স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ১২

0
406

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১২
শরীরের উপরে ভারি কিছুর অনুভব হচ্ছে।পিটপিট করে চোখজোড়া খোলে আরাবী।কিন্তু তীব্র মাথা ব্যথার কারনে সাথে সাথে আবার চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়।আরাবী একটা হাত মাথায় চেপে ধরল।ঠিক তখনই একটা ভারি কণ্ঠস্বর এসে বারি খেলো ওর কানে।
‘ মিস আরাবী?আপনি ঠিক আছেন?’

জায়ানের কণ্ঠস্বর সেটা বেশ ভালোই বুঝেছে আরাবী।বহু কষ্টে চোখজোড়া খুলে তাকালো আরাবী।মাথার যন্ত্রণায় কথা বলতেও ইচ্ছে করে না।জায়ানের মুখে যেন আঁধার নেমেছে।ঠিক সেইভাবেই খুব সাবধানে আরাবীকে ধরে উঠিয়ে বসালো।এদিকে জায়ানকে নিজের এতো কাছে দেখে যেন শ্বাস আটকে গেলো আরাবীর।হৃদস্পন্দের গতি বেরে গেলো হু হু করে।এতো কাছে কেন আসছে লোকটা?বুকের বা-পাশটায় অদ্ভুত রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে লোকটাকে নিজের এতোটা কাছে দেখে।জায়ান আরাবীকে সোফায় ভালোভাবে বসিয়ে দিয়ে।সরে এসে বলে,
‘ ঠিক আছেন আপনি?’

আরাবী দূর্বল কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ ঠি..ঠিক আছি।’
‘ মাথা ব্যথা হচ্ছে?’
‘ হু!’

জায়ান শ্বাস ফেলল।ডক্টর মাহবুব তো বলেছেই মাথা ব্যথা হবে।জায়ান ল্যান্ডলাইনে ফোন করে স্যুপ আনাতে বলল।তারপর আরাবীকে উদ্দেশ্য করে নরম কণ্ঠে বলে,
‘ ফ্রেশ হবেন?’

আরাবী মাথা নিচু করে মাথা দুলালো।ফ্রেশ তো হতে হবে।কিন্তু নিজে উঠে বসার শক্তিটুকু নেই।সেখানে ওয়াশরুমে যাবে কিভাবে?কি থেকে কি হয়ে গেল?ওই স্টোররুমের ঘটনা আবারও মস্তিষ্কে এসে হানা দিলো আরাবীর।কে ছিলো মানুষটা?কে এভাবে ওকে মারার চেষ্টা করল?ও তো এখানে ভালোভাবে কাউকে চিনেও নাহ। তাহলে? ভয়ংকর ঘটনাটুকু স্মরণ হতেই ভয়ে আরাবীর পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।
হঠাৎ মাথায় কারো আলতো স্পর্শ টের পেতেই হুশ ফিরে আরাবীর।মাথা উঁচু করে তাকাতেই সম্মুখে জায়ানকে দেখে।জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
‘ ভয় পাবেন না।আমি আছি আপনার পাশে।’

জায়ানের এইটুকু কথায় কেন যেন আরাবীর মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল।আবেগী হয়ে উঠল নিমিষেই। চোখ ভরে উঠল আরাবীর।যে অবস্থায় ও ছিলো সেখানে ম’রেও যেতে পারতো ও।ভাজ্ঞিস বেঁচে ফিরেছে।কিন্তু ওকে ওখান থেকে বাঁচালো কে?এই লোকটা কি ওকে বাচিয়েছে?তাহলে তো আরাবীর কাছ থেকে বিশাল বড়ো একটা ধন্যবাদ পাবে লোকটা।কিন্তু শুধু মুখে ধন্যবাদ দিলে কি হবে?লোকটা ওর জান বাচিয়েছে।
হঠাৎ করে জায়ান আরাবীর সামনে হাটু মুরে বসে পরল।এহেন কাজে অকস্মাৎ চমকে উঠল আরাবী।জায়ান আলতো হাতে আরাবীর ডানহাতটা স্পর্শ করল।কণ্ঠে কোমলতা এনে বলে,
‘ আ`ম রেয়েলি ভেরি সরি।আ`ম এক্সট্রিমলি সরি আরাবী।’

