স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ১৩

0
420

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৩
কপালের ঘামগুলো বার বার মুছতে ব্যস্ত ম্যানেজার সোলাইমান।ভয়ে তার হাত-পা কাঁপছে।শ্বাস আটকে আসছে একটু পর পর।চাকরি হারাবার ভয় আর টাকার লোভে একটা মারাত্মক অপরাধতো করে ফেলেছে সে।কিন্তু এখন ভয়ে যেন তার শ্বাস নেওয়া কষ্টের হয়ে গিয়েছে।অফিসে পুরোটা টাইম সাফওয়ান জায়ান সাখাওয়াত যেভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছিলো।তাতে উনি নিশ্চিত ওই পা’ষণ্ড হৃদয়ের মানুষটা জেনে গিয়েছে আরাবীর ওই অবস্থার জন্যে সে দায়ি।তাই তো ওমন সিংহের নজরে ওর দিকে তাকাচ্ছিলো।সুযোগ সময় পেলে এই বুঝি তার হিংস্র থাবা দিয়ে বসল ওর উপরে।ওই নিরেট চোয়ালদ্বয় যেন বারবার জানান দিচ্ছিলো ঠিক কতোটা রাগ পুষে রেখেছে সে।একবার যদি তার রাগের শিকার সে হয়।তাহলে যে নিস্তার নেই।
মোটর সাইকেল সাইকেল চালানো অবস্থায় এসব ভাবছেন সোলাইমান।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাড়ি পৌছাতে হবে।এবং তপলি তপলা নিয়ে ছাড়তে হবে এই দেশ।যেই টাকা সে সুহানা সাখাওয়াতের থেকে পেয়েছেন।তা দিয়ে অনায়াসে সে বিদেশ পারি দিতে পারবে।কিন্তু আপাততো এই শহর ছেড়ে দূরে কোথায় আত্মগোপন কর‍তে হবে।
ভাবনায় ব্যস্ত সোলাইমান হঠাৎ চোখে তীব্র লাইটের আলো পরায় বেষামাল হয়ে পরলেন।কোনোরকম ব্রেক কষলেন তিনি।আর একটু হলেই তো এই পিচঢালা রাস্তায় উড়ে পরতেন তিনি।যাক,বাঁচেলেন একটুর জন্যে।পরক্ষণে রাগে কিরমির করে উঠলেন।এভাবে কে মানুষের চোখের উপর লাইট মারবে?সোলাইমান মোটর সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালেন।কটমট করে বিশ্রি ভাষায় কয়েকটা গালি ছুড়লেন ওই অজ্ঞাত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে।তারপর বলেন,
‘ ওই জা***য়ারের বাচ্চা। কে তুই সামনে আয়।আজ তোর যদি একটা হেনস্তা আমি না করেছি।তো আমার নামও সোলাইমান নাহ।’

