষ দুই অতিথি কৌতুহলের চাপে মুখ বাড়িয়ে দেখলো, কিন্তু নিজের প্রাণান্তিকা প্রণয়ী বউ তাকে একপলক দেখলো না। ইচ্ছা ছিলো, বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকার সময় এমন বদমাইশ ধরনের কাজটা করলে মেহনূর লজ্জায় রাঙা হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু, বাস্তবে যেটা হলো সেটা অপমান ছাড়া কিছুই হলো না। জানালার ঠিক এই পর্দাগুলোই উড়লো, সেখানে কেউই এলো না। অবজ্ঞার রেশ যদি এখানেই শেষ হতো, তবে মাহতিম নিজের অশান্ত মনকে বুঝ্ দিতে পারতো। কিন্তু এখানে এসেও তার চেয়ে দ্বিগুণ অবহেলার স্বীকার হলো। চারটা মাসের ইতি টানার পর, মাহতিম আশায় ছিলো এবার হয়তো মেহনূর দূরত্বের গুরত্ব বুঝবে। যেই সুক্ষ্ম একফালি দূরত্ব তাদের প্রণয়পর্বে ফাঁক ছিলো, সেটা মেহনূর নিজেই ঘুচিয়ে আদর করবে। সেটার পরিবর্তে মেহনূর তাঁকে চলে যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করে বুঝালো। চারটা মাসের ভেতর কতরাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে, কতবার ঝিমুনি চোখ নিয়ে কাজ সেরেছে, নিজের আবেগের দুয়ার আবদ্ধ রেখে দুটো ইচ্ছের কথা পযর্ন্ত ফোনালাপে জানায়নি। এতোকিছু কার জন্য করলো? মাহতিম বৃষ্টির প্রবলধারার দিকে আর তাকিয়ে রইলো না, চোখদুটো নিবিড়তায় আচ্ছন্ন করে বন্ধ করলো। কানে পায়ের আওয়াজটা তীব্র হতে-হতে কাছে এসে থেমেছে। কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য রুমটা শান্ত, স্তব্ধ হয়ে থাকলো, বৃষ্টির পতনধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। মাহতিমের কাছাকাছি এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর, কথা বলার জন্যই মূলত এতোসময় যাবৎ সময় নিচ্ছিলো। কি কথা দিয়ে গা ঢাকা দিবে সেটা কোনোভাবেই হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছিলো না। শেষমেশ কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে গলাটা একটু সাফ করতেই আস্তে-আস্তে বলে উঠলো মেহনূর,

– হাতমুখ ধুয়ে নিন। আপনার খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছি।

মাহতিম চোখ না খুলেই নিগ্রহের সাথে বললো,
– খাবো না। তুমি তোমার রুমে যাও।

কথাটা তীরের মতো বিঁধে উঠলো, সাথে-সাথে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। চারটা মাস ধরে নিজেকে এই রুমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভেবেছে, যদিও এই রুমের উত্তরোত্তর ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তেমন অটুট হয়নি, তাই বলে সে কখনো নিজেকে অযোগ্য ভেবে কার্পণ্য করেনি। কন্ঠের আভাস ও কথার অবস্থা দেখে মন থেকে পরিস্কার হলো মাহতিম আসলেই শান্ত নয়। মেহনূরকে যেতে না দেখে এবার শঠতা বজায় রেখে ধমকে উঠলো মাহতিম,
– তুমি তোমার রুমে যাও মেহনূর আফরিন! আর অবহেলা দেখিয়ে আমার যন্ত্রণা বাড়াতে এসো না। প্লিজ আউট! যেতে বলেছি যাও!

