স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ১৪

0
774

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৪
‘ আরাবী তুমি এসব বলছ?যা করছ ভেবেচিন্তে করছ?’ আলিফার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।আরাবী চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরাবী মলিন হেসে বলে,
‘ চাকরিটা ছাড়া আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না আলিফা আপু।কিন্তু পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে। আমি কোনোভাবেই এই চাকরি করতে পারবো না।’
‘ কি এমন কারন আরাবী?’

আরাবী আলিফার প্রশ্নের জবাব দিলো না।বিনিময়ে হাসি উপহার দিলো আরাবী তাকে।তার রিজাইন লেটার লেখাও শেষ।আরাবী উঠে দাঁড়ালো।আলিফা মুখ ভার করে বলে,
‘ আরাবী আর একবার ভেবে দেখো প্লিজ।’
‘ আমার ভাবা শেষ আপু।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আলিফা।করুণ গলায় বলল,
‘ তুমি চলে যাবে।তোমার কাছে একটা আবদার করব, রাখবে?’
‘ কি আপু?’
‘ আমি কিন্তু তোমার থেকে বড়ো নাহ ওতো।নয়ন ভাইয়ের থেকে যা জেনেছি।তুমি আর আমি সমবয়সী। তাহলে এই এতো ফর্মালিটিস রাখবে না প্লিজ।আমরা বন্ধু হতে পারি নাহ?’

মুচঁকি হাসল আরাবী।বলল,
‘ আমরা তো বন্ধুই।’

মুখ ফুলিয়ে আলিফা বলে,
‘ কিসের বন্ধু?বন্ধুকে কেউ তুমি আর আপু বলে ডাকে?’

হেসে উঠল আরাবী আলিফার বাচ্চামো কথায়।তারপর বলে,
‘ আচ্ছা এখন থেকে নো তুমি আর আপু।অনলি তুই।ঠিক আছে?’

হাসি ফুটে উঠল আলিফার ঠোঁটেও,
‘ এখন থেকে তুই।কিরে ভালো আছিস?’

খিলখিল করে হাসল আরাবী।বলল,
‘ বিন্দাস আছি।তুই কেমন আছিস?’

আলিফা পর পর মন খারাপ করে বলে,
‘ আমি ভালো নেই।তুই চলে যাচ্ছিস যে।’
‘ আরে ধুর মন খারাপ করবে থুক্কু করিস না।আমাদের যোগাযোগ আর দেখা সাক্ষাৎ তো হবেই।’
‘ হুম!’
‘ এখন আর মন খারাপ করে থাকিস না।আমি যাই ঠিক আছে।’

আলিফা মাথা দুলালো।আরাবী বড়ো একটা শ্বাস ফেলে জায়ানের অফিসরুমের দিকে পা বাড়ালো।বুক ভড়ে শ্বাস নিয়ে দরজায় টোকা দিলো।
‘ ম্যে আই কাম ইন স্যার।’
‘ কাম।’

আরাবী ভেতরে প্রবেশ করল।দেখে জায়ান খুব মনোযোগ সহকারে ল্যাপটপে কাজ করছে।ভ্রু জোড়া কুচকে তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।সাদা শার্ট, আর কালো ডেনিম প্যান্টে মারাত্মক আকর্ষনীয় লাগছে তাকে।বলিষ্ঠ শরীরের ম্যাসলসগুলো যেন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ওই শার্টের উপর দিয়ে।অওডেমারস পিগুয়েট ওয়াচ (Audemars Piguet watch) পরিহিত হাতটি অনবরত ল্যাপটপে চালিয়ে যাচ্ছে সে।আঙুলগুলোর যেন দন্ড বিশ্রাম নেই।ফর্সা মুখটায় চাপ দাঁড়িগুলো যেন তার চেহারার সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।চোখজোড়ার দিকে তাকালেই যেন হারিয়ে যায় আরাবী।ওই কালচে খয়েরি ঠোঁটজোড়ার পাশে ছোট্টো একটা কালো তিল।কি যে অমায়িক সুদর্শন এই লোক।যার দিকে একবার তাকালে চোখ সরানো যায় না যেন।আর এই লোকটা নাকি তার মতো একটা মেয়ে ভালোবাসে।এটা কিভাবে সম্ভব?সে তো ওমন সুন্দর না,ফর্সা গায়ের রঙের মেয়ে না সে।এই দুনিয়াটা যে ফর্সা গায়ের রঙের জন্যে পাগল।কালো মেয়েদের তো সর্বদাই মানুষের তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে হয়।
এইযে লোকটা বলে, সে নাকি ওকে ভালোবাসে।তার ভালোবাসা যদি আরাবী মেনেও নেয়। কিন্তু ওর মতো একটা মেয়েকে কি লোকটার পরিবার মেনে নিবে?মেনে নিবে তাদের এই সমাজ?প্রতিনিয়ত ওকে আর ওর পরিবারকে কথা শুনতে হবে লোকের।
কতো কথা যে লোকে বলে।এই যেমন, ‘ হায়রে, এই ছেলে এই মেয়েকে বিয়ে করেছে?কিভাবে সম্ভব?নিশ্চয়ই জাদু টোনা করেছে।বড়োলোকের ছেলে তো।টাকা পয়সা হাতিয়ে নেবার ধান্দা।আজকালকার যুগের বাপ মা মেয়ে দিয়ে ব্যব’সা শুরু করে দিয়েছে।এমন চান্দের মতো সুন্দর ছেলের সাথে এই কালি রে কি মানাইবো?বাচ্চা কাচ্চা গুলো যদি এই মেয়ের মতো হয়।তাহলে তো কথাই নাহ।কি সর্বনাষ করল রে। ‘

