#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পূর্বাশার কথায় থমকে দাঁড়ালো জায়ান, বলল – একদম ঠিক বলেছেন। সকাল সকাল আপনি এত সুন্দর একটা পদক্ষেপ না নিলে আমি এবং আমার রুমমেটরা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। না নিজে ঘুমালেন আর না আমাদের ঘুমাতে দিলেন। এরপর থেকে আর এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে অন্যদের ঝামেলায় পড়তে হয়।
কথাটা বলেই জায়ান আবার হাঁটা ধরলো সামনের দিকে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো পূর্বাশার। এই লোকটা এভাবে বলতে পারলো তাকে? সমস্যায় পড়েছিল কল করে একটু সাহায্যই তো চেয়েছে শুধু। আর একজন মানুষ হিসেবে অন্য একজন মানুষকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। আর এ কিনা একটু সাহায্যের বিনীময়ে এভাবে বলছে? নিহাত বিপদে পড়েছে বলে এর সাথে যেতে হচ্ছে নয়তো কিছুতেই এর মুখ দর্শন করতো না সে। মুখের সামনে থেকে খাবারটা নামিয়ে নিলো পূর্বাশা। এই ছেলেটার দেওয়া খাবার সে খাবে না, কিছুতেই খাবে না। এর কথাতেই এর দেওয়া খাবার খাওয়ার রুচিবোধ মরে গেছে তার। ছেলেটার চক্ষুর আড়াল হলেই খাবারটা ছুঁড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে। সে তো আর এই ছেলেটার মতো নাক উঁচু নয় যে সামনা সামনি কিছু একটা করে কষ্ট দিবে কাউকে। সে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে ঝাল মেটাবে তার উপর।
হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়ালো জায়ান। ঘুরে তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – খাবারটা ফেলে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন নাকি? এসব বাচ্চামো চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনাকে আমি মাথামোটা ভেবেছিলাম তবে এতটাও নয়।
পূর্বাশা গোল গোল চোখে তাকালো জায়ানের পানে। সে মাথামোটা? এত বড় অপমান তাকে? তবে হে যে মনে মনে খাবার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলো তা এই ছেলেটা তা জানলো কিভাবে? ছেলেটা কোনো জাদু টাদু জানে নাকি? নাকি মানুষের মন পড়তে পারে? হবে দুটোর একটা। পূর্বাশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল জায়ান, বলল – আপনি জানেন প্রতিদিন পৃথিবীতে কত মানুষ না খেয়ে থাকে, পেটের ক্ষুধায় ধুকে ধুকে কঙ্কালে পরিনত হয়। আফ্রিকার দেশগুলোতে মানুষ মাটি খেয়ে বেঁচে থাকে। আফ্রিকা বাদ দিন আপনার দেশের রাস্তাতে বের হলেই দেখবেন ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটে আসবে আপনার দিকে। করুনভাবে হাত পেতে বলবে ” আপা দুইডা ট্যাকা দেন দুই দিন ধইরা না খাইয়া আছি।” আমরা অনেক সময় দেই অনেক সময় দেই না ভাবি ওরা মিথ্যা বলছে। হ্যা অনেকেই মিথ্যা বলে তবে সবাই না। ওদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুরাই না খেয়ে থাকে। দিনে এক বেলা খাবার পর্যন্ত পায় না। আপনার হাতের ঐটুকু যে খাবার রয়েছে ঠিক এটুকু খাবারের জন্য দেখবেন রাতের আঁধারে রাস্তার কুকুরগুলোর সাথে মানুষও ডাস্টবিনের ময়লা খুঁজছে যদি একটু খাবার পেয়ে যায়। আর আপনি কিনা সেই খাবার পেয়েও ফেলে দিতে চাইছেন শুধু মাত্র কোনো এক তুচ্ছ মানবের উপরে ক্ষোভ প্রকাশ করতে?