আরাবীর বুকটা ধ্বক করে উঠল।লোকটার কণ্ঠের এই ব্যাকুলতা।এতো অস্থির করে দিচ্ছে কেন ওকে?ভেতরটা কেন এতো কাঁপছে ওই কণ্ঠস্বরে?আরাবীর হাতটা জায়ান যেখানে স্পর্শ করেছে।সেদিকে তাকিয়ে আরাবী।লোকটার স্পর্শ করা জায়গাটুক শিরশির করছে।শুকনো ঢোক গিলল আরাবী।কাঁপা কণ্ঠে বলে,
‘ আপনি সরি বলছেন কেন?ইটস নট ইয়্যুর ফল্ট।আমিই নিজে নিজের পায়ে কু’ড়াল মেরেছি।আপনি বলেছিলেন এইখান থেকে একপা-ও বাহিরে না ফেলতে।কিন্তু আমি শুনিনি।’

জায়ান আরাবীর হাতজোড়া আরেকটু দৃঢ়ভাবে স্পর্শ করল।বলল,
‘ ডোন্ট ব্লেইম ইয়্যুরসেল্ফ।আমার অফিসে যে এভাবে কেউ কাউকে এট্যাক করতে পারে।সেটা আমার নজরে রাখা দরকার ছিলো। ‘
‘ দোষ কারোরই না।এটা আমার ভাগ্য লিখা ছিলো।
বাট থ্যাংক্স টু ইয়্যু স্যার।আপনি না থাকলে আমি হয়তো বেচে ফিরতে পারতাম নাহ।’

আরাবীর ভেজা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই তীব্র অনুশোচনায় জায়ানের হৃদয় ঝল’সে গেলো যেন।ওর অফিসে এসে ওরই প্রিয়তমাকে মে’রে ফেলার মতো দুঃসাহস কর‍তে পারে।এমন লোককে ও এতোদিন চিনতেই পারেনি?কিভাবে এভাবে অদেখা করল জায়ান তাকে?রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসল জায়ানের।তারপর উঠে দাঁড়ালো।বিনাবাক্য হুট করে আরাবীকে একঝটকায় কোলে তুলে নিলো জায়ান।অকস্মাৎ এমন করায় ঘাবড়ে যায় আরাবী।কেঁপে উঠে সর্বাঙ্গ মেয়েটার।এদিকে জায়ান যেন নিজের খেই হারিয়ে ফেলল।আরাবীকে এভাবে কোলে তুলে যেন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে একেবারে ঝাপ্টে ধরে বুকের গভীরে নিয়ে যেতে।কিন্তু না এখনও সময় হয়নি এসব করার।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।জায়ান জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।
এদিকে আরাবী হাশফাশ করছে।এভাবে জায়ানের কোলে উঠায় কেমন যেন লাগছে।ও বলে উঠল,
‘ স্যার?কি করছেন?’

জায়ান সামনের দিকে তাকিয়েই বলে,
‘ ফ্রেশ হতে হবে আপনাকে।দ্যেন খাবার খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে।’
‘ বাট স্যার আমাকে একটু হাতটা ধরে হ্যাল্প করলেই হতো।নামিয়ে দিন স্যার।কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।’

জায়ান এই কথা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আরাবীর দিকে।ভড়কে গেলো আরাবী।জায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ এটা আমার অফিস।আর এটা আমার অফিসরুম।এখানে আমার অনুমতি ব্যতীত কেউ আসতে পারবে না।সো নিজের ছোট্টো মাথায় এতো প্রেসার নেবার দরকার নেই আপনার।’

ওয়াশরুমে আসতেই জায়ান আরাবীকে নামিয়ে দিলো।তারপর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দরকার কাছ থেকে বলে,
‘ ফ্রেশ হয়ে আমাকে ডাক দিবেন।’

জায়ান দরজাটা আটকে দিলো।জায়ান যেতেই আরাবী বেসিনের সামনের আয়নায় তাকালো।পর পর লজ্জায় গাল দুটো ঈষৎ লালে ছেঁয়ে গেলো।ঠোঁটের কোণে মায়াময়ী হাসি।এই হাসি যদি জায়ান দেখত নিশ্চিত আরও একবার প্রেমে পরতো আরাবীর।
—-
ফ্রেশ হওয়া শেষে আরাবী হেটে হেটে দরজার কাছে আসল।দুবার টোকা দিতেই জায়ান দরজাটা খুলে দিলো।তারপর কোলে তুলে নিলো আরাবীকে।আরাবীর লজ্জায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।এভাবে কোনোদিন সে কোন ছেলের এতোটা কাছে আসেনি।শুধু ওর বাবা আর ভাইকে ছাড়া।এই লোকটাই প্রথম।জায়ান আরাবীকে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর সামনের টেবিল থেকে স্যুপের বাটিটা হাতে নিলো।আরাবীর পাশে বসে এক চামচ স্যপু নিয়ে ফু দিয়ে আরাবীর দিকে এগিয়ে দিলো। চোখের ইশারায় খেতে বলল আরাবীকে। আরাবী আলতো হাতে কানের পিঠে চুল গুজল।মুচঁকি হেসে স্যপটুকু মুখে নিলো।জায়ান ভ্রু-কুচকে বলে,
‘ স্যুপের ফ্লেভার ঠিক আছে?’

