স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ১৫

0
462

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৫
‘ আরু?ঘুমোচ্ছিস?’

মাত্রই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বেড়িয়েছে আরাবী।ফাহিমের ডাক শুনে।ও বলে,
‘ হ্যা ভাইয়া। এসো ভেতরে।’

ফাহিম আলগোছে ভেতরে প্রবেশ করল।আরাবীর বিছানায় বসে।পাশের জায়গাটা থপথপিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ এখানে এসে বোস।’

আরাবী চুপচাপ বাধ্য বোনের মতো ফাহিমের পাশে এসে বসল।আরাবী বসতেই ফাহিম আরাবীর মাথায় আদুরে স্পর্শে হাত বুলিয়ে বলে উঠে,
‘ আমি তোর বড়ো ভাই।আর তুই তো জানিস। তোর ভাই কখনও তোর খারাপ চাইবে না,তাই নাহ?’

আরাবী মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো।বলল,
‘ হ্যা তুমি আমার জন্যে যা করবে আমার ভালোর জন্যেই করবে সেটা আমি জানি।’

ফাহিমের চোখ মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল এই কথা শুনে।বলল,
‘ তাহলে আজ একটা কথা বলব। আমার কথাটা রাখবি?’

চিন্তিত হয়ে পরল আরাবী।কি এমন কথা বলবে ফাহিম?যার জন্যে সে এভাবে কথা বলছে?
আরাবী বলল,
‘ কি কথা ভাইয়া?’
‘ আগে বল আমার কথাটা রাখবি।বিশ্বাস করিস না আমাকে?’
‘ নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।আর তাই তোমার কথাটা আমি রাখব। এইবার বলো কি কথা।’

আরাবীর কথায় ফাহিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।বার কয়েক জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে অতঃপর বলল,
‘ তোর জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে।’

ফাহিমের মুখে এমন একটা কথা শুনে চমকে উঠল আরাবী।অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো ফাহিমের দিকে।ওর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ফাহিম নিজে এই কথাটা ওকে বলছে।যেই ফাহিম ওর জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ আসায় রেগে গিয়ে দুদিন বাড়িতে আসেনি।সে ফাহিম আজ নিজেই ওকে এই কথা বলছে।আরাবী কাঁপা স্বরে বলে,
‘ ভাইয়া এসব তুমি কি বলছ?’

ফাহিম বুঝতে পারল আরাবীর মনের অবস্থা।তাই আরাবীর একটা হাত আঁকড়ে ধরে ওকে ভড়সা দিলো।নরম গলায় বলে উঠল,
‘ দেখ বোন বিয়ে মানুষকে একদিন না একদিন করতেই হবে।আমি তুই যতোই বিরোধিতা করি না কেন? দুনিয়ার এই নিয়ম কেউ বদলাতে পারিনি।এমনিতেও জীবনের এক পর্যায়ে এসে মানুষের একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
বিয়ে হচ্ছে একটা সমাজিক বন্ধন বা চুক্তি । মানুষের জীবনে চলতে গেলে অনেক কিছু শেয়ার করতে হয়, অনেক হেল্প লাগে, প্রতিটি মুহুর্তে একজন কে প্রয়োজন হয়। নিজের সুখ দুঃখ হাসি আনন্দ শেয়ার করার জন্যে । জীবনে একজন সত্যিকারের বন্ধুর প্রয়োজন হয় যে কিনা সব সময় হেল্প করতে প্রতিটি মুহুর্তে , জীবনকে আরো সুন্দর আর সুখের করার জন্যেই মানুষ বিয়ে করে। আর আমিও চাই আমার বোনটা সুখে থাকুক।তুই সুখী মানে আমি সুখী।তোকে কোনো ভালো ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে জীবন থেকে আমার জীবনটা স্বার্থক হবে আরু।’