সোলাইমের দৃষ্টি ঝাপসা।অতিরিক্ত ভয় আর চিন্তায় সে ক্লাবে গিয়ে বেশ ভালোই নেশা করেছে।তাইতো এতো দেরি হয়ে গিয়েছে।রাত বোধয় দেঢ়টা বাজে।
নির্জন রাস্তা।মানুষ নেই বললেই চলে।শুধু ক্ষণে ক্ষণে দু একটা গাড়ি যেতে দেখা যায়।সোলাইমান আবারও গালাগাল করতে করলেন কিছুক্ষণ।
তারপর ঢুলতে ঢুলতে মোটর সাইকেলের কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াবেন।এমন সময় অকস্মাৎ জোড়ালো স্পীডে একটা বাইক এসে শা করে সোলাইমানের সামনে দিয়ে চলে যায়।ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই রাস্তায় আছরে পরেন সোলাইমান।তার গলার মাঝ বরাবর ছু’রির লম্বা আঘাত।যেখান থেকে গল গল করে র’ক্ত বের হচ্ছে।সোলাইমান কতোক্ষণ হাত পা ছুড়ে দপালেন।তারপর নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।তার নিথর দেহটা পরে রইলো ওই নির্জন রাস্তায়।
—–
সকাল আটটা চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পরছেন মিহান সাহেব।তিনি অসুস্থ মানুষ।কাজ টাজ করতে পারেন না।তার একটা পায়ে সমস্যা।আবার তার ফুসফুসেও সমস্যা আছে।তাই তো কোনো কাজ করলে ক্লান্ত হয়ে পরেন।ভাইয়ের এই অসুবিধা দেখে নিহান সাহেব তাকে কাজ করতে বারণ করে দিয়েছেন।টাকা পয়সা আল্লাহ্’র রহমতে অনেক আছে তাদের।তার এই অসুস্থ ভাইকে দিয়ে কাজ করাবেন এতোটা পাষাণ তিনি নন।
কোম্পানিটা বহু কষ্টে তিনি একা দাঁড় করালেও।বেঈ’মানি করেননি তিনি।কাগজপত্রে তৈরি করে রেখেছেন।সেখানে লিখা তিনি যখন মা’রা যাবেন এরপর জায়ান আর ইফতি কোম্পানির ফিফটি-ফিফটি পার্সেন্ট মানে সমানভাবে ভাগ পাবে তারা।আর নূর পাবে তার জুতোর ফ্যাক্টরিটা।
কোনো কিছুতেই কোনো খামতি রাখেননি তিনি।
মিহান সাহেব জ্বলজ্বল চোখে খবরের কাগজে নিজের বড়ো ভাই আর তার দুইপাশে তার দুটো ছেলে একটা জায়ান আর আরেকটা ইফতিকে দেখছেন।জায়ান তো তারও ছেলে তাই নাহ?
এইভাবে পরের পৃষ্ঠা উল্টালেন।ভালোভাবে খবরের কাগজে এমন কিছু দেখলেন যা দেখে তার হাত থেকে চায়ের কাপ পরে গেলো।চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
অকস্মাৎ তার এমন চিৎকারে ছুটে আসলেন সবাই।আজ শুক্রবার বিধায় আজ সবাই বাড়িতেই আছেন।
জায়ান আসল সবার শেষে।মিহান সাহেবের ওমন বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখল শান্ত চোখে।শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে চাচ্চু?’

মিহান আতংকিত নয়নে জায়ানের দিকে তাকালেন।কাঁপা স্বরে বললেন,
‘ ম্যানেজার সোলাইমান গতকাল রাতে খুন হয়েছেন।’

সুহানা সাখাওয়াতের যেন শ্বাস আটকে গেলো এমন একটা ঘটনার কথা শুনে।চেচিয়ে উঠলেন তিনি,
‘ কি বলছ তুমি মিহান ভাই?’
‘ হ্যা ভাবি।আমি ঠিক বলছি।আপনি নিজেই দেখে নিন।’

খবরের কাগজটা সুহানা সাখাওয়াতের হাতে দিয়ে দিলেন। সুহানা সাখাওয়াত নিউজটা পরে আতংকে স্থির হয়ে গেলেন।ভয়ে বুকটা ধরাস ধরাস করছে।

জায়ানের মুখয়বে কোনোরকম পরিবর্তন দেখা গেলো না।ও বেশ শান্ত স্বরে বলল,
‘ রিলেক্স চাচ্চু।তুমি অসুস্থ এতোটা হাইপার হবে না।টেক আ ডিপ ব্রেথ।’

মিলি বেগম স্বামিকে একগ্লাস পানি পান করালেন।পানি পান করে মিহান সাহেব জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলেন।
এদিকে নিহান সাহেব বললেন,
‘ এইভাবে সোলাইমানকে কে মারবে? বোঝাই যাচ্ছে এটা মার্ডা’র কেস।ওর গলায় ছু’রি চালানো হয়েছে।’

জায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ সেটা আমাদের না ভাবলেও চলবে।মেইন টপিক হচ্ছে সোলাইমান যেহেতু আমাদের কোম্পানিতে জব করতেন।এখন পুলিশ আমাদের বাড়িতেও আসবেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে।জাস্ট ডোণ্ট বি প্যানিক।কুয়েশ্চন আস্ক করা হলে সিম্পলি তার আন্সার দিবে।’

একটু থেমে আবার বলল,
‘ এখন যাও। যে যার কাজে যাও।আর এই বিষয়ে কেউ বারতি চিন্তা করবে না।আই উইল হ্যান্ডেল দিছ ম্যাটার।’

