#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ সংখ্যা ০২.
ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। বাতিহীন রুমের ভেতর অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে গেলো তখন, সেটা নিয়ে চিন্তাও করতে পারলো না সে। একজোড়া অশ্রুপূর্ণ চাহনির মাঝে বাক্য হারিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো, এই প্রথম নিজের উপর জোর খাটানো অধিকার দেখে চুপ হয়ে গেছে মাহতিম। খুবই কাছে, খুবই নিকটে থাকা মুখটার স্নিগ্ধ চোখজোড়া আজ বন্ধ, সেই বন্ধ চোখ থেকে পাপড়ি চুয়ে চুয়ে পানি পরছে, মোটা মোটা অশ্রু ফোঁটাগুলো নির্বিকারে চোয়াল বেয়ে নিচে পরছে, পুরো মুখটা যেনো লালচে আভায় আচ্ছন্ন, নিচের ঠোঁটটা এমনভাবে দাঁতে চেপে রেখেছে যেনো অসহ্য যন্ত্রনাটা কঠিনভাবে গলাধঃকরণের চেষ্টায় আছে। মাহতিম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিলো না, মুখ দিয়ে কথাও বলতে পারছিলো না, পরিস্থিতিটা কেমন করে স্বাভাবিক হবে সেটাও যেনো জানা নেই তার। ওই পাপড়ি চুয়ে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ঝরার দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে যেনো উত্তপ্ত ছুড়ির আঘাতের মতো বিঁধছে। মাহতিম তার হাতের ফোনটা বিছানায় ছেড়ে মেহনূরের গালের কাছে হাত আনলো, কিন্তু হাতটা গালের উপর রাখলো না। অবহেলার অভিমানটুকু এখনো সতেজ হয়ে মনের কোঠায় জেঁকে আছে, বারবার অন্তরের কোমল জায়গায় কেউ কড়াঘাত করে বলছে ‘ থেমে যা, তুই পুরুষ মানুষ, তুই অবলার কাছে ধরা দিবি না। নত স্বীকার করবি না। থাম! ‘ মাহতিম কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই স্থির হয়ে রইলো, বিবেকের দোরগোড়ায় নানা অজুহাত এসে তাকে দূঃসহ যন্ত্রনার ভেতর ফেলে দিচ্ছে। খানিকটা সময় তিরতির করে পেরিয়ে গেলো, গভীর নিশুতি রাত্রিকালীন প্রহর যেনো আরো নিঃশব্দতার ভুবনে তলিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মাহতিমের ভেতরে অভিমান-অপেক্ষা-অবজ্ঞার সুরগুলো হিংস্রতার দুনিয়ায় ধাবমান, অন্যদিকে তখন অব্যক্ত-অপ্রকাশ্য-অবসন্ন হৃদয়ের ব্যকুলতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে মেহনূরের। সচল মস্তিষ্কের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিচেতনার মাহতিম প্রিয়তমার একটা ইশারার জন্য অপেক্ষমাণ, সামান্যতম ইঙ্গিতপূর্ণ অবস্থা দেখলে বুকের মধ্যে টেনে নিতে দেরি সহ্য করবে না। আজ কোনো বিধি-নিষেধ, ন্যায়নীতি, আদেশ-আজ্ঞাদেশ কিচ্ছু মান্য করবে না মাহতিম। চার মাসের যেই অসহ্য দহনের অন্তঃক্রীয়ায় সে দগ্ধ ছিলো, সেটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে উদ্দীপিত হয়ে আশান্বিত চাহনিতে মুখিয়ে আছে। অনেক চিন্তাভাবনার হিসাব কষে শেষমেশ নিজেকে চূড়ান্তরূপে খোলাশা করার উদ্দেশ্যে ঠোঁট থেকে হাত সরালো মাহতিম। হাত সরানোর অনুকম্পন টের পেয়ে অশ্রুসিক্ত ফোঁপানো মুখায়বটা তার দিকে চক্ষু কপাট খুলে তাকালো। নিস্তব্ধ রুমটার শব্দহীন অবস্থার ভেতর দৃঢ় কন্ঠে বললো মাহতিম,