ফাহিমের প্রতিটা কথা মাথা নিচু করে শুনলো আরাবী।সত্যিই তো ফাহিম যা বলছে ঠিকই তো বলছে।হাজার ও বলুক বিয়ে করবে না।কিন্তু এটা যে কোনোভাবেই হয় না।
আরাবী ছলছল চোখে ফাহিমের দিকে তাকালো।ফাহিম মলিন হাসল আরাবীর ওই কান্নারত মুখশ্রী দেখে।তারপর নিজের হাতে যত্ন সহকারে আরাবী চোখজোড়া মুছিয়ে দিলো।তারপর বলল,
‘ তুই যদি না চাস।তবে আমি তোকে জোড় করব না আরু।তবে আমি নিজে যাচাই বাছাই করেছি ছেলে সম্পর্কে। এরপরই তোকে এই বিষয়ে জানাতে এসেছি।ছেলে অনেক ভালো।তার কোনো খারাপ ব্যাকগ্রাউন্ড নেই।তবে তুই না চাইলে আমি তাদের মানা করে দিবো। ‘
‘ তাদের আসতে বলো ভাইয়া।’

আরাবীর দৃঢ় কণ্ঠ।ফাহিম বড়ো বড়ো চোখে তাকালো।সত্যিই আরাবী রাজি হয়ে গিয়েছে?এতো তাড়াতাড়ি?
‘ তুই সত্যিই রাজি।’

আরাবী জোড়পূর্বক হাসার চেষ্টা করল।অতঃপর বলল,
‘ আমি জানি তুমি কখনও আমার খারাপ চাইবে না।আর মানুষের কটু কথা শোনার ভয় আমি কতোদিন পাবো বলো?’
‘এইতো আমার লক্ষী বোন।তবে তাদের আসতে বলি।ছেলে দেখে যদি তোর পছন্দ না হয়।তাহলে আর কোনো জোড় নেই।’
‘ হুম।’

ফাহিম উঠে দাঁড়ালো।তারপর আরাবীর মাথায় আদর করে হাত বুলালো।বলল,
‘ রেস্ট নেহ।আমি বাজারে যাচ্ছি।রান্নাবান্নাও তো করা লাগবে তাই নাহ?’
‘ আচ্ছা।’

ফাহিম চলে গেলো।ও যেতেই আরাবী চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো।কি হচ্ছে ওর সাথে?আর ভবিষ্যতেও বা কি হবে?জানে না আরাবী।এখন সবটা আল্লাহ্ তায়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছে সে।এইবার দেখা যাক তিনি কি লিখে রেখেছেন ওর কপালে।
_______
‘ হ্যা আমি নাম বলিনি তো।তবে শুনে রেখো আমার বোন যদি না করে দেয়। এরপর আর কোনো কথা হবে না।বহু কষ্টে ও নিজেকে শক্ত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

নিজের ঘরে বসে ফোনে কথা বলছে ফাহিম।ফোনের অপাশ থেকে ফাহিমের কথা শুনে ইফতি যেন চিন্তায় পরে গেলো।সত্যি যদি আরাবী জায়ানকে দেখে না করে দেয়?তবে কি করবে তারা?তবু নিজেকে সামলে ইফতি বলে,
‘ আমার বড়োবাবা বলেছে তো আপনাদের যা সিদ্ধান্ত হবে তাই আমরা মেনে নিবো। রাখছি তবে?কাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ! ‘
‘ ইনশাআল্লাহ! ‘

ফোন কেটে চুপচাপ বসে রইলো ইফতি।পরশুদিন থেকে যেন একের পর ঝটকা খাচ্ছে ইফতি।পরশুদিন রাতে অফিস থেকে ফিরতেই হুট করেই নিহান সাহেব সকলকে একসাথে ডাকলেন।তারপর এমন একটা কথা বললেন তিনি যে শুধু ইফতি না বাড়ির সকলেই অবাক হয়েছে।
নিহান সাহেব বলেছিলেন,
‘ আমার ছেলে জায়ানের বিয়ে দেব আমি।মেয়েও ঠিক করা হয়ে গিয়েছে।আর সেই মেয়েকে জায়ান নিজেও ভালোবাসে।আমরা আগামীকাল ওর পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলব।তারপরের দিন তাদের বাড়িতে যাবো বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করতে।’

