শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_৭ #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
670

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_৭
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

এতক্ষণ দুই কপোত কপোতীর কথা শুনছিল রায়হান। মিটমিট করে হাসছিল সে স্যার রুপি প্রেমিকের প্রেমিকার জন্য উৎকণ্ঠা দেখে। মিসবাহ কিছু বলার আগেই পাশ থেকে রায়হান মুখে হাসি নিয়ে বলে উঠল

“আহ্ মিসবাহ্! এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ এভাবে বকাবকি করে। তুই জানিস না মিষ্টি মেয়েদের জন্মই হয়েছে হৃদয়াসিক্ত ভালোবাসা পাবার জন্য।”

সূরা হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে রইল। কি বলে এই লোক। চেনা নেই জানা নেই কোথায় থেকে আসে এরা। আর মিসবাহ তো কটমট করে তাকালো রায়হানের দিকে যেনো চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে। কিন্তু মিসবাহর চাহনি সম্পূর্ন উপেক্ষা করে রায়হান সূরাকে উদ্দেশ্য করে বলল

“কি মিষ্টি পরী এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি জানি আমি সুদর্শন যুবক।‌ যাই হোক মিষ্টি পরী তুমি কিন্তু অনেক মিষ্টি দেখতে। আমার আবার এতো মিষ্টি মেয়েদের বকাবকি করতে ভালো লাগে না।”

সূরা কিছু টা বিরক্ত হলো রায়হানের গায়ে পরা স্বভাব দেখে। আর খারাপও লাগছে একজন অপরিচিত লোকের সামনে মিসবাহ তাকে বকলো ভেবে। পরক্ষনেই ভাবলো স্যার ছাত্রীকে বকতেই পারে এতে খারাপ লাগার কিছু নেই। কিন্তু মন যেন মানতে নারাজ। মনটাকে ধমকে উঠলো সূরা। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে “আসছি স্যার” বলেই আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না সে। হঠাৎ বিরক্ত লাগছে। খুব বিরক্ত লাগছে। সূরা যেতেই মিসবাহ হিংস্র চাহনি নিক্ষেপ করে তেড়ে গেল রায়হানের দিকে। রায়হান শুকনো ঢক গিলে একটু দূরে সরে গেল। বাঘকে রাগিয়ে দিয়েছে সে। নিজেকে বাঁচাতে বলল

“দেখ ভাই তোর সুর কে আমি বোনের নজরে দেখি। একেবারে মায়ের পেটের বোন যাকে বলে আরকি। বড়ো মিষ্টি মেয়ে সে।এসব বলার একটাই কারন দেখতে চেয়েছিলাম মিষ্টি পরীর মনে তোর জন্য অনুভূতি আছে কিনা? কিন্তু বুঝলাম তার হৃদয়ে তোর বসবাস। আমি তো তোর উপকার করলাম দোস্ত।”

মেকি হাসলো রায়হান। নিঃশ্বাস তার গলায় আটকে আছে। মিসবাহ রাগে চোয়াল শক্ত করে বলল

“ওর থেকে দশ হাত দুরে থাকবি বলে দিলাম। সা**লা পুরনো পাগলে ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি। ঘর শত্রু বিভীষণ।”

★★★★★★

গোধূলি লগ্নের অন্তিম প্রহর। আকাশ জুড়ে লালাভ আভা বিরাজমান। গুটিকয়েক পাখি ফিরে যাচ্ছে নিজ নীড়ে। পাখি উড়ে বেড়ায় নিজ স্বাধীনতায়। কেউ বাঁধা দেওয়ার নেই। সূরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশপানে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে। তারও যদি পিছু টান না থাকতো সেও দূরে কোথাও চলে যেত। যেখানে কোনো কষ্ট, হতাশা, একাকিত্ব তাকে ছুঁতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল সে। কিন্তু যাওয়ার আগে একটিবারও দেখল না দূর থেকে কেউ একজন মুগ্ধ হয়ে তাকেই দেখছিল।

★★★★★★

চৈত্রের তপ্ত দুপুরে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।ঘেমে পিঠের সাথে লেপ্টে আছে পরনের কালো রঙের জামা টি। কানের পাশ দিয়ে দু-এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ছে। শ্যামলা মুখোস্রি হয়ে উঠেছে ঈষৎ লাল। বড্ড বিরক্ত লাগছে তার। বাসায় গিয়ে গোসল দিতে পারলে শান্তি পেত। কিন্তু শয়তানের নানা গুলো তাকে বাসায় আর যেতে দিল না। কলেজ ক্যান্টিনে বসে আছে পঞ্চপাণ্ডব। সিহাব দিয়া একে অপরের সাথে চিপকে বসে আছে। মনে হচ্ছে রোমিও জুলিয়েটের বংশধর। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করছে সূরা। এখন এই দুটোকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে তার। জিহাদ তার পাশে বসে ফোন স্ক্রল করছে।রাফি গেছে ঠান্ডা পানিয় আনতে। সিহাব দিয়ার হাতে হাত রেখে প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েছে। হঠাৎ ধমকে উঠলো সূরা

“এই লাইলা মজনুর নিউ ভার্সন। তোদের সারাদিন এতো কিসের চিপকাচিপকি হ্যাঁ?চুইংগামের মতো অলটাইম চিপকে থাকিস দুটো। এই তোদের কি বিরক্ত বা গরম কিছুই লাগে না?”

