স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ #সাদিয়া_জাহান_উম্মি #পর্বঃ০৬

0
429

#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৬
নিহান সাহেব গতকাল থেকেই বেশ লক্ষ করছেন।ছেলে তার খুব অস্থির হয়ে থাকে।কি নিয়ে যেন শুধু চিন্তা করে।যে ছেলে তার কাজে গাফিলতি পছন্দ করে না।সে ছেলে গতকাল থেকে ঠিকঠাক কাজে মন বসাতে পারছে না।মিটিং রুমেও দু একবার অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলো।হঠাৎ কি হলো ছেলেটার?বাবা তো তিনি।তাই সন্তানের জন্যে চিন্তা হয়।
অফিস থেকে সবাই ফিরেছেন।ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করে সবাই এখন নিজেদের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন।এমন সময় নিহান সাহেব নিজ হাতে দু কাপ কফি বানিয়ে নিলেন।তারপর পা বাড়ালেন ছাদের উদ্দেশ্যে।কারন তিনি জানেন ছেলে তার দুশ্চিন্তায় থাকলে।ছাদে একাকি সময় কাটাতে পছন্দ করে গভীর রাত পর্যন্ত।নিহান সাহেব ছাদে গিয়ে দেখেন। তিনি যা আন্দাজ করেছেন তা কানায় কানায় সঠিক।জায়ান ছাদেই আছে।সাদা ট্রাউজারের সাথে ধূসর রঙের টি-শার্টে বেশ সুদর্শন লাগছে জায়ানকে।চাঁদের আলো ছেলেটার গায়ে এসে হুটোপুটি খাচ্ছে।এতে যেন জায়ানকে যেন আরও আকর্ষনীয় লাগছে।মাঝে মাঝে নিহান সাহেবের ইচ্ছে করে জায়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে।ছেলেটার তার অবিকল ওর মায়ের মতো হয়েছে।স্বভাব চরিত্রও অনেকটা মায়ের মতো।নিজের ছেলের মাঝে স্ত্রীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান তিনি।নিজের ভাবনায় মৃদ্যু হাসলেন নিহান সাহেব।তারপর সোজা গিয়ে জায়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।নিহান সাহেব এসেছেন তা বোধহয় টের পেয়েছে জায়ান।তাই তো উনার দিকে না তাকিয়েই জায়ান বলে,
‘ এতো রাত অব্দি জেগে কেন আছ আব্বু?’
‘ তুমি জেগে আছ কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন নিহান সাহেব।তারপর একটা কফির কাপ এগিয়ে দিলো জায়ানের দিকে।জায়ান কফিটা হাতে নিয়ে এক চুমুক পান করল।বাবার হাতে কফি বরাবরই খুব পছন্দ জায়ানের।এ যেন অমৃত মনে হয়।কফির কাপটা ছাদের রেলিং-এ রেখে জায়ান গম্ভীরমুখে বলে উঠে,
‘ আমি হঠাৎ করে কেমন যেন নিজেকে গুলিয়ে ফেলেছি আব্বু।নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছি না।অদ্ভুত একটা অনুভূতি আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।কিন্তু এটা কিসের অনুভূতি? কেন হচ্ছে এসব আমার সাথে আমি বুঝতে পারছি না।গতকাল হঠাৎ একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যে এভাবে আমার পুরো সত্ত্বাটাকে এলোমেলো করে দিবে আমি ভাবতেও পারেনি।’

নিহান সাহেব ছেলের এমন অগোছালো কথায় ভড়কে গেলেন।হঠাৎ কি হলো ছেলের তার?এতোটা অস্থির আর চিন্তিত জায়ানকে তিনি কোনোদিন তিনি।নিহান সাহেব চিন্তিত স্বরে বলে উঠেন,
‘ কি হয়েছে? আমাকে সবটা পুরোপুরিভাবে বিস্তারিতভাবে খুলে না বললে বুঝব কিভাবে?’

জায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এখন ওর বাবাই একমাত্র উপায় যার কাছে ও এই অজানা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাবে।জায়ান ধীরে ধীরে গতকালকের ওই মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটুকু খুলে বলল।এরপর থেকেই ওর মন মস্তিষ্কে এই মেয়েটার আনাগোনা সেটাও বলল।সবটা শুনে নিহান সাহেব অবিশ্বাস্য চাহনীতে তাকিয়ে আছেন জায়ানের দিকে।ছেলের মুখে যে এমন কথা শুনতে হবে তার। এটা কোনোদিন ভাবেননি তিনি।চোখ বড়ো বড়ো করে জায়ানের পা হতে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি।পর পর হঠাৎ করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।অকস্মাৎ বাবার এমন হাসিতে জায়ান চমকে উঠল।ভ্রু-কুচকে তাকালো নিহান সাহেবের দিকে।আশ্চর্য? তিনি এভাবে হাসছেন কেন?জায়ান বিরক্ত হলো বেশ।বলে উঠল,
‘ হোয়াট কাইন্ড ওফ বিহেভিয়ার ইস দিছ আব্বু? আমি এদিকে চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।এন্ড ইয়্যু আর কিডিং মি?’