ইফতি যেন নিজের দুকানে শোনা ওই কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না।অবিশ্বাস্য নজরে জায়ানের দিকে তাকায়া সে। দেখে তার ভাই নির্বিকার ভঙিতে সোফায় বসে কফি খাচ্ছে।যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলো ইফতি।যে তার ভাইয়ের এই বিয়েতে মত আছে।তা নাহলে বিয়ের কথা উঠলেই তো সে ছ্যাত করে উঠে।
এই পর্যায়ে ঠিক ছিলো।তারপর নিহান সাহেব আরও জানান।জায়ান যাকে ভালোবাসে সে আর কেউ না আরাবী।ওর ভাইয়ের পিএ। অনেকক্ষণ সময় লাগে ইফতির নিজেকে সামলাতে।এরপর সে বেশ খুশিই হয়।যাক অবশেষে তার ভাই নিজের জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে।
এর পরেরদিন তারা আরাবীর পরিবারের সম্পর্কে পুরো তথ্য জোগাড় করে।সে অনুযায়ী শটকার্টে ফাহিমের সাথে দেখা করার জন্যে ও যেখানে কর্মরত সেই কলেজে যায় তারা।সে,জায়ান আর নিহান সাহেব যান।
প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না ফাহিম।পরে জায়ান নিজেই কথা দেয় যে আরাবী যদি এই বিয়েতে একবার মানা করে দেয়। ব্যস,আর কিছুই করবেন না তারা।
এদিকে তারা চলে যেতেই ফাহিম তার বন্ধু নয়নকে নিয়ে জায়ানের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করে।খোঁজ খবর নিয়ে জায়ানের সম্পর্কে কোনোরকম খারাপ কথা জানতে পারেনি তারা।কিন্তু আরাবীর জন্যে চিন্তা হচ্ছিলো ফাহিমের। একেতো তার বোন এসব বিষয়ে অনেক ভয় পায়।আবার জায়ান আরাবীর অফিসের বস।আর বোন নিজেই তার পিএ।
পরে সেদিন রাতে ইফতি কল করে ফাহিমকে।ও ফাহিমকে জানায় যে।জায়ান’রা আরাবীকে দেখতে আসবে সেটা যেন তাকে না জানানো হয়।এটা যেন সিক্রেট রাখে ফাহিম আরাবীর কাছ থেকে।কারন এ সম্পর্কে জানলে আরাবী প্রথমেই মানা করে দেবে।তারা আরাবীকে তাদের পরিচয় না জানিয়ে আসবে।আসার পর তাদের পুরো পরিবার দেখে যদি মেয়েটার ধারণা পালটে যায়। যদি সে রাজি হয় তবে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর রাজি না হলেও কোনো জোড় নেই এতে।
সাখাওয়াত পরিবারের সকলের এই অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয় ফাহিম।সত্যিই মানুষগুলো অনেক ভালো।তার বোন যদি রাজি হয় তবে ওর বোনটা সুখি হবে ইনশাআল্লাহ। সেদিন রাতে বোনের জন্যে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে দোয়া করে ফাহিম।তার বোনটা যেন সুখে থাকে,ভালো থাকে।
_______
আরাবীকে ওর মা তৈরি করছে।মেয়ের ভীতু চেহারার দিকে তাকিয়ে লিপি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।শাড়ির আঁচলটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে।তিনি আরাবীর গালে আদুরে স্পর্শ করলেন।মমতাময়ী মায়ের আদুরে স্পর্শে আরাবী করুণ চোখে ওর মায়ের দিকে তাকালো।লিপি বেগম আলতো হেসে আরাবীর কপালে চুমু খেলো।আরাবী চোখ বন্ধ করে ফেলল।মায়ের আদরে এতো সুখ সুখ লাগে কেন?কেন মনে হয় সামনের মানুষটা ওর পাশে থাকলে ও সব করতে পারবে।লিপি বেগম ধীর আওয়াজে বলে উঠেন,
‘ আমি জানি তুই ভয় পাচ্ছিস।কি পাচ্ছিস না?’

আরাবী উপর নিচ মাথা দুলালো।লিপি বেগম মুচকি হেসে বলেন,
‘ জানিস তোর বাবা আর আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ। কিন্তু আমাদের দেখে কি তা মনে হয়?’