– তোমাকে নতুন করে কিছুই বলার নেই মেহনূর। জেনেশুনে যেহেতু তোমার মতো ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে বিয়ে করেছি, এতে দোষটা আমারই। আমারই দোষ যে, তোমার উপর নিজের সমস্ত কিছুর ভার রাখতে চেয়েছিলাম। আমার প্রোফেশনাল লাইফের সব ট্রার্মে সাকসেস এ্যাচিভ করতে পারলেও তোমার কাছ থেকে নূন্যতম যোগ্যতাটুকুও জুটলো না মেহনূর। হয়তো তোমাকে ফোর্স করেছি দেখে তুমিও ভয়ের চোটে আমাকে অনুভূতির আশ্বাস দিয়ে ফেলেছো। তোমাকে দোষ না দিলেও তোমার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছে। রাগ লাগছে, অসহ্য লাগছে।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো ঝেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করলো মাহতিম। বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, দৃষ্টিদুটো বিছানার উপর মলিন ভাবে স্থির হয়ে গেছে। ছোট ছোট টুকরোর মতো তার মনটা আজ চূর্ণবিচূর্ণ, চোখ বন্ধ করে যাতনার প্রতিটি দং’শিত নিশ্বাস ঠোঁট খুলে ছাড়ছে মাহতিম। অনবরত নিশ্বাস ছাড়তেই ব্যথার গ্লানিটুকু ভেতরে চেপে অতি কষ্টে ধীরভাবে বলতে লাগলো,
– আমাকে ছেড়ে যেতে পারো মেহনূর। তোমাকে বাধা দিবো না।
হাতের উলটোপিঠে কেবল চোখ মুছতে যাচ্ছিলো মেহনূর, কর্ণধারে বিষাক্ত কিছু শোনার পর মূর্ছার মতো স্থির হয়ে গেলো সে। চোখ মোছার হাতটা ধপ করে কোলের উপর পরে গেলে শরীর নিংড়ে যেনো শেষ শক্তিটুকু কেউ শুষে নিচ্ছে। অবশ-অচল-অকেজো অবস্থার মতো দেহটা যেনো যেকোনো সময় টলে পরবে, মাথাটা মা’রাত্মক ঝিমঝিম করছে। অনেক চেষ্টা শেষে শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলালো মেহনূর, আস্তে-আস্তে ঢোক গিলে গলদেশটা ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। অ’সভ্য উপাধি পাওয়া মানুষটা এখনো তার নিচু মাথাটা তুলেনি, কি সুন্দর নিঃসঙ্কোচে বলে দিলো ‘ ছেড়ে যাও ‘। মেহনূর হতবিহ্বল অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা এগিয়ে মুঠোবন্দি করা হাতটা ধরলো, শক্ত হাতটা কুড়িয়ে নিতেই হঠাৎ মাথা তুলে কপালে ভাঁজ ফেলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো,
– কি করছো মেহ —
কথাটুকু অর্ধপূর্ণ হয়ে গলায় আঁটকে গেলো মাহতিমের, সে আর কথাটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেলো না। শীতের শিশির ফোঁটা যেমন পাতার বুকে আশ্রয় পেয়ে সেখানেই জ্বলজ্বল করে নিজের দীপ্ত মহিমা ছড়িয়ে দেয়, তেমনি মাহতিমের শক্ত-প্রশস্ত বুকটার উপর নিজের চাপা অনুভূতি উন্মুক্ত করে মনের কিষ্টে-দহনে হু হু করে কেঁদে উঠে মেহনূর। সাদা শার্টের বেশে ঢেকে যাকা মাহতিমের দেহটা আজ নিজের কাছে রাখার চেতনায় খামচে ধরেছে। ওই দীর্ঘাটে মানুষটার পেশিবহুল পিঠটাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো মেহনূর, তার বুকটার মধ্যে নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে মুখ গুঁজে দিলো সে। পিঠের উপর সাদা শার্টটাকে মুঠোর মধ্যে খামচে ধরতেই নখের আকস্মিক ব্যথায় তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। ওমনেই দুপাটি দাঁত শক্ত করে ব্যথাটা হজম করে চোখ খুলে তাকালো। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে নিজের বুকের দিকে তাকাতেই কান্নায় ফুলে-ফুলে উঠা মেদহীন পিঠটার দিকে চোখ পরলো তার। গাঢ় বেগুনী রঙের ব্লাউজটা যথেষ্ট পাতলা, সেই সঙ্গে শীত নিবারণের জন্যও যথেষ্ট অনুপযুক্ত পোশাক। চুলের খোপাটা খুলে ঘাড়ের নিচে ঝুলে আছে, ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী অংশটুকু উন্মুক্ত হয়ে কোমরের টানটান চামড়াটা পরিদৃষ্ট। রুমে থাকা মৃদ্যু মাত্রায় সচল এসির হিমে স্বল্প উন্মুক্ত পিঠের সমস্ত পশম কাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরটাও ভয়াবহ ঠান্ডা মেহনূরের। মাহতিম দ্রুত তার খুলে রাখা জ্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে ডানপাশ থেকে নিতে গেলে বাধা দিলো মেহনূর। অস্ফুট সুরে ফুঁপিয়ে উঠলে আঁটকে আসা গলাতেই বলতে লাগলো,
