রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
362

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

কৃষ্ণবর্ণীয় বিশাল অন্তরিক্ষ। বাতাবরণে দাবদাহ মেশানো৷ শাড়ির আঁচলে মুখশ্রী আর গ্রীবায় জমে ওঠা বিন্দু ঘাম মুছে নিল মৃত্তিকা৷ রান্নাঘরের তপ্ত দহনে ঘাড়ের কাছে ছোটো চুলগুলো এলোমেলো লেপ্টে রয়েছে৷ মাত্রই রান্না করেছে সে। দুজনের জন্য রান্না করা ছিল কিন্তু এতে করে সবার হবে না। তাই আবারও রান্না করতে হয়েছে তাকে। যখন ইচ্ছে তখনই মাসিমণিকে চাইলে দেখতে আসতে পারে না সুদর্শিনী। ব্যস্ততার কারণে আসা হয় না। মাস ছয়েক আগে এসেছিল। রান্নার কাজ শেষ হতেই ঘরে এলো মৃত্তিকা৷ শয়নকক্ষে ঘুমচ্ছে সুদর্শিনী। আনন্দের খবর এই যে‚ সে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। খবরটা শোনা মাত্রই খুশিতে আত্মহারা মৃত্তিকা। সেই সঙ্গে তনুজাও খুব খুশি হলেন। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন বোনঝিকে। ছোট্টো একটা প্রাণ একটু একটু করে মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠবে। আধ আধ বুলিতে তাকে ‘মিম্মি’ বলে ডাকবে। ভাবতেই চিত্তচঞ্চল হয়ে উঠল। পাশাপাশি বিষাদের নীল বি’ষে জর্জরিত হৃদয়— আঁধারিয়া আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। নারী হিসেবে সে যে অপরিপূর্ণ।

হাত খোপা করে রাখা চুলগুলো খুলে দিল মৃত্তিকা। লতাপাতা ন্যায় পেচিয়ে থাকা ঘন দিঘল কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ সমগ্র কোমড় জুড়ে বিছিয়ে গেল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তাচ্ছিল্য করে হাসল মৃত্তিকা৷ এ হাসি অস্বাভাবিক আর জটিল। ছোটো ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা কাঁকই তুলে নিল। চুলে বিনুনি গাঁথতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে৷ এলোমেলো জড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো কাঁকইয়ে মিশে রইল অনেকখানি। বিনুনি গাঁথা হয়ে গিয়েছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবারও পর্যবেক্ষণ করল মৃত্তিকা৷ এরপর বিছানার কাছে এগিয়ে গেল৷ হাঁটার সঙ্গে লম্বা বিনুনি দোল খাচ্ছে৷

“অ্যাই দিদিভাই ওঠ!”

ঘুম ভাঙল না সুদর্শিনীর৷ মৃত্তিকা আস্তে করে আবারও ডাক দিল। কাজে দিয়েছে হয়তো। নড়েচড়ে উঠল সুদর্শিনী। আধবোজা চোখে পিটপিট করে তাকাল৷ মৃত্তিকাকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। শোয়া থেকেই আড়মোড়া ভাঙল। উঠে বসতেই সুদর্শিনীর পাশে গিয়ে বসল মৃত্তিকা।

“রাত হচ্ছে৷ খাবারে অনিয়ম করা যাবে না দিদিভাই।”

চোখ বন্ধ করে গাল এলিয়ে আবারও হাসল সুদর্শিনী। মেয়েটা যে কতটা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সেটা সে ভালো করে জানে। মেয়েটার প্রতি তার একটা আলাদা টান অনুভূত হয়। ইচ্ছে করে বুকের ভেতরটায় লুকিয়ে রাখতে। মেয়েটাকে দেখতেই ভীষণ আদর আদর পায়। হাই তুলে সুদর্শিনী জিজ্ঞেস করল‚

“খালামণি বলল‚ আজ নাকি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলি? নাচের ক্লাসের ইন্টারভিউ কেমন ছিল?”

“ভালোই হয়েছে। তিনদিন পর জানাবে।”

“তুই ভালো নাচিস৷ দেখবি তুই-ই সিলেক্ট হবি।”

“তাই-ই যেন হয়! চল দিদিভাই খেয়ে নিবি।”

“আজকের খাবার কে রান্না করেছে— তুই নাকি মাসিমণি?”

“মামনির কাজ করা বারন। আমিই রেঁধেছি।”

“তুই বোস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

মৃত্তিকা চোখের পলক ঝাপ্টে সায় জানাল। সুদর্শিনী চলে গেল ওয়াশরুমে। এলোমেলো বিছানা চট করে গুছিয়ে নিল মৃত্তিকা। বসার ঘরে টিভি দেখছেন তনুজা৷ উনার প্রিয় সিরিয়াল হচ্ছে। সেটা কী মিস করা যায় নাকি?