আরাবী বলল,
‘ একদমই না।তোমরা দুজন তো আমার কাছে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট কাপল।’

লিপি বেগম হাসলেন মেয়ের কথায়।তারপর আরাবীকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে চিরুনি হাতে নিয়ে ওর চুলগুলো আঁচড়ে দিতে দিতে বলে উঠেন,
‘ তোর বাবা যখন প্রথমবার আমায় দেখতে আসবেন আমারও অনেক ভয় করছিলো।কারন ওইটাই আমার জীবনের প্রথমবার কোনো পাত্রপক্ষের কাছে যাওয়া ছিলো।আমি যে একেবারে ছোটো ছিলাম তা কিন্তু না।আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম।আমাদের বিয়ে অনেক আগে হলেও।তোর নানা নানু কিন্তু ছিলেন অনেক ওপেন মাইন্ডেড মানুষ।ভাগ্য করে শশুড় শাশুড়িও তেমনটাই পেয়েছিলাম।তারা তোর বাবাকে আর আমাকে আলাদা কথা বলতে দিয়েছিলেন।সে কি ভয় আমার।আমার এই অবস্থা দেখে তোর বাবা কি বলেছিলো জানিস?বলেছিল,❝ আমার সামনে দাঁড়ানো এই ভীতু মেয়েটাকে সারাজীবন সামলে রাখার অনুমতি কি পেতে পারি জনাবা?❞ তার এই একটা বাক্যে যে কি ছিলো জানি না।আমার ভয় কোথায় চলে গিয়েছিলো নিজেও জানি না।ভয় কাটিয়ে,সব লজ্জা শরম এক সাইডে ফেলে আমি সরাসরি তার চোখে তাকিয়েছিলাম। জানিস তোর বাবার চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর।সেদিন তোর বাবার চোখে দেখেছিলাম একরাশ মুগ্ধতা। আমি ওতোটাও বোকা না।বুঝেছিলাম সে মুগ্ধ চোখে আমাকেই দেখছে।তোর বাবাকে তো দেখছিস কতো সুন্দর তিনি।আর আমি ছিলাম শ্যামলা রঙের।সেই আমাকে তোর বাবা এভাবে দেখছিলেন।যেন কতো সুন্দর আমি।অথচ তার সৌন্দর্যের কাছে আমি কিছুই না।এখনও যদি আমি নিজের গায়ের রঙ নিয়ে একটু আফসোস করলেই সে রেগে যায়।বলে এই গায়ের রঙের কারনেই নাকি তিনি আমার প্রেমে পরেছিলেন।তাও প্রথম দেখায়।’

বলতে বলতে লিপি বেগমের গালজোড়া লাল হয়ে আসে।আরাবী মুগ্ধ হয়ে দেখে তার মায়ের এই লজ্জামাখা মুখশ্রী।কি সুন্দর লাগে তার মাকে লজ্জা পেলে।ঠিকই তো এতো সুন্দর একটা মেয়েকে যে মন দিয়ে দেখবে সে নিশ্চিত প্রেমে পরে যাবে।যেমনটা ঘটেছে তার বাবার সাথে।
লিপি বেগম আবার বলে উঠলেন,
‘ তুই হয়েছিস আমার মতো।চেহারার গঠন তোর বাবার মতো হলেও৷ গায়ের রঙটা আমার পেয়েছিস।ফাহিম আমার চেহারার গঠন পেলেও গায়ের রঙ তোর বাবার পেয়েছে।
তুই শ্যামলা এটা নিয়ে মানুষ তোকে কটুক্তি করে এই নিয়ে তুই ভয় পাস।কিন্তু একদিন এমন দিন আসবে যে তুই নিজে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করবি। যে তিনি তোকে এরকম বানিয়েছেন।তোর জীবনেও এমন কেউ আসবে যে তোকে তোর মতো করেই ভালোবাসবে।যেমন আমার জীবনে আল্লাহ্ তোর বাবাকে পাঠিয়েছেন।
তাই বলছি এই সব ভয় ভীতু সব একটা সাইডে ফেলে দে।ফাহিম বলেছে ছেলে নাকি অনেক ভালো মা।সে নাকি তোকে আগেই দেখেছে।তোকে পছন্দও করেছে।’

