#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
রাক্ষুসে রোদ্দুর তপ্ততা ছড়াচ্ছে মেদিনীর বুকে। নীলচে অম্বর জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে শুভ্র তুলোর ঝাঁক৷ সাঁই বেগে ট্রেন ছুটছে। তপ্ত শীতল মিশ্রিত বাতাস বইছে পুরো কেবিন জুড়ে। ট্যুরের কথা বলতে দেরি— তিনজনে বাক্সপেটরা গুছিয়ে ছুটেছে রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে৷ অনলাইনে টিকিট কে’টে রেখছিল মৃত্তিকা। যেন সে এই অপেক্ষাতেই ছিল। এখন সময়টা দুপুর। ওরা রওনা হয়েছে এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে৷ সকালে চটজলদি কিছু নাস্তা টাইপ খাবার বানিয়ে নিয়েছিল মৃত্তিকা। লুচি‚ সবজি‚ সাদা আলুর তরকারি আর সুদর্শিনী প্রয়োজনীয় সবকিছু। এমনিতেই থাকা খাওয়ার বন্দবস্ত সে আগেই করে রেখেছে৷ গ্রামে বেড়াতে আসার ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই ছিল। তবে সময়ের স্বল্পতার কারণে কিছুই হয়ে উঠছিল না৷ তনুজার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছে সুদর্শিনী। ইদানীং প্রচুর ঘুম পায় তার৷ যখনই সময় পায় তখনই ঘুম। প্রেগন্যান্সির সময় এমনটাই হয় হয়তো। তনুজা বোনঝির মাথায় আলতো পরশ এঁকে দিচ্ছেন। মৃত্তিকা ওদের মুখোমুখি বসেছে৷ তার দৃষ্টি এখন বাহিরের দিকে স্থির। ক্ষিপ্রবেগে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। অপরপ্রান্তের গাছ-গাছালি‚ দোকানপাট যেন ট্রেনের সঙ্গেই উল্টো পথে ছুটছে। দুচোখ মুদে দীর্ঘ নিশ্বাস নিল মৃত্তিকা। শহর থেকে অনেকটা দূর চলে এসেছে। প্রাকৃতিক পরিমন্ডলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকছে৷ চোখ বন্ধ রেখেই উপভোগ করল মৃত্তিকা। তনুজা এদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। মেয়েটা দিনকে দিন কেমন নিস্পৃহ হয়ে যাচ্ছে। রণরঙ্গিণী রূপে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে অহর্নিশ।
❑
পশ্চিমাকাশ উজ্জ্বল লালচে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। উড়তে থাকা আবগুলোও একই বর্ণ ধারণ করেছে৷ দেখে মনে হচ্ছে অম্বরে র’ক্তজবার মেলা বসেছে। সাদা রঙা গাড়িটা একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ পরিত্যক্ত বাড়ির ইটের দেয়াল খসে খসে পড়ছে। মরিচাধরা ভাঙা জানালা ঝুলে রয়েছে। উঠোনে গজিয়ে ওঠা আগাছা গুলো জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। দোচালা বিশিষ্ট বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে। মেহরাব শিকদার গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে গেলেন। কিছু পুরোনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। গভীর চিন্তায় ডুব দিল মেহরাব শিকদার।
“আমি মা হতে চলেছি মেহরাব।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর কথা শুনে স্তব্ধ‚ নির্বাক হয়ে রইল মেহরাব শিকদার। এই সন্তান তো তার চাই না। ঘরে বউ রয়েছে‚ তিন বছরের ফুটফুটে ছেলে রয়েছে। এই সন্তান পৃথিবীতে এলে তো তার সাজানো সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে। না— এ কিছুতে হতে পারে না৷ রুক্ষ স্বরে মেহরাব শিকদার বললেন‚
“বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও মহু!”
মেহরাব শিকদারের মুখে এহেন কথা কর্ণগোচর হতেই নিটোল পা দুটো টলে উঠল। নিঃসাড় দেহ নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল৷ এই নিকৃষ্ট লোকটাকে এতদিন ধরে ভালোবেসে এসেছে৷ ঘৃণায় জর্জরিত গর্ভিণীর কোমল হৃদয়৷ কম্পিত কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল‚
“এমন কথা বোলো না গো। এটা তো আমাদের প্রথম সন্তান তাইনা?”
“আমার ঘরে বউ আছে— বাচ্চা আছে।”
দুহাত দ্বারা কান বন্ধ করল৷ এত বড়ো মিথ্যে! এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা! সবকিছুই অবিশ্বাস্য লাগছে৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল মেয়েটা৷ ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“ক..কী বললে তুমি?”
