রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
383

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

পতনোন্মুখ আরক্তিম গোধূলিলগ্ন। নীলচে আকাশ ধূসর হচ্ছে৷ অলিগলির ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ বাতিগুলো একে একে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ জুড়ে পাখিরা খেয়ালখুশি উড়ে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে৷ ঘরে ফেরার তাড়া তো সবারই আছে— ওদেরও রয়েছে। বারান্দায় রেলিঙের উপর দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণ। পশ্চিমাকাশে তাকিয়ে দেখছে দিবসপতির পতন। হসপিটাল থেকে সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছে৷ আসার পর থেকেই নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে অবরুদ্ধ রেখেছে। বাবার প্রতি চড়াও হয়েছে বিস্তর অভিমান। এই একটা মানুষের জন্য দুটো জীবন নষ্ট হয়ে গেল৷

“তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করব না বাবা৷ তুমি বাবা হয়ে কী করে নিজের সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলে? আই হেইট ইউ।”

অদ্ভুত বিষণ্ণতায় সন্ধ্যা গড়াল। যামিনী তমসাবৃত হলো। অলিগলির ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ রশ্মি একে একে দৃশ্যমান হতে শুরু করল। অর্পণ সেদিকপানেই চেয়ে রইল। গভীর আঁখিপল্লব অশ্রুপ্লুত। নিজের অপারগতায় ক্রোধাগ্নি জ্বলে উঠল। অন্তঃকরণ হতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ বিছানার উপর অযত্নে পড়ে থাকা মুঠোফোন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে। এই সময় কে-ইবা তাকে স্মরণ করবে। ডান হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা সিক্ত নেত্র যুগল মুছে ফেলল৷ এরপর বড়ো বড়ো পা ফেলে শয়নকক্ষে প্রবেশ করল অর্পণ। ফোনে হাতে নিলে স্ক্রিনে “ইরাবতী” নামটা দৃষ্টিগোচর হলো৷ অন্যসময় হলে অধর কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মিলত অথচ আজ তার কোনো অনুভূতি কাজ করছে না৷ নিজেকে নিস্পৃহ গোছের মনে হচ্ছে৷ ফোনটা এখনো বেজে যাচ্ছে৷ কথা বলার উৎসাহ পাচ্ছে না সে৷ অবহেলায় কল কে’টে গেল। সেকেন্ড তিন চারেকের মাঝে আবারও বেজে উঠল। রিসিভ করল অর্পণ। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

“আপনি কী ভুলে গেছেন আজ আমাদের দেখা করার কথা ছিল?”

একটু থেমে ইরা আবারও বলল‚ “ওহ্হো আমি তো ভুলেই গেছি— দ্য গ্রেট তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ তো খুবই ব্যস্ত মানুষ। গার্লফ্রেন্ডকে সময় দেওয়ার মতো সময় কী উনার আছে নাকি!”

অর্পণ কিছু বলল না। কিছুটা একা থাকার অভিলাষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল৷ প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষারত রমণী উত্তর না পেয়ে ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“কী হলো— কথা বলছ না কেন? আদৌ তুমি কলে আছ তো?”

“ইরাবতী আই নিড সাম স্পেস।”

“হঠাৎ কী হলো তোমার? সকালেও তো বেশ হাসিখুশি ছিলে। কিছু নিয়ে কী মন খারাপ?”

“আ’ল কল ইউ ব্যাক।”

অর্পণকে বেশি ঘাটল না ইরা। প্রত্যুত্তরে শুধু বলল‚ “ইয়াহ শিওর!”

পড়তে বসেছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। বিকেলে টিউটর এসে দুজনকে পড়িয়ে দিয়ে যান৷ কলেজ ছাড়া বাহিরে যাওয়ার অনুমতি নেই ওদের৷ প্রলয় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। খাতাটা বন্ধ করে পুষ্পিতা একপলক পূর্ণতার দিকে তাকাল। পূর্ণতা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। মেয়েটা বেশ গম্ভীর ধাঁচের— একদম বড়ো ভাইয়ার মতো। তার থেকে কয়েক মিনিটের বড়ো। পুষ্পিতা ডাকল‚ “পূর্ণ?”

বইয়ে মুখ গুজে রাখা পূর্ণতা এবার বোনের দিকে তাকাল। চশমাটা ঠিক করে ইশারায় জিজ্ঞেস করল‚ “কী হয়েছে?”