লিপি বেগমের শেষের কথায় চমকে উঠল আরাবী।ছেলে ওকে আগে দেখেছে?কিন্তু কোথায় দেখল?নাহ, দেখতেই পারে পথেঘাটে।এতে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। লিপি বেগম আরাবীর গলায় চেইন পরিয়ে দিতে দিতে বলেন,
‘ ছেলে আর আর তার পরিবার সকলেরই ব্যবহার অনেক ভালো।এসেই তোর বাবাকে জড়িয়ে ধরেছেন ছেলের বাবা।এতো সুন্দর ব্যবহার।এসেই আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমাদের কতো আপন তারা।ছেলে দেখতেও অনেক সুন্দর।আমার আরাবী আম্মুর সাথে অনেক মানাবে।তুই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাহ মা।তাদের মাঝে কোনো কিছুই খারাপ দেখিনি আমি।ছেলের সাথে তোকে আলাদাভাবে কথা বলতে দিবো আমরা।ছেলের মাঝে খারাপ কিছু নজরে না আসলে না করিস না।আর যদি দেখিস ছেলের ব্যবহার বা এমন কিছু তোর নজরে আসে যা তোর কাছে ভালো মনে হচ্ছে না।তবে আমাদের কাছে সেটা জানাবি।আমরা এই সম্বন্ধে মানা করে দিবো।’

লিপি বেগম আরাবীকে দাঁড় করালেন।আরাবীকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে তিনি বলেন,
‘ মাশাল্লাহ! এইযে কতো সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।কারো নজর না লাগুক। ‘

লিপি বেগম হাতে একটুখানি কাজল নিয়ে আরাবীর কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন।জিহাদ সাহেবের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।তার কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে তার বাবা কতোটা খুশি আজ।আরাবী লম্বা শ্বাস ফেলল। ওর পরিবারের প্রতিটা মানুষ এই সম্বন্ধে অনেক খুশি।যেখানে তারা খুশি সেখানে আর দ্বিমত করে কি হবে?বাবা মা আর ভাইয়ের এই হাসি মুখটা দেখার জন্যে আরাবী সব কর‍তে পারবে।
এদিকে ফাহিম ডাকছে তাদের।লিপি বেগম আরাবীর মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালোভাবে ঘোমটা দিয়ে দিলো।যতোটা কদম ফেলছে আরাবী ওর হৃদস্পন্দন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।আরাবী চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার জন্যে।কিন্তু একি?চোখ বন্ধ করতেই জায়ানের ওই গম্ভীর,নিরেট মুখটা ভেসে উঠল।দ্রুত চোখ খুলে ফেলল আরাবী।লোকটাকে কেন দেখলো ও?আচ্ছা,লোকটা এখন কি করছে? সে কি ওর রিজাইন লেটারটা পড়েছে?পড়লেও তখন কেমন করেছিলো সে?লোকটা কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে লেটারটা পড়ে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাবী।নাহ,এসব ভেবে এখন আর লাভ নেই।যা করার আরাবী করে ফেলেছে।তাই এখন যা ওর সাথে হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দিলো আরাবী।

সুহানা সাখাওয়াত না চাইতেও আজ পরিবারের সাথে এসেছেন।তিনি যদি না আসেন তবে জায়ানের চোখে নিজেকে ভালো মা হিসেবে তুলে ধরবেন কিভাবে? এটা তো কিছুতেই করা যাবে না।তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি এখানে এসেছেন।এখানে এসে জিহাদ সাহেবের ফ্লাট দেখেই নাক মুখ কুচকে ফেলেছিলেন।শেষমেষ ফ্লাট বাসায় থাকে এমন মেয়েকেই পছন্দ হলো জায়ানের?না চাইতেও ঠোঁটে জোড়পূর্বক হাসি টেনে তিনি সবার সাথে কথা বলছেন।যখন শুনল মেয়েকে নিয়ে আসা হচ্ছে।তিনি মেয়েটাকে দেখার জন্যে সেদিকে তাকালেন।তাকাতেই যেন আশ্চর্য হয়ে গেলো।এ কি মেয়েকে পছন্দ করেছে জায়ান?তিনি অবাক হয়ে বিরবির করলেন,
‘ শেষমেষ জায়ান এই কালো মেয়েটাকে পছন্দ করল?’