আরও অনেক জঘ’ন্য সব কথা বলে মানুষ।এসব আরাবী শুনতে পারবে না। একদম পারবে না।তাকে বললেও সে মানবে।কিন্তু ওর বাবা মাকে যদি কেউ কিছু বলে।তবে সেটা আরাবী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না।
তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাবী।

‘ দাঁড়িয়েই থাকবেন?কি জন্যে এসেছেন সেটা বলেন।আর যদি কিছু বলার না থাকে।তাহলে আমার সামনে এসে বসুন।’

অকস্মাৎ জায়ানের ভারিক্কি গলার আওয়াজে কেঁপে উঠে আরাবী।শুকনো ঢোক গিলে একপা দুপা করে জায়ানের কাছে এগিয়ে যায়।রিজাইন লেটারটা জায়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘ স্যার,এই লেটারটা পড়ে একটা সাইন করে দিন।’

জায়ান কাজে ব্যস্ত।ইদানিং কাজের চাপ বেড়েছে নতুন প্রজেক্ট হাতে পাওয়ায়।সে কাজ করতে করতেই বলে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘ এই ফাইলের উপরে রাখুন আরাবী।এই কাজটা শেষ করে তারপর কাজটা করে দিচ্ছি।’

আরাবী বাচল যেন।ভালো হয়েছে লোকটা জিজ্ঞেস করেনি এটা কিসের লেটার।সে জানে লোকটা এতো সহজে তাকে যেতে দিবে না।রিজাইন লেটার সে দিয়ে দিয়েছে।এখন যে করেই হোক এই অফিস থেকে তাকে বেরোতে হবে।আরাবী আমতা আমতা করে বলে,
‘ স্যার, আসলে আমার আজকের দিনের জন্যে আবারও ছুটির প্রয়োজন। জানি গতদিন আমি ছুটি কাটিয়েছি।কিন্তু আজকের দিনটার ছুটিও প্রয়োজন।’

জায়ান কাজ থামিয়ে দিলো।শান্ত চোখে তাকালো আরাবীর দিকে।ওই চোখের দৃষ্টির প্রখরতায় আরাবীর শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো।জায়ান ঠান্ডা স্বরে বলে,
‘ আমি আপনাকে সেদিনই বলে দিয়েছি আরাবী।আপনার শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অফিসে আসবেন না।তবুও যেহেতু এসেছেন ভালো কথা।অফিসে এসে যদি আপনার খারাপ লাগে।তাহলে সেটা সিম্পলভাবে আমাকে বলবেন।এতো কৈফিয়ত আমি চাইনি।বাড়ি যান।গিয়ে বিশ্রাম নিন।সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আসবেন না।’

আরাবী সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল।যাক অল্পতেই লোকটা মেনে গিয়েছে।আরাবী মৃদু স্বরে বলে,
‘ ধন্যবাদ স্যার। আসি তাহলে।’