“ক্ষিধে পেয়েছে আমার। চল না হালকা কিছু খেয়ে‚ পড়তে বসি?”

“পড়তে বসলেই তোর ক্ষিধে পায়?”

মেকি হাসল পুষ্পিতা। তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেল। পূর্ণতা তবুও উঠল না৷ আবারও আগের ন্যায় পড়তে শুরু করল৷ পুষ্পিতা এবার বোনের বাহু ঝাকিয়ে বলল‚

“প্লিজ বোনু— চল কিছু একটা খেয়ে তারপর পড়তে বসি!”

পুষ্পিতার জ্বালায় আর বসে থাকতে পারল না পূর্ণতা৷ দুজনে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। বৈঠকখানা পেরিয়ে রান্নাঘর। এই মুহূর্তে কেউই এখানে নেই৷ পূর্ণতা ঝটপট দুটো ম্যাগি নুডলস রান্না করে ফেলল। সেই সঙ্গে দুজনের জন্য দুটো অমলেট। এরপর খাওয়া শেষ হতেই আবারও স্টাডি রুমে চলে এলো তারা৷ বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই পুষ্পিতা আবারও ডাকল পূর্ণতাকে।

“পূর্ণ!”

“আবার কী দরকার তোর?”

“মায়ের কাছ থেকে তুঁতে শাড়িটা নিয়ে দিবি— প্লিজ।”

“মায়ের শাড়ি দিয়ে কী কাজ তোর? আমি চাইব আর মা আমাকে শাড়ি দিয়ে দেবে?”

“আমার না শাড়িটা খুব পড়তে ইচ্ছে করছে। তোকে তো মা বেশি আদর করে৷ প্লিজ জোগাড় করে দে।”

“আমি পারব না৷ তুই গিয়ে চাচি মাকে পটা। তিনি তোকে সাহায্য করতে পারবে।”

আবারও বইয়ে মুখ গুজল৷ না এই মেয়েকে বই আর পড়া থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। পড়াশোনার উপর চরম বিরক্ত পুষ্পিতা৷ তার ভালো লাগে আঁকিবুঁকি করতে‚ ঘুড়ি উড়াতে আর আড্ডা দিতে৷ আর পূর্ণতা? সে তো তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে গাছ লাগাতে‚ রান্না করতে আর পড়াশোনা ভালোবাসে। পুষ্পিতা এবার একটু মজা করার উদ্দেশ্য ডাকল‚

“অ্যাই পূর্ণ?”

“এবার কিন্তু মা’রব। চুপচাপ পড়।”

সশব্দে খিলখিল করে হেসে উঠল পুষ্পিতা। মুখ তুলে চাইল পূর্ণতা৷ এই মেয়ের কার্যকলাপে মাঝে মাঝে বোকা বনে যায় সে। কতটা চঞ্চল এই মেয়ে। আর সে? সে তো বিপরীতমুখি।

ব্লেন্ডারে শুকনো মরিচ পিষছে মৃত্তিকা৷ লোকটার সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। সাহস আছে বলতে হবে। তা নাহলে দিনদুপুরে মাথায় রিভলবার ঠেকাতে পারে? ইচ্ছে করছে লোকটাকে ক্রোধানলে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে৷ সাহস কী করে হয়— এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ের মাথায় রিভলবার তাক করার৷ ভেবেছে সে ভয় পাবে! অথচ লোকটা জানেই না তার কাছেও রিভলবার ছিল। বাঁকা হাসল মৃত্তিকা৷ একটা স্প্রের বোতল ভালো করে ধুয়ে নিল। এরপর সেটাতে শুকনো মরিচের গুড়ো সেই সঙ্গে পরিমাণ মতো পানি নিয়ে নিল। এরপরের বার যা হবে সমানে সমানে। সে-ও কারো থেকে কম যায় না৷ কোথাকার কোন এমপি এলো রে। তাকে নাকি ভয় পেতে হবে। এক একটাকে দেখে নেবে সে। হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে উঠতেই ভাবনাচ্যুত হলো। হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাতখানা ভালো করে ধুয়ে নিল। এরপর দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সদর দরজা খুলেই পরিচিত কাউকে দেখে খুশি হয়ে গেল মৃত্তিকা।

“হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কেমন আছ দিদিভাই?”

