স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_১২

0
305

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কিছুই পারলো না। মনে মনে জায়ানকে ভেংচি কাটলো পূর্বাশা। মেয়েটা ঘাস তোলার মধ্যিখানেই সেদিকে এগিয়ে গেল জায়ান। পূর্বাশা ফিরেও তাকালো না তার পানে, নিজ মনে ঘাস তুলছে সে। ভ্রু কুঁচকালো জায়ান, নিজের পা উঁচিয়ে এদিক ওদিকের ঘাস দেখিয়ে দেখিয়ে বলল – এখান থেকে তুলুন।

পূর্বাশা দাঁতে দাঁত চাপলো, নিঃশব্দে জায়ানের দেখানো ঘাসগুলোও তুলতে শুরু করলো। জায়ান তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – ওভাবে দাঁতে দাঁত চাপবেন না, দাঁতগুলো ভেঙে যেতে পারে। এমনিই তো কালো, দৈহিক গড়নও তেমন ভালো নয়। উচ্চতাও ছোট খাটো তার উপর যদি না থাকে দাঁত তাহলে তো কারো কাছে পাত্তাই পাবেন না। বিয়ে না করে সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে।

এইটুকু বলে থামলো জায়ান। আঁখি পল্লব ভারী হলো পূর্বাশার। পুরোনো কষ্টগুলো যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আবারও। সে তো এখানে এসে সবার ভালো ব্যবহার পেয়ে নিজের অতীত, নিজের চেহারা, নক্ষত্রকে, নক্ষত্রের বলা কথাগুলো, সমাজের তিরস্কার সবটা ভুলেই বসেছিল প্রায়। যাক এই ছেলেটা তবুও তাকে মনে করিয়ে দিল সবটা। বুঝিয়ে দিল তার মতো মেয়েকে সব ভুলে খুশি থাকতে নেই। কুৎসিত দের সুখে থাকার, খুশি থাকার অধিকার নেই কোনো। তাদের জন্মই হয়েছে সমাজের তিরস্কার, মানুষের বি’ষা’ক্ত বাক্যবান সহ্যের জন্য। পূর্বাশা আর তাকালো না জায়ানের পানে, টা টু শব্দও করলো না কোনো। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘাসগুলো তুলতে শুরু করলো। জায়ান কিছুক্ষণ সময় দাঁড়িয়ে রইলো, শীতল দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো মেয়েটাকে অতঃপর নিঃশব্দেই প্রস্থান করলো।

***

সময় গড়িয়েছে। সকালের নরম সূর্যটা বিদায় নিয়ে দেখা দিয়েছে দুপুরের তেজস্বী সূর্যটা। চারদিক কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়ার সময়ও হয়ে এসেছে। প্রশিক্ষণের বিরতি দিয়ে খাওয়ার খাওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে সবাইকে। একে একে সবাই ক্যান্টিনে গেল খেতে। পূর্বাশাও গেল হাত মুখ ধুয়ে ক্যান্টিনে চলে এলো। ক্ষুধা লেগেছে ভীষন। মাঠের মধ্যে বসে বসে এতক্ষন ঘাস তুলতে তুলতে কোমড় যেন ব্যথা হয়ে গেছে। পূর্বাশা নিজের খাওয়ার মতো কিছু খাবার নিয়ে বসলো সেনজেই ওদের সাথেই। তবে আজ আর সে ভুল করেনি, আজ চপস্টিকের বদলে চামচই নিয়েছে। চামচ দিয়েই একটু শান্তিতে খেতে শুরু করলো মেয়েটা। পেট শান্তি তো জগৎ শান্তি। এই মুহূর্তে তার পেটে যেন ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। দুই তিন চামচ খাবার খেতেই পূর্বাশা হঠাৎই খেয়াল করলো কিছু মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। কালও খাওয়ার সময় দেখেছিল এই মেয়েগুলোকে তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে আর হাসতে। হয়তো প্রথম দিন ছিল বলে কাছে আসেনি, আজ এসেছে। তবে তাদের সাথে আগ বাড়ি কথা বললো না পূর্বাশা। এমনিই চাপা স্বভাবের সে। নিজে থেকে কারো সাথে পরিচিত হতে পারে না, নতুন মানুষদের সাথে তো নয়ই। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করে তার। এই যেমন এখন এই মেয়েগুলো এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তাতেই কেমন অস্বস্তি লাগছে। নিজের মনের মধ্যে হীনমন্যতায় ভুগছে। এরা আবার তাকে তিরস্কার করবে না তো? এরা তাকে অপমান করবে না তো? তার শারীরিক কাঠামো, চেহারা, গায়ের রং নিয়ে কথা বলবে নাতো? নানান ধরনের চিন্তায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই তার পাশে থেকে একটি মেয়ে ইংরেজি বাক্যে বলল – তুমি কি বিদেশী?