আরাবী মাথা দুলালো।জায়ান বেশ যত্ন সহকারে আরাবীকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে।আরাবী খাচ্ছে আর জায়ানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আচ্ছা,কোনো জায়গায় কি এমন হয়?এতো বড়ো একটা কোম্পানির বস সাধারন একটা কর্মচারীর জন্যে এতোটা অস্থির হতে?এতোটা ব্যাকুল হয় কেউ?আরাবী কি মনে করে যেন জায়ানের চোখের দিকে তাকালো।লোকটার চোখজোড়া অদ্ভুত সুন্দর।হ্যাজেল বর্ণের চোখজোড়ার দিকে একবার তাকিয়ে আর চোখ সরাতে পারলো না আরাবী।ডুবে গেলো ওই চোখের গভীরতায়।মুগ্ধতা এসে ভড় করল ওর চোখে মুখে।অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়া যেন কিছু বলতে চাইছে ওকে।আরাবী আরও গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।সাথে সাথে বক্ষস্থল কেঁপে উঠল আরাবীর।ওই চোখে দেখতে পেলো বিশাল সমুদ্র সমান ভালোবাসা,এক আকাশ সমান ব্যাকুলতা।এই ভালোবাসা,এই ব্যাকুলতা কার জন্যে?জায়ানের সামনে তো একমাত্র ওই বসে আছে।তবে কি লোকটা ওকে ভালোবাসে?তাই তো এতো যত্ন,এতো চিন্তা করছে সে ওর জন্যে।কিন্তু এটা কিভাবে হবে?ওর তো চাঁপা গায়ের রঙের মেয়েকে এতো সুদর্শন পুরুষ কিভাবে ভালোবাসবে?কিভাবে সম্ভব এটা?পরমুহূর্তেই আরাবীর মনের ভেতর থেকে যেন কেউ বলে উঠল।
‘ সব সম্ভব আরাবী। সব সম্ভব।একবার এই লোকটার দিকে এক পা এগিয়ে দেখ আরাবী।শুধু একবার ভরসা করে তার হাতটা ধর।দেখবি কোনোদিন ঠকবি না তুই।’

আরাবীএ একে একে জায়ানের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত মনে পরতে লাগল।জায়ানের করা প্রতিটা কর্মকান্ড যেন তাকে চোখে আঙুল দিয়ে সবটা পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে।আরাবী যেন জায়ানের ওই হ্যাজেল বর্ণের চোখের মায়ায় পরে গেলো।ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনার চোখজোড়া অদ্ভুত সুন্দর আর আকর্ষনীয়।’

আরাবীর কণ্ঠে অকস্মাৎ এমন একটা কথা শুনে চমকে উঠল জায়ান।হাতে থাকার স্যুপের বাটিটা যেন কেঁপে উঠল দৃশ্যমান রূপে।সাথে কাঁপছে জায়ানের বুক।জায়ান অবাক কণ্ঠে বলে,
‘ হোয়াট ডিড ইস্যু স্যে?’

ধ্যান ভাঙলো আরাবীর।থতমত খেয়ে উঠল যেন মেয়েটা।এসব কি করছিলো ও?কিসব ভাবছিলো ও?আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।নিজের এইসব ফাউল চিন্তাভাবনায় নিজেকে গালাগাল করতে লাগল।কিভাবে তার মন এতোটা হাই এক্সপেকটেশন করতে পারল?নিজের বিবেকবুদ্ধি কোথায় খুইয়ে ফেলেছিলো ও?আরাবীর মাথা ব্যথা যেন এতে আরও একধাপ বেড়ে গেলো।
সেভাবে থেকেই ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ সরি স্যার।’