একটু থামলো জায়ান আবার বলল – আপনি আমার উপর ক্ষোভ প্রকাশের জন্য এই খাবারটা ফেলে দিবেন তারপর নিজের টাকা দিয়ে আবারও খাবার কিনে খাবেন। না খেয়ে তো আর থাকতে পারবেন না। আপনার টাকা যদি একটু বেশিই হয় তবে এক কাজ করুন আমার উপর অযথা ক্ষোভ প্রকাশ করতে খাবার না ফেলে এই খাবারটা আপনি খেয়ে ফেলুন। আর যে টাকাটা দিয়ে এরপরে আবার খাবার কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন ঐটা জমিয়ে রাখুন। কখনও কোনো দুঃস্থ, অসহায় মানুষকে দেখলে ঐ টাকাটা দিয়ে সাহায্য করবেন।
পূর্বশা মাথা নিচু করলো। হাতের খাবারগুলোর দিকে তাকালো সে। জায়ানের কথাগুলো যেন মন ছুঁয়ে গেল তার। হত্যিই তো, এভাবে তো সে কখনও ভেবে দেখেনি। আর এই খাবারগুলোই কিনা তারা প্রতিনিয়ত না ভেবেই অপচয় করে। লোকটাকে ঠিক যতটা খারাপ সে ভেবেছিল ততটা খারাপ নয়। পূর্বাশা হাতের খাবারগুলো তুলে ধরলো মুখের কাছে, আবারও খাওয়া শুরু করলো সে।
কলেজে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না তাদের। কিছুক্ষণ পরই জায়ান আর পূর্বশা এসে পৌঁছালো পূর্বাশার হোস্টেলের সম্মুখে। পূর্বাশা জায়ানের পানে তাকালো, ভদ্রতার খাতিরে বিদায় নিতে চাইলো তার থেকে। কিন্তু সেই সুযোগ আর দিল না ঐ নাক উঁচু ছেলেটা। হোস্টেল সম্মুখে আসতেই কিছু না বলেই চলে গেল সে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো পূর্বশা। এর কাছ থেকে অবশ্য কোনো কিছু আশা করাই বোকামি। তার মধ্যে এই ছেলেটা যে তাকে এই সাজ সকালে সাহায্য করেছে সেটাই অনেক।
______________________________________
বেলা গড়িয়েছে কিছুটা। যদিও সময়টা এখনও সকালেই থমকে রয়েছে দুপুরে গড়ায়নি এখনও। তবে সূর্যটা বেশ উজ্জ্বলভাবে জায়গা করে নিয়েছে আকাশে। গতকালকের মতো আজও পূর্বাশা আর বাকিরা সবাই মিলিটারির পোশাকে উপস্থিত হয়েছে কলেজ মাঠে। ঠা ঠা রৌদ্রের মধ্যে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সবাইকে। আজ অবশ্য পূর্বশা সবকিছুর জন্য একদম প্রস্তুত হয়েই এসেছে। আজ আর কোনো আজ্ঞান হওয়া বা ঝামেলা করা যাবে না। মিলিটারি পোশাকের পকেটে ভরে রুটি নিয়ে এসেছে। প্রশিক্ষণের ফাঁকে ক্লান্ত লাগলে বা ক্ষুধা লাগলে রুটি আর পানি খাবে। তাহলেই আবার ফিট হয়ে যাবে আবার। কিন্তু সে সুখ বুঝি আর সইলো না পূর্বাশার কপালে। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার আগেই প্রধান প্রশিক্ষক বলল – প্রশিক্ষণের সময়ে মোবাইল, খাবার বা অন্য কিছু নিজের সাথে রাখার নিয়ম নেই। কারোর কাছে কিছু থাকলে এখনই নিজ দায়িত্বে আমাদের কাছে জমা রাখুন।
চমকে উঠলো পূর্বাশা। কই কাল তো এমন কিছু জিজ্ঞেস করলো না বা চাইলো না তাহলে আজ কেন? কাল হয়তো প্রথমদিন ছিল, প্রশিক্ষণের থেকে পরিচিতি পর্ব বেশি ছিল তাই চায়নি। তাই বলে আজ চাইবে? না সে তার কাছে রাখা খাবার কিছুতেই দিবে না। তারপর যদি কালকের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ে আবারও। মাঠের মধ্যে সবার সম্মুখে লজ্জায় পড়তে হবে আবার সবাই ভাববে মেয়েটা রোজ রোজ অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণ মাঠে অবস্থানরত যার কাছে যা ছিল সবাই জমা দিল প্রশিক্ষকের কাছে । শুধুমাত্র পূর্বাশাই দিল না, পকেটে খাবার নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সে। প্রধান প্রশিক্ষক সবার দিকে তাকিয়ে আবার বলল – আশা করছি আপনাদের যার কাছে যা ছিল সবটা জমা রেখেছেন। এরপর যদি কারো কাছে কিছু পাওয়া যায় তবে কিন্তু শাস্তি পেতে হবে।
প্রধান প্রশিক্ষকের কথা শেষ হতেই জায়ান হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো পূর্বাশার পাশে, শক্ত কন্ঠে বলল – খাবারটা বের করুন।