– আমার হাতে কালি লেগে গিয়েছিলো, আমি কালি পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ছিলাম। আমার ভাগ্য খারাপ, আমার জানতাম না আপনি আমায় ডেকেছেন। আমি সত্যিই পানির আওয়াজের জন্য আপনার ডাক শুনতে পাইনি। যদি একবার বুঝতাম, যদি একবার জানতাম আপনি চলে এসেছেন, আমি কখনোই ওই ভুলগুলো করতাম না। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না। দোহাই, আমাকে মাফ করুন। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্যটুকু আমার নেই। আমি নিজেই স্বাভাবিক থাকবো না। আমার অবস্থা আপনি ছাড়া কে বোঝে বলুন? কেউতো আপনার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরের অবস্থা বুঝে না। আমি কিচ্ছু পারিনা, কিচ্ছু পারিনা, ঠিকঠাক মতো কিছু বলতেও পারিনা। আমার কথাও এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কোথায় যাই বলুন? আম্মা, বড়মা, বুবু, দাদাভাই কেউ এখানে নেই। প্রতিদিন দেখতাম, আপনি সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, আমি পাগলের মতো অপেক্ষায় থাকতাম। অথচ দেখতাম, আপনি কল কেটে দিতেন। আপনার সাথে একটু কথা বলার জন্য কত অপেক্ষায় থাকতাম আপনি জানেন না। যাওয়ার দিন যখন ভুলবশত কিছু বলে ফেললাম, সেটার জন্যও আপনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। আপনি বিয়ের আগে ভালো ছিলেন, বিয়ের পর আপনি আমাকে আর মূল্য দেন না। আপনি আমাকে ছাদের রুমে একা-একা থাকতে বলছেন, আমি শত ভয় পাওয়া সত্ত্বেও দ্বিমত করিনি। একা একাই ওই রুমটার ভেতর থেকেছি। যতো বারই দুঃস্বপ্ন দেখতাম, মনে মনে ওই অন্ধকার ঝুপড়িতে আপনাকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতাম, আপনাকে আমি পেতাম না। আপনাকে ছাড়া আমার এই শহরের মধ্যে থাকার সাহস নেই, আমি গেঁয়ো, অচল, গাধা। আমি কারোর সাথে সখ্যতা করতে পারিনা, আমি কিচ্ছু করতে পারিনা, কাউকে মন খুলে দুটো কথা বলতে পারি না, আমার চুপচাপ আচরণ দেখে সবাই আমাকে অহংকারী ভাবে। আমি কি করবো বলুন? আমি নিজেও জানিনা কিভাবে কি করবো, আমি কখনো মানুষের সাথে মিশিনি। আপনি শাস্তি দিতে চাইলে কঠোর কঠোর শাস্তি দিন, আমাকে মে:রে ফেললেও আমি কিচ্ছু বলবো না, কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবেন না। গ্রামের গেঁয়োদের মতোই রেখে দিন, উপন্যাসের ওই অবলাদের মতোই ফেলে রাখুন, আমি ওই অবলাদের মতোই ঘরের এককোণে থেকে যাবো। তবুও ছেড়ে যাবো না।