জায়ানের থেকে কোনো সারাশব্দ পেলো না আরাবী।এতে যেন মন খারাপটা আরও যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো।চোখ ভরে উঠল।ঠোঁটে ঠোঁট চিপে চুপ করে রইলো।চোরা দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকালো আরাবী।লোকটা শান্ত হয়ে মেডিসিন খুলছে।একসময় সেগুলো বারিয়ে দিলো আরাবীর দিকে।গাম্ভীর্যপূর্ণ আওয়াজে বলে,
‘ খেয়ে নিন।’

আরাবী কাঁপা হাতে মেডিসিনগুলো নিয়ে খেয়ে নিলো।তারপর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো।জায়ান ফের বলে,
‘ আপনি রেস্ট নিন।আমি আমার হাতের কাজগুলো সেরে তারপর আপনাকে আপনার বাসায় ড্রপ করে দিবো।আর আগামী তিনিদিন অফিসে আসবেন না।আপনার ছুটি।বাড়িতে বিশ্রাম নিবেন।মোট কথা ফুললি রিকোভার না হওয়া পর্যন্ত অফিসে আসবেন না।’

আরাবী মাথা নিচু করে বলে,
‘ তার দরকার নেই স্যার।আমি ঠিক আছি।আর একাই যেতে পারব৷ আর ছুটিরও দরকার নেই।মাত্রই অফিস জয়েন করেছি। এখনই এতো ছুটি নিলে। পরে…!’

বাকিটা আরাবী বলতে পারল না। জায়ান ভ্রু-কুচকে আরাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ আই ডোন্ট লাইক বিয়িং ডিসওবেইড। হোপ ইয়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড। রেস্ট ফোর নাও।’

জায়ান আর কিছু না বলে চলে গেলো নিজের টেবিলে।চেয়ারা বসে ঝটপট ল্যাপটপ অন করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।আরাবী করুণ চোখে তাকালো জায়ানের দিকে। লোকটা কি রাগ করেছে ওর কথায়?নাহলে এভাবে মুখ গোমড়া করে আছে কেন?অবশ্য লোকটা সর্বক্ষণ মুখে আঁধার নামিয়েই রাখে।হাসে না কেন লোকটা?আরাবীর খুব করে মন চাইলো একবার জায়ায়নের ওই কালচে ঠোঁটজোড়ার হাসি দেখতে।কিন্তু আদৌ কি তা দেখতে পাবে সে কোনোদিন? জায়ানকে নিয়ে নানানরকম চিন্তা ভাবনা করতে করতে আরাবীর সেখানেই চোখ লেগে আসল।সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলো।যা জায়ান আঁড়চোখে সবটাই খেয়াল করেছে।আস্তে আস্তে আরাবীর কাছে আসল।খুব সাবধানে আরাবীকে সোফায় শুইয়ে দিলো।একটা কম্বল মেলে দিলো আরাবীর গায়ে।
জায়ান গিয়ে আবারও কাজে লেগে পরল।কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখা বাকি।কিন্তু কাজ করবে কিভাবে সে?নজর যে বার বার তার কাঠগোলাপের দিকে চলে যাচ্ছে।জায়ান মুচঁকি হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।ইশ,এই হাসিটাই তো আরাবী দেখতে চেয়েছিলো।
_____
পুরো রাত আটটা বাজে জায়ানের কাজ শেষ হলো।ততোক্ষনে অফিসের সবাই চলে গিয়েছে।নিহান সাহেব আর ইফতি এসেছিলো ওর কাছে।জায়ান জানিয়ে দিয়েছে তাদের।হাতের কাজ শেষ করে আর আরাবীকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে তবেই সে বাড়ি ফিরব।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল জায়ান।গলার টাইটা অনেক আগেই খুলে ফেলেছে সে।শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা।গরমে ঘেমে নেয়ে গিয়েছে ছেলেটা।যেই ছেলে একমুহূর্তের জন্যেও এসি ছাড়া থাকতে পারে না।আর আজ সে গোটা একটাদিন এসি হীন কাটিয়ে দিলো।ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে কি কি করিয়ে ফেলে।আরাবীর দিকে তাকিয়ে হাসল জায়ান।তারপর নিশব্দে হেটে এসে দাঁড়ালো আরাবীর সামনে।মেয়েটা ঘুমোচ্ছে।ওকে না জাগানোই ভালো হবে।এখন তো অফিসে কেউ নেই।কেউ দেখবে না।জায়ান আরাবীর গা থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিলো আলগোছে।নিজের গায়ের কোটটা আরাবীর গায়ে দিয়ে দিলো।তারপর খুব সাবধানে আরাবীকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।আরাবীর মাথাটা ঠিক জায়ানের বুকের বা-পাশটায় এসে ঠেকল।জায়ানের হৃদস্পন্দন বেরে গেলো।অনুভূতিতে তলিয়ে গেলো হৃদয়।খুব সাবধানে আরাবীকে কোলে গাড়ির সামনে আসল জায়ান।ধীর আওয়াজে দারোয়ানকে ডাকল।বলল,
‘ গাড়ির দরজাটা খুলে দিন চাচা।’