চমকে উঠলো পূর্বাশা। তার কাছে যে খাবার জায়ান জানলো কিভাবে? না নিজেকে বাঁচাতে হবে তাকে নয়তো শাস্তি পেতে হবে আবার। আমতা আমতা শুরু করলো পূর্বাশা, তুতলিয়ে বলল – কককিসের খাবার? আমার কাছে কোনো খাবার নেই। কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার।
জায়ান কন্ঠটা কিছুটা খাদে নামালো অতঃপর বলল – সকালে দুইবার খেয়েছেন তারপর আবার পকেটে খাবার লুকিয়ে এনেছেন? এত খান তারপরও তো মোটা হওয়ার নাম গন্ধ দেখছি না।
কথাটুকু শেষ করে পরক্ষনেই কন্ঠ আবার শক্ত করলো জায়ান, ধমকের স্বলে বলল – আপনার পকেট থেকে খাবার বের করুন তাড়াতাড়ি।
জায়ানের হঠাৎ ধমকে কেঁপে উঠলো পূর্বাশা। বুঝলো এবার আর রক্ষা নেই তার। তার কাছে খাবার আছে যখন জেনে গিয়েছে এই লোকটা তখন এই খাবার সে নিয়েই ছাড়বে। ভয়ে ভয়ে পকেট থেকে খাবারটা বের করলো পূর্বাশা, দিল জায়ানের হাতে। জায়ান খাবারটা হাতে পেয়েই আদেশের সুরে বলল – খাবার এনে পকেটে লুকিয়ে রখার অপরাধে আগামী এক ঘন্টা মাঠের ঘাস তুলবেন আপনি।
আঁখি পল্লব ভারী হলো পূর্বাশার। এখন তাকে এই মাঠের ঘাস তুলতে হবে? সে বেশ বুঝতে পারছে জায়ান ইচ্ছে করে করছে সব। নয়তো যেহেতু সে জানতো যে তার কাছে খাবার আছে আগে এসেই নিতে পারতো। প্রধান প্রশিক্ষক শাস্তির ঘোষনা দেওয়ার পর নিবে কেন? তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই এই নাক উঁচু ছেলেটা এই কাজ করেছে। এই ছেলেটার সাথে তার কিসের শত্রুতা জানা নেই। কিন্তু ছেলেটা সর্বাদা তাকে শাস্তি দেওয়ার আর বিপদে ফেলার পায়তারা করে। কিঞ্চিৎ সময় নিল জায়ান, পূর্বাশার পানে তাকিয়ে বলে – লাইন থেকে বেরিয়ে ঘাস তোলা শুরু করুন।
পূর্বশা বেরুলো না লাইন থেকে। মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। কেমন লজ্জা লাগছে সবার সামনে তার। এত বড় মেয়ে হয়েও কিনা এভাবে ধমক খাচ্ছে আর শাস্তি নিচ্ছে। সাথে যদি আরও কেউ থাকতো তার শাস্তির ভাগীদার তাহলে হয়তো এত লজ্জা লাগতো না কিন্তু পুরো মাঠের এতগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র সে একা শাস্তি পেয়েছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি হতে পারে? কিছুটা সময় অবিবাহিত হলেও লাইন থেকে পূর্বাশার বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখলো না জায়ান। আবারও ধমকে উঠলো সে, বলল – কি বলেছি শুনতে পাননি? দ্রুত নিজের কাজে লেগে পড়ুন।
কেঁপে উঠলো মেয়েটা। ছলছল নয়নেই লাইন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো সে। মাঠের এক কোনে গিয়ে ছোট ছোট ঘাস তোলা শুরু করলো সে। এ ছাড়া উপায় আছে কি কোনো? না চাইতেও চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো পূর্বাশার। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে আবার ঘাস তোলা শুরু করলো সে।
ক্ষানিক সময় পর শুরু হলো শিক্ষার্থীদের মিলিটারি প্রশিক্ষন। ঘাস তুলতে তুলতেই পূর্বাশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে দেখলো সবাই পায়ের মধ্যে থেকে হাত নিয়ে ব্যাঙের মতো লাফ দিচ্ছে পুরো মাঠ জুড়ে। অনেকেই লাফাতে লাফাতে চিৎ কাত হয়ে পড়ছে আবারও উঠে দৌড় লাগাচ্ছে। অবাক হলো পূর্বাশা। জায়ান তাকে ঘাস তুলতে না দিলে তাকেও তো কড়া রোদে ওদের মতো ঐ ব্যাঙের লাফ দিতে হতো এতবড় মাঠ জুড়ে। নিমেষেই সকল মন খারাপেরা আর কান্নারা যেন বিদায় নিল তাকে ছেড়ে। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ হলো জায়ানের প্রতি। এই তীব্র রোদে ঐ ব্যাঙের লাফের থেকে তো এই ঘাস তোলা ঢেড় ভালো। এমনিও মাঠে ঘাস নেই বেশি। মাঠের বেশিরভাগ অংশই ইট পাথর আর কংক্রিটে গড়া। ছেলেটা ওর খারাপ করতে গিয়ে যাক শেষ পর্যন্ত ভালোই করে দিল। তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কিছুই পারলো না। মনে মনে জায়ানকে ভেংচি কাটলো পূর্বাশা।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]