জমাটবদ্ধ কথাগুলো ব্যক্ত করে প্রচণ্ড ক্লান্ত অনুভব করছে মেহনূর, নাক টেনে একটু সুস্থির অনুভব করলে চোখের ফোলাভাবের জন্য এখন চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে ফিসফিসিয়ে মুখ দিয়ে নিশ্বাস টানছে, মাথা ভারী হয়ে প্রচণ্ড টনটন করে ব্যথা করছে। পিঠের উপর হাতদুটো শিথিল করতেই মুঠো থেকে সাদা শার্টটা মুক্ত হয়ে গেলো, নিস্তেজ পরিবেশটা সুনশান শব্দে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পরিণত হলো। দূর থেকে হুটহাট ট্রাক চলার গমগম শব্দ ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে দু-একটা বেতাল সুরের হর্ণও শোনা যাচ্ছে। মেহনূর অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বুক থেকে মাথা উঠাতে গেলো, কিন্তু ক্লান্তির জন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, সে কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারলো না। প্রথমে ভেবেছিলো, মাথা ভারী হওয়ার কারণে এমন সমস্যাটা হচ্ছে কিন্তু সেই চিন্তাকে ফাঁকা করে আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলো মেহনূর। অনুমানটা ঠিকঠাক ধরতেই হঠাৎ কানের কাছে মৃদ্যু সুরের কন্ঠ শুনতে পেলো,
– রাতটুকু থেকে যাও। আমি কিচ্ছু করবো না।
চোখ খুলেও অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না মেহনূর, হাতটাও ছাড়াতে পারছে না সে। মাহতিমের বাহু বেষ্টনের মাঝে বন্দি হয়ে ছটফট করারও সুযোগ নেই আজ। যদি মাহদি এই রুমে ভুলবশত ‘ ভাই,ভাই ‘ করতে-করতে ঢুকে যায় তাহলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যাবে। মেহনূর আগাম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মাহতিমের পিঠে হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলতে থাকে,
– মাহদি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আমি ওকে মোবাইল ধরিয়ে বুঁদ করে চলে এসেছি। ওকে একটু দেখে আসি, ছাড়ুন।
মেহনূর বহু চেষ্টা চালিয়ে হাতদুটো টেনে এনে মাহতিমের বুক বরাবর ধাক্কা দিলো, লাভের-লাভ কিছুই হলো না, উলটো বাহুযুগলের মাঝে চাপ খেয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো। মেহনূর বারবার অনুনয় বিনয় করতে লাগলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য, মাহদি যদি দেখে ফেলে তাহলে মারজার কানে যেতে এবার কেউ বাধা দিতে পারবে না। এদিকে মাহতিম এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছে, অন্য কান দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো সুড়সুড় বের করে দিচ্ছে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সত্যি সত্যিই রুমের বাইরে থেকে ‘ ভাইয়া, ও ভাইয়া ‘ বলে ডাক শোনা গেলো। কন্ঠটা চিনতে পারলো দুজনই, দুজনই মারাত্মক চমকে উঠে হাতজোড়া শিখিল করে দরজার দিকে তাকালো। মাহতিমের তো ইচ্ছে করছে ফাজিলটাকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে, এদিকে মেহনূর তো ভয়েই জব্দ। দরজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুজনই একে-অন্যের মুখের পানে তাকালো, মেহনূরের অবস্থা দেখে মাহতিমের বড্ড হাসি পাচ্ছে। প্রেম করার সময় যেমন বাবার ভয়ে মেয়ে লুকিয়ে থাকে, তেমনি একটা ভাবভঙ্গী ধরে ভীতু বনে আছে মেহনূর। মেহনূরের কপালের উপর থেকে ছোট ছোট চুলগুলো ডানহাতের তর্জনী দিয়ে সরিয়ে দিতেই হাসতে-হাসতে বললো মাহতিম,
– ঘরে স্বামী রেখে দেবরের সাথে লুটোপুটি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমার মান-সম্মান, ইজ্জত, অর্জন সব শেষ করলে?
মেহনূর কপট রাগ দেখিয়ে ভ্রুদুটো কুঁচকালো। ক্ষীণ রাগের রেশে বলে উঠলো,
– আপনি কার সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছেন?