দারোয়ান তার পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে হাসলেন।গাড়ির দরজা খুলে দিতে দিতে তিনি বলেন,
‘ স্যার?আপামনিই কি আমাগো স্যারের বেগম হইবো নি?’

জায়ান দারোয়ানের কথায় বাঁকা হাসল।দারোয়ান যা বুঝার বুঝে ফেলল এতে।জায়ান আরাবীকে সিটে শুইয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং-এ বসল।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে খুব ধীরভাবে চালাচ্ছে।যাতে আরাবীর ঘুম না ভাঙে।আর আরেকটা কারন হলো এভাবে গেলে সে আরেকটু সময় পাবে আরাবীকে দেখার।পুরোটা রাস্তা ঘুমন্ত আরাবীকে দেখে দেখেই খুব সাবধানে পার করল।আরাবীদের বাড়ির সামনে আসল।এখন আর কি করার?মেয়েটাকে এইবার জাগাতেই হবে।কোনো উপায় নেই।অলরেডি ওর বাসা থেকে কল করছে। সেটা ফোনের আওয়াজেই বুঝতে পারছে জায়ান।নাহ,এইবার মেয়েটাকে ডাকা উচিত।জায়ান আলতো স্বরে ডাকল,
‘ মিস আরাবী?আরাবী?’

দু তিনবার ডাকার পর আস্তে আস্তে তাকায় আরাবীকে।ঘুমের ঘোর পুরো কাটতেই নিজেকে গাড়ির ভেতর আবিষ্কার করে চমকে যায়।অবাক হয়ে বলে,
‘ আমি কোথায়?’

জায়ান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
‘ আপাততো আমার গাড়িতে।আর আপনার বাড়ির সামনে।’

এবার যেন আরও অবাক হলো আরাবী।সে কিভাবে বাড়ির সামনে এসে পরল।আর ওর বাড়ির ঠিকানা জানল কিভাবে?আরাবী প্রশ্ন করল,
‘ আপনি আমাকে ডাকলেন না কেন স্যার?আর আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা জানলেন কিভাবে?’

এমন একটা প্রশ্ন আরাবী করবে সেটা জানতো জায়ান।তাই একটুও বিচলিত না হয়ে উত্তর দেয়,
‘ মিস আলিফা বলে দিয়েছে আমায়।’

অনায়াসে একটা মিথ্যে কথা বলল জায়ান।আর আরাবীর সরল মন সেটাই বিশ্বাস করল।আরাবী লম্বা শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।তারপর মাথাটা আলতো ঝুকিয়ে বলে,
‘ বাড়িতে আসুন স্যার।এক কাপ কফি অন্তত খেয়ে যাবেন।’

জায়ান বলল,
‘ সময় হলে এমনিতেও আসব আমি।তখন আপনি চাইলেও মানা করতে পারবেন না।’

বুঝতে পারল না আরাবী জায়ানের কথা।বলল,
‘ মানে বুঝলাম না স্যার।’
‘ আপনার বোঝার বয়স এখনও হয়নি।বাড়ি যান। গিয়ে বিশ্রাম নিবেন।আর হ্যা খাবার খাবেন ঠিক মতো।এন্ড ডোন্ট ফোরগেট টু টেক ইয়্যুর মেডিসিন ওন টাইম।’

আরাবী মাথা দুলালো।মিহি স্বরে বলে,
‘ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।আমার জন্যে এতো কষ্ট করার জন্যে।আপনার এই উপকার আমি কোনোদিন ভুলব না।’

আরাবী গাড়ির দরজা আটকে চলে যেতে নিবে।কিন্তু জায়ান তাকে আবার ডাকে।আরাবী থেমে যায়।জায়ান গাড়িটা এগিয়ে আরেকটু আরাবীর সামনে আসে।তারপর অদ্ভুত স্বরে বলে উঠে,
‘ মিস আরাবী দ্যা মুন ইজ বিউটিফুল ইজন্ট ইট?’