ধমকের কঠোরতা দেখে ওই মূহুর্ত্তেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলো মেহনূর। আশ্চর্য হয়ে হতে গিয়ে বাকশূন্য হয়ে গিয়েছে সে। আনমনে পিছাতে-পিছাতে চোখের পলকেই পা ঘুরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মেহনূর। দরজাটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হতেই চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। মুখটা বাঁকাধের দিক এনে আবার জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত দিলো।

.
মারজা এখনো আহাম্মক হয়ে আছেন। তাঁর ছেলে যে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলো, কিভাবে ছুটির ব্যবস্থা করলো, আপাতত কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা। অনবরত পানি খেয়ে-খেয়ে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছেন, মাহতিম কি অনামিকার জন্য ফিরে এলো? নাকি মেহনূরের টানে বাড়িমুখী হলো? মাহতিমের কার্যকলাপ দেখে যেটাই অনুমান করতে যান, দিনশেষে দেখা যায় সেটার উলটোটটা করে দেখায়। এই ছেলে ঠিক তার বাবার আদল পেয়েছে। বাবাও যেমন ফট করে একটা কাজ করে বসতো, মাহতিমও চট করে কাজ করে দেখায়। মারজাকে চিন্তিত দেখে রুমের দরজার মুখে দাঁড়ালো রজনী, সে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাইনিং স্পেসের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, কিন্তু মারজার রুমে এভাবেই চোখ ফেরতে গিয়ে তাকে চিন্তিত দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। রজনী কিছুকৈষণ আপনমনে ভেবে নিয়ে দরজায় এবার শব্দ করলো, মারজার চিন্তাগ্রস্থ দুনিয়াটা তার দিকে আর্কষণ হলে রজনী হাসি দিয়ে বললো,

– আপা, খাবেন না?

মারজা চিন্তার রেশটা এখনো কাটাতে পারেননি, তাই সদুপরি হাসিটা দিয়ে একটু বেগ পেতে হলো উনার। রজনীর দিকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললেন,
– আমিতো খেয়েছি ভাবী। মেহনূর একটু আগে এসে খাইয়ে গেলো।

রজনী এটা ভালো করেই জানতো, মেহনূর এখন সংসারের দিকে তৎপর হয়েছে। মেয়েদের সুখের জন্য সর্বোপরি চাবিকাঠিটা তাদের শ্বাশুড়ির হাতে থাকে, মেহনূরের মতো গেঁয়ো ধুরন্ধরটা ঠিক এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। এরা সরল-সোজা সেজে থাকে ঠিকই, কিন্তু তলে-তলে ষোলকলা ঠিকই বুঝতে জানে। রজনী কথার হাওয়াটা পরোক্ষ করে একটু খোঁচা দিয়ে বললো,

– আপা, আপনি মনে কিছু না করলে একটা কথা বলতে চাই। আপনাকে নিজের মানুষ ভাবি বলেই কথাটা বলা। মাহতিম তো কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলো এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপা আপনার কি মনেহয়না আপনারা ওকে নিয়ে একটু বেশি আহ্লাদ করছেন? মেয়েটা গ্রামের বলে বেশি সোহাগ দিবেন, পরে দেখা যাবে সবার মাথায় চড়ে চুল ছিঁড়তে শুরু করেছে। পুরুষ মানুষদের কোনো ভরসা নেই আপা। পুরুষ আর ছাগল সুযোগ পেলে মুখ দিতে ভুলবেনা। এদের বেঁধে রাখার টেকনিক —

রজনীর তির্যক ইঙ্গিতের কথাটা চট করে কেটে দিলেন মারজা। তিনি যথেষ্ট কৌশলী হয়ে ব্যাপারটা অনুকূল্য সূচকে বললেন,
– আপনি পুরুষকে ছাগলের সাথে তুলনা করলেন ভাবী। তারা যদি সুযোগ সন্ধানী হতো তাহলে তাদের জগতের নিয়মটা বিচিত্রই হতো। কোনো সভ্য পুরুষ সমাজে থাকতো বলে মনেহয় না, আর বিয়ে নামক বিশ্বাসটাও হয়তো পাশ্চাত্য দেশের মতো ছকি-নকি খেলার মতো দেখতো।

রজনী হাসি দিয়ে ব্যাপারটা আড়াল করার চেষ্টায় বললো,
– আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন আপা। কথাটা আমি বলিনি। কোনো এক বিশিষ্ট লেখক কথাটা বলেছিলো। আমি সেটাই এখানে —