পূর্বাশা মাথা তুলে তাকালো তাদের পানে, বলতে চাইলো হুম। কিন্তু পারলো না তার আগেই তাদের ভিতর থেকে আরেকটা মেয়ে কেমন নাক ছিটকে বলল – আরে গায়ের রং দেখে বুঝছিস না? এরা আফ্রিকান। ঐ যে বলে নীগ্র নীগ্র।

সাথে সাথেই একযোগে হেসে উঠলো সবাই। হাসি থামিয়ে অন্য একটা মেয়ে উঠে বলল – আরে না না এটা নীগ্রো না। নীগ্রদের উচ্চতা অনেক বেশি হয় এর তো তাও নেই।

পূর্বাশার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। সে কালো জানে কিন্তু নীগ্রদের মতো অতটা কালোও সে নয়। যদি নীগ্রোদের মতো কালো হতোও তাতেও বা কি হতো? নীগ্ররা কি মানুষ নয়? তাদের কি হৃদয় নেই? অবশ্যই তারাও মানুষ। তারাও আমাদের মতো রক্ত মাংসে গড়া। তাদেরও সুখ দুঃখ হাসি কান্না আছে। আমরা একজন কালো মানুষকে তিরস্কার করতে গেলেই নীগ্রদের কথা তুলে তিরস্কার করি যেটা একজন মানুষ হিসেবে চড়ম নিন্দনীয়। তবে তা বোঝার বোধ বুদ্ধি কোথায় আমাদের? পূর্বাশা আজ আর কিছু বুঝুক বা না বুঝুক একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝেছে যে কোনো দেশ, জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের সকল মানুষ ভালো হয় না। সব স্থানেই ভালো খারাপ দুটো মিলিয়েই হয় তবে একটু কম, একটু বেশি। এই যেমন তাদের দেশে গায়ের রংটা, খাটো, শুকনা মোটা এসব খুব বেশি ম্যাটার করলেও এই দেশগুলোতে ততটা ম্যাটার করে না। তবে এমন নয় যে একদম করে না, অবশ্যই করে তবে পরিমানে কম। হয়তো এসব দেশ আধুনিকতার দিক থেকে একটু বেশি এগিয়েছে বলে এসব দিকগুলোও একটু বেশি এগিয়েছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পূর্বাশার। মেয়েগুলোর হাসাহাসিতে আর খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন মরে গেল। একটু আগেও পেটে ক্ষুধা অনুভব করলেও এখন আর অনুভব হচ্ছে না সে ক্ষুধা। প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে, চলে যেতে চাইলো। কিন্তু এর মধ্যেই কোথা থেকে হুট করে এসে জায়ান তার প্লেটের খাবার নিয়ে পড়লো ঐ হাস্যরত মেয়েগুলোর উপর। প্লেটে থাকা খাবারগুলো সব পড়লো মেয়েগুলোর উপর। দ্রুত দূরে সরে গেল জায়ান, অপরাধীর কন্ঠে বলল – স্যরি স্যরি আসলে। একটু তাড়াহুড়োয় ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি, মাফ করবেন।

একে তো জায়ান তাদের একজন প্রশিক্ষক, তার উপর ক্লাস টপার আবার এত হ্যান্ডসাম। মেয়েগুলো যেন মিইয়ে গেল, বলতে পারলো না কিছুই। শুধুমাত্র সকলের ভিতর থেকে একটা মেয়ে লাজুক কন্ঠে জবাব দিল – ইটস ওকে, আমরা কিছু মনে করিনি। আপনি মাফ চেয়ে আমাদের লজ্জা দিবেন না।

জায়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর আবার মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল – আপনাদের টেবিল তো সম্ভবত এখানে নয়। আপনারা এখানে কি করছেন?

মেয়েগুলো অপ্রস্তুত হলো বেশ, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই বলল – একটু পরিচিত হতে এসেছিলাম আর কি।

– পরিচয় পর্ব শেষ আপনাদের?