আরাবী জায়ানের এমন প্রশ্ন বোকা বোকা চোখে তাকালো।তারপর চাঁদ দেখার জন্যে আকাশে দিকে তাকালো।ততোক্ষণে জায়ান দেখে আরাবীদের বাড়ির গেট পেরিয়ে কেউ আসছে। জায়ান আরাবী বোকা সোকা কান্ডে মুচঁকি হাসল।তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজ গন্তব্যে রওনা দিলো।
জায়ানের গাড়ির আওয়াজে হুশ ফিরল আরাবীর।তাকিয়ে দেখে জায়ান চলে গিয়েছে ওলরেডি।ও ফের আকাশের দিকে তাকায়।আশ্চর্য? লোকটা কি বলে গেলো এটা?আকাশে তো কোনো চাঁদই নেই।মেঘে ঢাকা আকাশ।তাহলে এই উল্টাপাল্টা কথার মানে কি?
ততোক্ষণে ফাহিম এসে দাঁড়িয়েছে আরাবীর কাছে।বোনের দেরি দেখে কতোগুলো ফোন করেছিলো সে।একটাও ধরেনি আরাবী।সে রওনাই দিতে নিয়েছিলো আরাবীর অফিসের উদ্দেশ্যে।বের হতেই দেখে রাস্তায় আরাবী।ছুটে চলে আসে বোনের কাছে।ফাহিমের ডাকে আরাবী সেদিকে তাকায়।আহ্লাদী কণ্ঠে ডেকে উঠে,
‘ ভাইয়া।’

ফাহিম দ্রুত আরাবীর কাছে আসল।রাস্তার সোডিয়ামের লাইটের আলোতে আরাবীর ফ্যাকাশে মুখটা দেখেই ফাহিমের মুখে আঁধার নেমে আসে।অস্থির হয়ে বলে,
‘ কিরে?তোর এই অবস্থা কেন?চোখ মুখ এমন কেন লাগছে দেখতে?আর আমার ফোন ধরিস নি কেন?’

আরাবী যেন ঘাবড়ে গেলো।কি উত্তর দিবে এখন সে ফাহিম।ওই ঘটনা সম্পর্কে ফাহিমকে বলা যাবে না কিছুতেই।তাহলে সর্বনাষ হয়ে যাবে।আরাবী ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যে বলল,
‘ ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো ভাইয়া।তাই শুনতে পাইনি।সরি।আর ওই অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে আলিফার সাথে একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম।আসার পথে ঝুম বৃষ্টির কবলে পরে যাই।আধভেজা হয়ে যাই আমরা।অফিসে পৌছাতেও দেরি হয়ে যায়।আধভেজা শরীর নিয়ে এসির মধ্যে কাজ করেছি।তাই এখন ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।স্যার বিষয়টা খেয়াল করে বলেছেন পুরো সুস্থ হয়ে অফিসে যেতে।আর হ্যা এখানে পৌছেও দিয়েছে স্যার।

ফাহিম একহাতে বোনকে আগলে নিলো।বাড়িতে যেতে যেতে বলে,
‘ নয়ন ঠিকই বলেছে।ওই অফিসের মালিক অনেক ভালো।যাক শুনে ভালো লাগল।আর হ্যা আগে থেকে ছাতা নিয়ে যাবি।নিজের প্রতি এতো খামখেয়ালি হলে হয়?চল বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিয়ে খাবার খাবি।তারপর মেডিসিন খেতে হবে।
অফিসের লোকটা অনেক ভালো।তুই অসুস্থ দেখে তোকে ছুটিও দিলো।তার সাথে একবার দেখা হলে আমি তাকে ধন্যবাদ দিবো।’

আরাবী ভাইয়ের কথায় বিরবির করল,
‘ আসলে ভাইয়া সে অনেক ভালো।অনেক অনেক ভালো।তোমার আর বাবার পর তাকেই আমার খুব ভালো মনের মানুষ মনে হয়েছে।মনে হয়েছে সে আমার খুব আপন একজন মানুষ।এমনটা কেন মনে হয় আমার?কেন? উত্তর কি পাবো কোনোদিন আমি?’

এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে যায় আরাবী ফাহিমের সাথে।

#চলবে________

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here