মাহতিম হাসি থামিয়ে চোখ স্বাভাবিক করলো। আপাতত উত্তর না দিয়ে মেহনূরকে কম্বলের নিচে আপাদমস্তক ঢেকে শুতে বললো। মেহনূর কথার পিঠে প্রশ্ন ছোঁড়ার সাহস পেলো না, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া প্রশ্ন ছোঁড়ার নিয়ম স্বামীর সাথে খাটানো ঠিক না। বড়মার কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে সেই মতেই কাজ করলো মেহনূর। এদিকে দরজা খুলে হুলস্থুল ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলো মাহদি, রুমে ঢুকতেই ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর সুরে বললো,
– ভাইয়া, এই তুমি আমার বউকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? ও নিজের রুমে নেই, মায়ের রুমেও নেই, কিচেনও নেই। কোথায় ও!
মাহতিমও পালটা উত্তর ছুঁড়ে দাম্ভিকতার সাথে বললো,
– রাতে কি টাটকা চড় খেতে এলি? লাগাবো? লাগালে কিন্তু ওই সাইড দিয়ে ভাত চিবাতে পারবিনা।
আলমারির ডান দ্বারটা খুলে কাঠের ড্রয়ারটা টান দিলো মাহতিম। মাহদির কথাটা স্পষ্ট ভাবে কানে শুনেছে সে। ফা’জিলের ‘ বউগিরি ‘ স্বভাব আজ কেমন করে ছুটিয়ে ছাড়বে সেটার জন্য জম্পেশ একটা শিক্ষা রেডি করছে। কম্বলের নিচে ভয়ে কাহিল অবস্থা মেহনূরের, যদি কম্বলটা খপ করে টান মারে তাহলেই খেলা শেষ। মাহদি নিজের উত্তর না পেয়ে মুখ কাঠিন্য করে কোমরে দুহাত রাখলো, ভাইয়ের কাছে কয়েক কদম এগিয়ে এলে মাহতিম ঠাস করে ড্রয়ার লাগিয়ে আলমারির দ্বার বন্ধ করলো। মাহতিম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে থাকলে পেছন থেকে মাহদি ফের বলে উঠলো,
– তুমি আলমারীতে ওকে লুকিয়ে রেখেছো তাইনা?
চোখ দুটো খিঁচুনি দিয়ে হাসি আঁটকালো মাহতিম, ভুলেও পিছু ফিরে তাকালো না। পেছন থেকে ভাইয়ের অবস্থাটা ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে হঠাৎ কম্বলের দিকে নজর চলে গেলো। কম্বলের ওমন ভূতুড়ে কাঁপুনির নড়াচড়া দেখে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিউরে উঠলো মাহদির। হরর সিরিজের দৃশ্যপট মনে পরতেই ‘ ও মাগো, ভাইয়া ‘ বলে চিৎকার দিয়ে তৎক্ষণাৎ মাহতিমকে পেছন থেকে জাপটে ধলো। হুট করে চিৎকারের কারণ বুঝতে পারলো না মাহতিম, সাথে-সাথে মাহদির দিকে ঘুরে দাঁড়ালে মাহদিকে কারণ দর্শাতে বললো। মাহদি ঢোকের-পর-ঢোক গিলতেই চোখমুখ খিঁচে তর্জনী তুলে বিছানার দিকে ইশারা করলো। ইশারা করতে দেরি ওমনেই ঘরের বাইরে পা চালিয়ে ভোদৌঁড়ে ছুঁটে পালালো। দুহাতে কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহনূর, হাসতে-হাসতে মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না তার। মাহতিমও সেই অবস্থা নিজের হাসি সামলাতে না পেরে হো-হো হেসে দিয়েছে। আচমকা হাসি থামাতে-থামাতে মাহতিমের দিকে মুগ্ধনেত্রে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। অস’ভ্য, নি’ষ্ঠুর, বে’পরোয়া মানুষটার হাসিটা হেসে আজ মেহনূর উপন্যাসের চরণযুগল মনের ভুবনে আওড়াতে লাগলো,
মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন।
মলিন বসন ছাড়ো সখা, পরো আভরণ।
( সংগৃহীত চরণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
.
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
( নোটবার্তা : মন মেজাজ ভালো না থাকলে লেখার প্রতি টান কাজ করে না। ক’টা দিন যাবৎ একটু বিষণ্ণতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এমতাবস্থায় কি লিখেছি, না লিখেছি, তার জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি অত্যন্ত দুঃখিত পাঠক 💔)