নিহান সাহেব কিছুতেই নিজের হাসি থামাতে পারছেন না।এদিকে জায়ান তো নিজের বাবার এমন অহেতুক হাসিতে মহাবিরক্ত।ভ্রু-কুচকে ফের বলল,
‘ থামবে তুমি?কি শুরু করলে?আমার রাগ লাগছে আব্বু।আমি তোমার কাছে সাজেশন চেয়েছি।উলটো তুমি এভাবে পাগলের মতো হাসছ।’

নিহান সাহেব বুঝলেন ছেলে তার বেজায় ক্ষেপে যাচ্ছে।আর হাসা যাবে না।তাহলে রেগে না আবার তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।নিহান সাহেব অনেক কষ্টে নিজের হাসি থামালেন।নিজেকে সামলে নিয়ে মুচঁকি হেসে বলেন,
‘ ছেলে যে তার বাবার মতো একই পথে হাটবে তা আমার আগে বুঝা উচিত ছিলো।কিন্তু আমি বুঝতে পারেনি।তবে পরিশেষে দেখা যায় আমরা একই ঘাটের মাঝি।’

জায়ান পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর বাবার দিকে তাকালো।তার কথাগুলো ঠিক আয়ত্ত্ব করতে পারল না ও।জিজ্ঞেস করল,
‘ মানে বুঝলাম না বাবা?আর এসব হোয়ালিপনা না করে সরাসরিভাবে সবটা বুঝিয়ে বলো আমাকে।’
‘ তুমি প্রেমে পরেছ জায়ান। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে নিজের অজান্তেই মনের মাঝে জায়গা দিয়ে ফেলেছ।যাকে ইংরেজিতে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট।’

নিহান সাহেবের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত একটা কথা শুনে চমকে উঠল জায়ান।অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো বাবার দিকে। পর পর চেঁচিয়ে উঠল উচ্চস্বরে,
‘ হোয়াট কাইন্ড ওফ ননসেন্স আর ইয়্যু ঠকিং এবাউট আব্বু?হাও ইস দিছ পসিবেল? আর ইয়্যু ইন দ্যা রাইট মাইন্ড ?’
‘ আমার মাথা ঠিকই আছে।ঠিক নেই তোমারটা।’

কথাটা বলেই নিহান সাহেব রেলিং এর উপর দু হাত রাখলেন।ওইতো দেখা যাচ্ছে আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা সবচেয়ে উজ্বল তারাটা।এটাই তো তার প্রিয়তমা।নিহান সাহেব বিরবির করলেন,’ সাথি তুমি তো আমার থেকে বেশি দূরে না।তবুও কেন তোমায় চাইলেও একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারিনা আমি।তুমি কি দেখছ সাথি?আমাদের ছেলের মনেও যে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে।ভালোবাসার ফুল ফুটেছে ওর পাথুরে হৃদয়ে।যেমনটা ঠিক আমার হয়েছিলো তোমার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনে।’