জায়ানের কথাটা সবাই যেন একটু ভড়সা পেলো।যে যার কাজে চলে গেলেন।
সুহানা সাখাওয়াত হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে আসলেন।দ্রুত হাতে শামিম শেখকে ফোন লাগালেন।তিনবারের সময় ফোন রিসিভ হলে তিনি অস্থির কণ্ঠে বলে উঠেন,
‘ হ্যালো?শামিম ভাই?বিশাল বড়ো একটা কান্ড ঘটে গিয়েছে ভাই।’

শামিম শেখ যেন বিরক্ত হলেন সুহানার এভাবে কথা বলায়।তিনি নাক মুখ কুচকে বলেন,
‘ কি হয়েছে বিষয়টা আমাকে খুলে বলো সুহানা।’
‘ সোলাইমানকে কারা যেন মে’রে ফেলেছে।’
‘ হোয়াট?’ চেচিয়ে উঠলেন শামিম শেখ।
‘ হ্যা।আমার ভয় করছে।কেউ কি জেনে গিয়েছে সোলাইমান ওই মেয়েটাকে মার’তে চেয়েছে?সেই কারনে কি সোলাইমানকে মেরে ফেলেছে সে?তাহলে তো ভাই সে এটাও জেনে গিয়েছে এর পেছনে আসল মাস্টারমাইন্ড আমি।কারন তাকে এটা করার কথা তো আমিই বলেছিলাম।’

শামিম শেখ ধমকে উঠলেন সুহানাকে,
‘ কি যা তা বলছ?’
‘ হ্যা আমি ঠিকই বলছি।যদি কোনোভাবে এটা জায়ান জানতে পারে। আমার নিস্তার নেই শামিম ভাই।আর ফাসলে আমি একা ফাসবো না।আপনাকে তো আমি মুক্ত ঘুরতে দিবো না।যদি আমার কিছু হয়ে যায়।’
‘ সুহানা ভালোভাবে কথাবার্তা বলিও।’
‘ কি?আমাকে থ্রেড দিবেন না আপনি।এটা মনে রাখবেন আমার কিছু হলে আপনার মেয়েকে এই বাড়ির পুত্রবধূ বানানো।আপনার স্বপ্নই রয়ে যাবে।এই আমি বলে দিলাম।’

খট করে ফোন কেটে দিলেন সুহানা সাখাওয়াত। শামিম শেখ চিন্তায় ডুবে গেলেন।কে সে?যে সোলাইমানকে এইভাবে মে’রে ফেলল?
_________
দেখতে দেখতে তিনটে দিন বাড়িতে বসেই কাটলো আরাবীর।শরীরটা এখন পুরোপুরি সুস্থ।সারা দিন বিশ্রাম করেই কাটিয়েছে সে।ঠান্ডা লাগায় তাকে কেউ কাজ টাজ করতে দেয়নি।
এসবের মাঝে জায়ানের কথা সর্বক্ষণ ভেবেছে আরাবী।লোকটা যেন একটা গোলকধাঁধা। ক্ষণে ক্ষণে লোকটার অদ্ভুত সব কথাবার্তা ওর মাথায় ঢুকে না।
সেদিন জায়ানের চোখে যেই অদ্ভুত অনুভূতি আবিষ্কার করেছিলো আরাবী।তা কি আদৌ ওর সঠিক ধারণা ছিল?নাকি নেহাৎ-ই ওর মনের ভ্রম?
আর সেদিন কি একটা কথা বলল।ওই একটা বাক্য শুনে কেন যেন হৃদয় কেঁপে উঠেছিলে আরাবীর।
কিন্তু এটাদ অর্থ কি?আজ তিনদিন যাবত ভাবছে আরাবী।
ব্যালকনিতে আনমনে আকাশে তাকিয়ে আছে আরাবী।আজ আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে।পরিষ্কার আকাশ।ওই কথাটা আজ বললে একটা মানান সই ছিলো।
কিন্তু মানুষটা তো আর বোকা না যে এইভাবে কোনো কারন ছাড়াই একটা কথা বলে ফেলবে।ওই বাক্যটা দিয়ে মানুষটা কি ওকে কিছু ইশারা করছিল?তবে সেটা কি?এই প্রশ্নের উত্তর সে কোথায় পাচ্ছে না।
আলিফার কাছে কি একবার জিজ্ঞেস করবে সে? আলিফা মেয়েটা অনায়াসে সব কিছুর সমাধান করে দেয়।
আরাবী সত্যি সত্যি আলিফাকে ফোন করে।আলিফা রিসিভ করলে আরাবী সালাম দিলো।আলিফাও সালামের জবাব দিলো।তারপর দুজন দুজনের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল।কথার এক পর্যায়ে আরাবী প্রশ্ন করে,
‘ আচ্ছা আলিফা আপু?দ্যা মুন ইজ বিউটিফুল ইজন্ট ইট?
এটা দ্বারা কি বুঝায়?’