“ঠিকই শুনেছ তুমি। তিন বছরের ছেলে আছে আমার।”
“এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলে তুমি?”
“আমি কিছু জানি না৷ শুধু এইটুকু বলতে পারি— এই সন্তানের কোনো দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।”
“এ-ও তো তোমারই অংশ৷ ওর প্রতি অবিচার কেন?”
“আমার সুখের সংসার ছারখার হয়ে যাবে। প্লিজ মুক্তি দাও আমায়।”
তাচ্ছিল্য করে হাসল রমণী। কণ্ঠনালিতে হরতাল নেমেছে। মফস্বলের সরল মেয়েটাকে একটা ছোট্টো সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে একটুও বুক কাঁপছে না এই লোকটার৷ নৃত্যশিল্পী হবার স্বপ্ন বুঝি এখানেই শেষ। নেত্রপল্লব হতে কয়েক ফোটা অশ্রুবর্ষিত হলো৷
একটা রাশভারি কণ্ঠে অন্যমনস্ক চেতনায় পানি পড়ল। কিছুটা হকচকিত‚ বিমূঢ় ভাব এলো মেহরাব শিকদারের গভীর মুখপানে। চোখের সামনে যেন পুরোনো অতীত ভেসে উঠল৷ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী মুছে নিলেন মেহরাব শিকদার। দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ ক্রস্ত কণ্ঠে ড্রাইভারকে বললেন‚
“রাসেল গাড়ি ঘোরাও। মোড়ল বাড়িতে যাবে।”
হায়দার আলী স্কুলের মাঠে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে৷ বিরোধী দলের নাজিম চৌধুরী এই সমাবেশের আয়োজন করেছেন৷ আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এই সমাবেশ আয়োজিত হয়েছে৷ পুরো মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। উত্তর দিকে স্টেজ সাজানো হয়েছে আর সামনে শত শত চেয়ার বিছিয়ে রাখা। এমনটাই শুনেছে প্রলয়। স্কুলের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়ের গাড়িটা৷ প্রলয় ড্রাইভিং সিটে বসা। তার পাশেই অর্পণ রয়েছে৷ বাহিরে কোনো কাজ পড়লে ছেলেটা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে৷ এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চায় না৷ প্রতিনিয়ত নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে যেন। ফোনে ক্রমাগত কল আসছে অর্পণের৷ ইরা কল করছে৷ প্রলয় বুঝতে পারল। সে অর্পণকে বলল‚
“কথা বলছিস না কেন ওর সাথে?”
“কল ধরলেই বলবে দেখা করার জন্য।”
“তো যা— দেখা করে আয়।”
“তোমাকে ছেড়ে এখন কোথাও যাব না আমি।”
“সবসময় এমন আঠার মতো সেঁটে থাকিস কেন? আমার কিন্তু ভয় করে!”
প্রলয়ের কথায় বোকা বনে গেল অর্পণ। চেয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে৷ সে বলল‚
“কীসের মধ্যে কী বলছ ভাই?”
প্রলয় আবারও বলল‚ “আমি কী তোর জিএফ নাকি?”
“প্লিজ ভাই তুমি চুপ কর! তুমি মুখ খুললেই আমার অস্বস্তি হয়।”
শব্দ করে হেসে উঠল প্রলয়। অর্পণ কল রিসিভ করে মিনমিনে স্বরে বলল‚ “আমি আসছি।” প্রলয় গাড়ি স্টার্ট দিল৷ কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে অর্পণকে নামিয়ে দিল। অর্পণ চলে যেতেই প্রলয় আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল৷ উদ্দেশ্য পার্টি অফিস। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে বাকিদের সঙ্গে। পার্টি অফিসের কাছ অবধি চলে এসেছে৷ গাড়ি স্পিড কমাতে গিয়েই বুঝতে পারল— গাড়ি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রলয়। কী করে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! এমন পরিস্থিতে কখনো পড়তে হয়নি তাকে৷ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে৷ মনে মনে বারবার আল্লাহর নাম স্মরণ করছে প্রলয়৷ সামনে থেকে একটা ট্রাক ছুটে আসছে। বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না প্রলয়৷ বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে। গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাক আর গাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নেই। ড্রাইভারও চেষ্টা করছে গাড়িটা সাইড করার। মুহূর্তেই প্রলয়ের গাড়িটা উল্টে একটা বড়ো আম গাছের কাছে গিয়ে ঠেকল। আশেপাশের অনেক মানুষই ছুটে এসেছে এখানে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।
মাথায় প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে। ভ্রুর কাছে এক টুকরো কাঁচ খুব গভীর ভাবে গেঁথে রয়েছে। অল্পের জন্য চোখে লাগেনি। কয়েক টুকরো কাঁচ ছিকটে এসে গেঁথেছে প্রলয়ের বাহুতে৷ টপটপ করে র’ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে৷ কপাল কে’টেও র’ক্ত ঝড়ছে। ধবধবে পাঞ্জাবিটা র’ক্তরঞ্জিত রূপ নিয়েছে। কাটখোট্টা শরীর নিমিষেই দূর্বল‚ নিঃসাড় হতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করার আগে ভূমির হাস্যজ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাকে দেখে যেন খিলখিলিয়ে হাসছে৷ সেই হাসির রিনিঝিনি শব্দ মাদল বাজতে শুরু করেছে৷
খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। অর্পণ এখানে এসেছে সবে দশ মিনিট হলো। রেস্টুরেন্টের বাহিরে ইরা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অর্পণকে নিয়েই রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করল ইরা। মেনু কার্ড দেখে— ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করল অর্পণ। ওয়েটার চলে যেতেই ইরা জিজ্ঞেস করল‚
“কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার?”