নিহান সাহেব জায়ানের দিকে তাকালেন।হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠলেন,
‘ তোমার মাকে প্রথম দেখেছিলাম আমাদের ভার্সিটির নবীনবরন উৎসবের দিন।তোমার মামা সাঈফকে তো চিনো?সাঈফ আমার বন্ধু ছিলো।তোমার মা বেড়াতে এসেছিলো ওদের বাড়ি।তোমার মা ভীষণ ঘরকুনো একটা মেয়ে ছিলেন।সহজে কোথাও যেতে চাইতেন না।তাকে জোড় করে ঘুরতে নিয়ে যেতে হতো।ঠিক তেমনটাই হয়েছিলো সেদিন।বাড়িতে একা একা পরে থাকবে।তাই সাঈফের মা আর সাঈফ জোড় জবরদস্তি করে ওকে আমাদের নবীনবরনের অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলো।সাঈফ যখন তোমার মাকে নিয়ে এসে আমাদের বন্ধুমহলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।ঠিক তখনই ওই এক দেখাতেই ভালোবেসে ফেলি আমি তোমার মাকে।সারা দিন রাত তোমার মায়ের চেহারা ভেসে বেড়াতে আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে।ঠিক যেমনটা তোমার সাথে হচ্ছে।আমি পাগলপ্রায় হয়ে গেলাম।অস্থির হয়ে উঠলাম তোমার মাকে এক পলক দেখার জন্যে।সহ্য করতে না পেরে ছুটে চলে গেলাম সাঈফদের বাড়ি।কিন্তু গিয়ে শুনতে পাই।তোমার মা নাকি চলে গেছেন নিজেদের বাড়িতে।ওকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।খুব সম্ভবত বাগদানও সম্পন্নকরণ হয়ে যাবে।এটা শুনে আমি বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করলাম।এই একটা বাক্য যেন হাহাকার সৃষ্টি করে দিলো আমার বুকে।আমি বুঝলাম ওই মেয়েটাকে ছাড়া একদণ্ড থাকাও আমার জন্যে সম্ভব না।ওকে হারিয়ে ফেললে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলব আমি।উপায় না পেয়ে সাঈফকে সবটা খুলে বললাম।ও শুনে খুব খুশি হলো।কারন ও তো জানে ছেলে হিসেবে আমি খারাপ না।তবে বেচারা চিন্তাও পরে গেল।হঠাৎ করে এখন কিভাবে কি করবে এই নিয়ে।আমি তোমার দাদু আর দাদাকে গিয়ে তৎক্ষনাত বিষয়টা জানাই।ছেলের পছন্দই তাদের পছন্দ।তাই তো আমার একবার বলাতেই তারা আমার সাথে সাথিদের বাড়ি চলে গিয়েছিলো বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে।আমাদের ওতো কাঠখোড় পোড়াতে হয়নি।বাবা তখন ছিলেন নামকরা এমপি।তার এক কথাতেই তোমার নানা নানু মেয়ে দিতে রাজি হয়ে যাব।ব্যস,এরপরের সপ্তাহেই তোমার মাকে নিজের বউ করে নিয়ে আসি।বিশ্বাস করো নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার মাঝে যেই সুখ নিহিত আছে তা জগতের আরও কোনো কিছুর মধ্যে নেই। ওই সুখ যে অনেক মূল্যবান।প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য ছাড়া তা অনুভব করা অসম্ভব।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি।তারপর জায়ানের কাছে এসে ওর কাধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বলেন,
‘ বাবা ছেলের সম্পর্ক নাকি বন্ধুদের মতো।তাই সেই হিসেবেই একটা সাজেশন দিচ্ছি।নিজের অনুভূতিটাকে সাদরে গ্রহণ করো।হারিয়ে যেতে দিও না নিজের ভালোবাসাকে।কারন যা একবার হারিয়ে যায়।তা হাজার যুগ সাধনা করেও ফিরে পাওয়া যায় না।তাই সময় থাকতে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে নেও।আমি তো তাকে যত্ন করে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারিনি।তবে আমি চাইনা আমার ছেলের সাথেও একই ঘটনা ঘটুক।সময় থাকতে মেয়েটাকে নিজের ভালোবাসা জানিয়ে দেও।যত্ন সহকারে আগলে রাখো নিজের কাছে।একবার চোখ বন্ধ করে মন থেকে ভেবে দেখো। হৃদয়ের অসীমতার মাঝে কোনে ব্যাক্তিকে সুন্দরভাবে খুজে পাওয়ার নামই ভালোবাসা।
আর হ্যা কেউ তোমার সাপোর্টে থাকুক বা না থাকুক আমি তোমার বাবা সর্বদা তোমার পাশে আছি।
এখন রুমে যাও।আমিও যাচ্ছি।অনেক রাত হয়েছে।কাল অফিসে জরুরি মিটিং আছে। আসি তবে।’

নিহান সাহেব চলে গেলেন।এদিকে জায়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তবে কি ও সত্যিই ওই মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে?এক দেখাতে কি কাউকে ভালোবাসা যায়? হ্যা, যায় তো।এইযে এই মাত্রই তো ওর বাবা নিজের ভালোবাসার কথাগুলো বলে গেলো।সবার মতে ওর মতো গম্ভীর,রগচটা মানুষটাও প্রেমে পরল।তাও এমন বাজেভাবেই পরল যে এখন আর সেখান থেকে উঠে আসার জো নেই।জায়ান চোখ বন্ধ করল।ভেসে উঠল আরাবীর স্নিগ্ধ,কোমল মুখশ্রী।এলোমেলো চুল,মাথায় কাঠগোলাপ ফুলের তৈরি ক্রাউন।হাতে একমুঠো কাঠগোলাপ।যার দিকে তাকিয়ে আছে ওই মায়াবী চোখের চাহনীতে।ঠোঁট জুড়ে তার প্রশান্তিময়ী হাসি।আস্ত এক মায়ার রাজ্য যেন মেয়েটা।ওমন মেয়েকে কি কেউ হাত ছাড়া করতে চায়?কে করবে?জায়ান?কোনোদিন না।আবার মেয়েটাকে ভালোবাসে সে।হ্যা,ভালোবাসে সে ওই মেয়েটাকে।বাবা আজ ওকে না বুঝালে ও এতো সহজে এই অনুভূতিগুলোকে বুঝতে পারতো না বোধহয় কোনোদিন।জায়ান বিরবির করল,
‘ থেংক্স আব্বু।তুমি জানোনা তুমি আমাকে ঠিক কি দিয়ে দিলে আজ।ইয়্যু আর দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।আই লাভ ইয়্যু আব্বু। ‘

পর পর বাঁকা হাসল জায়ান।বিরবির করল,
‘ মিস আরাবী মৃধা আমাকে প্রেমনদে এভাবে ভাসিয়ে দিলে।কিন্তু আমি তো একা ভাসব না ।প্রেমনদে তোমায় সাথে নিয়ে ভেসে বেড়াবো।গেট রেডি ফোর দ্যাট।’

#চলবে________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।এইতো জায়ানকে তার আসল ফর্মে দ্রুতই দেখতে পেতে চলেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here