আবারও নির্বিকারে কথা কাট করে নিজের মত পেশ করলেন মারজা,

– লেখকের উক্তি আর কথা খাপ-খাওয়ানো পরিবেশের জন্য বহাল ভাবী। সবখানে যে ওই কথাগুলো ব্যবহার হবে এমনটা তারা নিজেরাও বলেন নি। যেগুলো অসভ্য,কু’জাত ধরনের পুরুষ ওগুলোর স্বভাব ওই মুখ দেওয়ার মতোই। ভালো ঘরের সন্তানরা ওসব চিন্তার ভেতরও আনে না। আমি সন্তান পেটে ধরেছি তো, আমি জানি আমার সন্তানের স্বভাবটা কেমন। যেই বাড়িতে গিয়ে দিনের-পর-দিন থেকেছি, ওই বাড়িতে মুখ দেওয়ার মতো অবস্থা ভালোই ছিলো। আমার একটা সন্তানও ওরকম জঘন্য কাজ করেনি। ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছে, বিয়ে করিয়ে দিয়ে বউ তুলে এনেছি।

মারজার কথা শুনে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে উঠলো রজনী। ঠোঁটের উপর প্রাণবন্ত মিথ্যা হাসি ছাপিয়ে এমন ভান করলো যেনো সে মারজার কথায় সন্তুষ্ট। আজ রজনী চুপটি থেকেই কড়া কথাটা হজম করে নিলো। অপেক্ষায় আছে কবে মারজাকে চিকিৎসার ফ্যাসিলিটিসের জন্য এ্যাব্রড পাঠানো হবে। মারজার বিদেশ যাওয়ার সময়টা কিভাবে ঘনিয়ে এসেছে, সেটা হয়তো আর কেউ তেমন খেয়াল করেনি। এক-এক করে বাড়ি থেকে সব সদস্য কমিয়ে মূখ্য কাজটায় খুব সুন্দর করে হাতটান করবে রজনী। শুধু একবার এই মারজা ভিসার কাজটা শেষ করুক, দ্রুত হাট গুটিয়ে চিকিৎসার জন্য যাত্রা ধরুক, বাকিটা এভাবেই কন্ট্রোলে চলে আসবে।
.
অনেক তোষামোদের পর মারজার অবস্থা দেখে ডাইনিং টেবিলে বসলো মাহতিম। আসার পর থেকে সেইযে রুমে ঢুকেছে, এরপর আর বের হয়নি। খাওয়ার প্রতি মোটেই ইচ্ছাকর্ষণ নেই, তবুও মায়ের প্রত্যক্ষ জোড়াজুড়ি দেখে মায়ের হাতেই কয়েক লোকমা খেতে বসলো। অনামিকা কঠোর ডায়েট করছে দেখে রাতে সে খেতে আসেনি, কেবল এক গ্লাস দুধ খেয়ে মাহতিমের সাথে কুশলাদি করে চলে গিয়েছে। রজনী চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ দৃষ্টিটা মাহতিম ও মেহনূরের উপর বর্তায়মান। অন্যদিকে ভ্রুঁ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে মা ও ভাইয়ের তামাশা দেখছে মাহদি। মাহদির পেছনেই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর। প্লেটে ভাত মেখে রাখলেও মায়ের আহ্লাদী অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে মাহদি। জ্বলজ্বল করা রাগী দৃষ্টিদুটো একবার ভাইয়ের দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে ছুঁড়ছে। শেষমেষ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে গজগজ করে উঠলো মাহদি,

– ভাইয়াকে উতুবুতু করে খাওয়াচ্ছো, আর আমাকে খাইয়ে দিতে বললে তখন, ‘ এখান থেকে যা, বড় হইছিস না ‘ বলে দূরদূর করে সরিয়ে দাও। তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না মা। একদম ভালোবাসো না। তুমিযে ভাইয়ার জন্য পাগল আবারও প্রমাণ হলো। আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। সেদিন তুমি কাঁদলেও আমি ফিরে আসবো না। এই কথা আমি বউকে ছুঁয়ে বলে দিলাম!