নিশীথে ঘুম হলো না প্রলয়ের৷ রাত তিনটে অবধি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। শত চেষ্টা করেও আঁখিপল্লবে ঘুমি উঁকি দেয়নি। শ্যাম শ্রীতে গভীর চিন্তার ভাজ। তারাহীন দূরাকাশে আবদ্ধ পুরুষ চোখ। চোখ দুটোতে ক্লান্তির ছায়া। দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে কু’কুর গুলোর নিষ্ফল চিৎকার৷ রাত বিরেতে এদের মেলা বসেছে। এদের আর কোনো কাজ নেই। ওহ হ্যাঁ কাজ আছে তো! রাত বিরেতে ঘেউঘেউ করে অন্যদের ঘুমের বারোটা বাজানো। সিগারেটের উষ্ণ ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিল প্রলয়৷ মৃদুমন্দ বাতাস বইছে৷ হরিদ্রাভ বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে— বাতাসের তোড়ে মেহগনি গাছের পাতা গুলো নড়ছে। সেদিকে তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রলয়৷ এই বারান্দায় ভূমির সঙ্গে কাটানো কতশত মুহূর্ত অন্তঃকরণে বাসা বেঁধে রয়েছে। ভাগ্যের পরিহাসে আজ সবই স্মৃতি। শুধুই স্মৃতি।

অস্থিরতার মাঝেই রজনি গড়াল। সকালের রবি উঁকি দিতেই ঘুম পালাল প্রলয়ের নেত্র থেকে। ঘুম পুরো না হওয়ায় চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ মথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে৷ আজ আর ঘুম হবে না৷ উঠে একেবারে গোসল করে বের হলো। নিজেকে একটু হালকা লাগছে এবার। ধবধবে পাঞ্জাবি পরিধান করে আয়নার সামনে দাঁড়াল প্রলয়৷ ঘণ্টা খানেক পর বের হতে হবে৷ হাত দ্বারা চুল ঠিক করছে প্রলয়। হঠাৎ খট করে দুয়ার খোলার প্রতিধ্বনি হলো।

“আসতে পারি?”

কথাটা বলেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল এক তরুণী। আয়নায় প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করা গেল৷ ঘাড় বাকিয়ে তাকাল পেছন দিকে৷ অচেনা কেউ যে বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে— তার জানা ছিল না। মেয়েটাকে চিনতেও অসুবিধে হলো৷ আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে মেয়েটা বলল‚

“হাই! আমি তৃপ্তি জুনাইরাহ।”

“আপনার নাম কেউ জিজ্ঞেস করেছে?”

থতমত খেয়ে গেল তৃপ্তি। প্রলয় আবারও বলল‚

“উইদাউট পারমিশন— আমার ঘরে প্রবেশ করার সাহস কারো নেই।”

“কিন্তু আমি তো আসতেই পারি।”

“হোয়াট? হু দ্য হেল আর ইউ?”

প্রলয়ের গম্ভীর শান্ত স্বরে ভরকে গেল তৃপ্তি। অপ্রতিভ‚ কিংকর্তব্যবিমূঢ় রমণীর পা সেখানেই স্থির হলো। অচেনা কারো সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? জানা ছিল না! ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষকে দেখে হৃদয়ে সুপ্ত ডঙ্কা বেজে উঠল। বুকে দ্রিম দ্রিম মাদল বাজছে৷ সাদা টাইলসের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখল তৃপ্তি। লোকটার চোখের দিকে তাকানো দায়। গম্ভীর স্বরে প্রলয় আবারও বলল‚

“আউট।”

তৃপ্তি মুখ তুলে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। প্রলয় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল‚

“কানে কী শুনতে পান না? আই স্যে আউট।”

কেঁপে উঠল তৃপ্তি। কোমল হৃদয় অপমানে জর্জরিত হলো। প্রলয়ের প্রতি কিঞ্চিৎ রাগ অনুভূত হলো৷ মাধুরীর কথা শুনে পারমিশন ছাড়া এই ঘরে আসা একদমই উচিত হয়নি তার। তিনি তো বলেছিলেন‚ এই লোক অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। অথচ দেখছে তার উল্টোটা৷ আজকের দিনটা বোধহয় তার জন্য শুভ নয়৷ নীরবতায় আচ্ছাদিত কামরা থেকে বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেল তৃপ্তি। প্রলয় নিজের কাজে ব্যস্ত হলো।

অন্যদিকে….

রান্নাঘর থেকে চা আর নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলো মৃত্তিকা। সুদর্শিনী আর তনুজা বসে অপেক্ষা করছে৷ সময় মতো নাস্তা আর ঔষধ খেতে হয় তনুজাকে৷ টি টেবিলের উপর ট্রে রেখে মৃত্তিকা দৌঁড়ে গেল শয়নকক্ষে৷ ঔষধের বক্সটা নিয়ে এসে টি টেবিলের উপরই রাখল সে। চা পান করার ফাঁকে সুদর্শিনী বলে উঠল‚

“মাসিমণি চল না কোথা থেকে ট্যুর দিয়ে আসি। বাড়িতে থাকতে বোর হচ্ছি খুব।”

খাওয়া ছেড়ে সুদর্শিনীর দিকে তাকিয়ে শুধালেন‚ “এই শরীর নিয়ে কোথায় যাবি?”