আরাবী চলে গেলো।আরাবীর যাওয়ার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জায়ান।আরাবীকে আজ অদ্ভুত লাগছে।মেয়েটা কি কিছু নিয়ে টেনশন করছে?কিন্তু কি?
নাহ,ভালোভাবে খোঁজ নিতে হবে। কি হয়েছে তার প্রিয়তমা কাঠগোলাপের।
জায়ান মনে মনে সবটা ভেবে নিয়ে।আবার কাজে মনোযোগ দিলো।হাতের কাজটা তাকে দ্রুত শেষ করতে হবে।
________
বাসায় আসতেই মায়ের নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হলো আরাবী।আরাবী চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আপাততো না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো।ওর মা আর বাবাকে বলল,
‘ জ্বরটা বোধহয় এখনও পুরোপুরি সারেনি।শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।আর মাথাটাও ব্যথা করছে।এইজন্যে ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।’

জিহাদ সাহেব বলেন,
‘ আহা লিপি,এতো প্রশ্ন করো না তো।মেয়েটার ভালো লাগে না।এইজন্যেই চলে এসেছে তাই নাহ?যা মা তুই গিয়ে বিশ্রাম নেহ।’

আরাবী রুমে চলে আসল।তারপর থপ করে শুয়ে পরল বিছানায়।কি করবে আরাবী এইবার?চাকরিটা তো ছেড়ে দিলো।এখন কি করবে?ভাই যদি জেনে যায় চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা।তবে কি করবে সে?কি জবাব দিবে?
আরাবীর চোখ ভিজে উঠল।জীবনটা এতো কঠিন কেন?
আজ কালো বলেই কি এতো এতো সমস্যা ওর জীবনে।ও তো কালো না শ্যামলা গায়ের রঙ তার।তবুও মানুষ ওকে কালোই বলে।ছোটো থেকে এই গায়ের রঙ নিয়ে নানান কটু কথা শুনতে শুনতে আরাবীর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে। তিন চারবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিলো আরাবীর।প্রতিবার এই গায়ের রঙের কারনেই কেউ ওকে পছন্দ করেনি।উলটো আরও নানান কথা শুনিয়ে দিয়েছে ওকে আর ওর পরিবারকে।ফাহিম রেগে গিয়ে হুলুস্থুল কান্ড করে সেদিন।।এরপর আর আরাবীর বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠায়নি কেউ।নাহ কাউকে দেখতে দিয়েছে আরাবীকে।কিন্তু এতে আরাবী অনেক অসুস্থ হয়ে পরে।কারো সাথে ঠিকঠাক কথা বলতো না। মানুষের সান্নিধ্যে যেতে ভয় পেতো।ঘর ছাড়া বের হতো না।মানে পুরো ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো আরাবী। ফাহিম একদিন ওকে জোড় করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায়।তারপর জানতে পারে আরাবীর সোশ্যাল ফোবিয়া হয়ে গিয়েছে।
তবে ওতোটা মারাত্মক পর্যায়ে যায়নি।
সোশ্যাল ফোবিয়া হচ্ছে যেমন ধরুন।আপনার বন্ধুদের দ্বারা খারাপ আচরণ, টিটকারি, সমালোচনা বা বুলিংয়ের স্বীকার হলে পরবর্তী সময়ে সামাজিক ভয় রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ড বা সামাজিক মান সবসময় মানসিক চাপ তৈরি করে, ফলে সামাজিক পরিবেশে কাজ করতে গেলে বেশি দুশ্চিন্তা তৈরি হয় এবং দুশ্চিন্তা থেকে অনেক শারিরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ধীরে ধীরে সে সামাজিক পরিবেশ এড়িয়ে চলে। এভাবে সামাজিক ভয় বা সোশ্যাল ফোবিয়া তৈরি হয়।
জাতিগত বিভেদ ও বৈষম্য, ভেদাভেদ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সামাজিক ভয় রোগের কারণ হতে পারে।

ফাহিম যেন পাগল হয়ে যায় বোনের জন্যে।পুরো টানা ছয়মাস চিকিৎসা চালানোর পর আরাবী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।তবে ভয়টা এখনও মনের এককোণে থেকে গিয়েছে।
বিছানায় শুয়ে থাকা আরাবীর চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরছে।মনে মনে ভাবছে কবে হবে তার এই বিষাদ ভরা জীবন্টা রঙিন হয়ে উঠবে। কবে ও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে? কাঁদতে কাঁদতে সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় আরাবী।তবে আরাবী ভাবতেও পারবে না আগামীতে ঠিক কি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।যদি জানতো তবে এভাবে ঘুমোতে পারতো না কোনোদিন।

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here