সুহানা সাখাওয়াতের যেন বিশ্বাস হচ্ছে ব্যাপারটা।এটা কিভাবে সম্ভব?এতো এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ের জন্যে সম্বন্ধ এসেছে জায়ানের জন্যে। আহানাও কি কম সুন্দর?তাও তো জায়ান রাজি হচ্ছিলো না।তাই বলে শেষমেষ কিনা এই কালি মেয়েটা?সুহানা সাখাওয়াত জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।নাহ,তাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে।যাতে কারো নজরে সে খারাপ না হয়ে যায়।
তাই তিনি চুপচাপ বসে রইলেন।
______
জায়ান শক্ত হয়ে বসে আছে।চোখ দুটি স্থির সামনের রমনীটির দিকে।চোখে মুখে তার মুগ্ধতা এসে ভীড় করেছে। শাড়ি পরিহিতা আরাবীকে দেখে যেন শ্বাস আটকে বসে জায়ান।এ কোন রূপে নিজেকে তুলে ধরল মেয়েটা। এমনিতেই তো সে এই মেয়েটার জন্যে পাগল।আজ যেন পুরোপুরি তাকে বদ্ধ পাগল বানিয়েই ছাড়বে ওই মেয়ে।ছোট্টো মুখের ওই আদলটা এতো আদুরে কেন?এতো মায়া মায়া কেন ওই কাজল কালো নয়নজোড়া?নাকের বা-পাশটায় ওই জ্বলজ্বল করা পাথরের নাকফুলটা এতো কেন মানিয়েছে মেয়েটাকে?গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়ায় লিপগ্লস লাগানোতে যেন তা আরও আকর্ষনীয় লাগছে। কালো,খয়েরী সংমিশ্রণ রঙের জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে আরাবী।কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।জায়ানের ইচ্ছে করছে এখনই মেয়েটাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে।জায়ান ভেবে নিলো বিয়ের পর আরাবীকে সবসময় শাড়ি পরিয়ে রাখবে সে।ঘর ভর্তি শাড়ি কিনে দেবে তার বউকে।যখন যেই শাড়িতে তার কাঠগোলাপকে দেখতে ইচ্ছে করবে।তখন সেটাই পরিয়ে ওকে নিজের সামনে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখবে জায়ান।
নিজের ভাবনাতে হাসল জায়ান।আবারও আরাবীর দিকে তাকালো।সে এখন অপেক্ষায় আরাবী তাকে দেখে ঠিক কি রিয়েকশন দেবে।

এদিকে আরাবীকে সবার সামনে আনতেই আরাবী সালাম দিলো তাদের।সবাই সালামের উত্তর দিলো। আরাবী এখনও কারো দিকে তাকায়নি।মাথা নিচু করে আছে মেয়েটা।লিপি বেগম ট্রেতে করে চায়ের কাপ এনে আরাবীর হাতে দিলেন।বললেন,
‘ যা মা সবাইকে চা দে গিয়ে।’

আরাবী মাথা দুলালো।তারপর একে একে সবাইকে চা দিতে লাগল।ইফতির সামনে এসে ট্রে’টা ধরতেই হা হয়ে গেলো আরাবী।ইফতিকে দেখে যেন বিশাল বড়ো একটা ঝটকা খেয়েছে মেয়েটা।ইফতি এখানে কি করছে?এদিকে ইফতি আরাবীর রিয়েকশনে হাসছে।বেশ ভালোই ঝটকা খেয়েছে মেয়েটা।আরাবী চোখ বড়ো বড়ো করে ইফতির দিকে তাকিয়ে। ইফতি দুষ্টু হেসে চোখের ইশারায় নিহান সাহেব আর পাশে তাকাতে বলল।আরাবী তাকালো সেদিকে।নিহান সাহেব হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।বিষ্মিত আরাবী নিহান সাহেবের কাছে গিয়ে উনাকে চা দিলো।নিহান সাহেবের পাশেই জায়ান বসে।আরাবী এইবার তার কাছে গেলো।জায়ানকে দেখে যেন মেয়েটা নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো।শ্বাস গলায় আটকে দাঁড়িয়ে মেয়েটা।একের পর এক শুকনো ঢোক গিলছে।তার উপর জায়ান আরেক কান্ড ঘটালো।আরাবীর হাতের ট্রে থেকে চা নিতে নিতে সবার অগোচরে আরাবীকে চোখ মেরে দিলো।শিউরে উঠল আরাবী। ওর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।পাত্র যে জায়ান নিজে হবে এটা সে কখনই ভাবতে পারিনি।কখনই না।যার কাছ থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্যে এতো কিছু করল আরাবী।শেষমেষ কিনা তার কাছে আবার আসতে হলো ওকে?এ কি হচ্ছে ওর সাথে?

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here