কথাটা রাগের মাথায় অকপটে বলেছিলো মাহদি, কোনোরূপ না ভেবেই ফটফট করে বলে দিচ্ছিলো। ওমন অশুভ কথায় মেহনূর চমকে উঠে তাড়াতাড়ি মাহদির মুখটা চেপে ধরলো, দারুণ রাগ দেখিয়ে চ’ড়ের ইঙ্গিত করে বললো,

– খুব লাগাবো কিন্তু। এগুলো কিসব কথা হ্যাঁ? আর যদি কখনো এরকম বলতে শুনি, যদি শুনেছি এরকম বিশ্রী কথা মুখে এনেছো, তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলবো না। আর কখনো বলবে এসব? বলো এসব বলবে?

মেহনূরের ঈষৎ ক্রোধ দেখে মাহদি মিটিমিটি হাসলো, কিন্তু মাহতিম যেনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। শেষ লোকমা মুখে পুড়ে চট করে পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। খাবার চিবোতে-চিবোতে চেয়ার সরিয়ে পা বাড়াতেই মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

– ওই বদমাশটার মুখে দু’লোকমা ঢুকিয়ে দাও মা। নাহলে ওটা ফ্যাচফ্যাচ করতেই থাকবে।

মেহনূরের দিকে একবারও দৃষ্টি না দিয়ে এবার মাহদির দিকে গরম চোখে বললো,
– তুই আমার সামনে এসব বলা থেকে শতহাত দূরে থাকবি। পাদুটো ধরে এমন আছাড় মা’রবো, জন্মের শিক্ষা পেয়ে যাবি। তোকে সাবধান করে দিলাম। কাউকে ছুঁয়ে-ফুঁয়ে যা-তা কথা বকে যাবি, এক ঘুসি মেরে চাপার খুলে ফেলবো।

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে স্বগোতক্তি করে সেখান থেকে প্রস্থান হলো মাহতিম। পুরো রাগটাই যে পরোক্ষভাবে মেহনূরকে দেখিয়ে গেলো সেটা মাহদি বুঝতে পারেনি। মারজা কিছুক্ষণ দু’ভাইয়ের অবস্থা দেখে নালিশী অবস্থা পালন করলেন, মাহদিকে পাশের চেয়ার ডেকে ঠিকই খাইয়ে দিলেন। রান্নাঘরের অবস্থা দেখার নাম করে সেদিকে গিয়ে চোখ ঢাকা দিলো মেহনূর। এতোক্ষণ চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মারজা আপাতত সন্দেহ না করলেও মাহতিমের অযৌক্তিক রাগ দেখে কলহের গন্ধটা আঁচ করলো রজনী। নিজের মনে হাসতে গিয়ে হঠাৎ অনামিকার দিকে নজর পরলো। সে নিজের রুমের দরজার সাথে ডানহাতটা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনামিকার সাথে দৃষ্টি বদল হতেই দুজনেই আপন মনে বাঁকা হাসিতে হেসে দিলো।

.

গভীর রাত্রির প্রথম প্রহর চলছে। শীতের আবহকালে বাইরের প্রকৃতিটা যেনো কুয়াশার ধুম্রজালে আবদ্ধ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই, চন্দ্রপ্রভার কিরণ নেই, মনের মধ্যে পুলকাভাবের কারণ নেই। চাঁদহীন আকাশটার উপর কতক্ষণ দৃষ্টিপাত করতেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা পকেট থেকে বের করে কলার নামটা পরোখ করলো, কানে ফোন ঠেকাতেই প্রথম উত্তরটা দিলো,
– হ্যালো,

ওপাশ থেকে সৌজন্য কন্ঠে নোমান বললো,
– আপনার জরুরী ফাইল আর লাগেজটা কি আজই পাঠাবো স্যার? আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। ইমার্জেন্সী টিকিট নাকি নেই। কি করবো এখন?