“আগে তো ভেতরে আসতে দিবি।”

মেকি হেসে জিভে কামড় দিল মৃত্তিকা৷ সশব্দে হেসে উঠল সুদর্শিনী৷ মৃত্তিকা দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। চেয়ারে বসে ছিলেন তনুজা৷ সুদর্শিনী ভেতরে প্রবেশ করেই তনুজাকে প্রণাম করল৷ সুদর্শিনী হচ্ছে তনুজার বোনের মেয়ে। ভালোমন্দ অনেক কথাই জিজ্ঞেস করলেন তনুজা। মৃত্তিকা দরজা আটকে দিয়ে ওদের কাছে এসে সুদর্শিনীর পাশে বসল।

“আমি তো ভালোই আছি। তারপর বল— তোর কী খবর?”

“আ’ম অলওয়েজ ফিট এন্ড ফাইন। জামাইবাবুকে তো নিয়ে আসতে পারতে দিদিভাই।”

“তোর জামাইবাবুর সময় হচ্ছে না। ব্যবসার কাজে সিলেট গিয়েছে।”

এরপর তিনজনে খোশগল্পে মেতে উঠল তিনজন। সুদর্শিনীকে পেয়ে মৃত্তিকা যেন সবকিছু বেমালুম ভুলে গেল৷

বিছানার উপর বসে আছেন মাধুরী আর ফিরোজা। দু জায়ের মাঝে গল্পগুজব চলছে। এরই মাঝে মাধুরীর ফোনে কল এলো৷ উনার মা কল করেছেন। তিনি কল রিসিভ করেই সালাম জানালেন৷ ওপ্রান্ত থেকে কিছু শুনতে পেলেন না ফিরোজা৷ তিনি চুপ করে মাধুরীর কথা বলার ভঙ্গি দেখছেন। মাধুরী উনার মাকে বললেন‚

“আর বোলো না মা। অলক্ষ্মী মেয়েমানুষ। মরেও শান্তি দিচ্ছে না৷ কোথায় ভাবলাম ছেলের বিয়ে দেব— তা আর হলো কই?”

মাধুরীর কথা বলার ধরনে খানিকটা খারাপ লাগল ফিরোজার৷ শত হোক ভূমি উনার খুব আদরের ছিল। ওপর পাশ থেকে কী কথা বলছে কিছুই শোনা গেল না‚ “………”

মাধুরী বললেন‚ “তাহলে কালই তৃপ্তিকে পাঠিয়ে দাও।”

“………”

কল কে’টে গেল। ফিরোজা জিজ্ঞেস করলেন‚

“মাওই মা কী বললেন গো ভাবি?”

“আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে তৃপ্তি— ওকে মা আমাদের এখানে বেড়াতে পাঠাবেন। মেয়ে নাকি দেখতে শুনতে বেশ ভালো। ছোটো থাকতে মেয়েটাকে একবার দেখেছিলাম।”

রাত তখন আটটা…

ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রলয়। ঘর্মাক্ত শরীরের সাদা শার্টটা লেপ্টে রয়েছে। মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো। কালো গোল ফ্রেমের চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আঁখিদ্বয় র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছাদিত কামরায় প্রবেশ করেই গা থেকে শার্ট খানা খুলে ফেলল সে। শনশন শব্দ তুলে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল প্রলয়৷ সারাদিন নিজেকে কাজের মাঝে ডুবিয়ে রাখলেও দিন শেষে সে ভালো নেই। ভূমির শূন্যতা তাকে ভস্ম করে দিচ্ছে। একটা ভুল তার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অবিশ্বাস করার ফল সে পাচ্ছে এবং পেয়ে যাচ্ছে। আদতে কী মেনে নিতে হবে তার ভূমি আর নেই। মেয়েটা নিজের কথা রেখেছে। পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। ভূমির অস্তিত্ব কোথাও নেই— কোত্থাও না! বুক ভারী হয়ে এলো প্রলয়ের। সারাক্ষণ নিজেকে কাটখোট্টা প্রমাণ করা লোকটার নেত্র কোণে অশ্রুকণা উঁকি দিল৷ কম্পিত কণ্ঠে গুনগুনিয়ে উঠল প্রলয়‚

❝আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন‚
তোমাতে করিব বাস;
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনি দীর্ঘ বরষ মাস!❞

[রবীন্দ্র সঙ্গীত]

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here