সূরার কথায় দিয়া আর সিহাবের বোধহয় কিছু যাই আসলো না। এখনো চিপকে আছে তারা। ভাব এমন সূরা কোথাকার কোন মুলা তারা চিনে না। সূরা এখনো চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। জিহাদ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সূরার দিকে তাকালো। এই মেয়ে যে রেগে গেছে বুঝতে পেরে মুচকি হেসে কৌতুক স্বরে বলল

“দেখছিস যে সিঙ্গেলদের রাজা জিহাদ আর রানী সূরা সামনে বসে আছে তবুও দুটো ইচ্ছে মতো চিপকে আছিস। রানী তো রুষ্ট হবেই।”

দুম করে কিল বসাল জিহাদের পিঠে সূরা। জিহাদ “আহ্”বলে উঠলো। করুন চোখে তাকালো সূরার দিকে। দেখল সূরা তার দিকেই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট উল্টালো জিহাদ। এর মধ্যেই রাফি ঠান্ডা পানিয় নিয়ে হাজির। টেবিলে রাখতে না রাখতেই সূরা খপ করে একটা তুলে খেতে শুরু করে দিয়েছে। এই ঠান্ডা কোকাকোলারই এখন তার দরকার ছিল।গরম তার একদম সহ্য হয়না। একটু খেয়েই প্রশান্তি অনুভব করল সে। এখন বেশ লাগছে। এখন সিহাব আর দিয়ার প্রেম দেখতেও ভালো লাগছে। রাফি সূরার কান্ড দেখে সশব্দে হেসে উঠলো। ওর পাশাপাশি ওরা তিনজনও হাসলো। সূরা নিজেও ফিক করে হেসে দিল। সবাই খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। মাঝে কয়েক বার সূরার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে সিহাব। সূরা ফুরফুরে মেজাজে আছে দেখে সিহাব বলে উঠলো

“গাইস তোরা তো জানিস কাল আমার বার্থডে। প্রতিবার তোদের সাথে আড্ডা দিই,ঘুরি, কিন্তু এবার বাবা মা বাংলাদেশে আসছে বার্থডে পার্টি দিবে তাই। সো আমি চাই আমার এই আনন্দের দিনে আমার পাশে তোরা যেনো থাকিস। আর মা বাবা স্পেশালি দিয়া কে দেখতে চাই। তোরা পার্টি এটেন্ড করবি তো দোস্ত?”

দিয়া একটু লজ্জা পেল। আবার ভয়ও করছে তাই ভীতি স্বরে বলে “সিহাব আমার খুব ভয় করছে। আমি তো এতিম। আমার এই পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই। অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। তারা কি তোর পাশে আমাকে মেনে নিতে পারবে?”

সিহাব দিয়ার টেবিলের উপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে মুখে হাসি ফুটিয়ে আস্বস্ত করে বলল

“আমার মা বাবা এমনকি সবাই তোর বিষয়ে সব জানে দিয়া। বরং আমি যখন আম্মু কে বললাম যে তুই অনাথ তখন কি বলেছে জানিস? বলেছে তুই অনাথ হতে পারিস বিয়ের আগে কিন্তু বিয়ের পরে তুই তাদের মেয়ে। তোকে পেলে নাকি আম্মুর মেয়ের শখ পূরণ হবে।”

দিয়া ছলছল চোখে হাসলো। তার এখন বলতে ইচ্ছে করছে প্রিয়মানুষ টাকে ভালোবেসে সে ভুল করেনি। বরং এই প্রিয় মানুষটার জন্য আজ মা বাবা পেতে চলেছে সে। দিয়ার হাসিমাখা মুখোস্রি দেখে সূরা মনে শীতলতা অনুভব করল। মেয়েটা সুখে থাকলে তার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবেনা।পাশ থেকে জিহাদ বলে উঠলো

“দোস্ত আমরা সবাই যাবো বুঝলি। কিন্তু খাওয়ার মেনু জানতে পারলে ভালো হতো।”

রাফি বলল “সা**লা পেটুক। সামনে যে সেমিষ্টার ফাইনাল মনে আছে শুধু খায় খায় করিস।”

জিহাদ আয়েশ করে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল “আরে চিল মামা। আমাদের বিদ্যার রানী আছে তো। আমাদের ঠিক একটা গতি হয়ে যাবে।”

সূরা বলল “নোট পেয়ে যাবি চিন্তা করিস না।”