মাহতিম দ্বিরুক্তিভাব প্রকাশ না করলে বললো,
– আজ পাঠাতে পারলে আজই। আমার জন্য আজই দরকার। টিকিট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি এয়ারলেন্সে যোগাযোগ করছি, তারা টিকিটটা সময়মতোই দিবে। তুমি শুধু সবকিছু রেডি রাখো।

এদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে মেহনূর। রুমে ঢুকবে নাকি ঢুকবেনা এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় পড়েছে সে। এর মধ্যে চারপাশ নিরব হওয়ায় মাহতিমের কথোপকথন সবই রুমের বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। মেহনূর কান সজাগ না করলেও টিকিটের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে। টিকিট কিসের জন্য দরকার? মাহতিম কি চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে? মেহনূর পাগলের মতো মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো, মাহতিম নিশ্চয়ই যাচ্ছেনা। সে এগুলো ভুল বলছে, হয়তো অন্য কাউকে টিকিটের কথা বলছে। হ্যাঁ, এটাই হবে। ওদিকে কলের বিপরীত থেকে টিকিটের ঝামেলা সামলাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাসে বললো নোমান,
– থ্যাংকিউ স্যার। আমি কাল সকালের দিকেই আপনার ফাইল আর লাগেজ নিয়ে হাজির হচ্ছি। স্যার, আপনি কিভাবে বাড়িতে লাগেজটা তুলবেন?আমি কি সাহায্য করবো?

মাহতিমও দ্বিধাক্ষণ বিলম্ব না করে আশ্বস্ত সুরে উত্তর দিলো,
– ওটা তোমার দেখতে হবেনা। আমি সকালের দিকেই বের হচ্ছি। রেডি থাকো তাহলে। লাগেজটার বন্দোবস্ত নিয়ে ভেবে রেখেছি, তুমি জাস্ট টিকিট কনফার্ম দাও।

নোমানের কথা শেষ হতেই মাহতিম কল কেটে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বেজে পাঁচ মিনিট। ঠিক তিনটা বাজলে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসতে হবে। তিনটার পর মনেহয়না জেগে থাকার কথা। আরো পন্ঞ্চান্ন মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তিনটা না বাজলে ভুলেও সেখানে যাওয়া যাবেনা। মাহতিম জানালাটা আটঁকে দিয়ে পর্দা টেনে দিলো, রুমটার ভেতর অবস্থা অন্ধকারে ঘনিয়ে গেলো। বুকের চেইনটা একটান দিয়ে খুলে গা থেকে জ্যাকেট খুললো মাহতিম। পড়নের সাদা শার্টটা সেইযে হাতমুখ ধুয়ে পরেছিলো, সেটা খুলে গেন্ঞ্জি পরতে একদম ইচ্ছে করছেনা। শীতের জন্য মূলত ইচ্ছাটা নেই। বিছানায় বসে হেডসাইডের সাথে পিঠ ঠেকালো মাহতিম, পাদুটো লম্বা করতেই ক্রস করে রাখলো। হাতের ফোনটা নিয়ে পন্ঞ্চান্ন মিনিট কাটানোর জন্য মগ্ন হলে এদিকে ভেজানো দরজাটা ক্যাচ করে খুলে যেতে লাগলো। ফোন থেকে চোখ সরে দরজার দিকে তাকালো মাহতিম, ওমনেই চোখের কৌতুহল দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো। সেদিক থেকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় ফোনের সাদা স্ক্রিনে মনোযোগ দিলো, দরজাটা আস্তেধীরে বন্ধ করার আওয়াজ পেলো মাহতিম। শব্দটা পেতেই নিভিয়ে রাখা রাগটা আবার জ্বালিয়ে নিয়ে তিক্ততার সুরে বললো,

– কোন্ তামাশা দেখাতে এসেছো? সকালে এক তামাশা দেখিয়ে শান্তি পাওনি, এখানে তু —

ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। নিজের সাথে কি হলো নিজেও তখন টের পেলো না।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here