“কিছু হয়নি আমার। আ’ম অ্যাবসোলুটলি ফাইন।”
“তুমি যতই আড়াল করার চেষ্টা করো— তোমার মন তো একটু হলেও বুঝি আমি।”
অর্পণ কিছু বলল না৷ ইরার থেকে মুখ ফিরিয়ে আশেপাশে তাকাল। রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো সিমসাম রেস্টুরেন্ট৷ সফট মিউজিক বাজছে৷ এখানে বেশিরভাগই কপোত কপোতীরা রয়েছে৷ অর্পণের থেকে কোনো রকম উত্তর না পেয়ে ইরা আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“আঙ্কেল অথবা প্রলয় ভাইয়ার জন্য আপসেট?”
একটুও চমকাল না অর্পণ। মুখে কিছু না বললেও মেয়েটা তাকে কতটা বোঝে৷ অথচ মন খারাপের দিনে এই মেয়েটাকেই সে বেশি অবহেলা করে৷ ইরার হাতটা ধরে‚ আশ্বস্ত করে বলল‚
“আমার জন্য চিন্তা কোরো না ইরাবতী। কালকের করা ব্যবহারে আমি অত্যন্ত দুঃখিত।”
“তুমি প্লিজ এভাবে বোলো না৷ আমার তোমার জন্য চিন্তা হয় কিন্তু আমি জানি— আমার অর্পণ খুব স্ট্রং৷”
মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে অর্পণ বলল‚ “ইয়াহ!”
এমন সময় অর্পণের ফোনে কল এলো। কল রিসিভ করার পর অপরপ্রান্ত থেকে এমন একটা খবর এলো যে‚ সে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ এমন একটা পরিস্থিতে কে-ইবা নিজেকে স্থির রাখতে পারে? তার ভাইয়ের যে এক্সিডেন্ট হয়েছে৷ এখন কী অবস্থায় রয়েছে তারও কোনো খবর নেই। খাবার না খাওয়া স্বত্তেও বিল প্যে করে দিল অর্পণ। এরপর ইরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি করে একটা সিএনজিতে উঠে পড়ল দুজনে৷ মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করল অর্পণ। আজ যদি সে তার ভাইকে একা না ছাড়ত তাহলে হয়তো এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটত না৷ ইরা শক্ত করে অর্পণের হাতটা ধরে রেখেছে। আধ ঘণ্টার মাঝেই হসপিটালের পৌঁছে যায় দুজনে। ওদের হসপিটালেই প্রলয়কে আনা হয়েছে। এই তো ঘণ্টা খানেক আগেও আসার সময় প্রলয়ের সঙ্গেই এসেছিল৷ সুস্থ স্বাভাবিক ভাইকে এমন অবস্থায় দেখবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি অর্পণ। ইতিমধ্যেই এই খবরটা বাড়িতে পৌঁছে গেছে৷
খুবই নিভৃতে আড়ালে চিকিৎসা করা হচ্ছে প্রলয়ের৷ অর্পণ নিজ দায়িত্বে ভাইয়ের চিকিৎসা করছে। তবে এ খবর প্রেস মিডিয়া অথবা শত্রুপক্ষের কানে গেলে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে৷ অর্পণ কাউকে কিছু জানতে চাইছে না। তবে আসল দোষীকে তো শাস্তি পেতেই হবে৷
চলবে?…..