“এ সময় মন ভালো রাখতে হয়। আমার কিছু হবে না৷ প্লিজ চল না কোথাও যাই। অ্যাই মৃত্তিকা— তুই একটু বোঝা না মাসিমণিকে।”

ইশারায় মৃত্তিকাকে ইমোশনাল ব্ল্যা’কমেইল করল সুদর্শিনী। এবার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে মৃত্তিকা৷ একমাত্র সে-ই পারে মাসিমণিকে রাজি করাতে। হলো-ও তাই! তনুজাকে উদ্দেশ্য করে মৃত্তিকা বলল‚

“মামনি চল আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

তনুজা অবাক চোখে তাকালেন মৃত্তিকার দিকে৷ মেয়েটা তো আগে কখনো গ্রামের নাম মুখে আনেনি। আজ হঠাৎ যেতে চাইছে? মাহেন্দ্র বেঁচে থাকতেও তো কতবার যেতে চেয়েছিলেন অথচ মেয়ে কিছুতেই রাজি হয়নি। উনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা বলল‚

“প্লিজ মামনি। মাত্র দুদিনের জন্য যাব।”

“আমরা গিয়ে থাকব কোথায়?”

“তার ব্যবস্থা আমি করে নেব। তুমি শুধু পারমিশন দাও।”

“তাহলে চল।”

খুশিতে সুদর্শিনী আর মৃত্তিকা দুজনেই ‘ইয়ে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ তনুজা কানে হাত দিলেন। মেয়েদের বাচ্চামিতে খিলখিল করে উঠলেন তিনি।

সকাল সকাল ফর্মাল ড্রেসআপে তৈরি হয়ে বসে আছেন মেহরাব শিকদার। একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হবে৷ কেন— কী কারণে তা কাউকে বলতে পারছেন না তিনি। ফিরোজা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন তবে মেহরাব শিকদার বারবারই এড়িয়ে গেছেন উনাকে। যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। একপ্রকার না খেয়েই তিনি মালঞ্চ নীড় থেকে বেরিয়ে গেলেন।

খাবার টেবিলে নানা রকমের খাবার সাজিয়ে রাখা রয়েছে৷ সবকিছুই আজ মাধুরী নিজের হাতে তৈরি করেছেন৷ মোর্শেদ শিকদার‚ প্রলয়‚ অর্পণ আগেই নিজেদের চেয়ারে বসে আছেন। এ বাড়ির একটা নিয়ম হচ্ছে— সবাই একসঙ্গে খাওয়া শুরু করেন। এদিকে প্রলয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে তৃপ্তিও এলো। সে গিয়ে সোজা প্রলয়ের পাশে বসতে নিল। আবারও প্রলয় রাশভারী কণ্ঠে বলল‚

“যারতার পাশাপাশি আমি বসি না৷ আপনি প্লিজ পূর্ণ অথবা পুষ্পর পাশে গিয়ে বসুন।”

মোর্শেদ শিকদার রাগী স্বরে বললেন‚ “এ কোন ধরনের ব্যবহার তোমার?”

আবারও অপমানিত বোধ করল তৃপ্তি। লোকটার সমস্যা কী? কেন বারবার তাকে এভাবে অপমান করছে? মাধুরী কিছুটা চোখ রাঙিয়ে প্রলয়কে বললেন‚

“মেহমানদের সঙ্গে কী কেউ এই ধরনের আচরণ করে?”

“তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত— আমি এমনই।”

“তৃপ্তি মা‚ তুমি কিছু মনে কোরো না।”

“কোনো ব্যাপার না আন্টি৷ আমি কিছু মনে করিনি।”

তৃপ্তি গিয়ে পূর্ণর পাশে বসল। প্লেটে খাবার দিলেন মাধুরী। খাবার খাওয়ার ইচ্ছেই ম’রে গেছে তৃপ্তির। বারবার মাধুরী আন্টির কথা শুনতে গিয়ে তাকে অপমান হতে হচ্ছে। ছোটো থেকে আজ অবধি কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। তবে আজ? ভাবতেই গলা ঝেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার৷ খাবার নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করছে তৃপ্তি। মাধুরী আহ্লাদে গদগদ সুরে বললেন‚

“এ কী তৃপ্তি— তুমি তো দেখছি কিছুই খাচ্ছ না। পূর্ণ তরকারির বাটিটা এদিকে দে তো।”

“আন্টি প্লিজ আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

এই মেয়েকে দেখে এত আদিখ্যেতা করার মানে প্রলয় আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে। তবে সে তো দমে যাবে না। আর না মায়ের উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেবে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here