আলিফা ভ্রু-কুচকে বলে,
‘ আজকের চাঁদটা সুন্দর, তা নয় কি?’
‘ আরে আমি সেটা বলিনি।মানে ধরো আকাশে চাঁদ নেই।পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা।এরপরেও যদি কেউ এই কথাটা বলে তাহলে সেটার মানে কি?’

আলিফা হা হয়ে গেলো। বলল,
‘ আগে বলো এটা মানে তুমি জানো না? আর কথাটা তোমায় কে বলেছে?’
‘ আরে ধুর এই কেউ বলেনি আমাকে।আমি অন্যদের বলতে শুনেছি।আর এর অর্থ যদি আমি জানতাম।তবে কি তোমায় জিজ্ঞেস করতাম?’এখন বলো না এটার মানে কি?’

আলিফার কাছে বিষয়টা গোপন রাখল আরাবী।তাই মিথ্যে বলল।
এদিকে আলিফা বলল,
‘ আমার এক্সপ্লেনেশন তুমি হয়তো নাও বুঝতে পারো।এক কাজ করো এটা তুমি গুগল করে নেও।তাহলে ভালোভাবে বুঝতে পারবে।’
‘ কি বলো গুগলে এসবের উত্তর থাকে নাকি?’
‘ গুগলে সব কিছুর উত্তর পাবে।এখন রাখি হ্যা?কিছু ফাইল চ্যাক করছি। ওকে গুড নাইট।’

আরাবী ভাবনায় পরে গেলো।সত্যিই কি এর উত্তর গুগল করলে সে পাবে?আচ্ছা একবার করেই নাহয় দেখা যাক।কি হয়।নিজেকে শান্ত করে নিয়ে সত্যি সত্যি গুগল করল জায়ানের সেই কথাটা।
লিখল,
‘ হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং ওফ দ্যা মুন ইজ বিউটিফুল, ইজন্ট ইট?’

সার্চ বারে চাপ দিতেই ওর প্রশ্নের উত্তর আসে।
সেখানে লিখা,
“The moon is beautiful, isn’t it?” is more poetic way of saying I love you in Japanese language.And The most popular response is (I can die happy), which is a way of saying “I love you too.”

এটা পড়তেই ঠাস করে আরাবীর হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।চোখ দুটো বৃহৎ আকার ধারণ করেছে মেয়েটার।থর থর করে কাঁপছে শরীর।হার্টবিট এতোটাই জোড়ালো হচ্ছে যে সেই শব্দ আরাবী শুনতে পাচ্ছে।মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
তাহলে কি সেদিন লোকটা ওকে ইন্ডিরেক্টলি ভালোবাসি বলেছে।কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?কোথায় সে? আর কোথায় জায়ান সাখাওয়াত। এটা হবার হয়।কোনোদিন হবে না।এটা ভালোবাসা হতেই পারে না।ওর মতো একজন মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।লোকটা ওর মোহে পরেছে।যা আজ বাদে কাল চলে যাবে।
নাহ,আরাবী তোকে শক্ত হতে হবে।বোঝাতে হবে মানুষটাকে যে এটা ঠিক না।এটা সম্ভব না কোনোদিন।কিন্তু সে যদি না মানে?তবে?তবে কি করবে আরাবী?
কিছুক্ষণ নিরবে ভাবল আরাবী।পর পর সিদ্ধান্ত নিলো।এই চাকরি সে ছেড়ে দিবে।করবে না সে এই চাকরি।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here