– হ্যা হ্যা আমরা যাচ্ছি আমাদের টেবিলে।

কথাটা বলেই মেয়েগুলো তড়িঘড়ি কেটে পড়লো।জায়ান এবার তাকালো পূর্বাশার পানে, তার হাতে ধরে রাখা খাবারের প্লেটটা কেড়ে নিল মুহুর্তেই, শক্ত কন্ঠে বলল – যে কথা বলতে পারে না তার খাওয়ারও দরকার নেই কোনো।

পূর্বাশা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কে বলেছে সে কথা বলতে পারে না? সে কথা বলতে পারে তো। নিজের গলা পরীক্ষা করার জন্যই সে ডাক দিল সেনজেইকে, বলল – সেনজেই!

এই যে সে কথা বলতে পারলো। গলা থেকে স্বর বের হলো তো।

___________________________________

রাতের আঁধার ঘনিয়েছে। কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারপাশটা। পূর্বাশা প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে শুয়ে আছে নিজ বিছানায়। দৃষ্টি তার মাথার উপরে ছাদের দিকে। শুভ্র রঙে রংহীনভাবে রাঙানো হয়েছে সেখানটা। এদেশে সাদাকেই নাকি পবিত্র মনে করা হয়। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো পূর্বাশা। তার জীবনে কোনো রঙের অস্তিত্ব নেই যে। হোক তা ঐ বর্নহীন রং সাদা। তার জীবনে অস্তিত্ব থাকলে শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে ঐ অন্ধকারের, কালো রং। অবশ্য তার জীবনের অন্ধকারকে কালো রঙের সাথে তুলনা করাটা ঠিক মানানসই নয়, তার জীবনের কালো রংটা তো ঐ মহাকাশে অবস্থানরত কৃষ্ণগহ্বরের মতো, যা শুষে নেয় তার সকল হাসি, আনন্দ, রঙ। আজ যেন কেন পূর্বাশার নক্ষত্রের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে ঐ মানুষের কন্ঠস্বরটা একটাবের জন্য হলেও শুনতে। কিন্তু সে অধিকার যে তার নেই। তখনই তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পূর্বাশা। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলা বেজে উঠলো প্রবল ধ্বনি তুলে। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা হাতে নিল মেয়েটি। মোবাইলের স্ক্রীনে দেখতে পেল তৃষামের জ্বলজ্বলে নামটা। পূর্বাশা ধরলো কলটা, মোবাইলটা কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর পাওয়া গেল তৃষামের, বলল – বাইরে আয়।

– আসছি।

কল কাটলো পূর্বাশা। পড়নের ঢোলাঢালি টি শার্ট আর প্লাজোর উপরেই একটা ওড়না চাপিয়ে বেরিয়ে এলো সে বাইরে। দেখতে পেল তৃষামকে, তার পাশে অবশ্য জায়ানও দাঁড়িয়ে রয়েছে। জায়ানকে দেখেই দৃষ্টি নত করলো পূর্বাশা। এগিয়ে গেল তৃষামের পানে, বলল – কেমন আছো তৃষাম ভাইয়া?

– এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

তৃষাম নিজের হাতে ধরে থাকা একটা প্যাকেট বারিয়ে দিল পূর্বাশার পানে, বলল – এটা তোর। খেয়ে নিস, শুনলাম খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে করিস না।

তৃষামের কথায় কিছুটা অবাক হলো পূর্বাশা। অবাক কন্ঠেই বলল – তোমাকে কে বলল?

– জা…

কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না তৃষাম। তার আগেই “আহ” করে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে লাফিয়ে উঠলো সে। জায়ান পিছন থেকে চিমটি কেটেছে তৃষামের। যে চিমটির সুরে নেচে উঠেছে ছেলেটা। তৃষামকে লাফিয়ে উঠতে দেখেই ব্যস্ত হলো পূর্বাশা, বলল – কি হলো ভাইয়া?

তৃষাম তাকালো জায়ানের পানে। জায়ানের তীক্ষ্ম দৃষ্টির কাছে চুপসে গেল ছেলেটা, মিনমিনে কন্ঠে বলল – কিছু না।

জায়ান এবার দৃষ্টি সরালো তৃষামের দিক থেকে, তাকলো পূর্বাশার পানে। দৃষ্টিতে তীক্ষ্মতা বজায় রেখেই সে বলল – বাংলাদেশ থেকে আসতে না আসতেই দেখছি তোর বোনের শরীরে আধুনিকার ছোঁয়া লেগেছে। এক মাস যেতে না যেতেই পোশাক থ্রী পিস থেকে টিশার্টে নেমেছে। এক বছর গেলে কি হবে কে জানে!

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here