জিহাদ আর রাফি দাঁত কেলিয়ে একসাথে বলে উঠল “বিদ্যার রানীর জয় হোক।

সূরা শব্দ করে হেসে উঠে। চার বন্ধু তার দিকে তাকায়। মেয়েটাকে হাসলে অদ্ভুত সুন্দর মায়াবী লাগে। গালে টোল পড়ে। কিন্তু মেয়েটা প্রাণখোলা হাসি কখনোই হাসেনা‌। এভাবে সবাইকে একসাথে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভরকে গেল সূরা। ঈষৎ লাল হলো কপোলদ্বয়। জিহাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বলে

“আমরা সবাই যাবো মামা। কতোদিন চোখে সুন্দরী মেয়ে দেখিনা। পার্টিতে গিয়ে মেয়ে পটাবো। কতোদিন আর সিঙ্গেল থাকবো।”

সিহাব মুচকি হেসে শান্ত স্বরে বলে উঠলো “সবাই যাবি বলতে সূরা তুই? প্লীজ না করিস না দোস্ত।”

সূরা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। মিসবাহর থেকে সে দূরে থাকতে চায়। ওই লোকের কাছাকাছি গেলেই বিপদ। সে নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে যায়। নিজের খোলসে আবৃত সত্তা নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। নাহ্ যাবেনা সে। সে নিশ্চিত ওই ঠোঁটকাটা নির্লজ্জ বেহায়া পুরুষ বাড়ীর সবাই কে তার নাম ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানিয়েছে। সবার সামনে যেতে লজ্জা লাগবে তার। সূরা নিজের হয়ে কিছু বলবে তার আগেই দিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো

“সূরা যাবেনা মানে। ওকে যেতেই হবে। আমি প্রথম আমার শশুর বাড়ীর সবার সামনে যাবো। আমার নার্ভাস লাগছে। ওকে যেতেই হবে।”

সূরা বোঝানো ভঙ্গিতে বলল “তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর আমি..

সূরা কে কিছু না বলতে দিয়ে দিয়া এবার একটু আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলল

“তুই ছাড়া আমার কে আছে সূরা? এতিমখানায় বড় হয়েছি। এখানে আসার পর আপন আর সবচেয়ে কাছের বলতে একমাত্র তুই আছিস। কাল আমার আর সিহাবের জীবনের বড় একটা দিন। অথচ তুই আমার পাশে থাকবিনা‌। আসলে কি বলতো আমি যে অনাথ সেটা আমি তোকে পেয়ে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সত্য তো এটাই আমার কেউ নেই।”

সূরা ছলছল চোখে তাকালো প্রিয় বান্ধবীর দিকে। মেয়েটা কতো সহজে এগুলো বলে দিল। কিন্তু তারও তো ভুল হয়েছে যাবেনা বলে। দিয়ার দিকটা আগে ভাবা উচিত ছিল। কতোটা স্বার্থপর সে। নিকৃষ্ট স্বার্থপর সে। নিজের কথা ছাড়া কখনো কেন ভালবাসার মানুষ গুলোর কথা আগে ভাবেনা। সত্যিই কি স্বার্থবাদী মেয়ে সে।সূরার চোখে অশ্রু দেখে পঞ্চপাণ্ডবের সকলের বুক টা ধক করে উঠল। মেয়েটা তো সহজে কাঁদে না। তাহলে কি তারা কষ্ট দিয়ে ফেলল? সূরা সবার চুপসানো বেলুনের মতো মুখ দেখে অশ্রু চোখেই ফিক করে হেসে দিল। বলল

“কিরে শয়তানের নানা নানী। তোদের আবার কি হলো? সিহাব কাল আমি যাবো।আর ওই ড্রামাকুইন ড্রামা হয়ে গেলে চল এখন বাসায় ফিরতে হবে। তোরা তো জানিস তোরা আমার কতোটা আপন। আমাকে এভাবে স্বার্থপর কেন বানালি শুনি?”

দিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে সূরা কে জড়িয়ে ধরল।বলল “সরি জান আর কখনো এমন বলবোনা। তুই আমার বান্ধবী কম বোন বেশি তুই কি জানিস না?”

সূরা মুচকি হেসে নিজেও দিয়া কে দুই হাত দিয়ে আকড়ে ধরল। ছেলেগুলো বসে আর কি করবে এগিয়ে এসে একে অপরকে পাঁচ বন্ধু জড়িয়ে ধরলো। এটাই বুঝি বন্ধুত্ব। একজনের কষ্টে প্রত্যেকের হৃদয় ব্যথিত হয়। হু হু করে কেঁদে ওঠে বন্ধুর কষ্ট মিশ্রিত মুখোস্রি দেখে। আবার বন্ধু যখন হেসে উঠে অপর বন্ধুর বুকে প্রশান্তি অনুভব হয় নিমিষেই। এটাই বুঝি বন্ধুত্ব, আত্মার সম্পর্ক। বেঁচে থাকুক নিঃস্বার্থ ভালোবাসাময় এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গুলো।শত বছর, হাজার বছর, বছরের পর বছর এভাবেই অটুট থাকুক আত্মার সম্পর্ক।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here